কিন্তু একজন বিদেশীর পক্ষে চাকরি পাওয়া অত সহজ নয়।
ঘুরতে ঘুরতে একদিন হোটেলে এক বাঙালী প্রৌঢ়ের সঙ্গে আলাপ হয়। শোনা গেল, সেও নাকি একটা এসেছিল ভাগ্যান্বেষণে সিঙ্গাপুরে। সে-ইতাকে একরবার গুডসেরফ্যাক্টরীতে চাকরি করে দেয়। এবং সেখানেই আলাপ হয় বছর দেড়েক বাদে এক চীনা ভদ্রলোকের সঙ্গে। নাম তার লিং সিং।
লিং সিংয়ের দেহে পুরোপুরি চীনের রক্ত ছিল না। তার মা ছিল চীনা, আর বাপ ছিল অ্যাংলো মালয়ী। শহরের মধ্যেই লিং সিংয়ের ছিল একটা কিউরিও শপ। লোকজনের মধ্যে লিং সিং ও তার স্ত্রী–কু-সি। দুজনেরই বয়স হয়েছে।
শহরের একটা হোটেলে সাধারণতঃ যেখানে নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকেরাই যাতায়াত করত, লিং সিং-ও সেখানে যেত। পুরন্দর চৌধুরীও সেই হোটেলে মধ্যে মধ্যে যেতেন। সেইখানেই আলাপ হয় দুজনের।
লিং সিংকে মধ্যে মধ্যে পুরন্দর চৌধুরী কোথাও একটা ভাল চাকরি করে দেবার জন্য বলতেন।
লিং সিং আশ্বাস দিত সে চেষ্টা করবে।
শেষে একদিন লিং সিং তাঁকে বললে, সত্যিই যদি সে চাকরি করতে চায় তো যেন সে আজ সন্ধ্যার পর তার কিউরিও শপে যায়। ঠিকানা দিয়ে দিল লিং সিং পুরন্দরকে তার দোকানের।
সেই দিনই সন্ধ্যার পর পুরন্দর লিং সিংয়ের কিউরিও শপে গেলেন তার সঙ্গে দেখা করতে।
এ-কথা সে-কথার পর লিং সিং এক সময় বললে, সে এবং তার স্ত্রী দুজনেরই বয়স হয়েছে। তাদের কোন ছেলেমেয়ে বা আত্মীয়স্বজনও কেউ নেই। তারা একজন পুরন্দরের মতই বিশ্বাসী ও কর্মঠ লোক খুঁজছে, তাদের দোকানে থাকবে, দোকান দেখাশোনা করবে, খাওয়া থাকা ছাড়াও একশ ডলার করে মাসে মাইনে পাবে।
মাত্র পঞ্চাশ ডলার করে মাইনে পাচ্ছিলেন পুরন্দর ফ্যাক্টরীতে; সানন্দে তিনি রাজী হয়ে গেলেন। এবং পরের দিন থেকেই লিং সিংয়ের কিউরিও শপে কাজে লেগে গেলেন।
তারপর? মিঃ বসাক শুধালেন।
তারপর?
