সব কিছু ভুলে গিয়ে যেন ইন্সপেক্টার চেয়ে রইলেন বসে সেই মুখখানির দিকে।
এবং বেশ কিছুক্ষণ পরে কম্পিত ভীরু চোখের পাতা দুটি খুলে তাকাল সুজাতা।
সুজাতাদেবী! স্নিগ্ধ কণ্ঠে ডাকেন ইন্সপেক্টার বসাক।
বিস্রস্ত বেশ ঠিক করে উঠে বসবার চেষ্টা করে সুজাতা, কিন্তু বাধা দেন ইন্সপেক্টার বসাক, উঠবেন না, আর একটু শুয়ে থাকুন। চলুন রজতবাবু, আমরা বাইরে যাই। উনি একটু বিশ্রাম নিন।
ইন্সপেক্টার বসাকের ইঙ্গিতে সকলে ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
দরজাটা নিঃশব্দে ভেজিয়ে দিলেন বসাক।
২১-২৫. গত রাত্রে নীচের তলায়
গত রাত্রে নীচের তলায় যে ঘরে বসে সকলের কথাবার্তা হয়েছিল ইন্সপেক্টার বসাক সেই ঘরেই এসে প্রতুল বোস ও রজতকে নিয়ে প্রবেশ করলেন।
রেবতীর মুখেই ইতিমধ্যে সংবাদটা ড্রাইভার করালী, পাচক লছমন ও দারোয়ান ধনবাহাদুর জানতে পেরেছিল।
তারাও এসে দরজার বাইরে ভিড় করে দাঁড়ায় ইতিমধ্যে। ঐ সঙ্গে প্রহরারত একজন বাঙালী কনেস্টবল মহেশও দোরগোড়ায় এসে দাঁড়ায়।
সর্বাগ্রে মহেশকে ডেকে মিঃ বসাক থানায় রামানন্দ সেনকে তখুনি একটা সংবাদ দিতে বললেন, সংবাদ পাওয়া মাত্রই নীলকুঠীতে চলে আসবার জন্য। মৃতদেহটার একটা ব্যবস্থা করা দরকার।
রেবতীকে যা জিজ্ঞাসাবাদ করবার করা হয়ে গিয়েছিল বলে ইন্সপেক্টর বসাক প্রথমে ডাকলেন লছমনকে। লছমন সাধারণত একটু ভীতু প্রকৃতির লোক। তার উপরে রেবতীর মুখে রামচরণেরখুন হবার সংবাদ পাওয়া অবধি সে যেন আর তার মধ্যেই ছিল না। ইন্সপেক্টারের আহ্বানে সে যখন তাঁর সামনে এসে দাঁড়াল তার গলা দিয়ে স্বর বেরুবার মত অবস্থাও তখন আর তার নেই।
নাম কি তোর?
গোটা দুই ঢোঁক গিলে কোনমতে লছমন নামটা তার উচ্চারণ করে।
কাল রাত্রে কখন শুতে গিয়েছিলি?
লছমণের যদিও মুঙ্গের জিলায় বাড়ি, দশ বছর বাংলাদেশে থেকে বেশ ভালই বাংলা ভাষাতে কথাবার্তা বলতে পারে।
সে আবার কোনমতে একটা ঢোঁক গিলে বললে, রাত এগারোটার পরই হবে সাহেব।
শুনলাম, কাল রাত্রে নাকি রামচরণ কিছু খায়নি, সত্যি?
হ্যাঁ সাহেব। রামচরণ কাল রাত্রে কিছুই খায়নি।
কেন খায়নি জানিস কিছু?
না। বলতে পারি না সাহেব।
রামচরণ বোজ আফিং খেত, জানিস?
আজ্ঞে হ্যাঁ, দেখেছি তাকে খেতে।
তুই দেখেছিস?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
হুঁ, কাল রাত্রে তুই একটানাই ঘুমিয়েছিলি না এক-আধবার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল?
একবার মাঝখানে উঠেছিলাম বাইরে যাবার জন্য।
সেই সময় কিছু শব্দ বা কিছু শুনেছিস?
