চিঠিগুলোও সেই শ্যামসুন্দরেরই লেখা। চিঠি পড়ে বোঝা গেল, সম্পর্কে সেই শ্যামসুন্দর রামচরণেরভাইপোহয়। থাকে মেদিনীপুর। আর পাওয়া গেল একটাপোষ্ট-অফিসের পাস-বই।
পাস-বইটা উলটে-পালটে দেখা গেল, তার মধ্যে প্রায় শ-চারেক টাকা আজ পর্যন্ত জমা দেওয়া আছে। মধ্যে মধ্যে অবিশ্যি পাঁচ-দশ করে তোলার নিদর্শনও আছে। লোকটা দেখা যাহেতাহলে কিছুটা সঞ্চয়ীও ছিল।
বাক্সটা বন্ধ করে পুনব্ৰায় তালায় চাবি দিয়ে মিঃ বসাক রামচরণের ঘর থেকে বের হয়ে এলেন।
দ্বিপ্রহরের রৌদ্রতাপ তখন অনেকটা ঝিমিয়ে এসেছে। প্রশান্ত বসাক নীচের তলায় যে ঘরটায় গত দুদিন ধরে অফিস করেছিলেন সেই ঘরেই এসে প্রবেশ করলেন।
২৬-৩০. ঘরের মধ্যে ঢুকতেই চোখাচোখি
ঘরের মধ্যে ঢুকতেই চোখাচোখি হয়ে গেল প্রতুলবাবুর সঙ্গে।
প্রতুলবাবু বোধ হয় কিছুক্ষণ আগে এসেছেন, ঐ ঘরে ইন্সপেক্টারের অপেক্ষায় বসেছিলেন।
প্রতুলবাবুর পাশেইচেয়ারেস্যুট পরিহিত সুশ্রী আর একজন মধ্যবয়সী ভদ্রলোবসেছিলেন।
এই যে প্রতুলবাবু! কতক্ষণ এসেছেন?
এই কিছুক্ষণ হল। আলাপ করিয়ে দিই ইন্সপেক্টার সাহেব, ইনি মিঃ চট্টরাজ, বিনয়েন্দ্রবাবুর অ্যাটর্নী। আর ইনি ইন্সপেক্টার মিঃ প্রশান্ত বসাক।
উভয়ে উভয়কে নমস্কার জানান।
কথা বললেন তারপর প্রথমে মিঃ চট্টরাজই, আমাকে আপনি ডেকে পাঠিয়েছিলেন মিঃ বসাক?
হ্যাঁ। বিনয়েন্দ্রবাবুর কোন উইল আছে কিনা সেইটাই আমি জানবার জন্য আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম মিঃ চট্টরাজ।
না। উইল তিনি কোন কিছু করে যাননি।
কোন উইলই নেই?
না।
উইলের কোন কথাবার্তাও হয়নি কখনও তাঁর সঙ্গে আপনার?
মাস পাঁচ-ছয় আগে একবার তিনি আমাদের অফিসে যান, সেই সময় কথায় কথায় একবার বলেছিলেন উইল একটা তিনি করবেন—
সে উইল কী ভাবে হবে সে সম্পর্কে কোন কথাবার্তা হয়নি?
হ্যাঁ, বলেছিলেন, তাঁর যাবতীয় সম্পত্তি একমাত্র হাজার দশেক নগদ টাকা ছাড়া তিনি তাঁর ভাইঝি কে এক সুজাতাদেবীকেই নাকি দিয়ে যেতে চান।
একমাত্র দশ হাজার টাকা ব্যতীত সব কিছু সুজাতাদেবীকেই দিয়ে যাবেন বলেছিলেন?
হ্যাঁ।
রজতবাবু তাঁর একমাত্র ভাইপোর সম্পর্কে কোন ব্যবস্থাই করবার ইচ্ছা প্রকাশ করেননি?
হ্যাঁ, করেছিলেন, ঐ নগদ দশ হাজার টাকা মাত্র। আর কিছু নয়।
হুঁ। ক্ষণকাল চুপচাপ বসে কি যেন ভাবলেন মিঃ বসাক, তারপর মৃদু কণ্ঠে বললেন, একটা কথা মিঃ চট্টরাজ, বিনয়েন্দ্রবাবুর প্রপার্টির ভ্যালুয়েশন কত হবে নিশ্চয়ই জানেন?
