আজ্ঞে না!
কোন কিছুই শোননি?
না।
কাল কত রাত্রে শুতে গিয়েছিলে ঘরে?
রামচরণ কথা বলে চলে আসবার পরই খাওয়াদাওয়া সেরে এসে শুয়ে পড়ি।
.
২০.
একটা চাদর দিয়ে রামচরণের মৃতদেহটা ঢেকে রেবতীকে নিয়ে ইন্সপেক্টার বসাক ঘর থেকে বের হয়ে এলেন।
দরজাটা বন্ধ করে রেবতীতে বললেন, ঠাকুর আর করালীকে ডেকে নিয়ে তুমি ওপরে এস রেবতী।
দোতলায় এসে ইন্সপেক্টার দেখলেন মধ্যবয়স্ক একজন ভদ্রলোক দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। উভয়ের চোখাচোখি হল। দোহারা চেহারা হলেও বেশ বলিষ্ঠ গঠন ভদ্রলোকের!
মাথার এক-তৃতীয়াংশ জুড়ে বেশ মসৃণ চকচকে একখানি টাক।
মাথার বাকি অংশে যে কেশ তাও বিরল হয়ে এসেছে।
উঁচু খাঁড়ার মত নাক। প্রশস্ত কপাল। ভাঙা গাল, গালের হনু দুটো যেন বয়ের আকারে ঠেলে উঠেছে। গোল গোল চোখ। চোখে কালো মোটা ফ্রেমের সেলুলয়েডের চশমা। পুরু লেন্সের ওধার হতে তাকিয়ে আছেন ভদ্রলোক। উপরের ওষ্ঠ পুরু একজোড়া গোঁফে প্রায় ঢাকা বললেও অত্যুক্তি হয় না। নীচের পুরু কালচে বর্ণের ওষ্ঠটা যেন একটু উটে আছে। পুরুষ্টু গোঁফের অন্তরাল হতেও দেখা যায় উপরের দাঁত্রে সারি। উঁচু দাঁত। পরিধানে ধুতি ও গলাবন্ধ মুগার চায়না কোট। পায়ে চকচকে কালো রংয়ের ডার্বি শু।
আপনি? প্রথমেই প্রশ্ন করলেন ইন্সপেক্টার।
আমার নাম প্রতুল বোস। এ বাড়ির সরকার। আপনি বোধ হয় পুলিসের কেউ হবেন?
হ্যাঁ। পুলিস ইন্সপেক্টার প্রশান্ত বসাক।
গেটেই পুলিস প্রহরী মোতায়েন দেখে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম। তার মুখেই একটু আগে সব শুনে এলাম, কিন্তু ব্যাপারটা যে কিছুতেই এখনও বিশ্বাস করে উঠতে পারছিনা ইন্সপেক্টর। সত্যিই কি বিনয়েন্দ্রবাবুকে কেউ মাডার করেছে?
হাঁ। ব্যাপারটা যতই অবিশ্বাস্য হোক, সত্যি। আর শুধু তাই নয় প্রতুলবাবু, গত রাত্রে ইতিমধ্যেই আরও একটি হত্যাকাণ্ড এ বাড়িতে সংঘটিত হয়েছে।
তার মানে! কী আপনি বলছেন ইন্সপেক্টার? আবার কাকে কে হত্যা করল কাল রাত্রে এ বাড়িতে!
কে হত্যা করেছে তা জানি না। তবে হত্যা করেছে এ বাড়ির পুরাতন ভৃত্যকে।
কে! রামচরণ!
হ্যাঁ। সে-ই নিহত হয়েছে।
এ সব আপনি কি বলছেন ইন্সপেক্টার! বাড়ির চার পাশে পুলিস প্রহরী, আপনি নিজে উপস্থিত ছিলেন এখানে; এমন দুঃসাহস?
দুঃসাহস বটে প্রতুলবাবু।
ইন্সপেক্টার বসাকের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় দরজা খুলে প্রথমে রজত ও তারপরই সুজাতা যে-যার নির্দিষ্ট ঘর থেকে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়াল।
বসাকের শেষের কথাটা রজতের কানে গিয়েছিল, সে এগিয়ে আসতে আসতে প্রশ্ন করল, কি দুঃসাহসের কথা বলছিলেন ইন্সপেক্টার?
