ও কি! ওটা কি!
চাঁদের আবছা আলোয় বারান্দায় দীর্ঘ শ্বেত বস্ত্রাবৃত ওটা কি!
ভয়ে আতঙ্কে স্থান কাল ভুলে আর্ত একটা চিৎকার করে উঠল সুজাতা এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সিঁড়ির শেষ ধাপের উপরে মূর্ছিত হয়ে পড়ে গেল।
.
প্রশান্ত বসাকও তখন সবে মাত্র বাগান থেকে ফিরে দোতলায় ওঠবার প্রথম ধাপে পা দিয়েছেন। সুজাতার কণ্ঠনিঃসৃত আর্ত সেই তীক্ষ্ণ চিৎকারের শব্দটা তাঁর কানে যেতেই তিনি চমকে ওঠেন এবং সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পান যেন একটা দুত পদধ্বনি উপরের বারান্দায় মিলিয়ে গেল। এক মুহূর্তও আর দেরি করলেন না প্রশান্ত বসাক।
প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে দু-তিনটা সিঁড়ি এক একবারে অতিক্রম করে ছুটলেন উপরের দিকে।
বারান্দায় এসে যখন পৌঁছলেন, দেখলেন পুরন্দর চৌধুরীও ইতিমধ্যে তাঁর ঘর থেকে বের হয়ে এসেছেন।
কি! কি ব্যাপার! কে যেন চিৎকার করল! পুরন্দর চৌধুরী সামনেই প্রশান্ত বসাককে দেখে প্রশ্ন করলেন।
হ্যাঁ, আমিও শুনেছি সে চিৎকার। বলতে বলতেই হঠাৎ তাঁর নজরে পড়ল তিনতলার ছাতে ওঠবার সিঁড়িটার মুখেই কী যেন একটা পড়ে আছে।
ছুটেই একপ্রকার সিঁড়ির কাছে পৌঁছে প্রশান্ত যেন স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। সেই ক্ষীণ চন্দ্রালোকেও সুজাতাকে চিনতে তাঁর কষ্ট হয় না।
পুরন্দর চৌধুরীও প্রশান্ত বসাকের পিছনে এসে গিয়েছিলেন এবং তিনিও সুজাতাকে চিনতে পেরেছিলেন। বিস্মিতকণ্ঠে তিনি বললেন, এ কি, সুজাতাদেবী এখানে পড়ে!
প্রশান্ত বসাক ততক্ষণে সুজাতার জ্ঞানহীন দেহটা পরম স্নেহে দু হাতে তুলে নিয়েছেন। সুজাতার ঘরের দিকে এগুতে এগুতে বললেন, ছাতের সিঁড়ির দরজাটায় শিকল তুলে দিন তো মিঃ চৌধুরী।
সুজাতার ঘরে প্রবেশ করে তার শয্যার.ওপরেই ধীরে ধীরে শুইয়ে দিলেন সুজাতাকে।
চোখে মুখে জলের ছিটে দিতেই সুজাতার লুপ্ত জ্ঞান ফিরে এল।
চোখ মেলে তাকল সে।
সুজাতাদেবী!
কে?
আমি প্রশান্ত, সুজাতাদেবী।
আমি—
একটু চুপ করে থাকুন।
কিন্তু সুজাতা চুপ করে থাকে না। বলে, এ বাড়িতে নিশ্চয়ই ভূত আছে প্রশান্তবাবু।
ভূত!
হ্যাঁ। স্পষ্ট বারান্দায় আমি হেঁটে বেড়াতে দেখেছি।
ইতিমধ্যে পুরন্দর চৌধুরী রজতকে ডেকে তুলেছিলেন। রজতও এসে কক্ষে প্রবেশ করে বলে, ব্যাপার কি, কি হয়েছে সুজাতা?
প্রশান্ত বসাক আবার জিজ্ঞাসা করলেন, কী ঠিক দেখেছেন বলুন তো সুজাতা দেবী?
সাদা চাদরে সর্বাঙ্গ ঢাকা একটা মৃর্তি বারান্দায় হেঁটে বেড়াচ্ছিল। আমাকে দেখেই ছুটে সেই মূর্তিটা যেন ল্যাবরেটারী ঘরের মধ্যে গিয়ে ঢুকল।
প্রশান্ত বসাককে মনে হল যেন অত্যন্ত চিন্তিত।
রজত আবার কথা বলে, তাহলে রেবতী যে ছায়ামূর্তির কথা এ বাড়িতে মধ্যে মধ্যে রাত্রে দেখা দেয় বলেছিল তা দেখছি মিথ্যা নয়।
ছায়ামূর্তি? সে আবার কি? পুরন্দর চৌধুরী প্রশ্ন করলেন রজতকে।
হ্যাঁ, আপনি শোনেননি?
