অ্যাটর্নী চট্টরাজকে আজ একবার আসবার জন্য আপনাকে খবর দিতে হবে প্রতুলবাবু। রজত বলে।
প্রতুলবাবু ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে রজতের মুখের দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালেন। প্রতুলবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে রজত কথাটার আবার পুনরাবৃত্তি করে, ছোট্রকার অ্যাটর্নী চট্টরাজকে কাল কোন এক সময় আসবার জন্য একটা সংবাদ দেবেন। তাছাড়া, আমিও আর এখানে অনির্দিষ্ট কাল বসে থাকতে পারব না। লাহোরে আমাকে ফিরে যেতে হবে।
প্রতুলবাবু যেন এতক্ষণে ব্যাপারটি কিছু যাহোক বুঝতে পারেন। বললেন, এ বাড়িতে তাহলে আপনারা কেউ থাকবেন না রজতবাবু?
কে থাকবে এই চক্রবর্তীদের ভূতুড়ে নীলকুঠিতে বলুন। শেষকালে কি চক্রবর্তীদের প্রেতাত্মার হাতে বেঘোরে প্রাণটা দেব!
তাহলে এ বাড়িটার কী ব্যবস্থা হবে?
আপনি রইলেন, বেচে দেবার চেষ্টা করবেন।
কিন্তু আমি তো আর চাকরি করবনা রজতবাবু। মৃদু শান্ত কণ্ঠে প্রত্যুত্তর দিলেন প্রতুলবাবু।
তার মানে, চাকরি ছেড়ে দেবেন?
হ্যাঁ। তাছাড়া, এসব বাড়িঘর-দোর সব যখন আপনারা বেচেই দেবেন তখন আর আমার প্রয়োজনই বা কি! চক্রবর্তী মশাইয়ের মৃত্যুর পর থেকেই এক প্রকার আমার কোন কাজকর্ম ছিল না। তবু চক্রবর্তী মশাই মরবার আগে বিশেষ করে অনুরোধ করে গিয়েছিলেন, বিনয়েন্দ্রবাবুকে যেন একলা ফেলে আমি না চলে যাই। তাই ছিলাম। তা এখন সে প্রয়োজনও ফুরিয়েছে।
হঠাৎ এমন সময় সুজাতা কথা বলে, এক কাজ করলে হয় না রজতদা?
কী?
ছোট্কার ঐ ল্যাবরেটারীটা প্রাণের চাইতেও প্রিয় ছিল। সমস্ত নীলকুঠিটাকেই একটা গবেষণাগারে পরিণত করে দুঃস্থ বৈজ্ঞানিকদের এখানে গবেষণার একটা ব্যবস্থা করে দিলে হয় না?
কিন্তু আমার তো মনে হয়—
রজতকে বাধা দিয়ে সুজাতা বলে, অবিশ্যি আমি আমার অংশের ব্যবস্থাটা সেই ভাবেই করতে পারি! তবে তুমি–
না না–কথাটা তুই নেহাত মন্দ বলিসনি সুজাতা। দেখি ভেবে। হ্যাঁ প্রতুলবাবু, আপনি যত তাড়াতাড়ি পারেন, কোথায় কার কি দেনা-পাওনা আছে, চাকরবাকরদের মাইনে পত্র কে কি পাবে না পাবে সব একটা হিসাবপত্র করে ফেলুন। যত তাড়াতাড়ি পারি এদিককার সব মিটিয়ে দিয়ে আমাকে একবার লাহোরে যেতে হবে।
যে আজ্ঞে। তাই হবে। এখন তাহলে আমি উঠলাম।
প্রতুলবাবু বিদায় নিয়ে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন।
.
৩৩.
ল্যাবরেটারী ঘরে এক্সপেরিমেন্ট করবার লম্বা টেবিলের সেফেই ফোন ছিল। প্রশান্ত বসাকের সেটা পূর্বেই নজরে পড়েছিল।
ল্যাবরেটারী ঘরে ঢুকে দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিয়ে প্রশান্ত বসাকফোনের রিসিভারটা তুলে নিলেন এবং কিরীটীর ফোন-নম্বরটা চাইনে এক্সচেঞ্জে।
একটু পরেই কনেকশন পাওয়া গেল।
হ্যালো! কিরীটী রায় কথা বলছি।
নমস্কার মিঃ রায়। আমি প্রশান্ত বসাক। উত্তরপাড়ার নীলকুঠি থেকে কথা বলছি।
নমস্কার। নীলকুঠিতে ফোন আছে নাকি?