এই যে রজতবাবু! আসুন কাল রাত্রেও আবার একটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে এ বাড়িতে।
সে কি! অস্ফুট আর্ত চিৎকারে কথাটা বলে রজত, আবার! আবার কে নিহত হল?
রামচরণ। রামচরণ!
হ্যাঁ।
সুজাতার মুখ দিয়ে কোন কথাই বের হয় না। সে ফ্যাল ফ্যাল করে সদ্য-ঘুমভাঙা চোখে বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এবং হঠাৎ যেন কেমন তার মাথাটা ঘুরে ওঠে। ঢুলে পড়ে যাচ্ছিল সুজাতা, ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গেই ইন্সপেক্টার বসাক চকিতে এগিয়ে এসে দুহাত বাড়িয়ে সুজাতার পতনোম্মুখ দেহটা সযত্নে ধরে ফেললেন।
কী হল! কী হল সুজাতা! সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে আসে রজতও। সুজাতার দু চোখের পাতা যেন নিমীলিত। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ শিথিল। ইতিমধ্যে ইন্সপেক্টারবাকপাঁজা-কোলে সুজাতার শিথিল দেহটা প্রায় বুকের উপর তুলে নিয়ে এগিয়ে যান সামনের খোলা দরজাপথে ঘরের মধ্যে।
ঘরের মধ্যে খাটের উপর পাতা শয্যাটার উপরে এসে সযত্নে ইন্সপেক্টার সুজাতার দেহটা শুইয়ে দিলেন।
রজত পাশেই এসে দাঁড়িয়েছিল। তার দিকে তাকিয়ে ইন্সপেক্টার বললেন, দেখুন তো ঘরের কোণে ঐ কুঁজোতে বোধ হয় জল আছে।
কুঁজোর পাশেই একটা কাঁচের গ্লাস ছিল, প্রতুলবাবুই গ্লাসে করে তাড়াতাড়ি কুঁজো থেকে জল ঢেলে এনে দিলেন।
কী হল! একজন ডাক্তার কাউকে ডাকলে হত না? রজত ব্যগ্র কণ্ঠে বলে।
গ্লাস থেকে জল নিয়ে শায়িত সুজাতার চোখে-মুখে জলের মৃদু ঝাপটা দিতে দিতে সুজাতার নিমীলিত চোখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ইন্সপেক্টার বসাক বললেন, না। ব্যস্ত হবেন না রজতবাবু। একেগতকালের ব্যাপার থেকে হয়অেস্ট্রেনযাচ্ছিল, তার উপর আজকের নিউজটা একটা শক্ দিয়েছে। তাই হয়তো জ্ঞান হারিয়েছে। আপনি বরং পাখার সুইচটা অনুগ্রহ করে অন্ করে দিন।
রজত এগিয়ে পাখার সুইচটা অন করে দিল।
মৃদু মিষ্টি একটা ল্যাভেণ্ডারের গন্ধ নাসারন্ধ্রে এসে প্রবেশ করছে। জলবিন্দুশোভিত কোমল চার কপালটি, তার আশেপাশে চুর্ণকুন্তলের দু-এক গাছি স্থানভ্রষ্ট হয়ে জলের সঙ্গে কপালে জড়িয়ে গিয়েছে। নিমীলিত আঁখির জলসিক্ত পাতা দুটি মৃদু কাঁপছে। বাম গণ্ডের উপরে কালো ছোট্ট তিলটি।
অনিমেষে চেয়ে থাকেন ইন্সপেক্টার বসাক মুখখানির দিকে। শুধু কি মুখখানিই! নিটোল চিবুক, ঠিক তার নীচে শঙ্খের মত সুন্দর গ্রীবা। গ্রীবাকে বেষ্টন করে চিকচিক করছে সরু সোনার একটি বিছে হার। গলাকাটা ব্লাউজের সীমানা ভেদ করে থেকে থেকে নিঃশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলিত হচ্ছে যেন সুধাভরা দুটি স্বর্ণকুম্ভ।
চোখের দৃষ্টি যেন ঘুরিয়ে নিতে পারেন না ইন্সপেক্টার বসাক। সত্যিই আজ বুঝি সুপ্রভাত।