আরও একটু ঝুঁকে পড়ে ভাল করে পরীক্ষা করতে গিয়ে চোখে পড়ল জানলার ঠিক নীচেই চওড়া কার্নিশ।
সেই কার্নিশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া যায় বটে, তবে সেটা বেশ বিপদসঙ্কুল এবং শুধু তাই নয় সাহসেরও প্রয়োজন।
আবার ঘরের মেঝেতে জলসিক্ত সেই অস্পষ্ট পদচিহ্নগুলো পরীক্ষা করে দেখতে লাগলেন—যদি কোন বিশেষত্ব থাকে পদচিহ্নগুলোর মধ্যে। কিন্তু তেমন কোন উল্লেখযোেগ্য বিশেষত্বই চোখে পড়ল না প্রশান্ত বসাকের।
বাথরুমের দরজাটা বন্ধ করে একসময় ফিরে এলেন ল্যাবরেটারী ঘরের মধ্যে প্রশান্ত বসাক।
পূর্বোক্ত ঘরে প্রশান্ত বসাক যখন ফিরে এলেন, রজত সুজাতার পাশে বসে আছে আর জানলার কাছে দাঁড়িয়ে লম্বা সেই বিচিত্র পাইপটায় নিঃশব্দে ধূমপান করছেন পুরন্দর চৌধুরী। সুজাতার জ্ঞান ফিরে এসেছে।
একটা কটু তীব্র তামাকের গন্ধ ঘরের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে।
প্রশান্তর পদশব্দে ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেই যুগপৎ চোখ তুলে দরজার দিকে তাকাল। পুরন্দর চৌধুরীই প্রথমে কথা বললেন, Anything wrong ইন্সপেক্টার?
না কিছুই দেখতে পেলাম না।
আমার মনে হয় হঠাৎ উনি কোনরকম ছায়া-টায়া দেখে হয়তো–
পুরন্দর চৌধুরীর কথাটা শেষ হল না। জবাব দিল সুজাতাই, কোন রকম ছায়া যে সেটা নয় সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত মিঃ চৌধুরী। হঠাৎ দেখে আচমকা আমি চিৎকার করে উঠেছিলাম বটে সত্যি, তবে সে দেখার মধ্যে কোন রকম আমার ভুল হয়নি।
কিন্তু তাই যদি হবে, তবে এত তাড়াতাড়ি সেটা উধাও হয়ই বা কি করে দোতলা থেকে? কথাটা বললে রজত।
কিন্তু সেটাই তো আমার না দেখার বা কিছু একটা ভুল দেখবার একমাত্র যুক্তি নয় রজতদা। জবাবে বলে সুজাতা।
না। উনি ভুল দেখেননি রজতবাবু। কথাটা বললেন এবারে প্রশান্ত। এবং তাঁর কথায় ও তাঁর গলার স্বরে পুরন্দর চৌধুরী ও রজত দুজনেই যেন যুগপৎ চমকে প্রশান্তর মুখের দিকে তাকাল।
সত্যি বলছেন আপনি মিঃ বসাক? কথাটা বলে রজত।
হ্যাঁ রজতবাবু, আমি সত্যিই বলছি। কিন্তু রাত প্রায় পৌনে দুটো বাজে, বাকি রাতটুকু আপনারা সকলেই ঘুমবার চেষ্টা করুন, আমিও এবারে শুতে যাব, ঘুমে আমার দু চোখ ভেঙে আসছে।
সমস্ত আলোচনাটার উপরে যেন অকস্মাৎ একটা দাঁড়ি টেনে প্রশান্ত বসাক বোধ হয় ঘর ত্যাগ করে নিজের ঘরে শুতে যাবার জন্য পা বাড়িয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন। এবং কক্ষ ত্যাগের পূর্বে সুজাতাকে লক্ষ্য করে বললেন, ঘরের দরজায় খিল তুলে দিয়ে শোবেন মিস রয়।
কথাটা শেষ করেই আর মুহূর্তমাত্রও দাঁড়ালেন না ইন্সপেক্টার, নিঃশব্দে কক্ষ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।
অতঃপর রজত ও পুরন্দর চৌধুরীও যে যার ঘরে শুতে যাবার জন্য পা বাড়াল।
.
