সুন্দরলাল আবার বললেন, এতক্ষণ আমি চলেই যেতাম, কেবল আপনার সঙ্গে দেখা করব বলেই যাইনি। তাছাড়া ওঁরা বিশেষ করে বললেন ডিনারটা খেয়ে যেতে সে তো ভালই করেছেন, মৃদুকণ্ঠে ইন্সপেক্টার বলেন, তা উঠেছেন কোথায়?
কলকাতায়, তাজ হোটেলে।
আপনি যখন বিনয়েন্দ্রবাবুর বিশেষ পরিচিত তখন হয়তো তাঁর সম্পর্কে একটু খোঁজখবরও পাব আপনার কাছে। প্রশান্ত বসাক বললেন।
তাঁর সঙ্গে আলাপ আমার ইদানীং ঘনিষ্ঠ হলেও পরিচয় আমার তাঁর সঙ্গে একপক্ষে তাঁর থার্ড ইয়ারে ছাত্রজীবনে কয়েক মাস সহপাঠী হিসাবেই হয়। তারপর পড়া ছেড়ে দিয়ে আমার এক আত্মীয়ের কাছে নাগপুরে গিয়ে ব্যবসা শুরু করি। দীর্ঘকাল পরে আবার তাঁর সঙ্গে আমার দেখা এই কলকাতায়ই একটা বিজ্ঞান সভায়। তারপর বার দু-তিন নাগপুর থেকে কলকাতায় এলেই আমি এখানে এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করে যেতাম। সেদিক দিয়ে তাঁর পার্সোন্যাল ব্যাপারের বিশেষ তেমন কিছুই আমি জানি না। তাই সেরকম সাহায্য আপনাকে করতে পারব বলে তো আমার মনে হয় না, মিঃ বসাক।
আপনি বিনয়েন্দ্রবাবুর সহপাঠী যখন, তখন পুরন্দরবাবুর সঙ্গেও বোধহয় আপনার সেই সময়েই আলাপ মিঃ ঝা?
প্রশান্ত বসাকের আকস্মিক প্রশ্নে চকিতে সুন্দরলাল তাঁর পার্শ্বে উপবিষ্ট পুরন্দর চৌধুরীর দিকে একবার তাকালেন। তারপর মৃদু স্মিতকণ্ঠে বললেন, হ্যাঁ, ওঁর সঙ্গেও আমার আলাপ আছে।
মিঃ বসাক সুন্দরলালের সঙ্গে এমনি ঘরোয়া সহজভরে কথাবার্তা বলতে বলতেই তীক্ষ্ণ সতর্ক দৃষ্টিতে সুন্দরলালকে দেখছিলেন।
বয়েস যাই হোক না কেন, সুন্দরলালকে কিন্তু পুরন্দর চৌধুরী ও বিনয়েন্দ্র রায়ের সহপাঠী হিসাবে যথেষ্ঠ কম বয়েসী বলেই মনে হচ্ছিল।
শুধু তাই নয়, মুখে যেন কেমন একটা রমনী-সুলভ কমনীয়তা,দাড়ি নিখুঁতভাবে কামানন, সরু গোঁফ।
দেহের গঠনটাও ভারী সুশ্রী–লম্বা, খুব রোগাও নয়, আবার মোটও নয়।
কাঁটা চামচের সাহায্যে আহার করছিলেন সুন্দরলাল, হাতের আঙুলগুলো লম্বা লম্বা সরু সরু।
ডান হাতের অনামিকায় ও মধ্যাঙ্গুষ্ঠে দুটি পাথর বসানো স্বর্ণ-অঙ্গুরীয়। একটি পাথর, প্রবাল। অন্যটি বোধ হয় হীরা।
ঘরের আলোয় আংটির হীরাটি ঝিলমিল করছিল।
টেবিলে বসে খেতে খেতেই নানাবিধ আলোচনা চলতে লাগল অতঃপর।
.
