এ বাড়িতে তো কোন নারীর অস্তিত্বই নেই এবং ছিল না বলেই তো তিনি শুনেছেন। একমাত্র লতা, তাও সেদিন যার আগেই এ বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। সে ক্ষেত্রে চিরুণির দাঁতে নারীর কে দেখে মনে হচ্ছে, গতকাল দিনে বা রাত্রে, নিশ্চয়ই কেউ এক সময়ে এই চিরুনির সাহায্যে তাঁর কেশ প্রসাধন করেছিলেন যিনি কোন পুরুষই নন, নারীই। এ বাড়িতে একমাত্র বর্তমানে উপস্থিত নারী সুজাতাদেবীই। সুজাতাদেবী নিশ্চয়ই রামচরণের ঘরে এসে তাঁর চিরুনি দিয়ে কেশ প্রসাধন করেননি। আর করলেও সুজাতাদেবীর কেশ এ ধরনের নয়। তাঁর কেশ দের্ঘ্যে আরও বড় ও কালো কুচকুচে। আদপেই কোঁকড়ানো নয়।
তবে কে সেই নারী যার কেশ প্রসাধনের চিহ্ন এখনও এই চিরুনির দাঁতে রয়ে গিয়েছে।
আরও মনে হয়, যেই কেশ প্রসাধন করে থাকুক রামচরণের দৃষ্টিতে নিশ্চয়ই ব্যাপারটা পড়েনি, নচেৎ রামচরণের মত ছিমছাম প্রকৃতির লোকের চিরুনিতে এগুলো আটকে থাকা সম্ভব হত না, একবার তার দৃষ্টি চিরুনিতে আকৃষ্ট হলে।
তবে কি রামচরণের অজ্ঞাতেই কেউ তার চিরুনির সাহায্যে কেশ প্রসাধন করেছিল! সঙ্গে সঙ্গে আর একটা কথা মনে হয় মিঃ বসাকের, গত রাত্রে রামচরণ যখন তাঁদের আহার্য পরিবেশন করছিল তখনও তো তিনি লক্ষ্য করেছেন, তার মাথার কেশপরিপাটি করে আঁচড়ানো ছিল। যাতে করে তাঁর মনে হয়েছিল, বিকালের পরে কোন এক সময় সে তার কেশ প্রসাধন করেছিল। অতএব কি দাঁড়াচ্ছে তাহলে?
সন্ধ্যার পর রাত্রে কোন এক সময়ে কোন না কোন নারীই এই ঘরে এসে রামচরণের এই চিরুনির সাহায্যে তার কেশ প্রসাধন নিশ্চয়ই করেছিল। যার সুস্পষ্ট ও নিশ্চিত প্রমাণ এখনো এই চিরুনির দাঁতে কয়েকগাছি কেশে বর্তমান। এবং এ থেকে সহজেই অনুমান হয় কোন নারী তাহলে গতরাত্রে এ কক্ষে এসেছিল। কিন্তু কথা হচ্ছে, রামচরণের জ্ঞাতে না অজ্ঞাতে।
আরও একটা কথা সঙ্গে সঙ্গে মনে হয়, যে নারী গত রাত্রে এই ঘরে এসেছিল সে রামচরণের পরিচিতও হতে পারে, অপরিচিতও হতে পারে। এবং শুধু তাই নয় রামচরণের হত্যার ব্যাপারে সেই নারীর প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষ কোন যোগাযোগ ছিল কিনা তাই বা কে জানে!
মোট কথা, কোন এক নারীর এই কক্ষমধ্যে গত রাত্রে পদার্পণ ঘটেছিল। এবং সে বিষয়ে যখন কোন সন্দেহই থাকছে না তখন সেই নারীর এই কক্ষমধ্যে আবির্ভাবের ব্যাপারটাই রামচরণের হত্যার মতই বিস্ময়কর মনে হয়।
বাড়ির চারদিকে কাল সতর্ক পুলিস প্রহরী ছিল, তার মধ্যেই অন্যের দৃষ্টি এড়িয়ে কী করে এক নারীর এ বাড়িতে প্রবেশ সম্ভবপর হয়।
তবে কি সেই নারীই রামচরণের হত্যাকারী!
