চোখ মেলে তাকিয়ে দেখুন। বেশি দূরে নয়, সামনেই হয়তো তিনি আছেন।
সামনেই আছে?
হ্যাঁ। জানেন, আমাদের বাংলাদেশে এক শ্রেণীর সাপ আছে, যাকে গ্রাম্য ভাষায় বলা হয় লাউডগা সাপ। লাউপাতার সবুজ পত্রের মতই তার গায়ের বর্ণ। এবং সেই কারণেই সাপ যখন লাউ গাছে জড়িয়ে থাকে হঠাৎ বড় একটা চোখে পড়ে না। অথচ সাবধান না হলে দংশন করে।
কিরীটীর শেষের কথায় চকিতে একটা সম্ভাবনা যেন বিদ্যুৎস্ফুরণের মতই প্রশান্ত বসাকের মনের মধ্যে ঝিলমিল করে ওঠে। তবে কি সঙ্গে সঙ্গেই তারপর প্রায় প্রশান্ত বসাক বলে ওঠেন, বুঝেছি। বুঝেছি আপনার ইঙ্গিত মিঃ রায়। ধন্যবাদ ধন্যবাদ। আচ্ছা নমস্কার। রিসিভারটা নামিয়ে রেখে প্রশান্ত বসাক কয়েকটা মুহূর্ত মনে মনে কি যেন ভাবলেন। তারপর আবার রিসিভারটা তুলে নিয়ে হেড কোয়ার্টারে কনেশন চাইলেন।
প্রশান্ত বসাক জিজ্ঞাসা করলেন, যে সংবাদগুলো জানবার জন্য ওয়্যার করতে বলেছিলাম তার জবাব এসেছে কি?
না, এখনও আসেনি, জবাব এলে—
এলেই আমাকে জানাবেন, এ বাড়ির ফোন-নম্বরটা টুকে নিন।
প্রশান্ত বসাক নীলকুঠির ফোন-নম্বরটা দিয়ে দিলেন।
ঐদিন সমস্ত দ্বিপ্রহরটা মিঃ বসাক তন্ন তন্ন করে ল্যাবরেটারী ঘরের যাবতীয় সব কিছু নেড়ে-চেড়ে উল্টে-পাল্টে দেখতে লাগলেন। যদি আর কোন নতুন সূত্র পাওয়া যায়।
ঘাঁটতে ঘাঁটতে একটা ড্রয়ারে আলমারির মধ্যে একটা হাতীর দাঁতের সুদৃশ্য কৌটো পেলেন। এবং পেলেন একটা নোট-বই। কৌটোটার মধ্যে আট-দশটা মুক্তো পাওয়া গেল। বুঝলেন ঐগুলিইসেই সিঙ্গাপুরীমুক্তা। আর কালো মরোক্কো চামড়ায় বাঁধা ডিমাইসাইজেরনোট-বুকটা। নোট-বুকটার প্রায় দুইয়ের তিন অংশ ব্যবহৃত হয়েছে।
নানা ধরনের অঙ্ক, রসায়ন শাস্ত্রের অনধিগম্য অবোধ্য সব ফরমূলা লেখা পাতায় পাতায়।
অন্যমনস্কভাবে নোট-বইয়ের পাতাগুলো উল্টাতে লাগলেন প্রশান্ত বসাক।
হঠাৎ শেষের দিকে একটি পাতায় দেখলেন দুবাধ্য সব অঙ্কের নীচেই স্পষ্ট বাংলা অক্ষরে লেখা—লতা।
সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ যেন তিনি অত্যন্ত সচেতন হয়ে উঠলেন। অকস্মাৎ তাঁর মনের মধ্যে একটা সরীসৃপ যেন শিরশিরিয়ে উঠেছে। এবং শুধু লতা শব্দটিই নয়, তার চারপাশে নানাপ্রকারের বিচিত্র সব কালির আঁকিবুকি কাটা।
আবার পাতা উল্টে চললেন। এবং অন্য আর এক পাতায় দেখলেন লেখা-লতা চলে গেল।
তার নীচে আবার অঙ্ক কষা আছে। আবার পাতা উল্টে চললেন। হঠাৎ আবার শেষের একটা পৃষ্ঠায় নজর আটকে গেল সেখানে লেখা : লতা কি আর ফিরে কোনদিনই আসবে না! তবে সে কেন এল!
