ইন্সপেক্টার রজতের কথায় মৃদু হাসলেন মাত্র, কোন জবাব দিলেন না।
হাসিটা রজতের দৃষ্টি এড়ায় না। সে বলে, হাসছেন আপনি ইন্সপেক্টার, কিন্তু লোকটার মুখের দিকে তাকালেই কি মনে হয় না—ঠিক যেন একটা snake!
ইন্সপেক্টার রজতের প্রশ্নের এবারেও কোন জবাব দিলেন না, কেবল রামানন্দ সেনের দিকে তাকিয়ে বললেন, মৃতদেহটা একবার দেখবেন নাকি?
হ্যাঁ। একবার যাই, দেখে আসি। একটা ডাইরী আবার পাঠাতে হবে তো!
যান।
রামানন্দ সেন ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
ইন্সপেক্টার এবারে রজতের দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, আপনারা যখন এসে গেছেন রজতবাবু, মৃতদেহের মানে আপনাদের কাকার সৎকার করবেন তো?
তা করতে হবে বৈকি।
তাহলে আর দেরি করবেন না। রামানন্দরাবুর কাছ থেকে একটা Order নিয়ে কলকাতায় চলে যান।
.
রামচরণের মৃতদেহটা মর্গে পাঠাবার একটা ব্যবস্থা করে রামানন্দ সেন থানায় ফিরে গেলেন। চা পান করে রজতও বিনয়েন্দ্রবাবুর মৃতদেহ কলকাতার মর্গ থেকে নিয়ে সৎকারের একটা ব্যবস্থা করবার জন্য বের হয়ে গেল।
একজন কনস্টেবলকে নিচের তলায় প্রহরায় রেখে ইন্সপেক্টার বসাক উপরে চললেন।
প্রথমেই পুরন্দর চৌধুরীর সংবাদ দেবার জন্য তাঁর ঘরে গিয়ে প্রবেশ করলেন। পুরন্দর চৌধুরী শয্যার উপরে শুয়ে গভীর নিদ্রায় মগ্ন তখনও।
ধীরে ধীরে ঘরের দরজাটা টেনে দিয়ে, ঘর থেকে বের হয়ে এলেন ইন্সপেক্টার।
হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন, বেলা প্রায় সাড়ে দশটা বাজে। সুজাতাদেবীর একটা সংবাদ নেওয়া প্রয়োজন।
এগিয়ে চললেন ইন্সপেক্টার সুজাতার ঘরের দিকে।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কিছুটা ইতস্তত করলেন, তারপর আঙুল দিয়ে টুকটুক করে ভেজানো দরজার গায়ে মৃদু ‘নক’ করলেন।
কিন্তু কোন সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না। প্রথমে ভাবলেন সুজাতা ঘুমচ্ছে হয়তো তারপরেই আবার কি ভেবে মৃদু একটু ঠেলা দিয়ে ভেজালে দরজাটা ঈষৎ একটু ফাঁক করে ঘরের ভিতরে দৃষ্টিপাত করলেন।
দেখতে পেলেন, সুজাতা নিঃশব্দে খোলা জানলার সামনে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে।
বিস্রস্ত চুলের রাশ সারা পিঠ ব্যেপে ছড়িয়ে আছে। হাওয়ায় চুর্ণ কুন্তল উড়ছে। বেশেও কেমন একটা শিথিল এলোমেলো ভাব।
আবার দরজার গায়ে নক করলেন টুকটুক করে।
কে? ভিতর থেকে সুজাতার গলার প্রশ্ন ভেসে এল।
ভিতরে আসতে পারি কি?
আসুন।
দরজা ঠেলে ইন্সপেক্টার ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন।
সুজাতা ঘুরে দাঁড়াল: আসুন।
এখন একটু সুস্থ বোধ করছেন তো মিস রয়?
হ্যাঁ।
একটু চা বা গরম দুধ এক গ্লাস খেলে পারতেন। বলি না দিতে রেবতীকে ডেকে?
