আপনি কি বলতে চান স্যার বিনয়েন্দ্রবাবুর হত্যাকারীই তবে রামচরণকেও হত্যা করেছে!
নিশ্চয়ই। একই কালো হাতের কাজ। এবং এ বিষয়ও আমি স্থির নিশ্চয়ই যে বিনয়েন্দ্রর হত্যার ব্যাপারে অনেক কিছু জানত বলেই সে বেচারীকে হত্যাকারীর হাতে এইভাবে এত তাড়াতাড়ি প্রাণ দিতে হল। অনেক কথাই বিনয়েন্দ্রবাবু সম্পর্কে আমাকে সেগতকাল বলেছিল, আরও বেশী কিছু না প্রকাশ করে বসে যাতে করে হত্যাকারীর বিপদ ঘটতে পারে, সেই আশঙ্কাতেই হয়তো হত্যাকারী এত তাড়াতাড়ি তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলল। এবং—
কথাটা ইন্সপেক্টার শেষ করতে পারলেন না হঠাৎ তিনি থেমে গেলেন। বললেন, কে?
একটা মুখ দরজাপথে উঁকি দিয়েছিল।
ইন্সপেক্টরের প্রশ্নে ঘরের অন্যান্য সকলেরই দৃষ্টি সেইদিকে আকর্ষিত হয়।
একটা ভাঙা কর্কশ গলায় প্রশ্নোত্তর এল, আজ্ঞে, আমি করালী।
এস, ভেতরে এস।
করালী ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করল।
লোকটা দেখতে রোগা লম্বা। কালো পালিশ করা গায়ের রং। মুখভর্তি বসন্তের বিশ্রী ক্ষতচিহ্ন। নাকটা একটু চাপা। পুরু ঠোঁট অত্যাধিক ধূমপানে একেবারে কালচে হয়ে গেছে। মাথার চুল পর্যাপ্ত, তেল চকচক করছে। এলবার্ট তেড়ি। পরিধানে সাধারণ একটা ধোপ-দুরন্ত ধুতি ও গায়ে একটা সাদা অনুরূপ সিবু টুইলের হাফসার্ট।
আমাকে ডেকেছিলেন স্যার?
হ্যাঁ। কিন্তু ঘরে না ঢুকে দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে উঁকি মারছিলে কেন?
আজ্ঞে উঁকি তত মারিনি, ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখলাম আপনারা কথা বলছেন, তাই ঢুকতে একটু ইতস্তত করছিলাম।
হুঁ, তুমি তো এই নীচের তলাতেই লছমনের ঘরের পাশের ঘরটাতেই থাক?
আজ্ঞে।
কাল রাত্রে কখন ঘুমিয়েছিলে?
আজ্ঞে, শরীরটা আমার কয়দিন থেকেই ভাল যাচ্ছিল না বলে কাল রাতে আর কিছু খাইনি, সাড়ে নটার মধ্যেই ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছিলাম।
শোয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়েছিলে?
আজ্ঞে একরকম তাই, আমার তো বিছানায় শোওয়া আর ঘুমোনো।
রাত্রে আর ঘুম ভাঙেনি?
না।
কিন্তু ওই একটি মাত্র উচ্চারিত শব্দও যেন ইন্সপেক্টারের মনে হল, করালী একটু ইতস্তত করেই উচ্চারণ করল।
কাল রাত্রে তাহলে কোন রকম শব্দ বা চিৎকার শোননি?
শব্দ? চিৎকার? কই না।
হুঁ। ইন্সপেক্টার কি যেন ভাবতে লাগলেন।
তারপর হঠাৎ আবার প্রশ্ন শুরু করলেন, করালী, তুমি তো বছরখানেক মাত্র এখানে চাকরি নিয়েছ, তাই না?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
এর আগে কোথায় কাজ করতে?
কোথাও দুচার দিনের বেশি একটা ঠিকে কাজ ছাড়া করিনি, একমাত্র এই বাড়িতেই এই একবর একটানা কাজ করছি।
তোমার ড্রাইভিং লাইসেন্স কত দিনের?
চার বছরের।
চার বছর লাইসেন্স পেয়েছ, অথচ কোথাও এর আগে বড় একটা কাজ করোনি। কি করে তাহলে দিন চালাতে?
