হঠাৎ এক নিষুতি রাত্রে রামানন্দের ঘরে ডাকাত পড়ল। ডাকাতদের হাতে ছিল গাদা। বন্দুক আর জ্বলন্ত মশাল।
ডাকাতের দল কেবল যে রামানন্দর ধনদৌলতই লুঠ করল তাই নয়, লুঠ করে নিয়ে গেল ওই সঙ্গে তাঁর পরমাসুন্দরী যুবতী স্ত্রী লক্ষ্মীরাণীকেও।
সত্য কথাটা কিন্তু রামানন্দ কাউকেই জানতে দিলেন না। তিনি রটনা করে দিলেন ডাকাতদের হাতে লক্ষ্মীরাণীর মৃত্যু ঘটেছে।
দু-চারজন আত্মীয়স্বজন কথাটা বিশ্বাস না করলেও উচ্চবাক্ত করতে সাহস করল না বা রামানন্দর বিরুদ্ধে দাঁড়াতেও সাহস পেল না, রামানন্দের প্রতিপত্তি ও ধনৈশ্বর্যের জন্যই বোধ হয়।
রামানন্দের একটিমাত্র ছেলে যোগেন্দ্র চক্রবর্তী। যোগেন্দ্রকে বুকে নিয়ে রামানন্দ স্ত্রী-বিচ্ছেদের দুঃখটা ভুলবার চেষ্টা করতে লাগলেন কিন্তু কিছুতেই যেন ভুলতে পারেন না লক্ষ্মীরাণীকে।
সুরার আশ্রয় নিলেন। এবং শুধু সুরাই নয়, সেই সঙ্গে এসে জুটল বাগানবাড়িতে বাঈজী চন্দনাবাঈ। হু-হু করে সঞ্চিত অর্থ বের হয়ে যেতে লাগল।
তারপর একদিন যখন তাঁর মৃত্যুর পর তরুণ যুবা যোগেন্দ্রর হাতে বিষয়-সম্পত্তি এসে পড়ল, রামানন্দর অর্জিত বিপুল ঐশ্বর্যের অনেকখানিই তখন শুড়ীর দোকান দিয়ে সাগরপারে চালান হয়ে গেছে।
এদিকে উজ্জ্বলতার যে বিষ রামানন্দের রক্ত থেকে তাঁর সন্তানের রক্তের মধ্যেও ধীরে ধীরে সংক্রামিত হচ্ছিল, রামানন্দ কিন্তু সেটা জানতে পারলেন না এবং বাপের মৃত্যুর পর থেকেই তাঁর এতদিনকার জানা উচ্ছঙ্খলত স্বমূর্তিতে যেন প্রকাশ পেল। এবং যোগেন্দ্র তাঁর উচ্ছলতায় বাপকেও ডিঙিয়ে গেলেন যেন। ফলে তাঁর মৃত্যু হল আরও অল্প বয়সে। তাঁর পুত্র অনাদির বয়ঃক্রম তখন মাত্র আঠারো বছর। সম্পত্তিও তখন অনেকটা বেহাত হয়ে গেছে।
কিন্তু তা সত্ত্বেও অনাদি ছিলেন যাকে বলে সত্যিকারের উদ্যোগী পুরুষসিংহ। তিনি তাঁর চেষ্টায় ও অধ্যবসায়ের দ্বারা ক্রমশ সেই জীর্ণ দেউলকে সংস্কার করে ভাগ্যের চাকাটা আবার ফিরিয়ে দিলেন।
অনাদির কোন পুত্রসন্তান জন্মায়নি। জন্মেছিল মাত্র একটি কন্যা সুরধনী।
লক্ষ্মীরাণী চক্রবর্তী পরিবার থেকে লুষ্ঠিত হলেও তার রূপের যে ছাপ চক্রবর্তী পরিবারে রেখে গিয়েছিল সেটা পরিপূর্ণভাবে যেন ফুটে উঠেছিল সুরধনীর দেহে।
অপরূপা সুন্দরী ছিলেন সুরধনী। এবং চক্রবর্তীদের ঘরে লক্ষ্মীরাণীর যে অয়েলপেনটিংটা ছিল তার মুখের গঠন ও চেহারার নিখুত মিল যেন ছিল ওই সুরধনীর চেহারায়।
অনাদি চক্রবর্তী অল্প বয়সেই সুরধনীর বিবাহ দেন গরীবের ঘরের এক অসাধারণ মেধাবী ছাত্র মৃগেন্দ্রনাথের সঙ্গে।