ইদানীং অনেককিছুইহস্তান্তরিত হয়েছিল। কলকাতার তিনখানা বাড়ি, ফিক্সড ডিপোজিটের সুদ বাবদ যা পেয়েছেন সবই গিয়েছিল খরচ হয়ে তালেও এখনও যা প্রপার্টি আছে তার ভ্যালুয়েশন তা ধরুন, লাখ দুয়েক তো হবেই। তাছাড়া ব্যাঙ্কেও নগদ হাজার পঞ্চাশ এখনও আছে।
সম্পত্তির পরিমাণ তাহলে নেহাত কম নয়। বেশ লোভনীয়ই যে যে-কোন ব্যক্তির পক্ষে।
মিঃ চট্টরাজ বললেন, এ আর কি, একদিন চক্রবর্তীদের সম্পত্তির পরিমাণ পনের বিশ লাখ টাকা ছিল; যা কাগজপত্রে পাওয়া যায়। নানা ভাবে কমতে কমতে এখন কলকাতার পার্ক স্ট্রীটের বাড়ি, এই নীলকুঠি ও টালিগঞ্জ অঞ্চলে কিছু জমি ও ব্যাঙ্কে যা নগদ আছে।
এখন তাহলে বিনয়েন্দ্রবাবুর সমস্ত সম্পত্তি কে পাচ্ছে মিঃ চট্টরাজ?
উইল যখন কিছু নেই তখন রজতবাবু ও সুজাতাদেবীই সব সমান ভাগে পাবেন; কেন একমাত্র ওঁরাই দুজনে আজ বিনয়েন্দ্রবাবুর সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী।
রেবতী এসে ঘরে প্রবেশ করল এবং প্রতুলবাবুকে সম্বোধন করে বললে, বাবু চাল ডাল তেল ঘির ব্যবস্থা করে দিয়ে যাবেন।
এতদিন, এমন কি কাল রাত পর্যন্তও রামচরণের ঘাড়েই ঐ সব কিছুর দায়িত্ব গত বিশ বছর ধরে চাপানো ছিল। এখন অন্য কোন রকম ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত রেবতীকেই চালাতে হবে।
প্রতুলবাবু বললেন, যাবার আগে টাকা দিয়ে যাব। এখন যা যা দরকার মতি স্টোর্স থেকে এ বাড়ির অ্যাকাউন্টে গিয়ে নিয়ে আয়।
রেবতী মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানিয়ে ঘর ছেড়ে চলে গেল।
প্রতুলবাবু তখন চট্টরাজকে সম্বোধন করে বললেন, টাকার ব্যবস্থা কিছু আপনাকে শীগগিরই করতে হবে মিঃ চট্টরাজ। আমার ক্যাশেও সামান্যই আছে আর।
সামনের মাসের টাকাটা এ মাসের দশ তারিখেই তুলে রেখেছিলাম ব্যাঙ্ক থেকে। কাল সে টাকাটা পাঠিয়ে দেব। তারপর রেবতীর দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, এঁদের চা দাও রেবতী।
রেবতী বললে, চা প্রায় হয়ে এসেছে। এখুনি আনছে।
রেবতী ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
প্রতি মাসে সাধারণতঃ কত সংসার-খরচ বলে আসত মিঃ চট্টরাজ?
কলকাতার পার্ক স্ট্রীটের ফ্ল্যাট সিস্টেমের বাড়িটা থেকে ভাড়া বাবদ ৬০০ টাকা পাওয়া যায় আর ব্যাঙ্ক থেকে ৬০০ টাকা। এই বারশত করে প্রতি মাসে আসত।
তাছাড়া ৪০০ টাকা/৫০০ টাকা প্রতি মাসেই বেশী চেয়ে পাঠাতেন যেটা আবার তুলে দেওয়া হত ব্যাঙ্ক থেকেই।
ব্যাঙ্ক থেকে অত টাকা তুলতেন প্রতি মাসে? প্রশান্ত বসাক প্রশ্ন করেন চট্টরাজকে।
হ্যাঁ, ইদানীং বছর দেড়েক থেকেই তো অমনি টাকা খরচ হচ্ছিল।
তার আগে?
বাড়িভাড়ার টাকাতেই চলে যেত।
তা ইদানীং বছর দেড়েক ধরে এমন কি খরচ বেড়েছিল মিঃ চট্টরাজ, যে বিনয়েন্দ্রবাবুর অত টাকার প্রয়োজন হত?
তা কেমন করে বলব বলুন। টাকা তিনি চাইতেন, আমরা পাঠিয়ে দিতাম মাত্র। তাঁর অর্থ তিনি ব্যয় করবেন তাতে আমাদের কি বলবার থাকতে পারে বলুন? শুধু ঐ কেন, গত এক বছরের মধ্যেই তো তাঁর কলকাতায় আরও যে দুখানা ছোট বাড়ি ছিল তাও তিনি বিক্রি করেছেন।