আহা, অমন করে বোলো না বউদি। একজন এই বয়সে বাপ হারিয়েছে, আর একজন তো বাপ মা দুটো বালাই-ই চুকিয়ে বসে আছে।
সত্যিই তো!
রজতের বাবা অমরেন্দ্রনাথ সেক্রেটারিয়েটে বড় চাকরি করতেন। তিন ভাই অমরেন্দ্র, সুরেন্দ্র ও বিনয়েন্দ্রর মধ্যে তিনিই ছিলেন জ্যেষ্ঠ। অল্প বয়সেই দেখা দিল রক্তচাপাধিক্য, হঠাৎ করোনারী থ্রম্বসিসে একদিন দ্বিপ্রহরে অফিসে কাজ করতে করতেই অজ্ঞান হয়ে গেলেন। জ্ঞানহীন অমরেন্দ্রনাথকে অ্যাম্বুলেন্সে করে বাড়িতে নিয়ে আসা হল কিন্তু লুপ্ত জ্ঞান আর তাঁর ফিরে এল না। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই সব শেষ হয়ে গেল। রজতের বয়স তখন সবেমাত্র ন বছর। এক বছরও ঘুরল না, সুরেন্দ্রনাথ ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার, একটা ব্রিজ কনস্ট্রাকসনের তদ্বির করে ফিরছিলেন সস্ত্রীক নিজের গাড়িতেই। ড্রাইভার ড্রাইভ করছিল। একটা রেলওয়ে ক্রশিংয়ের বাঁকের মুখে ড্রাইভার স্পীডের মুখে গাড়ি টার্ন নিতে গিয়ে গাড়ি উল্টে গিয়ে একই সঙ্গে ড্রাইভার ও সস্ত্রীক সুরেন্দ্রনাথের আকস্মিক মৃত্যু ঘটে সঙ্গে সঙ্গেই।
সুজাতার বয়স তখন বছর ছয়েক মাত্র।
অতি অল্প বয়সে মা ও বাপকে একসঙ্গে হারালেও সুজাতার খুব বেশী অসুবিধা হয়নি। কারণ সে প্রকৃতপক্ষে তার জন্মের পর থেকেই আয়ার কোলে ও জ্যেঠাইমার তত্ত্বাবধানে মানুষ হচ্ছিল। বাপ-মার সঙ্গে তার সম্পর্ক খুব কমই ছিল। সুরেন্দ্রনাথ তাঁর কনট্রাকসনের কাজে বাইরে বাইরেই সর্বদা ঘুরে বেড়াতেন, সঙ্গে সঙ্গে থাকতেন তাঁর স্ত্রী সুপ্রিয়া। সুজাতার যা কিছু আদর-আবদার ছিল তার ছোট্কা বিনয়েন্দ্রনাথ ও জ্যেঠিমার কাছেই।
একটা বছরের মধ্যেই সাজানো-গোছানো সংসারটার মধ্যে যেন অকস্মাৎ একটা ঝড় বহে গেল। সব কিছু ওলটপালট হয়ে গেল।
সমস্ত ঝক্কি ও দায়িত্ব এসে পড়ল বিনয়েন্দ্রনাথের ঘাড়ে।
বিনয়েন্দ্রনাথ তখন রসায়নে এম. এস. সি. পাস করে এক বে-সরকারি কলেজে সবেমাত্র বছর দুই হল অধ্যাপনার কাজ নিয়েছেন ও ডক্টরেটের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন।
সংসারের টাকাপয়সার ব্যাপারটা কোন দিনও তাঁকে ভাবতে হয়নি ইতিপূর্বে। যা আয় করতেন তার সবটাই তাঁর ইচ্ছামত রসায়ন শাস্ত্রের বই কিনে ও ভাইপো-ভাইঝিদের আদর-আবদার মেটাতেই ব্যয় হয়ে যেত। কিন্তু হঠাৎ যেন মোটা রকমের উপার্জনক্ষম মাথার উপরে দুই ভায়ের আকস্মিক মৃত্যুতে সমস্ত ঝক্কি এসে তাঁকে একেবারে বিব্রত করে তুলল।
কিন্তু অত্যুৎসাহী, সদাহাস্যময় আনন্দ ও জ্ঞানপাগল বিনয়েন্দ্রনাথকে দেখে সেটা বোঝবার। উপায় ছিল না।
অমরেন্দ্রনাথ যত্র আয় করতেন তত্র ব্যয় করতেন; কাজেই মৃত্যুর পর সামান্য হাজার দু-তিন টাকা ব্যাঙ্কে ছাড়া আর কিছুই রেখে যেতে পারেননি এবং সময়ও পাননি।
সুরেন্দ্রনাথও তাই, তবে হাজার পনের টাকার জীবনবীমা ছিল তাঁর।
বিনয়েন্দ্রনাথ বউদির শত অনুরোধেও বিবাহ করলেন না, নিজের রিসার্চ ও ভাইপো-ভাইঝিদের নিয়েই দিন কাটাতে লাগলেন।
এমনি করেই দীর্ঘ চোদ্দটা বছর কেটে গেল।
রজত বি. এ. পাস করে এম. এ. ক্লাসে ভর্তি হল ও সুজাতা বি. এ. ক্লাসে সবে নাম লিখিয়েছে এমন সময় অকস্মাৎ একটা ঘটনা ঘটল।
.