তা আর চলত কই স্যার। আজকাল ভাল সুপারিশপত্র না হলে প্রাইভেট গাড়ি চালাবার কাজ কি বিশ্বাস করে কেউ দিতে চায় স্যার? কাজের সন্ধান নিয়ে কারও কাছে গেলেই। অমনি সকলে প্রশ্ন করবেন, আগে কোথায় কাজ করেছ, কেমন কাজ করতে তার সাটিফিকেট দেখাও।
হুঁ। তা বিনয়েন্দ্রবাবু সে রকম কিছু দেখতে চাননি তোমার কাছে?
আজ্ঞে না। আজ্ঞে তিনি ছিলেন সত্যিকারের গুণী। বললেন, ড্রাইভ কর দেখি, কাজ দেখে তবে কাজে বহাল করব। বললাম, এই তো বাবু কথার মত কথা। নিয়ে গেলাম গাড়িতে চাপিয়ে। আপনাদের আশীবাদে স্যার যে কোন মে বা মডেলের গাড়ি দিন না, জলের মত চালিয়ে নিয়ে যাব। আমার গাড়ি চালানো দেখে বাবুও খুশী হয়ে গেলেন। তিনি সেই দিনই কাজে বহাল করে নিলেন আমাকে।
ইন্সপেক্টার বুঝতে পারেন, লোকটা একটু বেশীই কথা বলে।
বাবু তাহলে গাড়ি চালানোয় খুশি ছিলেন বল?
আজ্ঞে, নিজমুখে আমি কি বলব স্যার, বলবেন অহঙ্কার, দেমাক। তবে হ্যাঁ, বাবু বেঁচে থাকলে তাঁরই মুখে শুনতে পারতেন। তবে তিনি বলতেন, করালী, তোমার হাতে গাড়ি ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমানো যায়।
হুঁ। ভাল কথা। দেখ করালী, কাল তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করা হয়নি।
বলুন স্যার।
তোমার আপনার জন আর কে কে আছে?
আজ্ঞে স্যার, সে কথা আর বলবেন না। ভাল করে জ্ঞান হবার আগেই মা বাপকে হারিয়েছি; তারপর লালন-পালন করলে এক পিসি; তা সেও বছর দশেক আগে মারা গেছে। সব ধুয়ে মুছে গেছে। একা স্যার—একেবারে একা।
বিয়ে করনি?
বিয়ে-থা আর কে দেবে বলুন স্যার। এতদিন তো ক্যাঁ কাঁ করে ভবঘুরের মত ঘুরে বেড়িয়েছি—এই তো সবে যাহোক একটা কাজ জুটেছিল। দেখুন না, তাও বরাতে সইল না। এবারে আবার সেই রাস্তা আর কলের জল।
কেন হে, এখানে তো শুনলাম দেড়শো টাকা মাইনে পেতে, থাকা খাওয়া লাগত না, এ ক বছরে কিছুই জমাতে পারনি?:
আজ্ঞে না স্যার। জমল আর কোথায়! আগের কিছু ধার-দেনা ছিল, তাই শোধ দিতে দিতেই সব বেরিয়ে যেত মাসে মাসে-জমাব কি করে আর।
আচ্ছা করালী, তুমি যেতে পার। হ্যাঁ, ভাল কথা, না বলে কোথাও বেরিও না যেন।
আজ্ঞে না স্যার, কোথাও বড় একটা আমি বের হই না।
করালী ঘর ছেড়ে চলে গেল।
.
২৩.
ইন্সপেক্টার বসাক থানা-ইনচার্জ রামানন্দ সেনের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, কিছু বুঝতে পারলেন সেন?
একেবারেই যে কিছু বুঝিনি তা নয় স্যার। বেশ গভীর জলের মাছ বলেই মনে হল।
হঠাৎ রজত কথা বললে, ঠিকই বলেছেন মিঃ সেন। লোকটার চোখ দুটো যেন ঠিক সাপের চোখের মত। একেবারে পলক পড়ে না। তা ছাড়া লোকটার মুখের দিকে তাকালেই যেন কেমন গা ঘিনঘিন করে। আশ্চর্য! লোকটাকে ছোেটা যে কি করে টলারেট করতেন তাই ভাবছি।