আর একজন নতুন লোক যে এ বাড়িতে এসেছে বাইরে থেকে কারও পক্ষে তা বোঝবারও উপায় ছিল না।
সারাটা দিন এবং প্রায় মধ্যরাত্রি পর্যন্ত দুজনেই যে যাঁর কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। এবং সে সময়টা বিশেষ কাজের এবং প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া দুজনের মধ্যে কোন কথাই নাকি হত না।
একমাত্র দুজনের মধ্যে সামান্য যা কথাবার্তা মধ্যে মধ্যে হত—সেটা ওই খাবার টেবিলে বসে।
বিনয়েন্দ্রকে নিয়ে এক টেবিলে বসেই তিনি খেতেন।
সেই সময় বিনয়েন্দ্রর সঙ্গে তাঁকে কথা বলতে শুনেছে রামচরণ, কিন্তু তাও সে-সব কথাবার্তার কিছুই প্রায় সে বুঝতে পারেনি, কারণ খাওয়ার টেবিলে বসে যা কিছু আলাপ তাঁর বিনয়েন্দ্রর সঙ্গে চলত তা সাধারণত ইংরেজীতেই হত।
এমনি করে চলছিল, তারপর হঠাৎ একদিন আবার যেমন তরুণীর ঐ গৃহে আবির্ভাব ঘটেছিল তেমনি হঠাৎই একদিন আবার তরুণী যেন কোথায় চলে গেলেন।
নিয়মিত খুব ভোরে গিয়ে রামচরণ তরুণীকে তাঁর প্রভাতী চা দিয়ে আসত, একদিন সকালবেলা তাঁর প্রাত্যহিক প্রভাতী চা দিতে গিয়ে রামচরণ তাঁর ঘরে আর তাঁকে দেখতে পেল না।
একটি মাত্র বড় সুটকেস কেবল যা সঙ্গে এনেছিলেন তিনি, সেইটিই ডালা-খোলা অবস্থায় ঘরের একপাশে পড়ে ছিল।
রামচরণ প্রথমে ভেবেছিল, তিনি বোধ হয় ল্যাবরেটরী ঘরেই গেছেন কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখে বিনয়েন্দ্র অ্যাপ্রন গায়ে একা-একাই কাজ করছেন।
সকালবেলার পরে দ্বিপ্রহরেও খাওয়ার টেবিলে তাঁকে না দেখে রামচরণ বিনয়েন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করে, মেমসাহেবকে দেখছি না বাবু? তিনি খাবেন না?
না।
আর কিছু জিজ্ঞাসা করতে রামচরণেরও যেমন সাহস হয়নি, বিনয়েন্দ্রও আর তাকে সেই তরুণী সম্পর্কে দ্বিতীয় কোন কথা বলেননি নিজে থেকে।
তবে তরুণীকে আর তারপর এ বাড়িতে রামচরণ দেখেনি।
চার মাস আগে অকস্মাৎ একদিন যেমন তিনি এসেছিলেন, চার মাস বাদে অকস্মাৎই তেমনি আবার যেন উধাও হয়ে গেলেন।
কোথা থেকেই বা এসেছিলেন আর কোথায়ই বা চলে গেলেন কে জানে!
