চারটার সঙ্গে ছুটতে ছুটতে উপরে গেলাম।
কি থেকে কী ভাবে দুর্ঘটনা ঘটেছিল সে-ও জানে না আমিও আজ পর্যন্ত জানি না। তবে যে ঘরে সাপগুলো থাকত সে ঘরে ঢুকে দেখি, বেলা আর থোকন মেঝেতে মরে পড়ে আছে।
সর্বাঙ্গ তাদের নীল হয়ে গেছে। আর নতুন কেনা গোখরো সাপটা যে খাঁচার মধ্যে ছিল, সেটা মেঝেতে উন্টে পড়ে আছে এবং সেই সাপটা ঘরের মধ্যে কোথাও নেই।
কয়েকটা মুহূর্ত আমার কণ্ঠ দিয়ে কোন শব্দ বের হল না।
ঘটনার আকস্মিকতায় ও আতঙ্কে আমি যেন একদম বোবা হয়ে গিয়েছিলাম।
কাঁদবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কাঁদতে পারলাম না।
সমস্ত জীবনটাই এক মুহূর্তে আমার কাছে মিথ্যে হয়ে গেল। সমস্ত আশা আকাঙ্ক্ষা ও চাওয়া-পাওয়ার যেন একেবারে শেষ হয়ে গেল। গত সাত বছর ধরে এই যে তিলে তিলে অর্থ সংগ্রহ করে ভাগ্যকে জয় করবার দুস্তর প্রচেষ্টা সব—সব যেন মনে হল শেষ হয়ে গেছে।
বেলাকে স্ত্রীরূপে পেয়ে জীবন আমার ভরে গিয়েছিল। জীবনে থোকন এনেছিল এক অনাস্বাদিত আনন্দ, এক মুহূর্তে ঈশ্বর যেন তাদের দুজনকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আমাকে জগতের সর্বাপেক্ষা নিঃস্ব ও রিক্ত করে ভিক্ষুকেরও অধম করে দিয়ে গেলেন। সমস্ত দিন সেই দুটি বিষজর্জরিত নীল মৃতদেহকে সামনে নিয়ে হতবাক, মুহ্যমানের মত বসে রইলাম।
ক্ৰমে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এল।
ছোকরা চাকরটাও বোধ হয় কেমন হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। উপরের সিঁড়িতে রেলিংয়ের গায়ে হেলান দিয়ে বসে থাকতে থাকতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়েছিল।
ধীরে ধীরে মৃতদেহের পাশ থেকে এক সময় উঠে দাঁড়ালাম। অপঘাতে মৃত্যু হয়েছে বেলা ও খোকনের। পুলিস জানতে পারলে ময়না ঘরে টেনে নিয়ে যাবে। নিষ্ঠুরের মত ডাক্তার বেলার ঐ দেহে এবং আমার সাধের খোকনের নবনীত ঐ দেহে ছুরি চালাবে। সহ্য করতে পারব না।
তারপর শুধু তাই নয়, ক্রিমেশন গ্রাউন্ডে নিয়ে গিয়ে তাদের শেষ কাজ করতে হবে। তার জন্যও তো কোন ডাক্তারের সার্টিফিকেট চাই। এবং আরও আছে, জানাজানি হলে। ব্যাপারটা পুলিস আসবে। তখন নানা গোেলমালও শুরু হবে। তার চাইতে এই বাড়ির উঠানেই, মা ও ছেলেকে মাটির নিচে শুইয়ে রেখে দিই।
আমার জীবনের সবচাইতে দুটি প্রিয়জন আমার বাড়ির মধ্যেই মাটির নিচে শুয়ে থাক। ঘুমিয়ে থাক।
চাকরটাকে জাগিয়ে নীচে নেমে এলাম।
কখন এক সময় বৃষ্টি থেমে গেছে। বর্ষণক্লান্ত আকাশে এখনও এদিক-ওদিক টুকরো টুকরো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। তারই ফাঁকে ফাঁকে কয়েকটি তারা উঁকি দিচ্ছে।
চাকরটার সাহায্যে দুজনে মিলে উঠানের এক কোণে যে বড় ইউক্যালিপটাস গাছটা ছিল তার নীচে পাশাপাশি দুটি গর্ত খুঁড়লাম। তারপর সেই গর্তের মধ্যে শুইয়ে দিলাম বেলা আর খোনকে।
