ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে সর্বাগ্রে তিনি ঘরের চতুর্দিকে একবার তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিটা বুলিয়ে নিলেন।
বসাক ভাবছিলেন তখন থানা-অফিসারের অনুমান যদি সত্যিই হয়, সত্যিই যদি ব্যাপারটা একটা নৃশংস হত্যাকাণ্ডই হয় তো এই ঘরের মধ্যেই সেটা গতরাত্রেই সঘটিত হয়েছে। সেক্ষেত্রে হত্যাকারী কি তার কোন দুর্বল মুহূর্তে কোন চিহ্নই আর দুষ্কৃতি রেখে যায়নি! নিশ্চয়ই গিয়েছে। আজ পর্যন্ত জগতের কোথাও এমন কোন হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় নি যার কিছু-না-কিছু চিহ্ন অকুস্থানে হত্যাকারীকে অনিচ্ছায় হোক বা অজ্ঞাতেই হোক ফেলে যেতে হয়েছে।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারিদিকে তাকাতে তাকাতে মিঃ বসাক লম্বা গবেষণার টেবিলটার সামনেই। যেখানে তখনও মৃতদেহটা ভূপতিত ছিল তার অতি নিকটে এসে দাঁড়ালেন।
মৃত্যু! তবে আত্মহত্যা, না হত্যাই সেইটাই ভাববার কথা।
মৃতের দুটি বিস্ফারিত চক্ষু–প্রাণহীন হলেও বোঝা যায় তার মধ্যে রয়েছে একট ভয়ার্ত : বিস্ময়। যেন একটা আকস্মিক জিজ্ঞাসায় সন্ত্রস্ত হয়েই সেই অবস্থাতেই থেমে গিয়েছে।
কিসের প্রশ্ন! কিসের আশঙ্কা মৃতের ঐ চোখের তারায়!
দুটি মুষ্টিবদ্ধ হাত। শেষ মুহূর্তটিতে কিছু কি আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলেন!
কোন আশ্রয়ের সন্ধানে বা কোন অবলম্বনের শেষ প্রচেষ্টায়! এখনও তাই হাত দুটি মুষ্টিবদ্ধ হয়েই আছে।
একেবারে সোজা লম্বালম্বিভাবে দেহটা চিৎ হয়ে মেঝেতে পড়ে আছে।
কিন্তু কই! দেহের মধ্যে আত্মহত্যা করবার পরের শেষ ও প্রচণ্ড আক্ষেপ কোথায়! বিষ-প্রক্রিয়ায় সাধারণত যা হয়ে থাকে।
যে বিষ আচমকা দেহান্ত ঘটায়, সে বিষ আক্ষেপও দেয় পেশীতে পেশীতে প্রচণ্ড একটা।
নীচু হয়ে মৃতদেহের পাশে বসলেন মিঃ বসাক।
ঈষৎ বিস্ফারিত নীলাভ ওষ্ঠের প্রান্ত বেয়ে ক্ষীণ একটা লালা-মিশ্রিত রক্তের ধারা কালচে হয়ে জমাট বেঁধে আছে।
দৃষ্টি আরও তীক্ষ্ণ করে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন মৃতের মুখখানি মিঃ বসাক।
দেখতে গিয়ে হঠাৎ তাঁর নজরে পড়ল নিচের ওষ্ঠটা যেন একটু ফোলা; ডান দিক এবং শুধু তাই নয় সেখানে একটা ক্ষতচিহ্নও আছে। যে ক্ষতচিহ্নে রক্ত একটু জমাট বেঁধে আছে এখনও।
কিসের ক্ষতচিহ্ন ঐ ওষ্ঠে? আর কেনই বা ক্ষতচিহ্ন? তবে কি? চিন্তা ও বিশ্লেষণ অতি দ্রুত মস্তিষ্কের কোষগুলির মধ্যে যেন বিদ্যুৎ-তরঙ্গের মত বহে যেতে থাকে।
সঙ্গে সঙ্গে একটা সম্ভাবনা মনের মধ্যে ক্রমে ক্রমে দানা বেঁধে উঠতে থাকে বসাকের।
একবারমুখ তুলেপার্শেই দণ্ডায়মান থানা-অফিসারের দিকে তাকালেন মিঃ বসাক, ওষ্ঠপ্রান্তে তাঁর জেগে ওঠে নিঃশব্দ স্মিত হাসির একটা ক্ষীণ রেখা।
পুলিস সার্জেন ডাঃ বক্সীও ইতিমধ্যে পাশে দাঁড়িয়ে দেহটা লক্ষ্য করছিলেন। মৃতের হাতের শক্ত আঙুলগুলো এবার টেনে দেখলেন ডাঃ বক্সী।
কতক্ষণ মারা গেছে বলে আপনার মনে হয় ডাঃ বক্সী? বসাক প্রশ্ন করলেন ডাক্তারকে।
তা ঘণ্টা নয়-দশ তো হবেই। মৃদু কণ্ঠে জবাব দিলেন ডাঃ বক্সী।
তাহলে রাত একটা দেড়টা নাগাদ মৃত্যু হয়েছে, এই তো?