হ্যাঁ।
১৬-২০. পুরন্দর চৌধুরী আবার বলতে লাগলেন
মাসখানেকের মধ্যেই পুরন্দর চৌধুরী দেখলেন এবং বুঝতেও পারলেন, লিং সিংয়ের দোকানটা বাইরে থেকে একটা কিউরিও শপ মনে হলেও এবং সেখানে বহু বিচিত্র খরিদ্দারদের নিত্য আনাগোনা থাকলেও, আসলে সেটা একটা দুষ্প্রাপ্য অথচ রহস্যপূর্ণ চোরাই মাদক দ্রব্য কারবারেরই আড্ডা।
লিং সিংয়ের কিউরিওর বেচা-কেনাটা একটা আসলে বাইরের ঠাট মাত্র। এবং চোরাই মাদক দ্রব্যের কারবারটাই ছিল লিং সিংয়ের আসল কারবার। কিন্তু সদা সতর্ক ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেও পুরন্দর কিন্তু অনেকদিন পর্যন্ত জানতেই পারেননি যে, লিং সিংয়ের সেই মাদক দ্রব্যটি আসলে কি? এবং কোথায় তা রাখা হয় বা কি ভাবে বিক্রি করা হয়।
মধ্যে মধ্যে পুরন্দর কেবল শুনতেন, এক-আধজন খরিদ্দার এসে বলত আসল সিঙ্গাপুরী মুক্তা চায়।…
লিং সিং তখন তাঁকে দোতলায় তার শয়নঘরের সংলগ্ন ছোট্ট একটি কামরার মধ্যে, ডেকে নিয়ে গিয়ে কামরার দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিত। মিনিট পনের-কুড়ি পরে খরিদ্দার ও লিং সিং কামরা থেকে বের হয়ে আসত।
অবশেষে পুরন্দরের কেমন যেন সন্দেহ হয় ঐ সিঙ্গাপুরী মুক্তার মধ্যে নিশ্চয়ই কোন রহস্য রয়েছে। নচেৎ ঐ মুক্তার ব্যাপারে লিং সিংয়ের অত সতর্কতা কেন।
ফলে পুরন্দর কাজ করতেন, কিন্তু তাঁর সজাগ সতর্ক দৃষ্টি সর্বদা মেলে রাখতেন যেমন করেই হোক আসল সিঙ্গাপুরী মুক্তা রহস্যটা জানবার জন্য।
আরও একটা ব্যাপার পুরন্দর লক্ষ্য করেছিলেন, লিং সিংয়ের কিউরিও শপে বেচাকেনা যা হত, সেটা এমন বিশেষ কিছুই নয় যার দ্বারা লিং সিংয়ের একটা মোটা রকমের আয় হতে পারে। এবং লিং সিংয়ের অবস্থা যে বেশ সচ্ছল, সেটা বুঝতে অন্ধেরও কষ্ট হত না।
পুরন্দর চৌধুরী লক্ষ্য করেছিলেন, মুক্তা সন্ধানী যারা সাধারণত কিউরিও শপে লিং সিংয়ের কাছে আসত তারা সাধারণত স্থানীয় লোক নয়।
চীন-মালয়, জাভা, সুমাত্রা, ভারতবর্ষ প্রভৃতি জায়গা থেকেই সব খরিদ্দারেরা আসত।
তারা আসত জাহাজে চেপে, কিন্তু সিঙ্গাপুরে থাকত না তারা।
পুরন্দর চৌধুরী চাকরি করতেন বটে লিং সিংয়ের ওখানে, কিন্তু একতলা ছেড়ে দোতলায় ওঠবার তাঁর কোন অধিকার ছিল না। লিং সিংয়ের বউই সাধারণত নীচে পুরন্দরের খাবার পৌঁছে দিয়ে যেত প্রত্যহ।
যেদিন তিনি আসতেন না, যে ছোরা মালয়ী চাকরটা ওখানে কাজ করত সে-ই নিয়ে আসত তাঁর খাবার।
এমনি করে দীর্ঘ আট মাস কেটে গেল।
এমন সময় হঠাৎ লিং সিং অসুস্থ হয়ে পড়ল কদিন। লিং সিং আর নীচে নামে না। পুরন্দর একা-একাই লিং সিংয়ের কিউরিও শপ দেখাশোনা করেন।
সকাল থেকেই সেদিন আকাশটা ছিল মেঘলা, টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। পুরন্দর একা কাউন্টারের ওপাশে বসে একটা ইংরেজী নভেল পড়ছেন। এমন সময় দীর্ঘকায় এক সাহেবী পোশাক পরিহিত, মাথায় ফেল্টক্যাপ, গায়ে বর্ষাতি এক আগন্তুক এসে দোকানে প্রবেশ করল।
গুড মর্ণিং!
পুরন্দর বই থেকে মুখ তুলে তাকালেন। আগন্তুকের তামাটে মুখের রঙ সাক্ষ্য দিচ্ছে। বহু রৌদ্র-জলের ইতিহাসের মুখে তামাটে রঙের চাপদাড়ি।
ভাঙা ভাঙা ইংরেজীতে আগন্তুক জিজ্ঞাসা করল, লিং সিং কোথায়?
পুরন্দর বললেন, যা বলবার তিনি তাঁর কাছেই বলতে পারেন, কারণ লিং সিং অসুস্থ।
আগন্তুক বললে, তার কিছু সিঙ্গাপুরী মুক্তার প্রয়োজন।