কথাটা ভাবতে গিয়েও যেন মিঃ বসাকের লজ্জার অবধি থাকে না। তাঁদের এতগুলো পুরুষের জাগ্রত ও সতর্ক দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে শেষ পর্যন্ত কিনা সামান্য এক নারী নিঃশব্দে এসে রামচরণকে হত্যা করে চলে গেল। এতগুলো লোক কেউ কিছু জানতেও পারল না।
কিন্তু এলই বা সে এ বাড়িতে কোন্ পথে, আবার ফিরে গেলই বা কোন্ পথে?
অথচ কিছুক্ষণ পূর্বে পর্যন্ত কেন যেন মিঃ বসাকের ধারণা হয়েছিল, গত রাত্রে রামচরণের হত্যাকারী এ বাড়ির মধ্যে যারা উপস্থিত ছিল গত রাত্রে তাদের মধ্যেই কেউ না কেউ হতে পারে। এখন মনে হচ্ছে তা নাও হয়তো হতে পারে।
ভাবতে ভাবতে চকিতে মিঃ বসাকের মনে আর একটা সম্ভাবনার উদয় হয়। এই কেশ যার সেই নারী ও বিনয়েন্দ্রর জীবনে তার ল্যাবরেটরী অ্যাসিস্টেন্ট হিসাবে যে রহস্যময়ী নারীর অকস্মাৎ আবির্ভাব ঘটেছিল—উভয়েই এক নয় তো!
কিন্তু কথাটার মধ্যে যেন বেশ কোন যুক্তি খুঁজে পান না মিঃ বসাক।
সে না হলেও কোন এক নারী কাল রাত্রে এ ঘরে এসেছিল ঠিকই এবং যে প্রমাণ একমাত্র যার পক্ষে আজ দেওয়া সম্ভব ছিল সে রামচরণ, কিন্তু সে আজ মৃত।
যে রহস্যের উপর আলোকপাত সম্ভব হত আজ আর তার কাছ থেকে পাওয়ার কোন উপায়ই নেই, তার মুখ আজ চিরদিনের জন্যই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আর সে কথা বলবে না।
আবার মনে হয়, তবে কি বিনয়েন্দ্রবাবুর হত্যাকারীও সে-ই! তাই সে এত তাড়াতাড়ি রামচরণের কণ্ঠও চিরতরে বন্ধ করে দিয়ে গেল, পাছে রামচরণ তার সমস্ত রহস্য ফাঁস করে দেয়!
আবার সেই রহস্যময়ীর কথাই মনের মধ্যে নতুন করে এসে উদয় হয়।
সমস্ত ব্যাপারটাই ক্রমে যেন আরো জটিল হয়ে উঠেছে। সব যেন কেমন বিশ্রীভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে যাই হোক, এই কয়েকগাছি কেশের মধ্যে নিঃসন্দেহে যথেষ্ট গুরুত্ব আছে।
যত্নসহকারে পকেট থেকে একটা কাগজ বের করেন মিঃ বসাক। এবং কাগজের মধ্যে কেশ কগাছি রেখে ভাঁজ করে সযত্নে পকেটের মধ্যে রেখে দিলেন।
তারপর রামচরণের স্টীল ট্রাঙ্কটা খুলবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু তালা দেওয়া। খোলা গেল। চাবিটা কিন্তু বিশেষ খুঁজতে হল না। রামচরণের শয্যার নীচে তোশকের তলাতেই পাওয়া গেল। চাবির সাহায্যে মিঃ বসাক তালা খুলে ফেললেন।
বাক্সটা খুলে ডালাটা তুললেন। ট্রাকের মধ্যে বিশেষ কিছুএমন পাওয়া গেল না। খানকয়েক ধুতি পাট করা, গোটা দুই জামা। একটা ব্যাগের মধ্যে গোটা ত্রিশেক টাকা ও কিছু খুচরো পয়সা। একটা ছোট কৌটোর মধ্যে খানিকটা আফিং এবং খানকয়েক চিঠি ও মনিঅর্ডারের রসিদ।
রসিদগুলো ফেরত আসছে কোন এক শ্যামসুন্দর ঘোষের কাছ থেকে।