কথাগুলো বলে এগিয়ে যেতে উদ্যত হতেই সুজাতাকে বাধা দিলেন মিঃ বসাক, না না—আপনি ব্যস্ত হবেন না মিস রয়। বসুন আপনি।
সুজাতা স্মিতকঠে বললে, ব্যস্ত নয়, আমিও আর একটু চা খাব।
গতরাত্রের মত আজও ঘরে প্রবেশ করার মুখে প্রশান্ত বসাক লক্ষ্য করেছিলেন, মিঃ সুন্দরলাল ও পুরন্দর চৌধুরী পাশাপাশি একটু যেন ঘনিষ্ঠ হয়ে বসেই নিম্নকণ্ঠে পরস্পরের সঙ্গে পরস্পর কথা বলছিলেন, এবং প্রশান্ত বসাকের কক্ষমধ্যে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই তাঁরা যেন অকস্মাৎ চুপ করে গেলেন।
সুজাতা ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় দু-মিনিটে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে, হঠাৎ কি একটা কথা মনে পড়ায় এখুনি আসছি বলে প্রশান্ত বসাকও বের হয়ে এলেন ঘর থেকে। এবং সোজা নিচে চলে গেলেন।
নিচের তলায় প্রহরারত কনস্টেবল মহেশকে নিয় অথচ দ্রুতকণ্ঠে কি কতকগুলো নির্দেশ দিয়ে বললেন, যাও এখুনি, বাইরে গেটের পাশে হরিসাধন আছে সাধারণ পোশাকে, যা যা বললাম তাকে বলবে। যেমন যেমন প্রয়োজন বুঝবে সে যেন করে।
ঠিক আছে, আমি এখুনি গিয়ে বলে আসছি।
মহেশ বাইরে চলে গেল।
মহেশকে নির্দেশ দিয়ে প্রশান্ত বসাক যেমন ঘুরে সিঁড়ির দিকে দোতলায় ওঠবার জন্য পা বাড়াতে যাবেন, আচমকা তাঁর নজরে পড়ল নীচের একখানি ঘরের ভেজানো দুই বাটের সামান্যতম মধ্যবর্তী ফাঁকের মধ্য দিয়ে একজোড়া শিকারীর চোখের মত জ্বলজ্বলে চোখের দৃষ্টি যেন চকিতে বাটের অন্তরালে দেখা দিয়েই আত্মগোপন করল।
থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন প্রশান্ত বসাক।
মুহূর্তকাল ভ্রূকুঞ্চিত করে কি যেন ভাবলেন, তারপর সোজা এগিয়ে গেলেন সেই ঈন্মুক্ত দ্বারপথের দিকে।
হাত দিয়ে ঠেলে কবাট দুটো খুলে ফেললেন, খালি ঘর, ঘরে কেউ নেই।
চিনতে পারলেন করালীর ঘর ওটা। পাশেই পাচক লছমনের ঘর। দু-ঘরের মধ্যবর্তী দরজাটার দিকে এবারে এগিয়ে গেলেন, কিন্তু দরজার কবাট ঠেলতে গিয়ে বুঝলেন ওপাশ থেকে দরজা বন্ধ। বের হয়ে এলেন করাঙ্গীর ঘর থেকে প্রশান্ত বসাক। বারান্দা দিয়ে গিয়ে লছমনের ঘরের সামনের দরজা ঠেলতেই ঘরের দরজাটা খুলে গেল। ভিতরে প্রবেশ করলেন। কিন্তু দেখলেন পাচক লছমনের ঘরও খালি। সে ঘরেও কেউ নেই। আরো দেখলেন করালী ও লছমনের ঘরের মধ্যবর্তী দরজার গায়ে সেই ঘর থেকেই খিল তোেলা। ঐ ঘরের ঐ মধ্যবর্তী দরজাটি বাদেও আরও দুটি দরজা ছিল। এবং দুই ঘরের মধ্যবর্তী দরজাটি বাদেও অন্য দুটি দরজাই খোলা ছিল।
যার চোখের ক্ষণিক দৃষ্টি ক্ষণপূর্বে মাত্র তিনি পাশের ঘরের উন্মুক্ত দরজা-পথে দেখেছিলেন, সে অনায়াসেই তাহলে এ দ্বিতীয় দরজাটি দিয়ে চলে যেতে পারে।
হঠাৎ ঐ সময় বারান্দার দিকে দ্বিতীয় যে দ্বারটি সেটি খুলে গেল এবং চায়ের কাপ হাতে গুণগুণ করে গান গাইতে গাইতে করালী এসে ঘরে প্রবেশ করেই ঘরের মধ্যে দণ্ডায়মান ইন্সপেক্টারকে দেখে যেন থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল, ইন্সপেক্টার সাহেব।
হ্যাঁ, তোমার ঘরটা আমি দেখছিলাম করালী।
করালী চা-ভর্তি কাপটা একটা টুলের উপর নামিয়ে রেখে সসম্ভমে সরে দাঁড়াল।
কোথায় ছিলে করালী?
