অনাদি ফেরত পাঠিয়ে দিলেন নাতিকে।
সেই থেকেই অনাদি চক্রবর্তীর সঙ্গে মৃগেন্দ্রদের আর কোন সম্পর্ক ছিল না। কোন পক্ষই কেউ কারোর সন্ধান করতেন না বা কোনরূপ খোঁজখবরও নিতেন না।
.
০৩.
আরও অনেকগুলো বছর গড়িয়ে গেল।
মৃগেন্দ্রও মারা গেলেন একদিন।
অমরেন্দ্র, সুরেন্দ্র লেখাপড়া শিখে উপার্জন শুরু করল, সংসার করল, তাদের ছেলেমেয়ে হল। কিন্তু চক্রবর্তী-বাড়ির সঙ্গে এ-বাড়ির আর যোগাযোগ ঘটে উঠল না। যক্ষের মত বৃদ্ধ অনাদি চক্রবর্তী একা একা তাঁর উত্তরপাড়ার বিরাট প্রাসাদোপম অট্টালিকা নীলকুঠিতে দিন কাটাতে লাগলেন।
অল্প বয়সে বিনয়েন্দ্র মাতামহের স্নেহের নীড় ছেড়ে এসে ক্রমে তাঁর দাদুকে ভুলতে পেরেছিলেন কিন্তু ভুলতে পারেননি অনাদি চক্রবর্তী। একটি বালকের স্মৃতি সর্বদা তাঁর মনের পদায় ভেসে বেড়াত।
তথাপি প্রচণ্ড অভিমানবশে কোন্দিনের জন্য বিনয়েন্দ্রর খোঁজখবর নেননি বা তাকে ডাকেননি অনাদি চক্রবর্তী।
চক্রবর্তী-বাড়ির পুরাতন ভৃত্য রামচরণ কিন্তু বুঝতে পারত বৃদ্ধ অনাদি চক্রবর্তীর মনের কোথায় ব্যথাটা। কিন্তু সে দু-একবার মুখ ফুটে অনাদি চক্রবর্তীকে কথাটা বলতে গিয়ে ধমক খেয়ে চুপ করে গিয়েছিল বলে আর উচ্চবাচ্য করেনি কোনদিন।
শেষের দিকে বৃদ্ধ অনাদি চক্রবর্তীর মাথায় কেমন একটু গোলমাল দেখা দিল।
প্রথম প্রথম সেটা তেমন কিছু উল্লেখযোগ্য মনে হয়নি বলেই রামচরণ ততটা মাথা ঘামায়নি কিন্তু শেষটায় যখন একটু বাড়াবাড়ি শুরু হল, তখন সে অনন্যোপায় হয়ে বিনয়েন্দ্রনাথকেই তার কলেজে, সরকার মশাইকে দিয়ে তার নিজের জবানীতেই একটা চিঠি লিখে পাঠাল।
খোকাবাবু,
কর্তাবাবু, আপনার দাদুর অবস্থা খুবই খারাপ। আপনি হয়তো জানেন না আপনার চলে। যাওয়ার পর থেকেই বাবুর মাথার একটু একটু গোলমাল দেখা দেয়। এবং সেটা আপনারই। জন্য, আপনাকে হারিয়ে এবারে হয়তো আর বাঁচবেন না। তাই আপনাকে জানাচ্ছি একটিবার এ সময়ে যদি আসেন তো ভাল হয়।
ইতি রামুদা
চিঠিটা পেয়ে বিনয়েন্দ্র কলেজের লাইব্রেরী ঘরে গিয়ে বসলেন।
একবার দুবার তিনবার চিঠিটা পড়লেন।
শৈশবের আনন্দ কলহাসি মুখরিত জীবনের অনেকগুলো পৃষ্ঠা যেন তাঁর মনের মধ্যে পর পর উল্টে যেতে লাগল। বহুকাল পরে আবার মনে পড়ল সেই বৃদ্ধ স্নেহময় দাদুর কথা। বিশেষ করে মধ্যে মধ্যে একটা কথা যা তাঁর দাদু তাঁকে প্রায়ই বলতেন, তোর বাবা যদি তোকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে চায় দাদুভাই, চলে যাবি না তো?
বিনয়েন্দ্র জবাবে বলেছেন, ইস, অমনি নিয়ে গেলেই হল কিনা, যাচ্ছে কে? তোমাকে কোনদিনও আমি ছেড়ে যাব না দাদু, দেখে নিও তুমি।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত দাদু তাঁকে আটকে রাখতে পারেননি। ছেড়ে দিতেই হয়েছে। পরের জিনিসের উপর তাঁর জোর কোথায়।
বিনয়েন্দ্রর মনটা ছটফট করে ওঠে। তিনি তখুনি বের হয়ে পড়েন দাদুর ওখানে যাবার জন্যে।
.
