কে যেন উঠে আসছে-কান্ত শিথিল পদবিক্ষেপে।
আরে ওই তো সমীরণদা—এ কি সমীরণদা, আপনি ম্যাড্রাস যাননি?
সুদৰ্শন তাকিয়েছিল আগুন্তুকের মুখের দিকে। সিঁড়ির আলোটা শক্তিশালী না হলেও স্পষ্টই, সব কিছু দেখা যায়।
বছর তেত্রিশ-চৌত্ৰিশ হবে সমীরণ দত্তর বয়সী।
রোগা, লম্বা এবং যাকে বলে রীতিমত সুশ্ৰী চেহারা সমীরণ দত্তর।
পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি-মাথার চুল তৈলহীন রুক্ষ এবং কিছুটা এলোমেলো।
তীক্ষ্ণ নাসা—সুন্দর দুটি চক্ষু।
চোখে চশমা।
তার হাতে কালো রংয়ের একটা সুটকেস, মাঝারি সাইজের। দেবজ্যোতির পাশে সম্পূর্ণ অপরিচিত সুদৰ্শনকে দেখে সমীরণ দত্ত হঠাৎ যেন থমকে সিঁড়ির মাঝপথেই একটা ধাপের উপর দাঁড়িয়ে ছিল।
দেবজ্যোতি বললে, আমি তো ভেবেছিলাম। এতক্ষণে আপনি ম্যাড্রাস পৌঁছে গিয়েছেন প্লেনে। এই যে এই ভদ্রলোক, আপনাকে খুঁজছিলেন।
পাশেই দন্ডায়মান সুদৰ্শনকে দেখিয়ে দিল দেবজ্যোতি।
সমীরণের দিক থেকে কিন্তু কোন সাড়া এল না, সে যেন কেমন বোবার মতই দাঁড়িয়ে আছে তখনো।
০৫. কয়েকটা স্তব্ধ মুহূর্ত
সমীরণ তাকিয়ে আছে। সুদর্শনের মুখের দিকে। আর সুদৰ্শন তাকিয়ে আছে। সমীরণের মুখের দিকে। দুজনে যেন দুজনের সমস্ত দৃষ্টি দিয়ে পরস্পরকে যাচাই করছে।
দেবজ্যোতি কিন্তু দাঁড়িয়ে ছিল না। তার কথাটা শেষ করেই সে তাদের ফ্ল্যাটে ঢুকে গিয়েছিল।
সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে সুদৰ্শন আর ধাপ-পাঁচেক নীচে সুটকেসটা হাতে ঝুলিয়ে প্রস্তর মূর্তির মত দাঁড়িয়ে তখনো সমীরণ দত্ত।
স্তব্ধতা ভঙ্গ করল। সুদর্শনই। মৃদু হেসে বললে, আসুন সমীরণবাবু-আপনার কাছেই আমি এসেছিলাম—আমার নাম সুদৰ্শন মল্লিক। এসে শুনি আপনি ম্যাড্রাস চলে গিয়েছেন–
ম্যাড্রাস?
হ্যাঁ-দেবজ্যোতিবাবু বললেন—
সমীরণ দত্ত উঠতে শুরু করেছে তখন সিঁড়ি দিয়ে আবার। সিঁড়িগুলি অতিক্রম করে উপরে এসে মুখোমুখি হয়ে বলে, দেবজ্যোতি ভুল করেছে—
ভুল?
হ্যাঁ—আমার বোম্বাই যাওয়ার কথা ছিল ম্যাড্রাস নয়—
তা গেলেন না?
সুটকেসটা একপাশে নামিয়ে রেখে পকেট থেকে চাবি বের করে দরজার তলাটা খুলতে খুলতে সমীরণ বললে, না—প্লেনটা মিস করলাম—আসুন—
সমীরণের আহ্বানে সুদৰ্শন ঘরের মধ্যে পা দিল।
ঘরটা অন্ধকার ছিল, সমীরণ সুইচ টিপে ঘরের আলোটা জ্বেলে দেয়।
ঘরটা আকারে বেশ বড়ই। মেঝেতে যদিও কাপেট পাতা কিন্তু কাপেটটায় যে অনেকদিন বঁটা পড়েনি সেটা বুঝতে কষ্ট হয় না। একদিকে একটা হারমোনিয়াম, তার পাশে বাঁয়া তবলা—একরাশ স্বরলিপির বই—গানের বই-খাতা-পেন্সিল, পানের ডিবে, পিকদানি অ্যাশট্রে—, রেকর্ড—সব ছত্রাকার হয়ে পড়ে আছে।
ঘরের দেওয়াল ঘেঁষে কয়েকটি সোফা। তার পাশে একটা ভাসে কিছু শুকনো গোলাপ।
দেওয়ালে বড় বড় সব গাইয়েদের ফটো।
মধ্যিখানে রবীন্দ্রনাথের ছবি।–
সব কিছুর মধ্যেই যেন একটা অযত্ন—এলোমেলো বিশৃঙ্খলতা।
সমীরণ দত্ত সুদৰ্শনকে বললে—বসুন।
কথাটা বলে মধ্যবর্তী একটা দরজা ঠেলে পাশের ঘরে গিয়ে ঢুকল এবং একটু পরে সুটকেসটা সেই ঘরে রেখে বের হয়ে এল আবার।
আপনি বললেন আপনার নাম সুদৰ্শন মল্লিক-আপনাকে তো আমি চিনতে পারলাম না! আমার কাছে কি কিছু প্রয়োজন ছিল?