রান্নাঘরে চায়ের জন্য গিয়েছিলাম সাহেব।
রান্নাঘরে আর কে কে আছেন?
লছমন আর নতুন দিদিমণি আছেন।
প্রশান্ত বসাক করালীর সঙ্গে দ্বিতীয় আর কোন কথাবার্তা না বলে রাগী যে পথে ঘরে প্রবেশ করেছিল ক্ষণপূর্বে, সেই খোলা দ্বার দিয়েই বের হয়ে গেলেন। এবং সোজা সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেলেন।
ঘরের মধ্যে ঢুকে দেখলেন সুন্দরলাল তখন ঘরে নেই। রজত আর পুরন্দর চৌধুরী বসে বসে গল্প করছেন, আর কেউ ঘরে নেই।
একটু পরেই সুজাতা এসে ঘরে প্রবেশ করল এবং তার পিছনে পিছনেই চায়ের কেতলী নিয়ে এসে ঘরে ঢুকল রেবতী।
.
চা পান করতে করতেই সামনাসামনি উপবিষ্ট সুজাতার দিকে তাকিয়ে প্রশান্ত বসাক বলেন, তাহলে আজই আপনি কলকাতায় চলে যাচ্ছেন মিস রয়?
সুজাতা প্রশান্ত বসাকের প্রশ্নে একবার মাত্র তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে মুখটা নামিয়ে মৃদুকণ্ঠে বললে, তাই ভেবেছিলাম যাব, কিন্তু রজতদা বলছে, দু-চারদিনের মধ্যে ও ফিরে যাবে, সেই সঙ্গেই যাবার জন্যে।
হ্যাঁ মিঃ বসাক, আমি তাই বলছিলাম সুজাতাকে। যেতে ওকেও হবে, আমাকেও হবে। এদিককার ব্যবস্থাপত্র যাহোক একটা কিছু করে যেতে হবে তো। এবং সেজন্য ওর ও আমার দুজনেরই থাকা প্রয়োজন। আপনি কি বলেন মিঃ বসাক? রজত কথাগুলো বললে।
হ্যাঁ, আপনারাই যখন বিনয়েন্দ্রবাবুর সমস্ত সম্পত্তির ওয়ারিশান তখন ইন্সপেক্টারকে বাধা দিল সুজাতা, না, ছোট্রকার সম্পত্তির এক কপর্দকও আমি স্পর্শ করব, তা আমি রজতদাকে বলেই দিয়েছি।
হ্যাঁ, সুজাতা তাই বলছিল বটে। কিন্তু মিঃ বসাক, আপনিই বলুন তো তাই কখনও কি হয়। সম্পত্তি ওকেও আমার সঙ্গে সমান ভাগে নিতে হবে বৈকি, কি বলেন?
না রজতদা, ও আমি স্পর্শও করব না। তুমিই সব নাও।
কিন্তু আমিই বা তোর ন্যায্য সম্পত্তি নিতে যাব কেন? বেশ তো, তোর ভাগ তুই না নিস—যে ভাবে খুশী দান করে যা বা যে কোন একটা ব্যবস্থা করে যা।
বেশ, তাই করে যাব।
এমন সময় প্রতুলবাবু এসে ঘরে ঢুকলেন।
এই যে প্রতুলবাবু, আসুন। রজত আহ্বান জানালেন প্রতুলবাবুকে।
প্রতুলবাবু এগিয়ে এসে একটা খালি চেয়ারে উপবেশন করলেন।