এবার মিঃ বসাক ঘুরে তাকালেন প্রতুলবাবুর মুখের দিকে এবং প্রশ্ন করলেন, কেন অত টাকার প্রয়োজন হত ইদানীং তাঁর, সে সম্পর্কে আপনি কিছু বলতে পারেন প্রতুলবাবু?
আজ্ঞে না, তাঁর একান্ত নিজস্ব ব্যাপার কেউ ঘুণাক্ষরেও কিছু জানতে পেত না। কাউকে তিনি কিছু বলতেনও না।
আচ্ছা মিঃ চট্টরাজ, বিনয়েন্দ্রবাবুর সঙ্গে আপনার কি রকম পরিচয় ছিল?
বিশেষ কিছুই না বলতে গেলে। বেশীর ভাগ তাঁর যা কিছু বলবার তিনি চিঠিতে বা ফোনেই জানাতেন।
এ বাড়িতে ফোন আছে নাকি? কই দেখিনি তো! বললেন প্রশান্ত বসাক।
জবাব দিলেন প্রতুলবাবু, আছে ল্যাবরেটারী ঘরের মধ্যে।
বাইরে এমন সময় জুতোর শব্দ পাওয়া গেল। পুরন্দর চৌধুরী এসে ঘরে প্রবেশ করলেন।
আসুন পুরন্দরবাবু, বিশ্রাম নেওয়া হল?
হ্যাঁ। আমাকে তাহলে অনুগ্রহ করে এবারে যাবার অনুমতি দিন ইন্সপেক্টার। কথা দিচ্ছি আপনাকে আমি, ডাকামাত্রই আবার আমি এসে হাজির হব।
আমি এখুনি একবার কলকাতায় যাব। ফিরে এসে আপনাকে বলব কখন আপনাকে ছেড়ে দিতে পারব মিঃ চৌধুরী। জবাব দিলেন ইন্সপেক্টার।
রেবতী চায়ের ট্রে হাতে ঘরে এসে প্রবেশ করল।
.
২৭.
লালবাজারে কিছু কাজ ছিল, সে কাজ শেষ করে মিঃ বসাক সোজা সেখান থেকে কিরীটীর টালিগঞ্জ ভবনে এসে হাজির হলেন।
কিরীটী তার দোতলার বসবার ঘরে আলো জ্বেলে বসে একখানা জ্যোতিষ-চর্চার বই নিয়ে পড়ছিল।
জংলী এসে সংবাদ দিল, ইন্সপেক্টার বসাক এসেছেন।
নিয়ে আয় এই ঘরেই। বই থেকে মুখ না তুলেই কিরীটী বললে।
একটু পরে প্রশান্ত বসাকের পদশব্দে পূর্ববং বই হতে মুখ না তুলেই একটা সাদা কাগজের বুকে একটা কুষ্ঠির ছকের পাশে কি সব লিখতে লিখতে আহ্বান জানাল কিরীটী, আসুন মিঃ বসাক, বসুন। সপ্তম স্থানে রাহু, অষ্টমে বুধ।
মিঃ বসাক বসতে বসতে বললেন, জ্যোতিষ চর্চা আবার শুরু করলেন কবে থেকে?
ভারতের বহু পুরাতন ও অবহেলিত অদ্ভুত সায়েন্স এই জ্যোতিষচচার ব্যাপার মিঃ বসাক। এবং সময় ও নক্ষত্র যদি ঠিক ঠিক হয় তো অনেক কিছুই দেখবেন, নির্ভুল পাবেন আপনি গণনায়। অঙ্ক শাস্ত্রের মত ঠিক হলে শুদ্ধ উত্তর ঠিক আপনি পাবেনই।
জ্যোতিষ চচটিাকে সত্যি সত্যিই তাহলে আপনি বিশ্বাস করেন মিঃ রায়?
নিশ্চয়ই, এ একটা অত্যাশ্চর্য সায়েন্স। আর বিশ্বাসের কথা বলছেন, এ তো আপনি বিশ্বাস করেন যে চন্দ্রের কলাবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নদীর জোয়ার-ভাঁটার পরিবর্তন হয়?
