.
২৪.
একটানা সুজাতা কথাগুলো বলে গেল।
মিঃ বসাকের বুঝতে কষ্ট হয় না, সুজাতাদেবী সত্যি সত্যিই তার মৃত ছোটাকে গভীর শ্রদ্ধা ও স্নেহ করত। এবং তাই ছোটকার মৃত্যু-সংবাদটা তার বুকে শেলের মতই আঘাত হেনেছে।
একটু থেমে সুজাতা আবার বলতে লাগল, আমার ও ছোট্কার মধ্যে ঠিক যে কি সম্পর্ক ছিল, আপনাকে বুঝিয়ে বলতে পারব না মিঃ বসাক। তাছাড়া আপনি হয়তো বুঝবেনও না। ছোটবেলায় মা-বাবাকে হারিয়েছি। মানুষ হয়েছি রজতদার মা-জেঠাইমার স্নেহ ও ভালবাসাতেই। কিন্তু সেদিনকার আমার বালিকা মনের খুব নিকটে যাকে আপনার করে পেয়েছিলাম, সে হচ্ছে আমার ছোটুকাই।
বলতে বলতে সুজাতার গলাটা যেন কেমন জড়িয়ে আসে।
নিজেকে একটু সামলে নিয়ে আবার বলতে শুরু করে, ছোট্কা ছিল আমাদের, বিশেষ করে আমার, জীবনে একাধারে বন্ধু ও সর্ব ব্যাপারে একমাত্র সাথী। তাই যেদিন তিনি তাঁর দাদামশাইয়ের জরুরী একটা চিঠি পেয়ে হঠাৎ কাউকে কিছু না জানিয়েই এ বাড়িতে চলে এলেন, এবং তারপর যে কারণেই হক আর তিনি আমাদের কাছে ফিরে গেলেন না, তার পর থেকে রজতদা ও জেঠাইমা তাঁর সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করলেও আমি তা পারিনি। তাঁদের সঙ্গে একমত না হতে পারলেও অবিশ্যি তাঁদের বিরুদ্ধেও যেতে পারিনি। তাই মনে মনে ছোট্রকার সঙ্গে দেখা করবার খুব বেশী একটা ইচ্ছা থাকলেও তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারিনি সেদিন।
একটু থেমে সুজাতা আবার বলতে লাগল, তারপর হঠাৎ এমন কতকগুলো কথা ছোটকার নামে আমার কানে গেল যে, পরে আর তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসতে ইচ্ছাও হয়নি।
কিছু যদি না মনে করেন তো একটা কথা জিজ্ঞাসা করি সুজাতাদেবী। কী এমন কথা আপনার ছোট্রকার সম্পর্কে, কার মুখে আপনি শুনেছিলেন বলতে আপনার যদি অপত্তি না থাকে–
না। আপত্তি কি। কথাটা শুনেছিলাম রজতদার মুখেই। তার সঙ্গে নাকি হঠাৎ একদিন ছোট্কার রাস্তায় দেখা হয়েছিল, তখন ছোট্কা নাকি রজতদা কথা বলে সত্ত্বেও তাকে চিনতে পারেনি। তাই ভয় হয়েছিল রজতদার মত আমাকেও যদি ছট্কা আর না চিনতে পারেন!
সুজাতার মুখে কথাটা শুনে মিঃ বসাক কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলেন। একটা কথা সুজাতাকে ঐ সম্পর্কে খুবই ইচ্ছা হচ্ছিল বলবার কিন্তু ইচ্ছা করেই শেষ পর্যন্ত বললেন না। এমন সময় রেবতী এসে ঘরে ঢুকল।
কি খবর রেবতী?
বাবু, ঠাকুর বলল খাবার তৈরী।
ঠিক আছে, ঠাকুরকে টেবিলে খাবার দিতে বল। আর অমনি দেখ পুরন্দরবাবু উঠেছেন কিনা।
রেবতী চলে গেল।
উঠুন সুজাতাদেবী। স্নান করবেন তো করে নিন।
হ্যাঁ, আমি স্নান করব।
খাবার টেবিলে বসে সুজাতা কিন্তু এক গ্লাস সরবৎ ছাড়া কিছুই খেতে চাইল না। না খেলেও খাবার টেবিলেই বসে রইল।
মিঃ বসাক ও পুরন্দর চৌধুরী খেতে লাগলেন।
এক সময় মিঃ বসাক বললেন, আপনি কি তাহলে আজই চলে যেতে চান, মিস রয়?
