.
মিঃ বসাক পুরন্দর চৌধুরী বর্ণিত কাহিনী শুনে স্তম্ভিত হয়ে যান। লোকটা শুধু শয়তানই নয়, পিশাচ। অবলীলাক্রমে সে তার দুষ্কৃতির নোংরা কাহিনী বর্ণনা করে গেল।
পুরন্দর চৌধুরী তাঁর কাহিনী শেষ করে নিঃশব্দে বসেছিলেন।
ধীরে ধীরে আবার একসময় মাথাটা তুললেন, অর্থের নেশায় বুদ হয়ে অন্যায় ও পাপের মধ্যে বুঝতে পারে নি এতদিন যে, আমার সমস্ত অন্যায়, সমস্ত দুস্কৃতি একজনের অদৃশ্য জমাখরচের খাতায় সব জমা হয়ে চলেছে। সকল কিছুর হিসাবনিকাশের দিন আমার আসন্ন হয়ে উঠেছে। কড়ায় গণ্ডায় সব—সব আমাকে শোধ দিতে হবে।
কথাগুলো বলতে বলতে শেষের দিকে পুরন্দর চৌধুরীর গলাটা ধরে এল। কয়েকটা মুহূর্ত চুপ করে থেকে যেন তিনি বুকের মধ্যে উদ্বেলিত ঝড়টাকে একটু প্রশমিত করবার চেষ্টা করতে লাগলেন।
আরও কিছুক্ষণ পরে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন, জন্মের পর জ্ঞান হবার সঙ্গে সঙ্গেই দুঃখ ও দারিদ্র্য আমার পদে পদে পথ রোধ করেছে। তাই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, ছলে-বলে-কৌশলে যেমন করে থোক অর্থ উপার্জন করতেই হবে। আশ্রয়দাতা লিং সিংয়ের দয়ায় সেই অর্থ যখন আমার হাতে এল, বাংলাদেশে এসে বেলাকে আমি বিবাহ করে সঙ্গে করে সিঙ্গাপুরে নিয়েগেলাম।
বেলা আমার প্রতিবেশী গাঁয়ের এক অত্যন্ত গরীব ব্রাহ্মণের মেয়ে। বেলাকে আমি ভালবাসতাম এবং বেলাও আমাকে ভালবাসত। চিরদিনের মত শেষবার গ্রামে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করে যখন চলে আসি, তাকে বলে এসেছিলাম, যদি কোনদিন ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে ফেলতে পারি এবং তখনও সে যদি আমার জন্য অপেক্ষা করে তো ফিরে এসে তাকে আমি তখন বিয়ে করব।
কলকাতা ছাড়বার চার বছর পরে ভাগ্য যখন ফিরল বেলার বাবাকে একটি চিঠি দিলাম। চিঠির জবাবে জানলাম, বেলার বাপ মারা গেছে, বেলা তখন তার এক দূর-সম্পকীয় কার সংসারে দাসীবৃত্তি করে দিন কাটাচ্ছে।
সঙ্গে সঙ্গে এলাম কলকাতায় ও গ্রামে গিয়ে বেলাকে বিবাহ করলাম।
জীবন আমার আনন্দে ভরে উঠল। দুবছর বাদে আমাদের খোকা হল। সুখের পেয়ালা কানায় কানায় ভরে উঠল। ভেবেছিলাম, এমনি করেই বুঝি আনন্দ আর সৌভাগ্যের মধ্যে বাকি জীবনটা আমার কেটে যাবে।
বেলা কিন্তু মধ্যে মধ্যে আমাকে বলতো, ওই মাদক দ্রব্যের ব্যবসা ছেড়ে দিতে। কিন্তু দুস্কৃতির নেশা তখন মদের নেশার মতই আমার দেহের কোষে কোষে ছড়িয়ে গিয়েছে। তা থেকে তখন আর মুক্তি কোথায়! তাছাড়া পাপের দণ্ড। কতজনকে হৃতসর্বস্বকরেছি, কতজনকে জোঁকের মত শুষে শুষে রক্তশূন্য করে তিলে তিলে চরম সর্বনাশের মধ্যে ঠেলে দিয়েছি, তার ফল ভোগ করতে হবে না!
