আচ্ছা মিঃ রায়, আপনার কি মনে হয় হত্যাকারী কোন পুরুষ বা নারী?
পুরুষও হতে পারেন, নারীও হতে পারেন। অথবা উভয়ের একত্রে মিলিত প্রচেষ্টাও থাকতে পারে। কিন্তু সে তো শেষ কথা বর্তমান রহস্যের। তার পূর্বে সে সূত্রগুলি ধরে আপনি অগ্রসর হবেন সেগুলো হচ্ছে, এক নম্বর, প্রত্যেকেরই গত চার-পাঁচ বছরের জীবনের অতীত ইতিহাস। বিনয়েন্দ্র, রজত, সুজাতাদেবী ও পুরন্দর চৌধুরীর। দুনম্বর,সেই ছায়ামূর্তির অন্বেষণ। যে ছায়ামূর্তিকে ইদানীং বিনয়েন্দ্র রাত্রে নীলকুঠিতে ঘন ঘন দেখতেন এবং রামচরণ ও ড্রাইভার করালীও দেখেছে বলে জানা যায়। তিন নম্বর, সেই শ্রীমতী রহস্যময়ী লতা। তাঁকেও খুঁজে বের করতে হবে, এবং সেই সঙ্গে জানতে হবে সেই লতা বিনয়েন্দ্রর কুমার জীবনে কতখানি ঘনিষ্ঠ হয়ে এসেছিল। চার নম্বর, বিনয়েন্দ্রর শয়নকক্ষ ও গবেষণা ঘরটি আর একবার পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে আপনাকে দেখতে হবে। এই চারটি প্রশ্নের মধ্যেই বিনয়েন্দ্রর হত্যার কারণ বা মোটিভটি জড়িয়ে আছে জানবেন।
প্রশান্ত বসাক গভীর মনোযোগ সহকারে কিরীটীর কথাগুলো শুনতে থাকেন।
কিরীটী একটু থেমে আবার বললে, এবারে হত্যা করা সম্পর্কে যা আমার মনে হচ্ছে, বিনয়েন্দ্রর হত্যার ব্যাপারটি হচ্ছে pre-arranged, premeditative and a well planned murder। খুব ধীরে-সুস্থে, সময় নিয়ে, প্ল্যান করে, এবং ক্ষেত্র তৈরি করে তারপর হত্যা করা হয়েছে বেচারীকে। এবং খুব সম্ভবত, তার কিছুটা পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে বেচারী রামচরণ জানতে পারায় হত্যাকারী রামচরণকেও সরিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছে। অতএব সেটাও ইচ্ছাকৃত হত্যা। দুটি নৃশংস হত্যাকাণ্ডের যিনি হোতা, জানবেন, তিনি যেমন ধূর্ত তেমনি সতর্ক, তেমনি শয়তানী বুদ্ধিতে পরিপক। এবং সম্ভবত আজ কাল বা দু-চারদিনের মধ্যেই হোক, হত্যাকারী আবার হানবে তার মৃত্যু-ছোবল।
কিরীটীর কথায় প্রশান্ত বসাক যেন চমকে ওঠেন, বলেন, কি বলছেন আপনি মিঃ রায়!
ঠিকই বলছি। আমার calculation যদি মিথ্যা না হয় তো শীঘ্রই আবার একটি বা ততোধিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হবে। অতএব সাবধান। খুব সাবধান। কিন্তু যাক সে কথা, এবারে আসা যাক আপনার সূত্রগুলির মধ্যে। ১নং, ভাঙা ঘড়ি। ২নং, অপহৃত বিনয়েন্দ্রর রবারের চপ্পল জোড়া। ৩নং, রামচরণের ঘরে তার নিত্যব্যবহার্য চিরুনিতে প্রাপ্ত কয়েকগাছি নারীর কেশ। ৪নং, তিনখানি চিঠি।
.
২৮.
