প্রশান্তবাবু তো ঠিকই বলছেন রজতদা। দিন কলম, আমি লিখে সই করে দিচ্ছি। এতক্ষণে সর্বপ্রথম কথা বললে সুজাতা।
প্রশান্ত বসাক সুজাতার দিকে কলমটা এগিয়ে দিলেন।
সুজাতা কোনরূপ দ্বিধামাত্রও না করে জবানবন্দির নীচে নিজের নামটা সই করে কাগজটা এগিয়ে দিল প্রশান্ত বসাকের দিকে, এই নিন।
পুরন্দর চৌধুরী এবার কথা বললেন, আমি যদি ইংরাজিতে লিখি আপত্তি আছে আপনার মিঃ বসাক?
কেন বলুন তো?
দীর্ঘদিনের অনভ্যাসের ফলে বাংলা আমি বড় একটা আজকাল লিখতে পারি না। তাছাড়া আমার বাংলা হস্তাক্ষরও অত্যন্ত বিশ্রী।
প্রশান্ত বসাক মৃদু হেসে বললেন, তা হোক। বাংলাতেই লিখুন।
অগত্যা পুরন্দর চৌধুরী যেন বেশ একটু অনিচ্ছার সঙ্গেই প্রশান্ত বসাকের নির্দেশ মত কাগজটায় লিখে দিলেন।
এবং রজত ও প্রতুলবাবুও নাম সই করে দিলেন।
প্রত্যেকের লেখা ও সই করা কাগজগুলো অতঃপর আর না দেখেই আঁজ করে প্রশান্ত বসাক নিজের জামার বুকপকেটে রেখে দিলেন।
সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পূর্বে এ ঘরে চা-পানে বসবার সময় যে আবহাওয়াটা ছিল, প্রশান্ত বসাক প্রদত্ত কাগজে নাম সই করবার পর যেন হঠাৎ সেই আবহাওয়াটা কেমন থমথমে হয়ে গেল। অচিন্ত্যনীয় একটা পরিস্থিতি যেন হঠাৎ একটা ভারী পাথরের মতই সকলের মনের মধ্যে চেপে বসে। কেউ কোন কথা মুখ ফুটে স্পষ্টাস্পষ্টি বলতে পারছে না, অথচ মনের গুমোট ভাবটাও যেন আর গোপন থাকছে না কারো।
বেশ কিছুক্ষণ ঘরের আবহাওয়াটা যেন একটা বিশ্রী অস্বস্তিতে থমথম করতে থাকে।
সকলেই চুপচাপ। কারো মুখে কোন কথা নেই।
ঘরের অস্বস্তিকর আবহাওয়া যেন প্রত্যেকেরই কেমন শ্বাস রোধ করে আনে। হঠাৎ সেই স্তব্ধতার মধ্যে কথা বলে ওঠেন পুরন্দর চৌধুরী, আপনার যদি আপত্তি না থাকে তো আমি কালই চলে যেতে চাই মিঃ বসাক।
বেশ। যাবেন। তবে কলকাতায় যেখানেই থাকুন ঠিকানাটা দিয়ে যাবেন যাবার আগে।
কিন্তু কলকাতায় তো আমি থাকব না মিঃ বসাক। প্লেন পেলে কালই আমি সিঙ্গাপুরে চলে যাব।
সিঙ্গাপুরে আপনি হেড কোয়ার্টারের পারমিশন ছাড়া যেতে পারবেন না মিঃ চৌধুরী।
কিন্তু সে পারমিশনের জন্য সব কাজকর্ম ফেলে এখনো যদি অনির্দিষ্ট কালের জন্য আমাকে কলকাতায় বসে থাকতে হয়—
পুরন্দর চৌধুরীর কথাটা শেষ হল না। প্রশান্ত বসাক বললেন, না, আর বড়জোর চার-পাঁচদিনের বেশী আপনাকে আটকে রাখা হবে না মিঃ চৌধুরী।
চার-পাঁচদিনের মধ্যেই তাহলে আপনাদের তদন্তের কাজ শেষ হয়ে যাবে বলতে চান মিঃ বসাক? পুরন্দর চৌধুরী প্রশ্ন করলেন।
সেই রকমই তো আশা করা যাচ্ছে। আর শেষ না হলেও আপনাদের কাউকেই আটকে রাখা হবে না।
ভাল।
কথাটা বলে সহসা পুরন্দর চৌধুরী চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘর হতে বের হয়ে গেলেন।
রজত প্রতুলবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, প্রতুলবাবু, আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল, আপনি একবার নীচে আসবেন কি?
