সিঙ্গাপুরী মুক্তা! সঙ্গে সঙ্গে একটা মতলব পুরন্দরের মনের মধ্যে স্থান পায়।
আগন্তুককে অপেক্ষা করতে বলেপুরন্দর এগিয়ে গিয়ে দরজার পাশেকলিং বেলটা টিপলেন।
একটু পরেই লিং সিংয়ের স্ত্রীর মুখ সিঁড়ির উপরে দেখা গেল।
পুরন্দর বললেন, তোমার স্বামীকে বল সিঙ্গাপুরী মুক্তার একজন খরিদ্দার এসেছে।
খানিক পরে লিং সিংয়ের স্ত্রী এসে আগন্তুক ও পুরন্দর দুজনকেই উপরে ডেকে নিয়ে গেল লিং সিংয়ের শয়ন ঘরে। এই সর্বপ্রথম লিং সিংয়ের বাড়ির দোতলায় উঠলেন পুরন্দর এখানে আসবার পর। শয্যার উপরে লি সিং শুয়েছিল।
পুরন্দরের সামনেই লি সিং তার শয্যার তলা থেকে একটা চৌকো কাঠের বাক্স বের করে ডালাটা খুলতেই পুরন্দর দেখলেন সত্যিই বাক্সে ভর্তি ছোট ছোট সব সাদা মুক্তা। একটা প্যাকেটে করে কিছু মুক্তা নিয়ে পরিবর্তে একগোছা নোট গুণে দিয়ে আগন্তুক চলে গেল।
সেই রাত্রেই আবার পুরন্দরের ডাক এল লিং সিংয়ের শয়নঘরে দোতলায়।
আমাকে ডেকেছ?
হ্যাঁ, বসো। শয্যার পাশেই লিং সিং একটা খালি চেয়ার দেখিয়ে দিল পুরন্দরকে বসবার জন্য।
পুরন্দর বসলেন।
ঘরের মধ্যে একটা টেবিল-ল্যাম্প জ্বলছে। বাইরে শুরু হয়েছে ঝোড়ো হাওয়া। ঘরের বন্ধ কাঁচের জানলা সেই হাওয়ায় থরথর করে কেঁপে কেঁপে উঠছে।
লিং সিংয়ের পায়ের কাছে তার প্রৌঢ়া স্ত্রী নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার ঈষৎ হলদে চ্যাপ্টা মুখে বাতির আলো কেমন ম্লান দেখায়।
দেখ পুরন্দর, লিং সিং বলতে লাগল, তোমাকে আমি এনেছিলাম সামান্য ঐ একশো ডলার মাইনের চাকরির জন্যে নয়। আমার এবং আমার স্ত্রীর বয়স হয়েছে, ক্রমশ দেহের শক্তিও আমাদের কমে আসছে। আমাদের কোন ছেলেপিলে নেই। তাই আমি এমন একজন লোক কিছুদিন থেকে খুঁজছিলাম যাকে পুরোপুরি আমরা বিশ্বাস করতে পারি। হোটেলে তোমার সঙ্গে আমার পরিচয় হওয়ার পর থেকেই তোমার উপরে আমার নজর পড়েছিল। তোমাকে আমি যাচাই করছিলাম। দেখলাম, তোমার মধ্যে একটা সং অথচ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ কষ্টসহিষ্ণু মানুষ আছে। আমাদেরও একজন দেখাশোনা করবার মত সৎ ও বিশ্বাসী লোক চাই। মনে হল, তোমাকে দিয়ে হয়তো আমাদের সে আশা যেন মিটতে পারে। চাকরি দিয়ে তোমাকে তাই নিয়ে এলাম। দীর্ঘ আটমাস তোমাকে দিনের পর দিন আমি পরীক্ষা করেছি। বুঝেছি, লোক নির্বাচনে আমি ঠকি নি।
এই পর্যন্ত একটানা কথাগুলো বলে লিং সিং পরিশ্রমে যেন হাঁপাতে লাগল। পুরন্দর বললেন, লিং সিং, তুমি এখন অসুস্থ। পরে এসব কথা হবে। আজ থাক।
না। আমার যা বলবার আজই আগাগোড়া সব তোমাকে আমি বলব বলেই ডেকে এনেছি এখানে। শোন পুরন্দর। কিওরিও শপটাই আমার আসল ব্যবসা নয়াআমার আসল ব্যবসাটি হচ্ছে বিচিত্র এক প্রকার মিশ্র মাদক দ্রব্য বৈচা। বিশেষ সেই দ্রব্যটি এমনই প্রক্রিয়ায় তৈরী যে, একবার তাতে মানুষ অভ্যস্থ হলে পরবর্তী জীবনে আর তাকে ছাড়তে পারবে না। এবং তখন যে কোন মূল্যের বিনিময়েও তাকে সেই মাদক দ্রব্যটি সংগ্রহ করতেই হবে। বিশেষ ঐ বিচিত্র মাদক দ্রব্যটির তৈরীর প্রক্রিয়া আমি শিখেছিলাম আমার ঐ স্ত্রীর বাপের কাছ থেকে। মরবার আগে সে আমাকে প্রক্রিয়াটি শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। সেইটি তোমাকে আমি শিখিয়ে দিয়ে যাব, কিন্তু তোমাকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে যতদিন আমরা বেঁচে থাকব আমাদের দেখাশোনা তুমি করবে। আমাদের মৃত্যুর পর অবশ্য তুমি হবে সব কিছুর মালিক।
পুরন্দর জবাবে বললেন, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের দেখব। তুমি আমাকে বিশেষ ওই মাদক দ্রব্য তৈরীর প্রক্রিয়া শিখিয়ে না দিলেও তোমাদের আমি দেখতাম এবং দেখবও।
আমি জানি পুরন্দর। তোমাকে আমি চিনতে পেরেছি বলেই তোমাকে আমার ঘরে এনে আমি স্থান দিয়েছি, হ্যাঁ শোন, যে মাদক দ্রব্যটির কথা বলছিলাম তারই নাম সিঙ্গাপুরী মুক্তা। কয়েক প্রকার বুনন গাছের ছাল, শিকড়, আফিং ও সর্পবিষ দিয়ে তৈরী করতে হয় সেই বিশেষ আশ্চর্য মাদক দ্রব্যটি। এবং পরে জিলাটিন দিয়ে কোটিং দিয়ে তাকে মুক্তার আকার দিই।
.