আজ্ঞে–
লছমন যেন কেমন একটু ইতস্তত করতে থাকে।
এবারে একটু চড়া সুরে মিঃ বসাক বললেন, চুপ করে রইলি কেন? যা জিজ্ঞাসা করছি তার জবাব দে।
আজ্ঞে আমি যখন বাইরে থেকে ঘুরে আবার ঘরে ঢুকতে যাব—
কী? আবার থামল দেখ। বল্–
তখন যেন মনে হল কে একজন সাদা চাদরে গা ঢেকে রামচরণের ঘর থেকে বের হয়ে রান্না-ঘরের সামনে যে সরু ফালি বারান্দাটা সেই দিকে চট্ করে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। ভয়ে বাবু তখন আমার গলা শুকিয়ে এসেছে, অড়াতাড়ি উঠি কি পড়ি কোনমতে নিজের ঘরের মধ্যে ঢুকে খিল তুলে দিই।
কেন, ভেবেছিলি বুঝি ভূত?
আজ্ঞে সাহেব। গত মাসখানেক ধরে রামচরণের মুখে শুনেছি—
কি শুনেছিস?
বুড়োকতাবাবু নাকি ভূত হয়ে এ বাড়িতে রাত্রে ঘুরে বেড়ায় মধ্যে মধ্যে।
কি বললি?
আজ্ঞে হ্যাঁ। আমাদের বাবুও নাকি তাকে–ঐ বুড়োকতাবাবুর ভূতকে অনেক রাত্রে উপরের বারান্দায় ঘুরে বেড়াতে দেখেছেন।
রামচরণ তোকে ঐ কথা বলেছিল?
হ্যাঁ।
শুধু তোদের কর্তাবাবুই বুড়োকতার ভূত দেখেছিলেন না তোরাও কেউ কেউ এর আগে দেখেছিস?
আমি বা রামচরণ কখনও দেখিনি তবে করালী নাকি বার দু-তিন দেখেছিল।
ভূত তুই বিশ্বাস করিস?
কি যে বলেন বাবু! সিয়ারাম! সিয়ারাম। ভূত প্রেত তেনারা আছে বৈকি!
রেবতী, করালী ওদের তোর কেমন লোক বলে মনে হয়?
রেবতীও আমারই মত ভীতু বাবু, তবে করালীর খুব সাহস।
মৃদু হেসে ইন্সপেক্টার এবারে বললেন, আচ্ছা হ্যাঁ। করালীকে এ ঘরে পাঠিয়ে দে।
নমস্কার জানিয়ে লছমন ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
তার মুখ দেখে মনে হল সে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।
ইন্সপেক্টার বসাক লছমনকে প্রশ্ন করতে করতে তাঁর ডাইরীতে মধ্যে মধ্যে নোট করে নিচ্ছিলেন।
রজত স্তব্ধ হয়ে পাশেই একটা চেয়ারে বসেছিল।
এমন সময় আবার ঘরের বাইরে জুতোর শব্দ পাওয়া গেল। এবং সঙ্গে সঙ্গেই বলতে গেলে স্থানীয় থানা-ইনচার্জ রামানন্দ সেন ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করলেন।
.
২২.
আবার কি হল স্যার? রামানন্দ সেন প্রশ্ন করলেন।
এই যে মিঃ সেন, আসুন। বসুন—
মুখ তুলে আহ্বান জানালেন ইন্সপেক্টার রামানন্দ সেনকে।
রামানন্দ সেন একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন।
This time poor রামচরণ।
বলেন কি, মানে সেই বৃদ্ধ পুরাতন ভৃত্য–সত্যি—
হ্যাঁ। তারপর একটু থেমে আবার বললেন, কিছুটা এখন অবশ্য বুঝতে পারছি আমারই অসাবধানতার জন্যে বেচারীকে প্রাণ দিতে হল।
কি বলছেন স্যার।
ঠিকই বলছি মিঃ সেন। রামচরণের কথাবার্তা শুনেই কলি মনে হয়েছিল স্বেচ্ছায় আমার প্রশ্নের জেরায় পড়ে যতটুকু সে স্বীকার করেছে, সেটাই সব নয়। যে কোন কারণেই হোক অনেক কথাই সে গোপন করে গিয়েছে। তাই কাল মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম একদিনেই আর বেশি চাপ দেব না। আজ রইয়ে সইয়ে আবার জিজ্ঞাসাবাদ করব। এবং আমার অনুমান যে এক্কেরে মিথ্যা নয়, তার মৃত্যুই সেটা প্রমাণ করে দিয়ে গেল। তাই বলছিলাম কাল যদি একটু রামচরণ সম্পর্কে সতর্ক থাকতাম এবং তার উপরে আরো একটু নজর রাখতাম, তবে হয়তো এমনি করে তাকে নিহত হতে হত না।