অমরেন্দ্র, সুরেন্দ্র ও বিনয়েন্দ্রর মাতামহ অনাদি চক্রবর্তী সেকালের একজন বর্ধিষ্ণু জমিদার, থাকতেন উত্তরপাড়ায়।
একদিন বিয়ে কলেজ থেকেই সেই যে তাঁর দাদুকে দেখতে গেলেন তাঁর উত্তরপাড়ার বাড়িতে, আর ফিরে এলেন না কলকাতার বাসায়।
সন্ধ্যার দিকে উত্তরপাড়া থেকে অবিশ্যি বিনয়েন্দ্রর একটা চিঠি একজন লোকের হাত দিয়ে এসেছিল রজতের মার নামে এবং তাতে লেখা ছিল:
বউদি,
দাদুর হঠাৎ অসুখের সংবাদ পেয়ে উত্তরপাড়ায় এসে দেখি তাঁর মস্তিষ্কবিকৃতিটা কয়েকদিন থেকে একটু বেশী রকমই বাড়াবাড়ি চলেছে। তাঁকে দেখবার কেউ নেই, এ অবস্থায় আঁকে একা একটিমাত্র চাকরের ভরসায় রেখে ফিরতে পারছি না। তবে একটু সুস্থ হলে যাব। রজতই যেন একরকম করে সব চালিয়ে নেয়।
ইতি বিনয়েন্দ্র
ওইটুকু সংবাদ ছাড়া ওদের কলকাতার বাসার ওই লোকগুলোর খরচপত্র কেমন করে কোথা থেকে চলবে তার কোন আভাস মাত্রও সে চিঠিতে ছিল না।
বিনয়েন্দ্রর পক্ষে ওই ধরনের চিঠি দেওয়াটা একটু বিচিত্রই বটে। যাহোক সেই যে বিনয়েন্দ্র উত্তরপাড়ায় চলে গেলেন আর সেখান থেকে ফিরলেন না। এবং দ্বিতীয় আর কোন সংবাদও দিলেন না দীর্ঘ তিন বছরের মধ্যে; এমন কি সকলে কে কেমন আছে এমনি ধরনের কোন একটি কুশল সংবাদ নিয়েও কোন সন্ধান বা পত্র এল না ওই দীর্ঘ তিন বছরে।
রজতের মা বিনয়েন্দ্রর এতাদৃশ ব্যবহারে বেশ কিছুটা মর্মাহত তো হলেনই এবং অভিমানও হল তাঁর সেই সঙ্গে।
আশ্চর্য! বিনয়েন্দ্র অকস্মাৎ সকলকে কেমন করে ভুলে গেল আর ভুলতে পারলই বা কী করে? যাহোক অভিমানের বশেই রজতকে পর্যন্ত তাঁর অনুরোধ সত্ত্বেও একদিনের জন্যও তিনি বিনয়েন্দ্রর সন্ধানে যেতে দিলেন না।
যাক সে যদি ভুলে থাকতে পারে, তাঁরাই বা কেন তাকে ভুলে থাকতে পারবেন না!
.
০২.
উত্তরপাড়ায় বিনয়েন্দ্রর যে মাতামহ ছিলেন অনাদি চক্রবর্তী, তাঁর বয়স প্রায় তখন সত্তরের কাছাকাছি।
এমন একদিন ছিল যে সময় উত্তরপাড়ায় চক্রবর্তীদের ধনসম্পদের প্রবাদটা কিংবদন্তীর মতই হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সে হচ্ছে রামানন্দ চক্রবর্তীর যুগ। অথচ খুব বেশী দিনের কথাও তো সেটা নয়। কলকাতায় সে সময় ইংরাজ কুঠিয়ালদের প্রতিপত্তি সবে শুরু হয়েছে। রামানন্দ ছিলেন ওইরূপ এক কুঠিরই মুছুদ্দি। রামানন্দ বিয়ে করেছিলেন ভাটপাড়ার বিখ্যাত গাঙ্গুলী পরিবারে। বউ লক্ষ্মীরাণী ছিলেন অপরূপা সুন্দরী। কিন্তু সুখে বা আনন্দে সংসার তিনি করতে পারেননি।