হ্যাঁ। ঐ রকমই মনে হচ্ছে।
মৃত্যুর কারণ কী বলে মনে হচ্ছে?
মনে তো হচ্ছে a case of poisoning-ই।
অতঃপর ডাঃ বক্সী মৃতদেহটাকে উল্টে দিলেন মেঝের উপরই।
Occipital protuberence-এর ঠিক নীচেই একটি ১ X ১ ইঞ্চি পরিমাণ একিমোসিসের চিহ্ন। হাত দিয়ে পরীক্ষা করে দেখলেন ডাঃ বক্সী। তারপর মৃদু অনুচ্চারিত কণ্ঠে মিঃ বসাককে সম্বোধন করে বললেন, শুধু একিমোসিসই নয় মিঃ বসাক, ল্যাসারেসনও আছে। আর মনে হচ্ছে base of the skull-এর ফ্র্যাকচারও সম্ভবত আছে! আমার তো মনে হচ্ছে বেশ ভারি ও শক্ত কিছু যেমন ধরুন কোন লোহার রড জাতীয় জিনিস দিয়েই ঘাড়ে আঘাত করা হয়েছিল। এখন কথা হচ্ছে—
কী? মিঃ বসাক ডাঃ বক্সীর মুখের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন।
ঐ আঘাতটাই primary cause of death, না poison-ই primary এবং আঘাতটা secondary—এইটাই এখন ভাববার বিষয়।
আমার কিন্তু মনে হচ্ছে থানা-অফিসার রামানন্দবাবুর অনুমানই ঠিক। পরিষ্কার এটা একটা হত্যাকাণ্ড। এবং আঘাতটা primary, আর secondary হচ্ছে poison। এখন কথা হচ্ছে হত্যাকারী প্রথমে মারাত্মক আঘাত হেনে পরে আরও sure হবার জন্য poison-এর ব্যবহার করেছিল, না হত্যা করে পরে poison দিয়েছিল ব্যাপারটাকে সম্পূর্ণ একটা অন্য light দেবার জন্য
মানে, বলতে চাইছেন অন্যের চোখে ব্যাপারটাকে আত্মহত্যা বোঝাবার জন্য, তাই তো?
ঠিক তাই।
কিন্তু কেন আপনার সে কথা মনে হচ্ছে বলুন তো মিঃ বসাক। ডাঃ বক্সী প্রশ্ন করলেন।
চেয়ে দেখুন ভাল করে, মৃতের নীচের ওষ্ঠে ক্ষতচিহ্ন রয়েছে, এবং শুধু ক্ষতচিহ্নই নয়, জায়গাটা একটু ফুলেও আছে। তাতে করে কি মনে করতে পারি না আমরা যে, হয়তো কোন আঘাত দিয়ে অজ্ঞান করবার পর ব্যাপারটাকে আত্মহত্যার light দেবার জন্যই metal tube বা ঐ জাতীয় কোন কিছুর সাহায্য মুখের মধ্যে বিষ ঢেলে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ যার দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে এটা pure simple case of homicide নৃশংস হত্যা, আত্মহত্যা আদৌ নয়।
এবারে ডাঃ বক্সী একটু বিশেষ দৃষ্টি দিয়েই মৃতের ওষ্ঠটা আবার পরীক্ষা করলেন, তারপর বললেন, সত্যিই তো, আপনার অনুমান হয়তো মিথ্যা নাও হতে পারে মিঃ বসাক। আমার মনে হচ্ছে, you are right। হ্যাঁ, আপনিই হয়তো ঠিক।