ভাঙা জামান টাইমপিসটা লম্বা টেবিলটার উপরেই রাখা ছিল। মিঃ বসাক ঘড়িটা হাতে তুলে নিলেন এবারে দেখবার জন্য।
ঘড়ির কাচটা ভেঙে শত চিড় খেয়ে গেলেও কাঁচের টুকরোগুলো খুলে পড়ে যায় নি। ঘড়িটা ঠিক একটা বেজে বন্ধ হয়ে আছে।
ঘড়িটা বার দুই নাড়াচাড়া করে মিঃ বসাক পুনরায় সেটা টেবিলের উপরেই রেখে দিলেন।
খুব সম্ভবত ঘড়িটা বন্ধ হয়ে গেছে রাত একটায়।
যে কোন কারণেই হোক ঘড়িটা নিশ্চয়ই ছিটকে পড়েছিল এবং যার ফলে ঘড়ির কাচটা ভেঙেছে ও ঘড়িটাও বন্ধ হয়ে গেছে।
ঘড়িটা কোথায় পেয়েছেন? মিঃ বসাক থানা-অফিসারকে জিজ্ঞাসা করলেন।
মেঝেতে পড়েছিল।
ভৃত্য রামচরণকে পরে জিজ্ঞাসা করে জানা গিয়েছিল ঘড়িটা ওই টেবিলটার উপরেই নাকি সর্বদা থাকত।
.
১০.
যদিচ থানা-অফিসার সকলেরই জবানবন্দি নিয়েছিলেন, তথাপি মিঃ বসাক প্রত্যেককেই আবার পৃথক পৃথকভাবে ডেকে জিজ্ঞাসা করেন। বিশেষ করে একটা প্রশ্ন সকলকেই করলেন, রাত সাড়ে বারোটা থেকে একটার মধ্যে কোনরূপ শব্দ বা চিৎকার শুনতে কেউ পেয়েছিল কিনা।
কিন্তু সকলেই জবাব দেয়, না। তারা কোনরূপ শব্দই শোনেনি। কারও কোন চিৎকারও শোনেনি।
সমস্ত গবেষণা-ঘরটা মিঃ বসাক চারদিক খুব ভাল করে দেখলেন অন্য কোন সূত্র অথাৎ clue পাওয়া যায় কিনা।
.
গবেষণা-ঘরটি প্রশস্ত একটি হলঘরের মতই বললে অত্যুক্তি হয় না। দরজা মাত্র দুটি; একটি বাইরের বারান্দার দিকে ও অন্যটি পাশের ঘরের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে। অতএব এই দুটি দরজা ভিন্ন ওই ঘরে যাতায়াতের আর দ্বিতীয় কোন রাস্তাই নেই।
বারান্দার দিকে তিনটি জানলা। সেগুলো বোধ হয় দীর্ঘদিন পূর্বেই একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ভিতর থেকে স্কু এঁটে। অন্যদিকে যে জানলাগুলো সেগুলোতে পূর্বে খড়খড়ির পাল্লা ছিল। বিনয়েন্দ্রনাথ ঘরটিকে ল্যাবরেটরী করবার সময় সেগুলো ফেলে দিয়ে বড় বড় কাঁচের পাল্লা সেট করিয়ে নিয়েছিলেন। পাল্লাগুলো ফ্রেমের মধ্যে বসানো। তার দুটি অংশ। নীচের অংশটি ফিক্সড়, উপরের অংশটি কার উপরে ওঠানো-নামানোর ব্যবস্থা আছে কর্ডের সাহায্যে।
ঘরের ভিতর থেকে জানলার সামনে আবার ভারী কালো পর্দা টাঙানো। সেই পর্দাও কর্ডের সাহায্যে ইচ্ছামত টেনে দেওয়া বা সরিয়ে দেওয়া যায়।
মধ্যে মধ্যে গবেষণার কাজের জন্য ডার্করুমের প্রয়োজন হত বলেই হয়তো জানলায় পর্দা দিয়ে বিনয়েন্দ্রন্দ্ৰ ঐরূপ ব্যবস্থা করে নিয়েছিলেন।
ঘরের তিন দিকেই দেওয়াল ঘেঁষে সব লোহার র্যাক, আলমারি, রেফ্রিজ, কোল্ড স্টোরেজ। নীল কুঠী আলমারি ও র্যাকে নানাজাতীয় শিশি বোতল রং-বেরংয়ের ওষুধে সব ভর্তি। কোন কোন র্যাকে ভর্তি সব মোটা মোটা রসায়ন বিজ্ঞানের বই।