তা অবিশ্যি করি।
তবে কেন আপনার বিশ্বাস করতে বাধে মানুষের দেহের উপরেও গ্রহ-উপগ্রহের প্রভাব আছে? জানেন না আপনি, ভৃগুর কি অসাধারণ ক্ষমতা। আমি এ যতই পড়ছিএবং যতই মনে মনে বিশ্লেষণ করছি ততই বিস্ময় যেন আমার বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। কুষ্টির ছকটা আর কিছুই নয়, মানুষের বহু বিচিত্র রহস্যময় অজ্ঞাত জীবনের কতকগুলো সত্য ও অবধারিত সূত্র একত্রে গ্রথিত একটা সংকেত মাত্র। সূত্রগুলির সঠিক পাঠোদ্ধার করতে পারলে আপনি সুনিশ্চিত পৌঁছবেন সেই অজানিত সংকেতের নির্ভুল মীমাংসায়। আজ উত্তরপাড়ার নীলকুঠির যে হত্যা-রহস্য আপনাকে চিন্তিত করে—
বাধা দিলেন ইন্সপেক্টার, আশ্চর্য, কি করে জানলেন যে সেই ব্যাপারেই আপনার কাছে আমি এসেছি।
কিছুটা শুনেছি আজ দুপুরে, আপনাদের হেডকোয়ার্টারে গিয়েছিলাম, সেখানেই। শুনলাম, নীলকুঠির মার্ডারের মোটামুটি কাহিনীটা এবং সেখানেই শুনলাম আপনিই সেই ঘটনাটা তদন্ত করছেন বর্তমানে। তার পরই অকস্মাৎ আপনার আমার কাছে আগমন। ব্যস, একেবারে অঙ্কশাস্ত্রের যোগ-বিয়োগ—উত্তর মিলে গেল।
সত্যি! সেই কারণেই আপনাকে বিরক্ত করতে এসেছি মিঃ রায় এই সময়ে।
না না—এর মধ্যে বিরক্তির কী আছে। বলুন, শোনা যাক।
প্রশান্ত বসাক সেই একেবারে গোড়া থেকেই সব বলে যেতে লাগলেন।
কিরীটী সোফাটার উপর গা এলিয়ে দু চক্ষু বুজে একটা ফুরোট. টানতে টানতে শুনতে লাগল।
কাহিনী যখন শেষ হল, কিরীটী তখনও চোখ বুজে পূর্ববং সোফার উপরে হেলান দিয়েই বসে আছে।
ঘরের মধ্যে একটা স্তব্ধতা যেন থমথথ করছে।
ওয়াল-ক্লকটা ঢং ঢং করে রাত্রি নটা ঘোষণা করল।
সময় সংকেতের সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় কিরীটী চোখ মেলে তাকাল, এবং মৃদু কণ্ঠে এই সর্বপ্রথম প্রশ্ন করল, আপনি যা বললেন, তার মধ্যে কয়েকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে।
কী বলুন তো?
প্রথমত ধরুন, সিঙ্গাপুরী মুক্তা।
কিন্তু সিঙ্গাপুরী মুক্তার ব্যাপারটা তো–
হ্যাঁ। যতটুকু মুক্তা সম্পর্কে আপনি জেনেছেন, আমার মনে হচ্ছে, সেটাই সব নয়, আংশিক মাত্র। দ্বিতীয়ত সেই রহস্যময়ী নারীলতা। লতা শব্দের আর একটি অর্থ জানেন তো, সাপ, এবং সেই সাপই শুধুনয়, ইউ. পি. থেকে আগত সেই আগন্তুকের কথাটাও আপনাকে স্মরণ রাখতে হবে। যেমন করে হোক ঐ দুটি ব্যক্তিবিশেষের খুঁটিনাটি কিছু সংবাদ বা পরিচয় আপনাকে জানতে হবে। আর আপনার মুখে সমস্ত কথা শোনবার পর, মনে মনে আমি। যে ছকটি গড়ে তুলেছি তা যদি ভুল না হয়, অর্থাৎ আমার অনুমান যদি ভুল না হয়ে থাকে তো জানবেন, এ ক্ষেত্রে হত্যার কারণ বা মোটিভ প্রেমঘটিত।
প্রেমঘটিত!
হ্যাঁ, প্রেমেরই যে সর্বাপেক্ষা বিচিত্র গতি। এবং যে প্রেম ক্ষেত্রবিশেষে নিঃস্ব করে আপনাকে বিলিয়ে দিতে পারে, মনে রাখবেন, সেই প্রেমই আবার ভয়াবহ গরল উদগীরণ করতে পারে।