নীলকুঠীতে লোকজনের মধ্যে এ বাড়ির পুরাতন ভৃত্য প্রৌঢ় রামচরণ, পাচক লছমন, বয়স তার ত্রিশ-বত্রিশের মধ্যে বছর দুই হল এখানে চাকরিতে লেগেছে। আর একজন ভৃত্য বাইরের যাবতীয় বাজার ও ফাইফরমাস খাটবার জন্য, নাম রেবতী। পূর্ববঙ্গে বাড়ি। বয়েস ত্রিশ-বত্রিশইহবে। বছর পাঁচেক হল এ বাড়িতে কাজ করছে। দারোয়ান নেপালী ধনবাহাদুর থাপা। সেও এ বাড়িতে প্রায় বছর ছয়েক আছে। আর সোফার ও ক্লীনার করালী। করালী এ বাড়িতে কাজে লেগেছে বছরখানেক মাত্র। তার আগে যে ড্রাইভার ছিল গাড়িতে অ্যাক্সিডেন্ট করে এখন হাজতবাস করছে বছর দেড়েক ধরে।
বিরাট নীলকুঠী। ত্রিতল। তিনতলায় দুখানা ঘর, দোতলায় সাতখানা ও একতলায় ছখানা ঘর। এছাড়া বাড়ির সামনে অনেকখানি জায়গা জুড়ে ফুলের বাগান। একধারে গ্যারেজ ও দারোয়ানদের থাকার ঘর।
গ্যারেজটা মস্ত বড়। এককালে সেখানে তিনটি জুড়ি গাড়ি ও চারটে ওয়েলার ঘোড়া থাকত।
অনাদি চক্রবর্তীর মৃত্যুর বছরখানেক বাদেই শেষ গাড়িখানা ও শেষ দুটি ঘোড়া বিক্রয় করে দিয়ে, সহিস ও কোচওয়ানকে তুলে দিয়ে মস্ত একটা ফোর্ড গাড়ি কিনেছিলেন বিনয়েন্দ্র।
মোটরগাড়িটা অবিশ্যি কেনা পর্যন্তই।
কারণ বেশীর ভাগ সময়েই গ্যারেজে পড়ে থাকত, কচিৎ কখনও বিনয়েন্দ্র গাড়িতে চেপে বের হতেন। ড্রাইভার বসে বসেই মোটা মাইনে পেত। বাড়ির পশ্চাৎ দিকেও মস্ত বড় বাগান, চারিদিকে তার একমানুষ সমান উঁচু লোহার রেলিং দেওয়া প্রাচীর। তারই ঠিক নীচে প্রবহমাণ জাহ্নবী। একটা বাঁধানো প্রশস্ত ঘাটও আছে চক্রবর্তীদেরই তৈরী তাদের নিজস্ব ব্যবহারের জন্য।
ঘাটের গায়েই একটা লোহার গেট। তবে গেটটা সদাসর্বদা বন্ধই থাকে। একদা ঐ পশ্চাৎ দিককার বাগানে অত্যন্ত সমারোহ ছিল, এখন অযত্নে ও অবহেলায় ঘন আগাছায় ভরে গেছে।
রামচরণ, রেবতী, লছমন ও করালী সকলেই খানতিনেক ঘর নিয়ে বাড়ির নীচের তলাতেই থাকে।
নীলকুঠীতে ঐ চারজন লোক থাকলেও বিনয়েন্দ্রর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল একমাত্র রামচরণেরই। অন্যান্য সকলের সঙ্গে বাবুর দেখাসাক্ষাৎ কচিৎ কখনও হত। তবে মাইনেপত্র নিয়মিত সকলে মাসের প্রথমেই বাড়ির পুরাতন সরকার প্রতুলবাবুর হাত দিয়েই পেত।
প্রতুলবাবু নীলকুঠীতে থাকতেন না। ঐ অঞ্চলেই কাছাকাছি একটা বাসা নিয়ে গত তের বৎসর ধরে পরিবার নিয়ে আছেন। অনাদি চক্রবর্তীর আমল থেকেই নাকি ঐ ব্যবস্থা বহাল ছিল। বিনয়েন্দ্র তার কোন অদলবদল করেননি তাঁর আমলেও।
প্রত্যহ সকালবেলা একবার প্রতুলবাবু নীলকুঠীতে আসতেন। বেলা দশটা সাড়ে দশটা নাগাদ চলে যেতেন, তারপর আবার আসতেন গোটা পাঁচেকের সময়, যেতেন সেই রাত নটায়।