দীর্ঘ একুশ বছর বাদে সেই পরিচিত বাড়িতে এসে প্রবেশ করলেন বিনয়েন্দ্র।
বিরাট প্রাসাদ শূন্য—যেন খাঁ খাঁ করছে। সিঁড়ির মুখেই বাড়ির পুরাতন ভৃত্য রামচরণের সঙ্গে দেখা হয়েগেল, রামচরণ প্রথমটায় ওঁকে চিনতে পারেনি কিন্তু বিয়ে ঠিকই চিনেছিলেন।
মাথার চুল সাদা হয়ে গেলেও মুখের চেহারা তার বিশেষ একটা পরিবর্তিত হয়নি।
রামুদা না?
কে?
আমাকে চিনতে পারছ না রামুদা, আমি খোকাবাবু, বিনু।
বিনু! খোকাবাবু, সত্যিসত্যিই তুমি এতদিন পরে এলে! চোখে জল এসে যায় রামচরণের।
দাদু—দাদু কেমন আছেন রামুদা?
চল। ওপরে চল।
রামচরণের পিছু পিছু বিনয়েন্দ্র দোতলায় যে ঘরে অনাদি চক্রবর্তী থাকতেন সেই ঘরে এসে প্রবেশ করলেন।
বিকৃত-মস্তিষ্ক অনাদি চক্রবর্তী তখন ঘরের মধ্যে একা একা পায়চারি করছিলেন আপন মনে ভূতের মত।
পদশব্দে ফিরে তাকালেন। দৃষ্টি ক্ষীণ—স্পষ্ট কিছুই দেখতে পান না।
রামচরণ বললে, এই জ্বর নিয়ে আবার বিছানা ছেড়ে উঠে ঘরের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছেন?
বেশ করছি। আমার খুশি। তোর বাবার কী!
এখুনি মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন যে!
পড়ি পড়ব মাথা ঘুরে, তোর বাবার কী!
এমন সময় বিনয়েন্দ্র ডাকেন, দাদু!
কে?
চকিতে ঘুরে দাঁড়ালেন অনাদি চক্রবর্তী।
দাদু, আমি বিনু।
বিনু! বিনু!
হঠাৎ অনাদি চক্রবর্তীর সমস্ত দেহটা থরথর করে কেঁপে উঠল এবং সঙ্গে সঙ্গে পড়ে যাচ্ছিলেন উলে; কিন্তু চকিতে এগিয়ে গিয়ে বলিষ্ঠ দুহাতে বিনয়েন্দ্র ততক্ষণে পতনোম্মুখ বৃদ্ধকে ধরে ফেলেছেন।
আর ফেরা হল না বিনয়েন্দ্রর। চক্রবর্তীদের নীলকুঠিতেই রয়ে গেলেন। এবং মাস চারেক বাদে অনাদি চক্রবর্তী মারা গেলেন।
অনাদি চক্রবর্তী মারা যাবার পর দেখা গেল তিনি তাঁর স্থাবর-অস্থাবর যা কিছু সম্পত্তি ছিল সব এবং মায় চল্লিশ-পঞ্চাশ হাজার টাকার ব্যাঙ্ক-ব্যালেন্স সব কিছু দিয়ে গিয়েছেন বিনয়েন্দ্রকেই।
কিন্তু তার মধ্যে দুটি শর্ত আছে।
বিনয়েন্দ্র জীবিতকালে তাঁর ঐ নীলকুঠি ছাড়া অন্য কোথাও গিয়ে থাকতে পারবেন। তাহলেই তাঁর সমস্ত সম্পত্তি চলে যাবে ট্রাস্টির হাতে এবং তখন একটি কর্পদকও আর পাবেন না। দ্বিতীয়ত অমরেন্দ্র সুরেন্দ্রর সন্তানসন্ততিদের সঙ্গেও কোন সম্পর্ক রাখতে পারবেন না।
মৃগেন্দ্রর প্রথম দুই সন্তান অমরেন্দ্র ও সুরেন্দ্র তাদের বাপের মতই হয়েছিল। কখনও তারা দাদুর ওখানে আসেনি এবং দাদুর কথা কোনক্রমে উঠলে কখনও প্রীতিকর কথা বলত না।