বলতে হবে না। রেবতী কিছুক্ষণ আগে নিজেই এসে আমাকে চা দিয়ে গিয়েছে। চা খেয়েছি। কিন্তু আপনি দাঁড়িয়ে রইলেন নে মিঃ বসাক? বসুন না ঐ চেয়ারটার ওপরে।
হ্যাঁ, বসি। পাশেই একটা চেয়ার ছিল, টেনে নিয়ে ইন্সপেক্টার উপবেশন করলেন: আপনিও বসুন মিস রয়।
সুজাতা খাটের উপরেই শয্যায় উপবেশন করে।
কিছুক্ষণ দুজনের কেউ কোন কথা বলে না স্তব্ধতার মধ্যেই কয়েকটা মুহূর্ত কেটে গেল। এবং স্তব্ধতা ভঙ্গ করে প্রথমেই কথা বললেন ইন্সপেক্টার, আপনি কি তাহলে কলকাতায়ই ফিরে যাবেন ঠিক করলেন, মিস রয়?
সুজাতা নিঃশব্দে মুখ তুলে তাকাল ইন্সপেক্টারের মুখের দিকে।
রজতদা কোথায়? সুজাতা প্রশ্ন করে।
রজতবাবু তো এই কিছুক্ষণ আগে কলকাতায় গেলেন।
কলকাতায় কেন?
বিনয়েন্দ্রবাবুর মৃতদেহের সৎকারের একটা ব্যবস্থা করতে হবে তো, তাই।
সুজাতা আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললে, আমি যদি লক্ষ্ণৌয়ে ফিরে যাই আপনার কোন আপত্তি আছে কি?
না। আপত্তি আর কি, তবে আপনার কাকার সলিসিটারকে একটা সংবাদ পাঠাতে বলেছি প্রতুলবাবুকে, আজই সন্ধ্যার সময় এখানে এসে একবার দেখা করবার জন্য।
সলিসিটারকে কেন?
আপনার কাকার উইল-টুইল যদি কিছু থাকে, তা সেটা তো আপনাদের জানা প্রয়োজন।
থাকলেও আমার সে বিষয়ে কোন interestই নেই জানবেন, মিঃ বসাক। সুজাতা যেন মৃদু ও নিরাসক্ত কণ্ঠে কথাটা বললে।
বিস্মিত ইন্সপেক্টার সুজাতার মুখের দিকেতাকালেন।
হ্যাঁ। তাঁর সম্পত্তি যার ইচ্ছা সে নিক। আমার তাতে কোন প্রয়োজনই নেই। চাই না আমি সেই অর্থের এক কপর্দকও, এবং নেবও না। পূর্ববৎ নিরাসক্ত কণ্ঠেই কথাগুলো বলে গেল সুজাতা।
সে তো পরের কথা পরে। আগে দেখুন তাঁর কোন উইল আছে কিনা। উইলে যদি আপনাদেরই সব দিয়ে গিয়ে থাকেন তো ভালই, নচেৎ উইল না থাকলেও তাঁর সব কিছুর একমাত্র ওয়ারিশন তো আপনারাই, আর কিছু যদি আপনি না নেনইযাকে খুশি সব দানও করতে পারবেন।
না। তাঁর হোপার্জিত অর্থ তো নয়, সবই তো সেই বাবার দাদামশাইয়ের অর্থ। যে লোক মরবার সময় পর্যন্ত তাঁর নাতি-নাতিনীদের মুখ দেখেননি, তাঁর সম্পত্তি লাখ টাকা হলেও আর যেই নিক আমি একটি কপর্দকও স্পর্শ করব না তা জানবেন।
কি বলছেন আপনি মিস রয়?
ঠিক বলছি। আপনি তো জানেন না আমার পিতামহকে। অনাদি চক্রবর্তী তাঁর একমাত্র জামাই হওয়া সত্ত্বেও সব কিছু থেকে তাঁকে তিনি বঞ্চিত করে গিয়েছিলেন। আর শুধু কি তিনিই, শুনেছি আমার পিতামহীরও এমন অহমিকা ছিল ধনী-কন্যা বলে যে, আমার পিতামহকে যাচ্ছেতাই করে অপমান করতেও একদিন দ্বিধাবোেধ করেননি। বাবা বলেছিলেন একদিন, সুজাতা, যদি কখনও ভিক্ষা করেও খেতে হয় তবু যেন অনাদি চক্রবর্তীর এক কপর্দকও গ্রহণ কোরো না। এমন কি তিনি যেচে দিতে এলেও জেনো যে অর্থ বিবাহিতা স্ত্রীকে পর্যন্ত স্বামীর কাছ থেকে দূরে ঠেলে দেয়, সে অর্থ মানুষের জীবনে আর যাই দিক মঙ্গল আনতে পারে না। আমি এখানে এসেছিলাম শুধু তাকে একটিবার দেখব বলে, অন্যথায় আসতামই না।