চলুন।
প্রতুলবাবু ও রজতবাবু ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
ঘরের মধ্যে কেবল রইলেন প্রশান্ত বসাক ও সুজাতা। টেবিলের দুধারে দুজনে পরস্পরের মুখখামুখি বসে।
হঠাৎ প্রশান্ত বসাকের কণ্ঠস্বরে যেন চমকে মুখ তুলে তাকাল সুজাতা তাঁর দিকে।
একটা কথা বলছিলাম সুজাতাদেবী।
আমাকে বলছেন?
হ্যাঁ।
বলুন।
যদি কিছু মনে না করেন তো কথাটা বলি। প্রশান্ত বসাক যেন ইতস্তত করেন।
বলুন না।
আপনি আজই কলকাতাতেই চলে যান বরং—
কেন বলুন তো? সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল সুজাতা প্রশ্নটা করে প্রশান্ত বসাকের মুখের দিকে।
তাছাড়া প্রথমে আপনি তো যেতেও চাইছিলেন।
কিন্তু তখন তো আপনিই যেতে দিতে চাননি।
না চাইনি। কিন্তু এখন নিজে থেকেই আপনাকে চলে যাবার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি মিস রয়।
মৃদু স্মিতকণ্ঠে সুজাতা বলে, কেন বলুন তো?
নাই বা শুনলেন এখন কারণটা।
বেশ। তবে আজ নয়, কাল সকালেই চলে যাব।
কাল?
হ্যাঁ।
কি ভেবে প্রশান্ত বসাক বললেন, বেশ, তাই যাবেন।
তারপর আরো কিছুক্ষণ বসে দুজনে কথা বলেন।
.
৩৫.
ঐদিন রাত্রে।
কিরীটী ফোনে যে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিল, চব্বিশ ঘণ্টাও উত্তীর্ণ হল না, তা সত্যি হয়ে গেল।
সে রাত্রে সকলের খাওয়াদাওয়া করতে প্রায় এগারোটা হয়ে গেল। এবং খাওয়াদাওয়ার পর রাত সোয়া এগারোটা নাগাদ যে যার নির্দিষ্ট ঘরে শুতে গেল।
প্রশান্ত বসাক তাঁর নির্দিষ্ট ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে ঘরের দরজার ভিতর থেকে খিল তুলে দিয়ে বাগানের দিককার খোলা জানলাটার সামনে দাঁড়িয়ে নিশব্দে ধূমপান করছিলেন। একটা সিগারেট ধরিয়ে।
কিন্তু দুটি শ্রবণেন্দ্রিয়ই তাঁর সজাগ হয়ে ছিল একটি সাঙ্কেতিক শব্দের প্রত্যাশায়।
ঠিক আধঘণ্টা পরে তাঁর ঘর ও পাশের ঘরের মধ্যবর্তী দরজার গায়ে টুক টুক করে দুটি মৃদু টোকা পড়ল।
মুহূর্তে এগিয়ে গিয়ে দুই ঘরের মধ্যবর্তী দরজাটা খুলে দিতেই অন্ধকারে ছায়ামূর্তির মত একজন নিঃশব্দে এসে ঘরে প্রবেশ করল।
এসেছেন। মৃদু কণ্ঠে শুধালেন প্রশান্ত বসাক।
হ্যাঁ।
আপনার ঘর থেকে যখন বের হন কেউ আপনাকে দেখেনি তো? দেখেনি তো কেউ আপনাকে ল্যাবরেটারী ঘরে ঢুকতে?
না।
তাহলে এবারে আপনি নিশ্চিন্তে গিয়ে ঐ বিছানাটার ওপরে শুয়ে পড়ুন।
শুয়ে পড়ব?
হ্যাঁ। শুয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোন।
প্রশ্নোত্তর পাওয়া যায় না।
কি হল?
কিন্তু—
কিন্তু কি?
আপনি—
আমি! আজ রাত্রে আমার ঘুমের আশা আর কোথায়!