রজতদা ফিরে আসুক। কাল সকালেই যাব।
কালই তাহলে লক্ষ্ণৌ রওনা হচ্ছেন?
না। দু-একদিন পরে রওনা হব।
আহারাদির পর সুজাতা ও পুরন্দর চৌধুরী যে যার ঘরে বিশ্রাম নিতে চলে গেলেন। মিঃ বসাক নীচে এলেন।
যে ঘরে রামচরণ নিহত হয়েছিল সেই ঘরে এসে ঢুকলেন।
ঘণ্টাখানেক আগে মৃতদেহ মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ঘরটা খালি।
ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে দরজাটা ভেজিয়ে দিলেন। ঘরের জানলাগুলো ভেজানো ছিল, এগিয়ে গিয়ে ঘরের পশ্চাতে বাগানের দিককার দুটো জানলাই খুলে দিলেন। দ্বিপ্রহরের পর্যাপ্ত আলোয় স্বল্পান্ধকার ঘরটা আলোকিত ও স্পষ্ট হয়ে উঠল।
ঘরের দেওয়ালে পেরেকের সাহায্যে দড়ি টাঙিয়ে তার উপরে খান দুই পরিষ্কার পাট করা ধুতি ঝুলছে। একপাশে একটা ভোয়ালে। একটা শার্ট ও গোটা দুই গেঞ্জিও দড়িতে বোলানো রয়েছে।
এক কোণে একটা কালো মাঝারি আকারের রঙ ওঠা স্টীল ট্রাঙ্ক। দেওয়ালে একটা আরশি ও তার পিছনে গোঁজা একটা চিরুনি। আরশিটার পাশেই দেওয়ালে টাঙানো একটা ফটো। ফটোটার সামনে এগিয়ে গেলেন মিঃ বসাক।
পাঁচ-ছ বছরের একটি শিশুর হোট ফটো। অনেক দিন আগেকার ভোলা ফটো হবে। কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
ফটোটা দেখতে দেখতে হঠাৎ তার পাশেই দেওয়ালে টাঙানো আরশিটার পিছনে গোঁজা চিরুনিটার দিকে নজর পড়তেই একটা জিনিস তাঁর দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে।
চিরুনিটার সরু দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে কয়েকগাছি কেশ তখনও আটকে আছে।
বিশেষ করে কয়েকগাছি কেশই তাঁর দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে।
.
২৫.
হাত বাড়িয়ে চিরুনিটা হাতে নিলেন মিঃ বসাক।
চার-পাঁচগাছি কেশ আটকে রয়েছে চিরুনির সরু দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে। এবং কেশগুলি লম্বায় হাতখানেকের চাইতে একটু বেশীই হবে। আর সেগুলো সামান্য একটু কোঁকড়ানো এবং রংও তার ঠিক কালো নয়, কেমন একটু কটা কটা।
ধীরে ধীরে কেশগুলি চিরুনির দাঁত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আরও ভাল করে পরীক্ষা করতে লাগলেন মিঃ বসাক।
রামচরণের নিত্যব্যবহৃত এই চিরুনি তাতে কোন সন্দেহই নেই। কিন্তু স্পষ্ট মনে আছে। এখনও মিঃ বসাকের, রামচরণের কেশের রং কুচকুচে কালোই ছিল; যদিচ অনেক কেশেই তার পাক ধরেছিল। বিশেষ করে, তার কেশ দৈর্ঘ্যে এতখানি হওয়াও অসম্ভব। মোট কথা, চিরুনির এই কেশ আদপেই রামচরণের মাথার নয়। এবং কেশের দৈর্ঘ্য দেখে মনে হয়, এ কোন রমণীর মাথার কেশ হবে। কোন পুরুষের মাথার কেশ এ নয়। এবং কোন নারীরই মাথার কেশ যদি হবে, তবে এই চিরুনিতে এ কে এল কোথা থেকে?