অনাদি চক্রবর্তীর আমলে অনেক কাজই প্রতুলবাবুকে করতে হত, অনেক কিছুরই দেখাশোনা করতে হত, কিন্তু বিনয়েন্দ্র আসার পর ক্রমে ক্রমে তার দায়িত্ব ও কাজগুলো নিজেই তিনি নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন।
গতকাল প্রতুলবাবু উত্তরপাড়ায় ছিলেন না, তাঁর এক ভাইঝির বিবাহে দিনচারেকের জন্য শ্যামনগর গিয়েছেন।
ভৃত্য, পাচক, সোফার ও দারোয়ান কাউকেই জিজ্ঞাসা করে এমন কোন কিছু জানতে : পারা যায়নি, যা বিনয়েন্দ্রর মৃত্যু-ব্যাপারে আলোকসম্পাৎ করতে পারে।
মিঃ বসাক শুধু একাই আসেন নি, তিনি আসবার সময় সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন পুলিস সার্জেন ডাঃ বক্সিকেও।
থানা-ইনচার্জ রামানন্দবাবুও ওঁদের দেখে উঠে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা জানালেন।
চলুন। কোন্ ঘরে মৃতদেহ আছে, একবার দেখে আসা যাক।
.
০৯.
মিঃ বসাক সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বললেন, ব্যাপারটা আপনার তাহলে সুইসাইড নয়, হোমিসাইড বলেই মনে হচ্ছে?
হ্যাঁ স্যার।
মাথার নীচে ঘাড়ে abbression ছাড়া অন্য কিছু কি দেখতে পেয়েছেন, যাতে করে আপনার মনে হয়েছে ব্যাপারটা হোমিসাইড?
হ্যাঁ, আরও একটা কারণ আছে স্যার।
কি?
মৃতদেহ দেখেই অবশ্য বোঝা যায়, যে, বিষই মৃত্যুর কারণ এবং মৃতদেহের পাশে যে গ্লাস-বিকারটি পাওয়া গেছে, সেটার যে অবশিষ্টাংশ তরল পদার্থ এখনও বর্তমান আছে, সেটার chemical analysis হলে হয়তো সেটাও বিষই প্রমাণিত হবে, রামানন্দবাবুবললেন।
বসাক বললেন, কিন্তু বিষই যদি তিনি খেয়ে আত্মহত্যা করবেন, তাহলে মেঝেতে শুয়ে খেলেন কেন? তারপর ঘড়িটা ভাঙা অবস্থায় বা পাওয়া গেল কেন? বরং আমার যেন সব শুনে মনে হচ্ছে তাঁকে কেউ অতর্কিতে প্রথমে পিছন দিক থেকে কোন ভারি বস্তু দিয়ে আঘাত করে, তারপর হয়তো বিষ প্রয়োগ করেছে অজ্ঞান অবস্থায়। আরও একটা কথা, ভেবে দেখেছেন কি ঘরের দরজা খোলাই ছিল! অথচ দেখা যায় আত্মহত্যার সময় সাধারণ লোক দরজা বন্ধ করেই রাখে।
থানা-অফিসার রামানন্দ সেনের কথার জবাবে মিঃ বসাক কোন সাড়া দিলেন না বা। কোনরূপ মন্তব্য করলেন না।
ল্যাবরেটরী ঘরের দরজায় থানা-অফিসার ইতিমধ্যে তালা লাগিয়ে রেখেছিলেন। চাবি তাঁর কাছেই ছিল।
ঘরের তালা খুলে সকলে গিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলেন।
মিঃ প্রশান্ত বসাক মাত্র বছর কয়েক পুলিস লাইনে প্রবেশ করলেও ইতিমধ্যেই তাঁর কর্মদক্ষতায় স্পেশাল ব্রাঞ্চেরইন্সপেক্টরের পদে উন্নীত হয়েছিলেন। বয়স তাঁর বত্রিশ-তেত্রিশের মধ্যে হলেও ঐ ধরনের জটিল সব কেসে অদ্ভুত ও আশ্চর্য রকমের ঘটনা বিশ্লেষণের ন্যাক ছিল তাঁর।