মাটি চাপা দিয়ে গর্ত দুটো যখন ভরাট হয়ে গেল, তখন রাত্রি-শেষের আকাশ ফিকে আলোয় আসন্ন প্রভাতের ইঙ্গিত জানাচ্ছে।
তারপর সাতটা দিন সাতটা রাত কোথা দিয়ে কেমন করে যে কেটে গেল বুঝতেও পারলাম না। সমস্ত জীবনটাই যেন মিথ্যা হয়ে গেছে। কিছুই আর ভাল লাগে না। আর কি হবে এই দূর দেশে একা পড়ে থেকে। ব্যবসা-পত্র সব বন্ধ করে দিয়েছি।
মাঝে মাঝে খরিদ্দার এলে তাদের ফিরিয়ে দিই।
দোকান সর্বদা বন্ধই থাকে।
মনের যখন এই রকম অবস্থা, উত্তরপাড়া থেকে বিনয়েন্দ্রর চিঠি পেলাম। জরুরী চিঠি, চলে আসবার জন্য।
পরের দিনই প্লেনে একটা সীট পেয়ে গেলাম। রওনা হয়ে পড়লাম। মনে মনে ঠিক করলাম, এখানে এসে একটা ব্যবস্থা করে দু-চারদিনের মধ্যেই আবার সিঙ্গাপুর ফিরে সেখানকার সব কাজ-কারবার বন্ধ করে চিরদিনের মত এখানে চলে আসব।
কিন্তু হায়! তখন কি জানতাম যে, এখানে এসে এ বাড়িতে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গেই এই দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে যাব।
এই পর্যন্ত বলে পুরন্দর চৌধুরী যেন একটা বড় রকমের দীর্ঘশ্বাস কোনমতে রোধ করলেন।
.
১৮.
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে আবার এক সময় পুরন্দর চৌধুরী বললেন, কিন্তু এখনও পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারছি না ইন্সপেক্টার, সত্যি কথা বলতে কি, এ দুর্ঘটনা কি করে ঘটল। আপনি বলছেন, বিনয়েন্দ্রকে কেউ হত্যা করেছে। কিন্তু আমি তো বুঝে উঠতে পারছি না বিনয়েন্দ্রকে কেউ হত্যা করতে পারে।এ যেন কেমন অবিশ্বাস্য বলে এখনও আমার মনে হচ্ছে।
কেন বলুন তো? ইন্সপেক্টর প্রশ্ন করলেন।
প্রথমত বিয়েকে আমি খুব ভাল করেই জানতাম। ইদানীং বিনয়েন্দ্র আমার প্ররোচনায় মুক্তার নেশায় জড়িয়ে পড়েছিল সত্য, কিন্তু ওই একটি মাত্র নেশার বদ অভ্যাস ছাড়া তার চরিত্রে আর কোন দোষই তো ছিল না। মিতভাষী, সংযমী, স্নেহপ্রবণ, সমঝদার এবং যথেষ্ট বুদ্ধিমান লোক ছিল সে। এবং যতদূর জানি, তার কোন শত্রুও এ দুনিয়ায় কেউ ছিল বলে তো মনে হয় না। তার জীবনের অনেক গোপন কথাও আমার অজানা নয়তবু বলব, তাকে কেউ হত্যা করতে পারে এ যেন সম্পূর্ণই অবিশ্বাস্য।
আচ্ছা পুরন্দরবাবু, ইন্সপেক্টার প্রশ্ন করলেন, এ বাড়ির পুরাতন ভৃত্য রামচরণের মুখে যে বিশেষ একটি মহিলার কথা শুনলাম, তার সম্পর্কে কোন কিছু আপনি বলতে পারেন?
কি আপনি ঠিক জানতে চাইছে ইন্সপেক্টার?
কথাটা আমার কি খুব অস্পষ্ট বলে বোধ হচ্ছে পুরন্দরবাবু?
মিঃ বসাকের কথায় কিছুক্ষণ পুরন্দর চৌধুরী তাঁর মুখের দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলেন। তারপর মৃদুকণ্ঠে বললেন, না ইন্সপেক্টার।