প্রশান্ত বসাক কিরীটীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, শুভরাত্রি জানিয়ে নিজের গাড়িতে এসে যখন বসলেন, রাত তখন সোয়া দশটা।
ড্রাইভারকে নির্দেশ দিলেন উত্তরপাড়া যাবার জন্য।
চলন্ত গাড়ির মধ্যে বসে আর একবার সমস্ত ব্যাপারটা ও কিরীটীর কথাগুলো মনে মনে পর্যালোচনা করতে লাগলেন প্রশান্ত বসাক।
নীলকুঠিতে যখন এসে পৌঁছলেন রাত্রি তখন প্রায় পৌনে এগারটা।
সিঁড়ির মুখেই রেবতীর সঙ্গে প্রশান্ত বসাকের দেখা হয়ে গেল।
এবং রেবতীর কাছেই শুনলেন, এতক্ষণ সকলে ওর জন্য অপেক্ষা করে এই সবে খেতে বসেছেন।
রজতবাবুরাত আটটা নাগাদ ফিরে এসেছেন এবং আরও একটি সংবাদ পেলেন, সুন্দরলাল নামে এক ভদ্রলোক রায়পুর থেকে এসেছেন।
প্রশান্ত বসাক সোজা একেবারে খাবার ঘরেই এসে প্রবেশ করলেন। ঘরের মধ্যে টেবিলের সামনে বসে সবেমাত্র সকলে তখন আহার শুরু করেছেন।
ঘরের মধ্যে উপস্থিত চারটি প্রাণী-সুজাতা, রজত, পুরন্দর চৌধুরী ওঁদের তো চেনেনই প্রশান্ত বসাক, চেনেন না কেবল চতুর্থ ব্যক্তিকে। পরিধানে তাঁর সুট, মাথায় পাঞ্জাবীদের মত পাগড়ি এবং চোখে কালো লেন্সের চশমা। বুঝলেন, উনিই আগন্তুক সুন্দরলাল।
প্রশান্ত বসাকের পদশব্দে সকলেই মুখ ফিরিয়ে তাকালেন।
রজত ও সুজাতা পাশাপাশি একদিকে ও অন্যদিকে টেবিলের পাশাপাশি বসে পুরন্দর চৌধুরী ও সুন্দরলাল।
প্রশান্ত বসাক ঘরে প্রবেশের মুখেই লক্ষ্য করেছিলেন, রজত ও সুজাতা নিম্নকণ্ঠে পরস্পরের সঙ্গে কী যেন কথাবার্তা বলছে। আর সুন্দরলাল ও পুরন্দর চৌধুরী দুজনে কথাবার্তা বলছেন। ইন্সপেক্টারকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে সর্বাগ্রে রজতই তাঁকে আহ্বান জানাল, আসুন মিঃ বসাক, আপনার জন্য এতক্ষণ অপেক্ষা করে থেকে এইমাত্র আমরা সকলে বসলাম।
না না—তাতে কি হয়েছে, বেশ করেছেন। বলতে বলতে এগিয়ে এসে একটা খালি চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন প্রশান্ত বসাক, তারপর বললেন, দাহ হয়ে গেল।
হ্যাঁ। রেবতী এসে ইন্সপেক্টারের সামনে দাঁড়িয়ে বললে, আপনার খাবার দিতে বলি? হ্যাঁ, বল। ওকে আপনি বোধ হয় চিনতে পারছেন না মিঃ বসাক? সুন্দরলালকে ইঙ্গিতে দেখিয়ে প্রশ্ন করল রজত।
না। মানে—
সুন্দরলালই জবাব দিলেন ইংরাজীতে, My name is Sundarlal Jha।
সুস্পষ্ট শুদ্ধ উচ্চারণ। কোথাও এতটুকু জড়তা নেই, এবং গলাটা সরু ও মিষ্টি।
হ্যাঁ, রেবতীই বলছিল আপনার এখানে আসবার কথা এইমাত্র। তা আপনি—
বিনয়েন্দ্রবাবু আমার বিশেষ বন্ধু ছিলেন। আমি তাঁর সঙ্গেই দেখা করতে এসেছিলাম। কিন্তু এখানে পৌঁছে এঁদের মুখে সব শুনে তো একেবারে তাজ্জব বনে গেছি ইন্সপেক্টার, how horrible, how absurd!
ইন্সপেক্টার কিন্তু কোন জবাব দেন না। তাঁর মনে পড়ে ঘণ্টাখানেক আগে কিরীটীর সেই কথাগুলো-pre-arranged, pre-meditative and a well planned murder!