একটি ফটো বিজিতা ও মণিশঙ্করের—হাসিখুশী দুটি তরুণ-তরুণী—অন্য ফটোটি তাদের একমাত্র সন্তান রুণুর।
ঘরের মেঝেতে চারিদিকে রক্তের ছিটে কালো হয়ে জমাট বেঁধে আছে।
ইতিমধ্যে থানা-অফিসার রবীন দত্ত যতটা সংবাদ মোটামুটি সংগ্রহ করতে পেরেছিল সুদৰ্শনকে বললে।
সুদৰ্শন নিঃশব্দে সব শুনে গেল।
ফ্ল্যাটে তাহলে ঐ তরুণী, ঐ বাচ্চাটা আর চাকরিটা ছাড়া কেউ ছিল না? সুদৰ্শন প্রশ্ন করে।
না। রবীন দত্ত বলে।
চাকরিটার কোন পাত্তা এখনো পাওয়া যায়নি?
না।
কতদিন কাজ করছিল। এখানে চাকরিটা?
মণিবাবু—মানে ভদ্রমহিলাটির স্বামী তো বলছিলেন, বছর কয়েক হবে চাকরাটা ওঁদের কাছে আছে।
কত বয়স?
বছর বারো-তেরো হবে!
দরজাটা তাহলে খোলাই ছিল?
হ্যাঁ—ভেজানো ছিল—মণিবাবু হাত দিয়ে ধাক্কা দিতে গেলেই খুলে যায়।
মণিশঙ্করবাবু আর কাউকেই দেখেননি?
না।
সুদৰ্শন আবার ঘরের চারিদিকে দৃষ্টিপাত করলো। দুপুরেই কোন এক সময় ঐ নিষ্ঠুর নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে অথচ কেউ জানতে পারল না!
কেউ কোনরকম আশেপাশে শব্দ, আওয়াজ বা চিৎকার শোনেনি? সুদৰ্শন আবার প্রশ্ন করে।
রবীন দত্তর প্রশ্নে সুদৰ্শন ওর মুখের দিকে তাকাল, কি?
ঐ চাকর ব্যাটারই কীর্তি। খুন করে চুরিটুরি করে পালিয়েছে দলবল নিয়ে।
কিছু চুরি গেছে কিনা জানতে পেরেছেন?
না। এখনো সব অনিশ্চিত, ভাল করে সন্ধান করা হয়নি, তবে সঙ্গে যে বাৰ্গােলরি আছে নিশ্চিত।
তাই যদি হবে তো ভদ্রমহিলার হাতে সোনার চুরি — গলায় সোনার হার কানে টাব— বাচ্চটারিও গলায় হার, হাতে বালা হয়তো থাকত না। ওগুলো না নিয়েই কি তারা যেত! সুদৰ্শন বললে।
হয়তো কেউ এসে পড়েছিল বা তাড়াহুড়াতে সময় করে উঠতে পারেনি, সঙ্গে সঙ্গে পালিয়েছে–
আমার তা যেন ঠিক মনে হচ্ছে না মিঃ দত্ত।
কিন্তু স্যার—
যে ভাবে হত্যা করা হয়েছে দুটো মানুষকে, যদি একটু চিন্তা করেন তো একটা কথা স্বভাবতই মনে হবে
কি স্যার?
ইট ইজ এ ডেলিবারেট, প্রিমেডিটেটেড মার্ডার! সুপরিকল্পিত হত্যা। এবং হত্যার জন্যই হত্যা—হত্যাকারী চুরি করতে এখানে আসেনি! এসেছিল হত্যা করতে এবং হত্যা করে চলে গিয়েছে—হয়তো কোন প্রতিহিংসাবৃত্তি চরিতার্থ করবার জন্যই হত্যা করে গিয়েছে।
প্রতিহিংসা!
সব কিছু দেখে তাই মনে হচ্ছে। হত্যার পিছনে হয়তো একটা আক্রোশ ও প্রতিহিংসার ব্যাপার জড়িয়ে আছে। তাহলেও বলবো হত্যাকারীর দুর্জয় সাহস আছে। দিনের বেলা আশেপাশে লোকজনের মধ্যে এসে হত্যা করে গিয়েছে।
আপনি বলছেন চাকরিটার সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই!
তা ঠিক বলা যায় না। হয়তো থাকতেও পারে—
নিশ্চয়ই স্যার। নচেৎ পালাবে কেন?