হ্যাঁ–বসুন না।
সমীরণ কিন্তু বসল না। সুদর্শনের মনে হচ্ছিল সমীরণ দত্ত যেন তাকে দেখা অবধি একটু বিব্রতই বোধ করছে। কেমন যেন একটু অস্থির—চঞ্চল।
বসুন সমীরণবাবু–
সমীরণ বসল। পাশের সোফায়।
সমীরণবাবু—আপনাকে আমার আসল পরিচয়টা ও আসার উদ্দেশ্যটা খুলে বলছি–
সমীরণ চেয়ে আছে। সুদর্শনের দিকে!
আমি স্পেশাল ব্রাঞ্চ থেকে আসছি—
কেন?
আপনাকে আমার কিছু প্রশ্ন করার আছে।
কেন?
হ্যাঁ—আপনি বিজিতা ঘোষালকে চিনতেন?
হঠাৎ যেন নামটা শুনে সুদর্শনের মনে হল সমীরণ কেমন একটু চমকে উঠল।
আপনি তাঁকে চিনতেন, মানে অনেকদিন, তাঁর বিবাহের আগে থেকেই, তাই না?
হ্যাঁ।
আপনি বোধ হয় একটা সংবাদ এখনো পাননি!
কি সংবাদ? সমীরণ যেন অতি কষ্টে কথাটা উচ্চারণ করল।
আজ দুপুরে তাঁকে এবং তঁর কন্যা রুণুকে সি. আই, টির ফ্ল্যাটে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে।
সে কি? কে বললে?
মৃত বললেই সবটুকু বলা হবে না। দে হ্যােভ বীন ব্রটালি মার্ডারড্—নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে তাদের–
নৃশংসভাবে হত্যা!
হ্যাঁ—আর সেই ব্যাপারেই কয়েকটা প্রশ্ন করতে এসেছি আপনার কাছে।
আমি—
আপনি তো ওদের দুজনেরই বন্ধু ছিলেন। ওদের দুজনকেই ভাল করে জানবার ও চিনবার সুযোগ হয়েছিল। আপনার। তাই—
অতঃপর সুদর্শণ সমস্ত দুর্ঘটনাটা আনুপুর্বিক বলে গেল।
সমীরণ স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ যেন বসে থাকে।
মণিশঙ্কর কোথায় এখন? কেমন যেন মিনমিনে গলায় প্রশ্ন করলে সমীরণ একটু পরে।
কাছেই আছেন তিনি-কালিকা বোর্ডিংয়ে।
আপনি বলছেন যখন ব্যাপারটা ঘটে তখন সে অফিসে ছিল?
হ্যাঁ-ফোনে সংবাদ পেয়ে এসে দেখতে পায়—
সে কিছুই জানে না?
না। অন্তত তাই তো তিনি বললেন।
কিছু অনুমানও করতে পারেনি?
না।
ও!
ওকথা বলছেন কেন সমীরণবাবু? আপনি কি কাউকে সন্দেহ করেন?
আমি!
হ্যাঁ।
আমি কাকে সন্দেহ করব? তাছাড়া ইদানীং মাসকয়েক তাদের সঙ্গে আমার একদম দেখাসাক্ষাৎও হয়নি।
কাজে ব্যস্ত থাকার দরুনই বোধ হয়?
সমীরণ হাসল মৃদু। বললে, না—
তবে?
মণি পছন্দ করত না।
কি পছন্দ করত না-আপনাদের মেলামেশা?
হ্যাঁ-বিজিতার উপর সেজন্য সে টরচারও করত।
কি ধরনের টরচার?