একদৃষ্টে লেখাটার দিকে তাকিয়ে থেকে মনে মনে বারে বার লেখাটা পড়তে পড়তে হঠাৎ সম্পূর্ণ অন্য আর একটি কথা মনে পড়ে যায় প্রশান্ত বসাকের।
ভ্রূ দুটো কুঁচকে যায় তাঁর।
যে সম্ভাবনাটা এইমাত্র তাঁর মনে উদয় হয়েছে তার মীমাংসার জন্য তাড়াতাড়ি নোট-বুকটা বন্ধ করে পকেটে পুরে ঘর থেকে বের হয়ে আসেন প্রশান্ত বসাক।
বাইরে বেলা অনেকখানি গড়িয়ে এসেছে। সূর্যের আলো স্তিমিত হয়ে এসেছে।
নিজের নির্দিষ্ট ঘরটার মধ্যে এসে প্রবেশ করলেন প্রশান্ত বসাক; এবং ঘরে প্রবেশ করে ভিতর থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন।
.
৩৪.
ঐদিনই সন্ধ্যার দিকে ডাইনিং হলে সান্ধ্য চা-পানের পর এক সময় প্রশান্ত বসাক তাঁর পকেট থেকে চারখানা কাগজ বের করলেন। চারখানা কাগজেই কি যেন সব লেখা রয়েছে। লেখা কাগজ চারখানি হাতে করে ঘরের মধ্যে উপস্থিত সুজাতা, রজত, পুরন্দর চৌধুরী ও প্রতুলবাবুকে সম্বোধন করে বললেন, আপনারা প্রত্যেকেই এই কাগজগুলো পড়ে দেখুন। কাগজে আমি বাংলায় আপনাদের প্রত্যেকের জবানবন্দি সংক্ষেপে আলাদা আলাদা করে লিখেছি। পড়ে দেখুন, আপনারা যে যেমন জবানবন্দি দিয়েছেন আমার লেখার সঙ্গে তা মিলছে কিনা।
প্রত্যেকেই যেন একটু বিস্মিত হয়ে যে যার হাতের কাগজখানা চোখের সামনে মেলে ধরে পড়তে শুরু করে।
প্রশান্ত বসাক নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে থাকেন।
খুব সংক্ষিপ্ত জবানবন্দি, পড়তে কারোরই বেশি সময় লাগে না!
পড়লেন? কারও জবানবন্দিতে কোন ভুল নেই তো? প্রত্যেকের দিকেই তাকিয়ে আলাদা আলাদা ভাবে প্রশ্নটা করলেন প্রশান্ত বসাক।
না। প্রত্যেকেই জবাব দেয়।
বেশ। এবারে আপনারা প্রত্যেকেই প্রত্যেকের কাগজের তলায় বাংলায় বেশ পরিষ্কার স্পষ্টাক্ষরে লিখুন। উপরিউক্ত জবানবন্দির মধ্যে কোন ভুল নেই এবং পরে তার নীচে আপনারা যে যার নাম দস্তখত করুন।
প্রথমটায় কয়েকটা মুহূর্ত প্রশান্ত বসাকের প্রস্তাবে কেউ কোন জবাব দেয় না। কেবল পরস্পর পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে।
আমার বক্তব্যটা নিশ্চয়ই আপনারা বুঝতে পেরেছেন?
জবাব দিল এবারে প্রথমে রজতই, বললে, হ্যাঁ। কিন্তু এটা বুঝতে পারছি না মিঃ বসাক, এর কি প্রয়োজন ছিল?
সঙ্গে সঙ্গে প্রতুলবাবু জবাব দেন, তাই মিঃ বসাক। আমিও তাই বলতে চাইছিলাম। তাছাড়া আমি তো এখানে আদৌ উপস্থিতই ছিলাম না।
কিন্তু আমার প্রস্তাবে আপনাদের আপত্তি কি থাকতে পারে তাও তো বুঝতে পারছি না প্রতুলবাবু।
আমার ও আমাদের যার যা বলবার ছিল সবই খোলাখুলিভাবে আপনাদের কাছে বলেছি ইন্সপেক্টার। কথাটা বললে রজত।
অস্বীকার করছি না রজতবাবু সে কথা আমি। এবং পড়েই তো দেখলেন, আপনারা যে যেমন জবানবন্দি আমাদের কাছে দিয়েছেন সেইটুকুই কেবল ঐ কাগজে লিখেছি আমি। তবে আপনাদের আপত্তিটাই বা হচ্ছে কেন? অবিশ্যি you are at libertyযদি কিছু অন্যরকম লিখে থাকি সে জায়গাটা বরং কেটে ঠিক করে আপনারাই লিখে দিন।