গাড়িটা নতুন না পুরনো?
নতুন গাড়ি বলেই মনে হল হুজুর।
আর কাউকে দেখনি?
আজ্ঞে আরো দুটো ট্যাক্সিতে লোক এসেছে—তারা ব্যাঙ্কে ঢুকেছে—তারপর ব্যাঙ্ক থেকে বের হয়ে গিয়েছে।
পথে লোকজন ঐসময় ছিল না?
ছিল—তবে খুব বেশী নয়।
মকবুল!
হুজুর?
তোমরা তো অনেকদিন ধরে ঐ ফ্ল্যাটে কাজ করছ?
আজ্ঞে তা মাস তিনেক হবে
ওই বাড়ির একটা চাকরকে দেখেছ?
হ্যাঁ বাবু-শম্ভুকেও জানি।
তার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল?
হ্যাঁ-রোগা পাতলা ছেলেটা।
আজ তাকে দেখেছ?
দেখেছি।
কখন?
বেলা সাড়ে এগারটা নাগাদ, আমাদের টিফিনের কিছু আগে।
কোথায় দেখলে?
হাতে কিছু ছিল? একটা সাদা খাম ছিল বলে মনে হচ্ছে।
তাকে ফিরতে দেখনি?
না। নজরে পড়েনি।
মকবুলকে যখন জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে, মণিশঙ্করেরই ফ্ল্যাটের বাইরের ঘরে বসে একজন সেপাই বারো-তেরো বছরের একটা ক্ৰন্দনরত রোগা ছেলেকে ধরে টানতে টানতে সুদৰ্শনের সামনে নিয়ে এল।
হুজুর, ছেলেটাকে পাকাড়াও করেছি।
শম্ভু কাঁদতে কাঁদতে বললে, ওরা সব কি বলছে সেপাইরা—দোহাই হুজুর আমি কিছু জানি না।
তোর নাম শম্ভু?
আজ্ঞা শম্ভুচরণ বেরা।
বাড়ি কোথায়?
আজ্ঞা পানিপারুল—বড় পোস্টাপিস এগরা—মেদিনীপুর জিলা।
কোথায় গিয়েছিলি তুই?
আমার পিসের কাছে টালিগঞ্জে-জিজ্ঞাসা করেন না কেনে আমার বাবুকে—ঐ যে— আমি তো—পরশুই ছুটি চেয়ে রেখেছিলাম।
মণিশঙ্কর বললে, হ্যাঁ, ও আমাকে পরশু বলেছিল বটে—পিসির সঙ্গে দেখা করতে যাবে টালিগঞ্জে
তা কখন তুই গিয়েছিলি?
কেন, এগারটায়
তোর মাকে বলে গিয়েছিলি?
হ্যাঁ-মা তো বললেন যেতে–
সুদৰ্শনই আবার প্রশ্ন করে, যখন যাস দরজাটা খোলা রেখে গিয়েছিলি?
না-মা তো দরজা বন্ধ করে দিলেন, ভিতর থেকে আমার সামনেই।
তোর মা তখন কি করছিলেন?
মার তো তখনো স্নানই হয়নি।
আর খুকু?
সে তো খেলছিল। ঘরে। কি হয়েছে হুজুর—সত্যিই মা আর খুকুকে মেরে ফেলেছে!
সুদৰ্শন শম্ভুর কথার কোন জবাব দেয় না।
সে তখন মনে মনে ভাবছিল—শম্ভু এগারটায় চলে যায়। অর্থাৎ এগারটার পর থেকেফ্ল্যাটে মণিশঙ্করের স্ত্রী ও মেয়ে ছাড়া আর কেউ ছিল না-ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন মণিশঙ্করের স্ত্রী। অথচ মণিশঙ্কর ফোন পেয়ে অফিস থেকে এসে দেখে তার ফ্ল্যাটের দরজা ভেজানো এবং ঠেলতেই সেটা খুলে গেল।
সুদৰ্শন আবার প্রশ্ন করে, তুই যখন যাস তোর হাতে একটা চিঠি ছিল?
হ্যাঁ হুজুর–
ডাকে ফেলতে যাচ্ছিলি?
না।
তবে?
শম্ভু কেমন যেন ইতস্তত করে।
কিরে, কথা বলছিস না কেন?
আজ্ঞে–
চিঠিটা কার, কোথায় নিয়ে যাচ্ছিলি সেটা?
আজ্ঞে–
তোর মা দিয়েছিল চিঠিটা?
আজ্ঞে–
পোস্ট করতে?
হ্যাঁ।
সত্যি কথা বলছিস?