রামচরণ তাঁকে আবার দেখলে হয়তো চিনতে পারবে, তবে তাঁর নাম-ধাম কিছুই জানে না।
তরুণী চলে যান আজ থেকে ঠিক দশ দিন আগে।
এই একটি সংবাদ। এবং দ্বিতীয় সংবাদটি ওই তরুণী ছাড়াও আর একজন পুরুষ আগন্তুক বিনয়েন্দ্রর সঙ্গে গত এক বছরের মধ্যে বার দুই দেখা করেছেন।
আগন্তুক সম্ভবত একজন ইউ.পি.বাসী।
লম্বা-চওড়া চেহারা, মুখে নূর দাড়ি, চোখে কালো কাঁচের চশমা ছিল আগন্তুকের। এবং পরিধানে ছিল কেনা পায়জামা, সেরওয়ানী ও মাথায় গান্ধী-টুপি।
তিনি নাকি প্রথমবার এসে বিনয়েন্দ্রর সঙ্গে তাঁর ল্যাবরেটরী ঘরে বসে আধঘণ্টাটাক আলাপ করে চলে যান।
দ্বিতীয়বার তিনি আসেন দুর্ঘটনার মাস চারেকের কিছু আগে।
তৃতীয় সংবাদ যা ইন্সপেক্টার সংগ্রহ করেছেন রামচরণের কাছ থেকে তা এই: পুরন্দর চৌধুরী গত দু-বছর থেকে মধ্যে মধ্যে চার-পাঁচ মাস অন্তর অন্তর বার পাঁচেক নাকি এবাড়িতে এসেছেন। এবং রামচরণ তাঁকে চেনেন। পুরন্দর চৌধুরী এখানে এলে নাকি দু-পাঁচদিন থাকতেন।
চতুর্থ সংবাদটি হচ্ছে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এবং শুধু উল্লেখযোগ্যই নয়, একটু রহস্যপূর্ণও।
গত দেড় বছর ধরে ঠিক দু মাস অন্তর অন্তর সিঙ্গাপুর থেকে বিনয়েন্দ্রর নামে একটি করে নাকি রেজিস্টার্ড পার্শেল আসত।
পার্সেলের মধ্যে কি যে আসত তা রামচরণ বলতে পারে না। কারণ পার্সেলটি আসবার সঙ্গে সঙ্গেই রসিদে সই করেই বিনয়েন্দ্র পার্সেলটি নিয়েই ল্যাবরেটরী ঘরের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করতেন। কখনও তিনি রামচরণের সামনে পার্সেলটি খোলেন নি।
এবং একটা ব্যাপার রামচরণ লক্ষ্য করেছিল, পার্সেলটি আসবার সময় হয়ে এলেই বিনয়েন্দ্র যেন কেমন বিশেষ রকম একটু চঞ্চল ও অস্থির হয়ে উঠতেন। বার বার সকালবেলা পিওন আসবার সময়টিতে একবার ঘর একবার বারান্দা করতেন।
যদি কখনও দু-একদিন পার্সেলটি আসতে দেরি হত, বিনয়েন্দ্রর মেজাজ ও ব্যবহার যেন কেমন খিটখিটে হয়ে উঠত। আবার পার্সেলটি এসে গেলেই ঠাণ্ডা হয়ে যেতেন।
শান্ত ধীর যেমন তাঁর স্বভাব।
ছোট একটি চৌকো বাক্সে পার্সেলটি আসত।
সিঙ্গাপুর থেকে যে পার্সেলটি আসত রামচরণ তা জেনেছিল একদিন বাবুর কথাতেই, কিন্তু জানত না কে পাঠাত পার্সেলটি এবং পার্সেলটির মধ্যে কি থাকতই বা।
.
১২.
দরজার বাইরে এমন সময় জুতোর আওয়াজ পাওয়া গেল।
কেউ আসছে এ ঘরের দিকে। ইন্সপেক্টার বসাক চোখ তুলে খোলা দরজাটার দিকে তাকালেন।
ভিতরে আসতে পারি স্যার? বাইরে থেকে ভারী পুরুষ-কণ্ঠে প্রশ্ন এল।
কে, সীতেশ? এস এস—
চব্বিশ-পঁচিশ বৎসর বয়স্ক একটি যুবক ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করল। পরিধানে তার ক্যালকাটা পুলিশের সাদা ইউনিফর্ম।
কি খবর সীতেশ?
জামার পকেট থেকে একটি মুখ আঁটা অন হিজ ম্যাজেস্টিস সার্ভিস ছাপ দেওয়া লম্বা খাম বের করে এগিয়ে দিতে দিতে বললে, পোস্টমর্টেম রিপোর্ট স্যার।
আগ্রহের সঙ্গে খামটা হাতে নিয়ে ইন্সপেক্টার বসাক বললেন, থ্যাঙ্কস্। আচ্ছা তুমি যেতে পার সীতেশ।
সার্জেন্ট সীতেশ ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
ইন্সপেক্টার বসাক খামটা ছিড়ে রিপোর্টটা বের করলেন।
.
বিনয়েন্দ্রর মৃতদেহের ময়না তদন্তের রিপোর্ট।
ডাঃ বক্সীই ময়না তদন্ত করেছেন নিজে।
দেখলেন মৃতদেহে বিষই পাওয়া গেছে, তবে সে সাধারণ কোন কেমিকেল বিষ নয়, মেক-ভেন। সর্প-বিষ!