হ্যাঁ।
বেশ। তারপর কি সংবাদ বলুন, any further development?
বসাক তখন ফোনে সংক্ষেপে অথচ কিছু বাদ না দিয়ে, গত রাত্রে এ বাড়িতে ফিরে আসবার পর যা ঘটেছে সব একটু একটু করে বলে গেলেন। তারপর বললেন, কোন সঠিক সিদ্ধান্তেই তো এখনও পৌঁছতে পারছি না মিঃ রায়। অথচ এদেরও আর কেমন করে আটকে রাখি বলুন?
ওপাশ থেকে কিরীটীর মৃদু হাসির শব্দ শোনা গেল। সে বললে, নীলকুঠি-রহস্য শেষ ধাপে পৌঁছতে আমার মনে হয় বেশী দেরি নেই প্রশান্তবাবু।
কি বলছেন আপনি?
হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। হয়তো বা আজ রাত্রেও আবার সেই ছায়ামূর্তির আবির্ভাব ঘটতে পারে। আর একান্তই যদি আজ বা কাল না ঘটে, জানবেন দু-চারদিনের মধ্যেই আবির্ভাব তার ঘটবে। কিন্তু তার আগে একটা কথা বলছিলাম–
কী?
সুজাতাদেবী নীলকুঠি থেকে চলে গেলেই ভাল করতেন।
কিরীটীর কথায় প্রশান্ত বসাক যেন অতিমাত্রায় চমকে ওঠেন এবং তাঁর সেই চমকানো গলার স্বরে ফুটে ওঠে। বলেন কি মিঃ রায়! তবে কি
হ্যাঁ প্রশান্তবাবু। দিনেরাত্রে সর্বদা সুজাতাদেবীর উপরে তীক্ষ্ণ নজর রাখবেন।
আপনি—আপনি কি তাহলে সত্যি সত্যিই হত্যাকারী কে ধরতে পেরেছেন মিঃ রায়? কিরীটীকে কথাটা আর না জিজ্ঞাসা করে থাকতে পারেন না প্রশান্ত বসাক।
অনুমান করেছি প্রশান্তবাবু।
অনুমান?
হ্যাঁ।
কে? কে তাহলে হত্যাকারী?
মৃদু হাসির একটা শব্দ আবার ভেসে এল এবং সেই সঙ্গে ভেসে এল প্রশ্নোত্তরে দুটি কথা: আপনিই বলুন না?
আমি?
হ্যাঁ, আপনি।
কিন্তু আমি তো—
ঠিক এখনও অনুমান করতে পারছেন না। তাই না?
হ্যাঁ, মানে–
শুনুন প্রশান্তবাবু। আপনি ভোলেননি নিশ্চয়ই, বৈজ্ঞানিক বিনয়েন্দ্রর হত্যা ব্যাপারটা গতকালই আপনাকে বলেছিলাম pre-arranged, pre-meditative and well planned। এবং আমার অনুমান, সেই প্ল্যানের মধ্যে একটি নারী আছে।
নারী?
হ্যাঁ।
You mean তাহলে সেই লতা!
লতা কি পাতা জানি না, তবে একটি নারী এ ব্যাপারের মধ্যে আছে। তাকে খুঁজে বের করুন, তাহলেই হত্যাকারীকেও সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে যাবেন। আর এও জানবেন, সেই নারী বৈজ্ঞানিক বিনয়েন্দ্রবাবুকে বেশ জোরেই আকর্ষণ করেছিল। জানেন তো আকর্ষণ মানেই দুর্বলতা। আর দুর্বলতা মানেই—আত্মসমর্পণ। এবং তার পশ্চাতে এসেছে বিষ। আর এ সব কিছুর মূলে বিনয়েন্দ্রবাবুর বিপুল সম্পত্তিও নিশ্চয়ই আছে জানবেন।
কিন্তু সেই নারী।