- বইয়ের নামঃ নীলকুঠি
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
০১-০৫. রজত আর সুজাতা
দেখা হয়ে গেল দুজনের। রজত আর সুজাতার।
এতদিন পরে এমনি করে দুজনের আবার দেখা হয়ে যাবে কেউ কি ওরা ভেবেছিল! দুজনে দুদিকে যে ভাবে ছিটকে পড়েছিল, তারপর আবার কোন দিন যে দেখা হবে, তাও এক বিচিত্র পরিস্থিতির মধ্যে, ব্যাপারটা দুজনের কাছেই ছিল সত্যি স্বপ্নতীত।
তবু দেখা হল দুজনের। রজত আর সুজাতার।
দুজনের একজন আসছিল লাহোর থেকে। অন্যজন লক্ষ্ণৌ থেকে। এবং দুজনেরই কলকাতায় আগমনের কারণ হচ্ছে একই লোকের কাছ থেকে পাওয়া দুখানা চিঠি।
আরও আশ্চর্য, যখন ওরা জানতে পারল একই দিনে নাকি দুজনে এই চিঠি দুখানা পেয়েছে।
.
একই তারিখে লেখা দুখানা চিঠি। এবং একই কথা অত্যন্ত সংক্ষিপ্তভাবে দুখানা চিঠিতে লেখা। আর সেই চিঠি পেয়েই লক্ষ্ণৌ থেকে সুজাতা ও লাহোর থেকে রজত একই দিনে রওনা হয়ে এক ঘণ্টা আগে-পিছে হাওড়া স্টেশনে এসে নামল।
পরবর্তী উত্তরপাড়া যাবার লোকাল ট্রেনটা ছিল ঘণ্টা দেড়েক পরে। দুজনের সঙ্গে সাক্ষাত হয়ে গেল তাই হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফরমের উপরেই।
এ কি, সুজাতা না! রজত প্রশ্ন করে বিস্ময়ে।
কে, ছোড়দা! সুজাতাও পাল্টা বিস্ময়ের সঙ্গে প্রশ্নটা করে।
কোথায় যাচ্ছিস? লক্ষৌ থেকেই আসছিস নাকি?
হ্যাঁ, উত্তরপাড়া। ছোট্রকার একটা জরুরী চিঠি পেয়ে আসছি।
আশ্চর্য! আমিও তো ছোট্রকার জরুরী চিঠি পেয়েই উত্তরপাড়ায় যাচ্ছি। জবাবে বলে রজত।
রজত ও সুজাতা জ্যেঠতুত ও খুড়তুত ভাই-বোন। একজন থাকে লাহোরে, অন্যজন লক্ষৌতে। প্রায় দীর্ঘ পাঁচ বছর পরে ভাই-বোনে সাক্ষাৎ।
এদিকে ট্রেন ছাড়বার শেষ ঘণ্টা তখন বাজতে শুরু করেছে। তাড়াতাড়ি দুজনে সামনের লোকাল ট্রেনটায় উঠে বসল।
শীতের বেলা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। বেলা সবে সাড়ে চারটে হলেও, বাইরের আলো ইতিমধ্যেই ঝিমিয়ে এসেছে।
ইতিমধ্যেই অফিস-ফেরতা নিত্যকার কেরানী যাত্রীদের ভিড় শুরু হয়ে গেছে ট্রেনে। ট্রেনের কামরায় ঠেলাঠেসি গাদাগাদি। সেকেণ্ড ক্লাস কামরায় ভিড় থাকলেও ততটা ভিড় নেই। একটা বেঞ্চের একধারে ওরা কোনমতে একটু জায়গা করে নিয়ে গায়ে গা দিয়ে বসে পড়ল।
.
দুজনেই ভাবছিল বোধ হয় একই কথা।
ছোটকাকা বিনয়েন্দ্রর জরুরী চিঠি পেয়ে দুজনে, একজন লাহোর থেকে অন্যজন লক্ষৌ থেকে আসছে উত্তরপাড়ায় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। জরুরী চিঠি পেয়ে আসছে ওরা কিন্তু তখনো জানে না কী ব্যাপারে জরুরী চিঠি দিয়ে তাদের আসতে বলা হয়েছে। অথচ গত দশ বছর ধরে তাদের ওই কাকা বিনয়েন্দ্র, যদিও আপনার কাকা, তাঁর সঙ্গে ওদের কোন সম্পর্কই ছিল না।
দেখা-সাক্ষাৎ বা মুখের আলাপে কুশল প্রশ্ন পর্যন্ত দূরের কথা, গত দশ বছর পরস্পরের মধ্যে ওদের কোন পত্র বিনিময় পর্যন্ত হয়নি। ওরাও সত্যি কথা বলতে কি ভুলেই গিয়েছিল যে, ওদের একজন আপনার কাকা এ সংসারে কেউ এখনো আছেন!