এমনও তো হতে পারে মিঃ দত্ত, চাকরিটা বাড়িতে ছিল না সে-সময়—হয়তো সে কোন কাজে ঐ সময় বাইরে গিয়েছিল অথবা ঐ মহিলাই তাকে কোন কাজে কোথাও পাঠিয়েছিলেন আর ঐ সময়ই হত্যাকারী আসে। দরজায় ধাক্কার শব্দ পেয়ে ভদ্রমহিলা গিয়ে দরজা খুলে দেন-তারপর হত্যাকারী তার কাজ শেষ করে চলে যাবার পর হয়তো চাকরিটা ফিরে আসে এবং ঘরে ঢুকে ঐ দৃশ্য দেখে ভয়ে পালিয়েছে।
সে তো থানায় একটা খবরও দিতে পারত!
একটা বারো-তেরো বছরের ছেলের ঐ দৃশ্য দেখে মাথা ঠিক রাখা সাধারণতঃ সম্ভব নয়–সে যাক-সে-সব তো তদন্তসাপেক্ষ।
সুদৰ্শন কথাগুলো বলে আবার ঘরের চারিদিকে দৃষ্টিপাত করতে লাগল, পায়ে পায়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল।
মাথা আঁচড়াবার চিরুনিটা হাত দিয়ে তুলল সুদৰ্শন-কয়েক গাছি চুল চিরুনিতে তখনো আটকে আছে
আরো একটা ব্যাপার নজরে পড়ল—ড্রেসিং টেবিলের উপরে কাচের উপরে সিঁদুর ও পাউডারের কিছু গুড়ো এদিক ওদিক পড়ে আছে।
সুদৰ্শন বললে, মনে হয় দুপুরে হয়তো প্রসাধন করেছিলেন ভদ্রমহিলা। প্রসাধনের পর টেবিলের কাঁচটা পরিষ্কার করেননি—করতে ভুলে গিয়েছেন বা করবার সময় পাননি।
তাই কি মনে হচ্ছে স্যার? রবীন দত্ত বলে।
তাছাড়া ভদ্রমহিলার পরনের দামী ঢাকাই শাড়িটা দেখে মনে হয় তো কোথাও বেরুবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন বা হয়েছিলেন, এমন সময় হত্যাকারীর আবির্ভাব ঘটেছিল।
রবীন দত্ত কোন কথা বলে না। সুদৰ্শন আবার বলে, দেওয়ালটা দেখুন। মিঃ দত্ত—
ঘরের দেওয়ালেও কয়েকটা রক্তের ছিটে নজরে পড়ল রবীন দত্তর। রক্ত শুকিয়ে আছে। অতঃপর সুদৰ্শন পাশের ঘরে এলো দুটি ঘরের মধ্যবর্তী দরজা-পথে।
এ ঘরটি মাঝারি সাইজের। এ ঘরেও একপাশে একটি শয্যা, একটি সিঙ্গল খাটে শয্যাটি নীল রংয়ের একটা বেডকভারে ঢাকা।
এক পাশে ডাইনিং টেবিল ছোট সাইজের একটি এবং খােন তিনেক চেয়ার। অন্য পাশে ছোট একটি মীট-সেফ ও একটি কাঠের আলমারি।
ঐ ঘরেরই সংলগ্ন বাথরুম ও কিচেন।
ঐ ঘরেই একটা চেয়ারের ওপরে মাথায় হাত দিয়ে বসে ছিল মণিশঙ্কর।
রোগা পাতলা চেহারা।
পরনে দামী টেরিলিনের সুট-গলার টাইটার নাট লুজ, মাথার চুল সযত্নে ব্যাকব্রাশ করা।
সুদৰ্শন ও রবীন দত্তর পদশব্দে মণিশঙ্কর মুখ তুলে ওদের দিকে তাকাল।
চোখ দুটো তার লাল।
বোধ হয় কাঁদছিল?
মণিশঙ্কর উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করে।
সুদৰ্শন বাধা দেয়, বসুন বসুন মিঃ ঘোষাল।
মণিশঙ্কর আবার চেয়ারটার ওপরে বসে পড়ল।
সুদৰ্শনও একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। জিজ্ঞাসা করল, আপনি অফিস থেকে ফোন পেয়েই তো আসেন, তাই না?
হ্যাঁ।
ফোনে পুরুষের গলা শুনেছিলেন?
হ্যাঁ—মোটা, কর্কশ—সর্দিধারা গলার মতো, যেন কেমন ভাঙা-ভাঙা গলার স্বরটা ছিল।