ঢালু পাড় বরাবর অশ্বথ গাছের তলা থেকে গঙ্গার মধ্যে নেমে গেছে।
অশ্বত্থতলা থেকে নীলকুঠির লাগোয়া পশ্চাতের বাগানটার সবটাই চোখে পড়ে। এবং বাড়ির পশ্চাতের অশটাও সবটাই দেখা যায়। নীলকুঠির দিকে তাকাতেই দোতলার ঐ দিককার একটি ভোলা জানলা প্রশান্ত বসাকের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। খোলা জানলার সামনে যেন স্থির একটি চিত্র। চিনতে কষ্ট হয় না কার চিত্র সেটা।
সুজাতা।
দৃষ্টি তাঁর সম্মুখের দিকে বোধ হয় গঙ্গাবক্ষেই প্রসারিত ও স্থির। হাওয়ায় মাথার চুর্ণ কুন্তলগুলি উড়ছে। অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন প্রশান্ত বসাক সেদিকে। চোখ যেন আর ফিরতে চায় না।
ধীরে ধীরে এক সময় চোখ নামিয়ে পূর্বের পথে আবার ফিরে চললেন প্রশান্ত বসাক।
গলির অন্যদিকে যে সীমানাপ্রাচীর বহু স্থানে তা ভেঙে ভেঙে গিয়েছে। সেই রকম ভাঙাই একটা জায়গা দিয়ে প্রাচীরের অন্যদিকে গেলেন প্রশান্ত বসাক। প্রায় দু-তিন কাঠা জায়গা প্রাচীরবেষ্টিত। জীর্ণ একটি একতলা পাকা বাড়ি। গোটা তিনেক দরজা দেখা যাচ্ছে, তার মধ্যে একটি দরজার কড়ার সঙ্গে তালা লাগান।
এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালেন প্রশান্ত বসাক সেই দরজার সামনে। পাকা ভিতের বহু জায়গায় ফাটল ধরেছে—সিমেন্ট উঠে গিয়ে তলাকার ইটের গাঁথুনি বিশ্রী ক্ষতচিহ্নের মত দেখাচ্ছে।
হঠাৎ তাঁর নজরে পড়ল সেই তালা দেওয়া দরজাটার সামনেই জীর্ণ বারান্দার মেঝেতে অনেকগুলো অস্পষ্ট শ্বেত পদচিহ্ন।
এবারে দিনের স্পষ্ট আলোয় পরীক্ষা করে দেখে বুঝতে কষ্ট হয় না, সেইশ্বেত পদচিহ্নগুলো পড়েছে পায়ে চুন লেগে থাকার দরুন। এবং এও মনে হয় গত রাত্রে যে পদচিহ্ন অস্পষ্ট জলসিক্ত তিনি বাথরুমে দেখেছেন এগুলো ঠিক তারই অনুরূপ।
ঘরের দরজাটা বন্ধ, তালাটা ধরে টানলেন, কিন্তু ভাল জামান তালা, সহজে সে তালা ভাঙবার উপায় নেই।
এমন সময় হঠাৎ তাঁর কানে এল তুলসীদাসের দোঁহা মৃদু কণ্ঠে কে যেন গাইছে।
সামনের দিকে চোখ তুলে তাকালেন, একজন মধ্যবয়সী হিন্দুস্থানী গঙ্গা থেকে সদ্য স্নান করে বোধ হয় হাতে একটা লোটা ঝুলিয়ে তুলসীদাসের দোঁহা গাইতে গাইতে ঐ গৃহের দিকেই আসছে।
হিন্দুস্থানী ব্যক্তিটি দণ্ডায়মান প্রশান্ত বসাকের কাছ বরাবর এসে মুখ তুলে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করলে, কিকো মাঙতে হে বাবুজী?
এ কোঠিমে আপই রহেতে হে?
হ্যাঁ। লেকেন আপ্ কিকো মাঙতে হে?
আপকো নাম কেয়া জী?
হরিরাম মিশির।
ব্রাহ্মণ?