আহারাদির পর পুনরায় আগামী কাল আসবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সুন্দরলাল বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
রজত অসুস্থ ছিল, সেও শুতে গেল।
সুজাতার ঘুম আসছিল না বলে তিন তলার ছাতে বেড়াতে গেল।
কেবল একটা টর্চ ও লোডেড পিস্তল পকেটে নিয়ে প্রশান্ত বসাক বাড়ির পশ্চাতের বাগানে গিয়ে প্রবেশ করলেন।
চাঁদ উঠতে আজ অনেক দেরি। অন্ধকার আকাশে এক ঝাঁক তারা জ্বলজ্বল করছে।
দীর্ঘ দিনের অযত্নে বাগানের চারিদিকে প্রচুর আগাছা নির্বিবাদে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। অন্ধকার রাত্রি যেন চারিদিককার আগাছা ও জঙ্গলের মধ্যে লুকোচুরি খেলছে। প্রাচীরের সীমানা ঘেঁষে বড় বড় দুটি কনকচাঁপার গাছ। ডালে ডালে তার অজস্র বিকশিত পুষ্প-গন্ধ বাতাসে যেন ম-ম করছে।
পায়ে-চলা একটা অপ্রশস্ত পথ বাগানের মধ্যে দিয়ে বরাবর চলে গিয়েছে প্রাচীর সীমানার গেট পর্যন্ত, সেই পথটা ধরেই এগিয়ে চললেন প্রশান্ত বসাক।
.
২৯.
সুজাতা একাকী তিনতলার ছাদে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। আজ যেন কোথায়ও হাওয়া এতটুকুও নেই। অসহ্য একটা গুমোট ভাব।
কালই সকালে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে মনস্থ করেছিল সুজাতা। এবং যাবার জন্য। গতকাল দ্বিপ্রহর পর্যন্ত তার মনের মধ্যে একটা আগ্রহও যেন তাকে তাড়না করছিল। কিন্তু এখন সে তাড়না যেন আর তত তীব্র নেই।
ছোট্রকার আকস্মিক মৃত্যুসংবাদে যে বিহ্বলতা এসেছিল সেটাও যেনকেমন থিতিয়ে এসেছে। নিজেকে কেমন যেন দুর্বল মনে হয়।
বিশেষ একখানি মুখ মনের মধ্যে যেন কেবলই ভেসে ভেসে ওঠে। মনে হয় সত্যিই তো, তাড়াতাড়ি লক্ষ্ণৌ ফিরে গিয়ে কি হবে! সেই তো দৈনন্দিনের রুটিন-বাঁধা একঘেয়ে শিক্ষয়িত্রীর জীবন।
একই বহুবার পঠিত বইয়ের পাতাগুলি একের পর এক উল্টে যাওয়া, একই কথা, একই লেখা, কোন বৈচিত্র্য নেই। কোন নূতনত্ব বা কোন আবিষ্কারের আনন্দ বা উত্তেজনা নেই।
সেই স্কুল, সেই বাসা।
বহু পরিচিত লক্ষ্ণৌ শহরের সেই রাস্তাঘাটগুলো।
সীমাবদ্ধ একটা গণ্ডির মধ্যে কেবলই চোখ-বাঁধা বলদের মত পাক খাওয়া।
এই জীবন তো সুজাতা কোনদিন চায়নি। কল্পনাও তো কখনো করেনি। সারাটা জীবন ধরে এমনি করেই সে রুক্ষ এক মরুভূমির মধ্যে ঘুরে ঘুরেই বেড়াবে!
সেও তো কতদিন স্বপ্ন দেখেছে, জীবনের পাত্রখানি তার একদিন সুধারসে কানায় কানায় ভরে উঠবে। জীবন-মাধুর্য পরিপূর্ণতায় উপচে পড়বে।
জীবনের ত্রিশটা বছর কোথা দিয়ে কেমন করে যে কেটে গেল!
কোথা থেকে এত মিষ্টি চাঁপা ফুলের গন্ধ আসছে! মনে পড়ল আজই সকালে জানলার ভিতর দিয়ে সে দেখেছে বাগানের প্রাচীর সীমানার ধার ঘেঁষে বড় বড় দুটি কনক চাঁপার গাছ অজস্র স্বর্ণ-ফুলে যেন ছেয়ে আছে। এ তারই গন্ধ।
এয়োদশীর ক্ষীণ চাঁদ দেখা দিল আকাশ-দিগন্তে। আবছা মৃদু কোমল আলোর একটি আভাস যেন চারিদিকে ছড়িয়ে গেল।
কত রাত হয়েছে, কে জানে!
সুজাতা সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল।
শেষ সিঁড়িতে পা দিয়ে সামনের দিকে তাকাতেই আপনার অজ্ঞাতেই যেন থমকে দাঁড়িয়ে যায় সুজাতা।