আবার একটু থেমে যেন নিজেকে একটু সামলে নিয়ে পুরন্দর বলতে লাগলেন, পূর্বেই আপনাকে বলেছি ইনসপেক্টার, ওই সিঙ্গাপুরী মুক্তা তৈরীকরবার জন্য সর্পবিষ বাস্নেক-ভেনমের প্রয়োজন হতো। সেই কারণে জ্যান্ত সাপই খাঁচায় রেখে দিতাম।
সাপের বিষ-থলি থেকে বিষ সংগ্রহ করতাম। সিঙ্গাপুরে ভাল বিষাক্ত সাপ তেমন মিলত বলে জাভা, সুমাত্রা ও বোর্ণিয়োর জঙ্গল থেকে বিষধর সব সাপ একজন চীনা মধ্যে মধ্যে ধরে এনে আমার কাছে বিক্রি করে যেত। সেবারে সে একটা প্রকাণ্ড গোখরো সাপ দিয়ে গেল। অত বড় জাতের গোখররা ইতিপূর্বে আমি বড় একটা দেখি নি। খাঁচার মধ্যে সাখটার সে কি গর্জন। মনে হচ্ছিল ছোবল দিয়ে খাঁচাটা বুঝি ভেঙেই ফেলবে।
চীনাটা বারবার আমাকে সতর্ক করে গিয়েছিল যে সাপটা একটু নিস্তেজ না হওয়ার আগে যেন তার বিষ সংগ্রহের আমি চেষ্টা না করি।
উপরের তলার একটা ছোট ঘরে সিগাপুরীমুক্তা তৈরীর সবমালমশলা ও সাপের খাঁচাগুলো থাকত। সাধারণত সে ঘরটা সর্বদা তালা দেওয়াই থাকতো।
যে দিনকার কথা বলছি সে দিন কি কাজে সেই ঘরে ঢুকছি এমন সময় একজন খরিদ্দার। আসায় তাড়াতাড়ি নিচে নেমে গেছি এবং তাড়াহুড়ায় সেই ঘরের তালাটা বন্ধ করতে ভুলে গেছি। খরিদ্দারটি আমার অনেক দিনকার জানাশোনা। সে মধ্যে মধ্যে এসে অনেক টাকার মুক্তা নিয়ে যেত। সে বললে, এখুনি তার সঙ্গে যেতে হবে একটা হোটেলে। একজন পাঞ্জাবী ভদ্রলোকের সঙ্গে আমাকে আলাপ করিয়ে দেবে, যে লোকটি আমার সঙ্গে মুক্তার কারবার করতে চায়। গাড়ি নিয়েই এসেছিল খরিদ্দারটি। আমার স্ত্রী রান্নাঘরে ছিল, তাকে বলে খরিদ্দারটির সঙ্গে বের হয়ে গেলাম।
বের হবার সময়ই ভুলে গেলাম যে সেই ঘরটা তালা দিতে হবে। ফিরতে প্রায় ঘণ্টা দুই দেরী হয়ে গেল। যে কাজে গিয়েছিলাম তাতে সফল হয়ে পকেট ভর্তি নোট নিয়ে বাড়ি ফেরবার পথে ভাবতে ভাবতে আসছিলাম এবারে আর মাসকয়েক কারবার করে স্ত্রীপুত্রকে নিয়ে কলকাতায় ফিরে আসব এবং কারবার একেবারে গুটিয়ে ফেলব। কিছুদিন থেকেই বেলা বলছিল কলকাতায় ফিরে যাবার জন্য। এখানে তার কোন সঙ্গী সাথী ছিল না একা একা। তার দিন যে খুব কষ্টে কাটে তা বুঝতে পেরেছিলাম।
বাড়িতে ঢুকেই উচ্চকণ্ঠে ডাকলাম, বেলা! বেলা!
কিন্তু বেলার কোন সাড়া পাওয়া গেল না। বাচ্চা চাকরটা আমার ডাক শুনে উপর থেকে ছুটতে ছুটতে এসে বললে, সর্বনাশ হয়ে গেছে। দেখবেন চলুন।
সে বেচারীও কিছু জানত না। বেলা তাকে কি কিনতে যেন বাজারে পাঠিয়েছিল, সে আমার মিনিট পনের আগে মাত্র ফিরেছে।