সেই কাকার কাছ থেকে জরুরী চিঠি। অত্যন্ত জরুরী তাগিদ, পত্র পাওয়ামাত্র যেন চলে আসে ওরা উত্তরপাড়ায়। ইতি অনুতপ্ত ছোট্কা। চিঠির মধ্যে কেবল এতকাল পরে আসবার জন্য এই জরুরী তাগিদটুকু থাকলেই ওরা এভাবে চিঠি পাওয়ামাত্রই চলে আসতে কিনা সন্দেহ। আরও কিছু ছিল সেই সংক্ষিপ্ত চিঠির মধ্যে যেটা গুরুত্বের দিক দিয়ে ওরা অস্বীকার করতে পারেনি। এবং যে কারণে ওরা চিঠি পাওয়ামাত্রই না এসেও পারেনি।
কল্যাণীয়েষু রজত,
আমার আর বেশী দিন নেই। স্পষ্ট বুঝতে পারছি মৃত্যু আমার একেবারে সন্নিকটে এসে দাঁড়িয়েছে। তার হাত থেকে আর আমার কোন মতেই নিস্তার নেই। দাদুর প্রেতাত্মার চেষ্টা এতদিনে বোধ হয় সফল হবেই বুঝেতে পারছি। আগে কেবল মধ্যে মধ্যে রাতের বেলা তাকে দেখতাম, এখন যেন তাকে দিনে রাত্রে সব সময়ই দেখতে পাচ্ছি। সেই প্রেত-ছায়া এবারে বোধ হয় আর আমাকে নিস্তার দেবে না। এতকাল যে কেন তোমার সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখিনি যাবার আগে অন্তত সে কথাটা তোমাকে জানিয়ে যদি না যাই এবং আমার যা কিছু তোমার হাতে তুলে না দিয়ে যেতে পারি তবে মরণের পরেও হয়তো আমার মুক্তি মিলবে না। তাই আমার শেষ অনুরোধ এই চিঠি পাওয়ামাত্রই রওনা হবে।
ইতি আশীবাদক, অনুতপ্ত, ভাগ্যহীন, তোমার ছোকা।
সুজাতার চিঠিতেও অক্ষরে অক্ষরে একই কথা লেখা। কেবল কল্যাণীয়েষু রজতের জায়গায় লেখা, কল্যাণীয়া মা সুজাতা।
তাই যত মন-কষাকষিই থাক, দীর্ঘদিনের সম্পর্কহীন এবং ছাড়াছাড়ি থাকা সত্ত্বেও রজত বা সুজাতা কেউই তাদের ছোট্কা বিনয়েন্দ্রর ওই চিঠি পড়ে রওনা না হয়ে পারেনি।
গত দশ বছরই না হয় ছোট্কার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নেই কিন্তু এমন একদিন তো ছিল যখন ওই ছোটকাই ছিল ওদের বাড়ির মধ্যে সবার প্রিয়। যত কিছু আদর আবদার ছিল ওদের ঐ ছোট্রকার কাছেই।
সেজন্য রজতের মাও কম তো বলেননি ওদের ছোট্কাকে।
প্রত্যুত্তরে হোটকা হেসেছেন শুধু ওদের দুজনকে পরম স্নেহে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে।
ছোট্রকার ওরা দুজনেই যে ছিল বাড়ির মধ্যে একমাত্র সঙ্গী সাথী। হাসতে হাসতে ছোেটা রজতের মাকে সম্বোধন করে বলেছেন, না না, ওদের তুমি অমন করে বোলো না।
রজতের মা জবাবে বলেছেন, না, বলবে না! আদর দিয়ে দিয়ে ওদের মাথা দুটো যে চিবিয়ে খাচ্ছ। দুটিই সমান ধিঙ্গি হয়েছে, লেখাপড়ার নামে ঘণ্টা। কেবল ছোটকা এটা দাও,ছোট্কা ওটা দাও, এটা করো ছোটকা, ওটা করো।