সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতেই নজরে পড়ল ঘরের দরজা খোলা। ঝুলন্ত পর্দার ওদিক থেকে আলোর আভাস আসছে—তারপরই একটা পরিচিত গলার স্বর কানে ভেসে আসতেই সুদৰ্শন হঠাৎ যেন খুশি হয়ে ওঠে।
সঙ্গে সঙ্গে পর্দা তুলে ঘরে পা দেয়।
দাদা! কতক্ষণ?
সুদৰ্শনের দিকে ফিরে কিরীটী বলে, তা ভায়া ঘণ্টাদেড়েক তো হবেই। ভাবছিলাম এবারে উঠব-তোমার সঙ্গে বুঝি দেখাই হল না।
সাবিত্রী উঠে পড়েছে ততক্ষণে। স্বামী সুদর্শনের দিকে তাকিয়ে সাবিত্রী বললে, চা খেয়েছ? নিশ্চয়ই চা খাওয়া হয়নি—
সুদৰ্শন হেসে বলে, না—সময়ই পাইনি—
জানতাম আমি। দাদা, আপনিও খাবেন তো?
কিরীটী মৃদু হেসে বলে, তোমার দাদার চায়ে যে অরুচি নেই তা তো তুমি জান সাবিত্ৰী!
সাবিত্রী ভিতরের ঘরে চলে গেল।
সত্যি মেয়েটি বড় ভাল—তাই না সুদৰ্শন? কিরীটী মৃদু হেসে বলে।
সুদৰ্শন বললে, সত্যিই জহুরী আপনি দাদা—
স্বীকার করছ? কিরীটি হাসতে হাসতে বললে।
একবার কেন, হাজারবার স্বীকার করব।
আমার সঙ্গে গল্প করছিল বটে, সাবিত্রীর কিন্তু মনটা পড়ে ছিল সর্বক্ষণ দরজার দিকে–মাঝখানে একবার ঘুরে গেলেই তো পার!
আসি দাদা—নেহাত কাজে আটকে না পড়লে। আজ এক জোড়া খুনের ব্যাপারে এমন জড়িয়ে পড়লাম যে—
আরে ভায়া তোমার চাকরিই তো খুনজখম রাহাজানি নিয়ে—
তা জানি দাদা। কিন্তু আজকের ব্যাপারটা এমন নৃশংস, এমনি বীভৎস যে—মনটা যেন কেমন হয়ে গিয়েছে।
তাই নাকি! তা জোড়া খুন হল কোথায়?
খুন হয়েছে বেলেঘাটা অঞ্চলে দিনের বেলা—একেবারে ভরদুপুরে। ত্রিশ-একত্রিশ বছরের একটি সুন্দরী মেয়ে আর তার ফুলের মত বছর চারেকের বাচ্চাটা—মানুষ যে এত নিষ্ঠুর কি করে হয়—
ভালবাসার উল্টোদিকেই তো নিষ্ঠুরতা। —মানবচরিত্রের আলো অন্ধকার দুটি দিক।
জানি দাদা। তবু এক-এক সময় মনে হয় এটা কেমন করে সম্ভব হয় মানুষের পক্ষে!
আসল ব্যাপারটা কি জান ভায়া, প্রত্যেক মানুষের ভিতরেই পশুবৃত্তি থাকে। ভালবাসা, স্নেহ, মমতা—সেই পশুবৃত্তিটাকে একটা পোশাক পরিয়ে চাপা দিয়ে রাখে। কিন্তু সব সময় তা সম্ভব হয় না-আর যখন সম্ভব হয় না। তখনই তার শিক্ষা কৃষ্টি রুচি সরে গিয়ে তার মুখোশটা হঠাৎ খুলে যায়—ভিতরের পশুটা বের হয়ে আসে নখদন্ত বিস্তার করে কুটিল হিংস্র হয়ে। আমরা চমকে উঠি তখন। কিন্তু সেটা মনুষ্য-চরিত্রের আলোর, অন্য দিক যে স্বাভাবিক অন্ধকার—সেটা ভুলে যাই।
সাবিত্রী ঐ সময় দু’কাপ চা নিয়ে এসে ঘরে ঢুকল।
চায়ের কাপটা তুলে নিয়ে চুমুক দিতে দিতে সুদৰ্শন বলে, আপনাকে বলতে ইচ্ছা করছে ঘটনাটা দাদা। কিন্তু সাবিত্রী ঐ সব সহ্য করতে পারে না।
কিরীটী হেসে বলে, তা না সহ্য করতে পারলে হবে কেন? পুলিস অফিসারের বেী হয়েছে। যখন-সত্যি সাবিত্রী—এ কিন্তু অন্যায় তোমার—
বাঃ, আমি কখনও কিছু বলেছি নাকি? সাবিত্রী বললে।
না। মুখে বলোনি বটে। কিন্তু তোমার মুখের চেহারা যা হয়—আমার মায়া লাগে।— সুদৰ্শন বললে।
না, না—সুদৰ্শন। তুমি বলবে সাবিত্রীকে সব কথা। হয়ত দেখবে ওর অনেক পরামর্শ তোমার অনেক কাজে লাগবে—জান না তো মেয়েদের একটা বিচিত্র তৃতীয় নয়ন আছে। তুমি বল, আমরা শুনি আজকের ঘটনা।
শুনবেন?