কই, না তো।
যাকগে সে কথা। রজতবাবু, এ ঘরে আপনি ততক্ষণ একটু বসুন, আমি আসছি।
কথাটা বলে হঠাৎ যেন প্রশান্ত বসাক ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
.
৩০.
প্রশান্ত বসাক সুজাতার ঘর থেকে বের হয়ে সোজা ল্যাবরেটরী ঘরের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করে সুইচ টিপে ঘরের আলোটা জ্বালালেন।
কিরীটীর কথাটাই তাঁর ঐ মুহূর্তে নতুন করে মনে পড়েছিল, সে বলেছিল ল্যাবরেটারী ঘরটা আর একবার ভাল করে দেখতে।
শূন্য ঘর। কোথাও কিছু নেই।
তবু সমস্ত ল্যাবরেটারী ঘর ও তৎসংলগ্ন বিনয়েন্দ্রর শূন্য শয়ন ঘরটা তন্ন তন্ন করে খুঁজলেন।
কিন্তু কোথায়ও কিছু নেই। আবার ল্যাবরেটরী ঘরে ফিরে এলেন।
হঠাৎ তাঁর নজরে পড়ল ল্যাবরেটরীর মধ্যস্থিত বাথরুমের দরজাটা হাঁ হাঁ করছে খোলা।
এগিয়ে গেলেন প্রশান্ত বসাক বাথরুমের দিকে।
কিন্তু বাথরুমের দরজাপথে প্রবেশ করতে গিয়েই যেন দরজার সামনে থমকে দাঁড়ালেন। দরজার সামনে কতকগুলো অস্পষ্ট জলসিক্ত পায়ের ছাপ। ছাপগুলো বাথরুম থেকে এসে যেন ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেছে। খালি পায়ের ছাপ। বাথরুমের খোলা দরজাপথে প্রশান্ত বসাক ভিতরে উঁকি দিলেন, বাথরুমের মেঝেতে জল জমে আছে, বুঝলেন ঐ জল লেগেই পায়ের ছাপ ফেলেছে এ ঘরে।
প্রশান্ত বসাক এবারে বাথরুমের মধ্যে প্রবেশ করলেন।
বাথরুমে একটি মাত্রই কাঁচের জানালা। ঠিক ল্যাবরেটরী ঘরেরই জানলার অনুরূপ।
লোহার-ফ্রেমে ঘষা কাচ বসানো একটি মাত্রই পাল্লা। এবং সেই পাল্লাটি ঠিক মধ্যস্থলে একটি ফালক্রেমের সাহায্যে দড়ি দিয়ে ওঠা নামা করা যায়।
প্রশান্ত বসাক বাথরুমের মধ্যে ঢুকে দেখলেন, জানলার পাল্লাটি ওঠানো।
হস্তধৃত টর্চের আলোর সাহায্যে বাথরুমের আলোর সুইচটা খুঁজে নিয়ে আলোটা জ্বালালেন মিঃ বসাক।
বাথরুমটা আলোয় ভালভাবে পরীক্ষা করে দেখতে গিয়ে প্রশান্তর মনে হল ঘরের সংলগ্ন ঐ বাথরুমটি যেন বরাবর ছিল না। পরে তৈরি করে নেওয়া হয়েছে। অথবা এমনও হতে পারে ঐ বড় হলঘরটির সংলগ্ন এই ছোট ঘরটি পূর্বে অন্য কোন ব্যাপারে ব্যবহার করা হত, বিনয়েন্দ্র পরে সেটিকে নিজের সুবিধার জন্য বাথরুমে পরিণত করে নিয়েছিলেন।
প্রশান্তর বুঝতে কষ্ট হয় না, বাথরুমের ঐ জানলাপথেই কেউ এ ঘরে প্রবেশ করেছিল। কিন্তু কি ভাবে এল জানলাপথে!
কাঁচের জানলার পাল্লাটার তলা দিয়ে উঁকি দিলেন। নীলকুঠির পশ্চাতের বাগানের খানিকটা অংশ চোখে পড়ল।