গবেষণা-ঘর নয় তো, জ্ঞানী কোন তপস্বীর জ্ঞানচর্চার পাদপীঠ।
হত্যাকারী এই মন্দিরের মধ্যেও তার মৃত্যু-বীজ ছড়িয়ে যেন এর পবিত্রতাকে কলঙ্কিত করে গেছে।
কাঁচের জানলার ওদিকে বাড়ির পশ্চাৎ দিক। জানলার সামনে এসে দাঁড়ালে পশ্চাতের বাগান ও প্রবহমান গঙ্গার গৈরিক জলরাশি চোখে পড়ে।
ঘরের দুটি দরজা। দুটিই খোলা ছিল। অতএব হত্যাকারী যে কোন একটি দরজাপথেই ঘরে প্রবেশ করতে পারে। তবে বারান্দার দরজাটা সাধারণত যখন সর্বদা বন্ধই থাকত তখন মনে হয়, বিনয়েন্দ্রর শয়নঘর ও গবেষণাঘরের মধ্যবর্তী দরজাপথেই সম্ভবত হত্যাকারী ঐ ঘরে প্রবেশ করেছিল এবং হত্যা করে যাবার সময় দ্বিতীয় দরজাটা খুলে সেই পথে ঘর থেকে বের হয়ে গিয়েছে।
গবেষণাঘরের মেঝেটি সাদা ইটালীয়ান মার্বেল পাথরে তৈরী। মসৃণ চকচকে।
মৃতদেহের আশেপাশে মেঝেটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে করতে মিঃ বসাকের সহসা নজর পড়ে এক জায়গায়।
মেঝের উপরে খানিকটা অংশে যেন একটা হলদে ছোপ পড়ে আছে। মনে হয় যেন কিছু তরল জাতীয় রঙিন পদার্থ মেঝেতে পড়েছিল, পরে মুছে নেওয়া হয়েছে।
মেঝেটা দেখতে দেখতে হঠাৎ মিঃ বসাকের দৃষ্টি একটা ব্যাপারে আকর্ষিত হয়। মৃতের পা একেবারে খালি। বিনয়েন্দ্র কি খালিপায়েই গবেষণা করতেন।
রামচরণ একটি পাশে চুপটি করে দাঁড়িয়ে ছিল। তাকে মিঃ বসাক প্রশ্ন করলেন, রামচরণ, তোমার বাবু কোন স্যাণ্ডেল বা স্লিপার ব্যবহার করতেন না বাড়িতে?
হ্যাঁ, বাবুর পায়ে সর্বদা একটা সাদা রবারের স্লিপার তো থাকত।
কিন্তু তাহলে গেল কোথায় স্লিপার জোড়া?
সমস্ত ঘর তন্ন তন্ন করে ও পাশের শয়নঘরটি অনুসন্ধান করেও বিনয়েন্দ্রর নিত্যব্যবহৃত, রামচরণ-কথিত সাদা রবারের স্লিপার জোড়ার কোন পাত্তাই পাওয়া গেল না।
রামচরণ বিস্মিত কণ্ঠে বললে, আশ্চর্য! গেল কোথায় বাবুর স্লিপার জোড়া? বাবু তো এক মুহূর্তের জন্যও কখনও খালিপায়ে থাকতেন না।
সত্যি মৃত বিনয়েন্দ্রর পায়ের পাতা দেখে সেটা বুঝতে কষ্ট হয় না।
তবে স্লিপার জোড়া দেখা গেল না। এবং বাথরুম থেকে বের হয়ে আসবার মুখে আর একটি ব্যাপারে মিঃ বসাকের দৃষ্টি পড়ল, গবেষণাগারের একটি জলের সিঙ্ক।
সিঙ্কের কলটি খোলা। কলের ভোলা মুখ দিয়ে জল ঝরে চলেছে তখনও। এবং সেই জল সিঙ্কের নির্গম পাইপ দিয়ে বাইরে চলে যাচ্ছে।
ভাঙা টাইমপিস, ভোলা কল ও অপহৃত নিত্যব্যবহার্য স্লিপার, ঘরের দুটি দ্বারই খোলা এবং মেঝেতে কিসের একটা দাগ; এ ভিন্ন অন্য কোন কিছু দৃষ্টি আকর্ষণ করবার মত মিঃ বসাকের মনে লাগল না।