নিশ্চয়ই, বল।
সুদৰ্শন সাবিত্রীর মুখের দিকে তাকাল। সাবিত্রী বললে, কি হয়েছে?
কিরীটী বলে, কোথায় নাকি জোড়া খুন হয়েছে–
জোড়া খুন!
হ্যাঁ।
সুদৰ্শন তখন সংক্ষেপে ঐদিনকার ঘটনোটা আনুপূর্বিক বিবৃত করে যায়। কিরীটী একটা চুরুটে অগ্নিসংযোগ করে নিঃশব্দে বসে শোনে ধূমপান করতে করতে।
সাবিত্রী বলে, কি নিষ্ঠুর।
কিন্তু সাবিত্রী, কিরীটী বলে, তোমার কি মনে হয় বল তো? মা ও মেয়েকে কে খুন করল—আর কেনই বা খুন হল? মানে খুনের সম্ভাব্য কারণ কি হতে পারে?
জানি না দাদা–
ব্যাপারটা বোধ হয় খুব একটা জটিল নয়—কিন্তু এবারে উঠব ভায়া। কিরীটী উঠে দাঁড়াল।
এখুনি যাবেন দাদা?
হ্যাঁ-রাত প্রায় পৌনে নটা হল।
চলুন আমাকেও একবার ওদিকে যেতে হবে। সুদর্শনও উঠে দাঁড়ায়।
কোথাও যাবে?
ভাবছি। একবার মনোহরপুকুর রোডে যাব।
সমীরণ দত্তর ওখানে?
হ্যাঁ-সাবিত্রী, দরজাটা বন্ধ করে দাও। দুখনকে দেখছি না—কোথায় গেল?
দুখন তো বিকেলে বের হয়েছে তার এক দেশওয়ালী ভাইয়ের সঙ্গে—এখনো ফেরেনি। তুমি যাও না—সরলা তো আছে— ·
সাবিত্রীর কথা শেষ হল না, দুখন এসে ঠিক ঐ সময় ঘরে ঢুকল।
কিরে, এত দেরী হল তোর? সাবিত্রী শুধায়।
বছর কুড়ি বয়স হবে দুখনের। বেশ তাগড়াই চেহারা। পুলিসের চাকরির লোভে কলকাতায় তার কনস্টেবল কাকার কাছে এসেছিল, কিন্তু এখনো কোন সুবিধা না হওয়ায় তার কাকা রামনারায়ণের সুপারিশে সুদৰ্শন তাকে তার গৃহে স্থান দিয়েছে।
বাসন মাজা, ঘর বঁটি দেওয়া, ছোট কাজ ইত্যাদি কিছু করে না—তবে বাজার-হাট করা, অন্য ফাইফরমাশ সব করে। খুব বিশ্বাসী।
দুখন বললে, কি করি, দেরি হয়ে গেল ঝগড়া করতে করতে।
সে কি রে? ঝগড়া আবার কার সঙ্গে করছিলি? সুদৰ্শন জিজ্ঞাসা করে?
আমার ভাইয়ের সঙ্গে, দেশ থেকে সে এসেছে।
কেন?
দেখুন না—নোকরি-উকরি নেই, বলে কিনা সাদী করা—আমি তা রাজী নই, ওরা রাজী করাবেই আমাকে।
তা শেষ পর্যন্ত কি ঠিক হল?
কি আবার—আগে নোকরী তারপর সাদী।
সকলেই হাসতে থাকে।
রাস্তায় বের হয়ে সুদৰ্শন কিরীটীর গাড়িতেই উঠে বসল—এবং নিজের জীপটা তার পিছনে পিছনে চলতে লাগল।