১৭.
পুরন্দর চৌধুরী বলতে লাগলেন, লিং সিংয়ের মৃত্যুর পর সেই মাদক দ্রব্য বেচে আমি অথোপার্জন করতে লাগলাম।
ঐভাবে ব্যবসা করতে করতে একদিন আমার মনে হল, শুধু ঐভাবে সিঙ্গাপুরে বসে কেন, আমি তো মধ্যে মধ্যে কলকাতা এসেও ঐ মাদক দ্রব্যের ব্যবসা করতে পারি। তাতে করে আমার আয় আরও বেড়ে যাবে। এলাম কলকাতা। কলকাতায় এসেই কয়েকটি শাঁসালো পুরাতন বন্ধুকে খুঁজে খুঁজে বের করলাম। যাদের অর্থ আছে, শখ আছে। ঠিক সেই সময় একদিন মার্কেটে বিনয়েন্দ্রর সঙ্গে বহুকাল পরে আমার দেখা হল।
বহুদিন পরে দুই পুরোন দিনের বন্ধুর দেখা। সে আমায় তার এই বাড়িতে টেনে নিয়ে এলো। দেখলাম বিনয়েন্দ্র প্রভূত অর্থের মালিক হয়েছে তার মাতামহের দৌলতে। সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হল, এই বিনয়েন্দ্রকে যদি আমি গাঁথতে পারি তো বেশ মোটা টাকা উপার্জন করতে পারব। বিনয়েন্দ্র দিবারাত্রই বলতে গেলে তার গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত। এবং প্রচুর পরিশ্রম করতে হয় বলে রাত্রে শয়নের পূর্বে সে সামান্য একটু ড্রিঙ্ক করত। তাকে বোঝালাম, নেশাই যদি করতে হয় তো লিকার কেন। লিকার বড় বদ নেশা। ক্রমে ক্রমে লিভারটি একেবারে নষ্ট করে ফেলবে। বিনয়েন্দ্র তাতে জবাব দিল, কি করি ভাই বল। শুধু যে পরিশ্রমের জন্যই আমি ড্রিঙ্ক করি তা নয়। যতক্ষণ নিজের গবেষণা ও পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত থাকি, বেশ থাকি। কিন্তু নির্জন অবসর মুহূর্তগুলি যেন কাটতেই চায় না। নিজের এমন একাকীত্ব যেন জগদ্দল পাথরের মত আমাকে চেপে ধরে। আপন জন থেকেও আমার কেউ নেই। জীবনে বিয়ে-থা করি নি, একদিন যারা ছিল আমার আপনার, যাদের ভালবেসে যাদের নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম, যাদের আঁকড়ে ধরে ভেবেছিলাম এ জীবনটা কাটিয়ে দের, তারাও, আজ আমাকে ভুল বুঝে দূরে সরে গিয়েছে। দেখা করা তত দূরে থাক, একটা খোঁজ পর্যন্ত তারা আমার নেয় না, বেঁচে আছি কি মরে গেছি। এওঁ একপক্ষে আমার ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ছাড়া আর কিছুই নয়। না হলে দাদামশাই বা তাঁর উইলটা বিচিত্র করে যাবেন কেন! আর করেই যদি গেলেন তো তারাই বা আমাকে ভুল বুঝে দূরে সরে যাবে কেন! আমাকে অনাত্মীয়ের মত ত্যাগ করবে কেন! অথচ তারা ছাড়া তো আমার এ সংসারে আপনার জনও আর কেউ নেই। আমার মৃত্যুর পর তারাই তো সব কিছু পাবে। সবই হবে, অথচ আমি যতদিন বেঁচে থাকব তারা আমার কাছেও আসবে না। এই সব নানা কারণেই ড্রিঙ্ক করে আমি ভুলে থাকি অবসর সময়টা। আমি তখন তাকে বললাম, বেশ তো, ঐ লিকার ছাড়া ভুলে থাকবার আরও পথ আছে। তখন আমিই নিজের তাগিদে তাকে সিঙ্গাপুরী মুক্তার সঙ্গে পরিচয় করালাম। প্রথমটায় অনিচ্ছার সঙ্গেই সে আমার প্রস্তাবে ঠিক রাজী নয়, তবে নিমরাজী হয়েছিল। পরে হল সে ক্রমে ক্রমে আমার ক্রীতদাস। সম্পূর্ণ আমার মুঠোর মধ্যে সে এল। ধীরে ধীরে তাকে গ্রাস করতে শুরু করলাম। কলকাতায় তিনখানা বাড়ি তো গেলই–নগদ টাকাতেও টান পড়ল তার।