হ্যাঁ, কনৌজকা ব্রাহ্মণ।
ও। এমনি বেড়াতে বেড়াতে চলে এসেছিলাম মিশিরজী। ভেবেছিলাম পোড়ো বাড়ি।
হঠাৎ এমন সময় পাশের একটি বন্ধ দরজা খুলে গেল এবং একটি হিন্দুস্থানী তরুণী আবক্ষ ঘোমটা টেনে বের হয়ে এল।
মিশিরজী তরুণীকে প্রশ্ন করে, কিধার যাতা হায় বেটি? গঙ্গামে?
তরুণী কোন কথা না বলে কেবল মাথা হেলিয়ে গঙ্গার দিকে চলে গেল।
প্রশান্ত বসাক চেয়ে থাকেন সেই দিকে, বিশেষ করে সেই তরুণীর চলার ভঙ্গিটা যেন প্রশান্ত বসাকের চোখের দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে।
চোখ যেন ফেরাতে পারেন না।
বাবুজী!
মিশিরজীর ডাকে আবার ফিরে তাকালেন প্রশান্ত বসাক।
বাবুজী কি এই উত্তর পাড়াতেই থাকেন?
অ্যাঁ। না—মানে—
এখানে ঢুকলেন কি করে? গেটে আমার তালা দেওয়া।
না না–গেট দিয়ে আমি ঢুকিনি; ঐ যে ভাঙা প্রাচীর—তারই ফাঁক দিয়ে এসেছি। ভেবেছিলাম পোড়ো বাড়ি।
হ্যাঁ, বাবুজী, এতদিন পোড়ো বাড়িই ছিল, মাসখানেকের কিছু কেঁশী হবে মাত্র আমরা এখানে এসে উঠেছি। তা বাবুজী দাঁড়িয়েই রইলেন, ঘর থেকে একটা চৌকি এনে দিই, বসুন—
না না, মিশিরজী, ব্যস্ত হতে হবে না। আমি এমনিই বেড়াতে চলে এসেছি। এবারে যাই।
প্রশান্ত বসাক তাড়াতাড়ি নেমে যাবার জন্য পা বাড়ালেন।
মিশিরজীও এগিয়ে এল, চলুন বাবুজী, আপনাকে গেট খুলে রাস্তায় দিয়ে আসি।
গেট থেকে বের হয়ে প্রশান্ত বসাক কিন্তু নীলকুঠির দিকে গেলেন না, উলটো পথ ধরে হাঁটতে লাগলেন।
এগিয়ে যেতে যেতে একবার ইচ্ছা হল, পিছন ফিরে তাকান, কিন্তু তাকালেন না। তবে পিছন ফিরে তাকালে দেখতে পেতেন তখনও খোলা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে মিশিরজী একদৃষ্টে প্রশান্ত বসারে গমনপথের দিকেই তাকিয়ে আছে।
তার দু চোখের তারায় ঝকঝকে শাণিত দৃষ্টি, বহুপূর্বেই তার সহজ সরল বোকা বোকা চোখের দৃষ্টি শাণিত ছোরার ফলার মত প্রদীপ্ত হয়ে উঠেছিল।
.
৩২.
অনেকটা পথ ঘুরে প্রশান্ত বসাক যখন নীলকুঠিতে ফিরে এলেন বেলা তখন প্রায় পৌনে আটটা।
দোতলায় চায়ের টেবিলে প্রভাতী চায়ের আসর তখন প্রায় ভাঙার মুখে।
টেবিলের দু পাশে রজত, পুরন্দর চৌধুরী ও সুজাতা বসে এবং শুধু তারাই নয়, গত সন্ধ্যার পরিচিত সেই কালো কাঁচের চশমা চোখে সুটপরিহিত যুবক সুন্দরলালও উপস্থিত।
প্রশান্ত বসাককে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে সকলেই একসঙ্গে তাঁর মুখের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল। এবং কথা বললে পুরন্দর চৌধুরী, এই যে মিঃ বসাক! সক্কাল বেলাতেই উঠে কোথায় গিয়েছিলেন?
এই একটু মর্ণিংওয়াক করতে গিয়েছিলাম। তারপর মিঃ সুন্দরলাল, আপনি কতক্ষণ?
এই আসছি।
সুজাতা ততক্ষণে উঠে চায়ের কেতলিটার গায়ে হাত দিয়ে তার তাপ অনুভব করে বললে, কেতলির চা-টা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, আপনি চা খাননি, রেবতীকে বলে আসি কিছু গরম চা দিতে প্রশান্তবাবু।