প্রশান্ত নিজের নির্দিষ্ট ঘরে প্রবেশ করে দরজাটা কেবল ভেজিয়ে দিলেন।
ঘুমের কথা বলে আলোচনার সমাপ্তি করে বিদায় নিয়ে এলেও ঘুম কিন্তু প্রশান্ত বসারে দুচোখের কোথাও তখন ছিল না।
তিনি কেবল নিজের মনে মনে সমস্ত ব্যাপারটা আগাগোড়া আর একবার ভাল করে ভেবে দেখতে চান।
বাথরুমের মেঝেতে, জলসিক্ত পদচিহ্নগুলো সত্যিই তাঁকে বিশেষভাবেই যেন বিচলিত করে তুলেছিল। আর কিছুনা হোক পদচিহ্নগুলো সুস্পষ্টভাবে একটা জিনিস প্রমাণিত করছে, ওই রাত্রে কিছুক্ষণ আগে কোন তৃতীয় ব্যক্তিবিশেষের আবির্ভাব ওই নীলকুঠীতে ঘটেছিল নিঃসন্দেহে। কোন ছায়ার মায়া নয়। এবং লছমনের মুখে শোনা সেই ভৌতিক আবির্ভাবের সঙ্গে যে আজকের রাত্রে সুজাতাদেবীর দৈখা ছায়ামূর্তির বিশেষ এক যোগাযোগ আছে সে বিষয়েও তাঁর যেন কোনই আর সন্দেহ বা দ্বিমত থাকছে না।
আর এও বোঝা যাচ্ছে ভৌতিক ব্যাপারটা এ বাড়িতে পূর্বে যারা দেখেছে তাদের সে দেখাটাও যেমন মিথ্যা নয়, তেমনি ব্যাপারটাও সত্যি সত্যিই কিছু আসলে ভৌতিক নয়।
লছমনের মুখ থেকেই তার জবানবন্দিতে শোনা গেছে রামচরণ বিনয়েন্দ্র এবং লছমন নিজেও পূর্বে এ বাড়িতে রাত্রে ওই ছায়ামূর্তি নাকি দেখেছে। অর্থাৎ ব্যাপারটা চলে আসছে বেশ কিছুদিন ধরে। এবং ছায়ামূর্তির ভৌতিক মুখোসের অন্তরালে যখন সত্যিকারের একটা জলজ্যান্ত মানুষ আছে তখন ওর পশ্চাতে কোন রহস্য যে আছে সেও সুনিশ্চিত।
৩১-৩৫. নীলকুঠির আশেপাশে
নীলকুঠির আশেপাশে একমাত্র বাঁদিকে লাগোয়া একটা দোতলা বাড়ি ভিন্ন আর কোন বাড়ি নেই প্রশান্ত বসাক সেটা পূর্বেই লক্ষ্য করেছিলেন।
জায়গাটার গত কয়েক বৎসরে অনেক কিছু ডেভালপমেন্ট হলেও ঐ অঞ্চলটির বিশেষ কিছু পরিবর্তন হয়নি।
ভোরের আলো আকাশে ফুটে ওঠবার সঙ্গে সঙ্গেই প্রশান্ত বসাক নীলকুঠি থেকে বের হয়ে পড়লেন।
কুঠির আশপাশটা একবার ভাল করে পরীক্ষা করে দেখাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য।
বাঁদিককার দোতলা বাড়িটায় একজন প্রফেসার থাকেন, সংসারে তাঁর এক বৃদ্ধা মা ও স্ত্রী। পূর্বেই সংবাদ পাওয়া গিয়েছিল গত মাসখানেক ধরে প্রফেসার মা ও স্ত্রীকে নিয়ে পুরীতে চেঞ্জে গেছেন। বর্তমানে বাড়ি দেখাশোনা করে একটি ভৃত্য।
ঘুরতে ঘুরতে প্রশান্ত বসাক নীলকুঠির ডান দিকে এবারে এলেন। সংকীর্ণ একটি গলিপথ। গলিপথটি বড় একটা ব্যবহৃত হয় বলে মনে হয় না। এবং পথটি বরাবর গঙ্গার ধার পর্যন্ত চলে গিয়েছে।
এগিয়ে গেলেন সেই গলিপথ ধরে প্রশান্ত বসাক। গঙ্গার একেবারে ধারে গিয়ে যেখানে পথটা শেষ হয়েছে, বিরাট শাখাপ্রশাখাবহুল একটি পুরাতন অশ্বত্থ বৃক্ষ সেখানে।