অমরেন্দ্র ও সুরেন্দ্রের জন্মের পর তৃতীয়বার যখন সুরধনীর সন্তানসম্ভাবনা হল তিনি উত্তরপাড়ার পিতৃগৃহে আসেন কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে।
মৃগেন্দ্রনাথ অসাধারণ মেধাবী ছাত্র হলেও জীবনে তেমন উন্নতি করতে পারেননি। অথচ নিজে অত্যন্ত স্বাধীনচেতা ও আত্মাভিমানী ছিলেন বলে শ্বশুর অনাদি চক্রবর্তীর বারংবার অনুরোধ সত্ত্বেও তাঁর কোনরূপ সাহায্যও কখনো গ্রহণ করেননি। এবং স্ত্রীকেও সহজে পিতৃগৃহে যেতে দিতেন না।
এজন্য জামাই মৃগেন্দ্রর উপরে অনাদি চক্রবর্তী কোনদিন সন্তুষ্ট ছিলেন না। ঠাট্টা করে বলতেন, সাপ নয় তার কৃপানা চক্র।
ধনী পিতার আদরিণী ও সুন্দরী কন্যা সুরধনীও স্বামীর প্রতি কোন দিন খুব বেশী আকৃষ্ট হননি। কারণ তাঁর রূপের মত ধনেরও একটা অহঙ্কার ছিল।
সেবারে যখন অনেক অনুনয় বিনয় করবার পর দিন সাতেকের কড়ারে সুরধনী পিতৃগৃহে এলেন এবং সাতদিন পরেই ঠিক মৃগেন্দ্র স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এলেন, সুরধনী বললেন, আর কটা দিন তিনি থাকতে চান।
মৃগেন্দ্র রাজী হলেন না। বললেন, না, চল।
কেন, থাকি না আর কটা দিন?
না সুরো। গরীব আমি, আমার স্ত্রী বেশী দিন ধনী শ্বশুরের ঘরে থাকলে লোকে নানা কথা বলবে।
তা কেন বলতে যাবে। বাপের বাড়িতে গিয়ে থাকব।
না, চল। মানুষকে তুমি চেন না, তারা বাঁকাভাবেই নেবে।
সবারই তো তোমার মত বাঁকা মন নয়।
কী বললে, আমার মন বাঁকা?
তা নয় তো কী। অন্য কোথাও নয়, এ আমার নিজের বাপের বাড়ি। থাকিই না কটা দিন আর। গিয়েই তো আবার সেই হাঁড়ি ঠেলা শুরু।
ও, সোনার পালঙ্কে দুদিন শুয়েই বুঝি আরাম ধরে গেছে!
কোথা থেকে কী হয়ে গেল।
সমান বক্রভাবে সুরধনী জবাব দিলেন, সোনার পালঙ্কে ছোটবেলা থেকেই শোওয়া আমার। অভ্যাস। তোমরাই বরং চিরদিন কুঁড়েঘরে থেকেছ, তোমাদেরই চোখে ধাঁধা লাগা সম্ভব দুদিনের সোনার পালঙ্কে শুয়ে, আমাদের নয়।
হুঁ। আচ্ছা বেশ, থাক তবে তুমি এখানেই।
মৃগেন্দ্র চলে গেলেন।
.
সত্যি সত্যি মৃগেন্দ্রর দিক থেকে পরে আর কোন ডাকই এল না।
সুরধনী এবং অনাদি চক্রবর্তী ভেবেছিলেন দু-একদিন পরেই হয়তো মৃগেন্দ্রর রাগ পড়বে কিন্তু দেখা গেল দু-একদিন বা দু-এক সপ্তাহ তো দূরের কথা দশ বছরেও মৃগেন্দ্র চক্রবর্তী বাড়ির ছায়াপর্যন্ত আর মাড়ালেন না। এমন কি সুরধনীর মৃত্যুসবাদ পেয়েও তিনি এলেন। কেবল জ্যেষ্ঠ পুত্র অমরেন্দ্রকে ও সঙ্গে একটি ভৃত্য পাঠিয়ে দিলেন তাদের হাতে এক নীলকুঠী চিঠি দিয়ে অবিলম্বে বিনয়েন্দ্রকে তাদের সঙ্গে পাঠিয়ে দেবার জন্যে।
বিনয়েন্দ্র চক্রবর্তী মামার বাড়িতেই জন্মেছিল এবং দাদুর আদরে মানুষ হচ্ছিল।