হ্যাঁ হুজুর।
চিঠিটা ডাকে দিয়েছিলি?
হ্যাঁ।
সুদৰ্শন আর কোন প্রশ্ন করে না।
রবীন দত্ত পাশের সোফায় বসে নীচু টেবিলের উপর কাগজপত্র রেখে রিপোর্ট লিখছিল। সে মুখ তুলে তাকাল, তাহলে ওর কি ব্যবস্থা করব স্যার?
কার, শম্ভুর?–
আপাততঃ ‘ওকে থানায় নিয়ে রাখুন। এদিককার কাজ শেষ হয়েছে। মিঃ দত্ত?
একরকম মোটামুটি-ডেড বডি দুটো মর্গে পাঠিয়ে দিতে পারলেই—, কিন্তু এ ফ্ল্যাটের কি ব্যবস্থা করব?
এটা আপাততঃ আনডার লক অ্যান্ড কী থাকবে, আর পাহারা রাখুন।
বেশ। তাহলে মিঃ ঘোষাল-দত্ত মণিশঙ্করের দিকে তাকাল।
সে অন্য একটা সোফায় বসে ওদের কথা শুনছিল। রবীন দত্তর প্রশ্নে ওর মুখের দিকে তাকাল।
আপনি তাহলে এক কাজ করুণ—
কি বলুন?
এই ফ্ল্যাটটা আপনার আপাততঃ আন্ডার লক অ্যান্ড কী ও পুলিস প্রহরায় থাকবে— আপনি আপনার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে—
সে আপনার বলবার কোন প্রয়োজন ছিল না—এরপর এখানে আমি রাত্রিবাস করতে পারব। আপনি ভাবতেই বা পারলেন কি করে? আমি এখুনি শম্ভুকে নিয়ে চলে যাব।
সুদৰ্শন বললে, ওর জন্য আপনার ভাবতে হবে না। মিঃ ঘোষাল—ও থানায় থাকবে। ওকে কি তাহলে আপনারা অ্যারেস্ট করছেন?
না।
তবে থানায় নিয়ে যাচ্ছেন?
ওকে আমাদের প্রয়োজন আছে।
ওঃ, তাহলে তো আপনাদের আশ্রয়েই থাকল!
হ্যাঁ-কিন্তু আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
আজ রাত্রের গাড়িতেই মালদায় চলে যাব।
মালদায়?
হ্যাঁ আমার এক বন্ধু সেখানে থাকে-ভাবছি ছুটি নিয়ে তার ওখানেই কিছুদিন থাকব। কিন্তু আপনাকে যে আমাদের প্রয়োজন হবেমালদার ঠিকানা রেখে যাচ্ছি, যখনই তার করে দেবেন। আমি চলে আসব।
না।
তবে?
আপনি বরং আপাততঃ কিছুদিন কলকাতাতেই থাকবার ব্যবস্থা করুন।
কলকাতায়?
হ্যাঁ।
বেশ-তাহলে আমি ভবানীপুরেই, আমার একটা পরিচিত মেস আছে—কালিকা বোর্ডিং–সেখানেই থাকব।
কোথায় বোর্ডিংটা? সুদৰ্শন শুধায়। ৩৩/১২ কালীঘাট রোড। আমি তাহলে উঠি-কিছু জিনিসপত্র নিতে হবে
যান।
মণিশঙ্কর উঠে পাশের ঘরে গেল। ইতিমধ্যে সুদর্শনেরই নির্দেশে দুটো বেডকভার দিয়ে ডেড বডি দুটো ঢেকে দেওয়া হয়েছিল।
সুদৰ্শনের চোখের ইঙ্গিত পেয়ে রবীন দত্ত মণিশঙ্করের পিছনে পিছনে যায়, নিঃশব্দে ওকে অনুসরণ করে।
মণিশঙ্কর পকেট থেকে একটা চাবির রিং বের করে স্টীলের আলমারিটা খুলে কিছু জামা-কাপড় বের করে আলমারির মাথায় যে অ্যাঢাচি কেন্সটা ছিল তার মধ্যে ভরে নিল। ও যখন ব্যস্ত তখন হঠাৎ পেছন থেকে সুদর্শনের গলা শোনা গেল।
ও যে ইতিমধ্যে রবীন দত্তর পাশে এসে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে সব কিছু দেখছিল— মণিশঙ্কর জানতেও পারেনি।
মণিশঙ্করবাবু?
অ্যাঁ—
ফিরে তাকাল মণিশঙ্কর ওদের দিকে। ওরা দুজনে এসে ততক্ষণ ঘরের মধ্যে ঢুকেছে।