একটা বাথরুম—রান্নাঘর বা কিচেন, ছোট্ট মত একটা স্টোররুম।
তারই ভাড়া তিনশ টাকা।
অফিস থেকে ভাড়ার অর্ধেক টাকা দেয়, বাকিটা দিতে হয় নিজের পকেট থেকে, তাই মণিশঙ্কর ফ্ল্যাটটা নিতে সাহস করেছিল মাসচারেক আগে।
নূতন ফ্ল্যাটে উঠে এসেছে মাত্র চার মাস। আগে ছিল শ্যামবাজার অঞ্চলে দেড়খানা ঘর নিয়ে একতলায়। দমবন্ধ হয়ে আসার যোগাড়। মাত্র দেড়খানা ঘর, স্বামী স্ত্রী ওরা দুজন ছাড়াও একজন চাকর।
চাকর না হলে চলে না। বাজার আনাটা—টুকটাক ফাইফরমাশ কে করে। তার উপর মেয়েটাকে একটু বেড়াতে নিয়ে যাওয়া।
মণির তো সময়ই নেই। সেই সকাল নটায় অফিস যায়, ফিরতে সেই কোন সাড়ে ছাঁটাসাতটা। বিজিতাকেও একলা থাকতে হয়!
অনেক খুঁজে পেতে বছর বারোর একটা বাচ্চা চাকর পাওয়া গিয়েছিলশদ্ভুচরণ।
তা ছেলেটা ভাল। সব সময়ই হাসিমুখ। এক পায়ে খাড়া। শম্ভুকে পেয়ে যেন ওমা বেঁচে গিয়েছিল।
বাইরের বসবার ঘরটা বেশ সাজানো। ছিমছাম।
কিন্তু ঘর খালি।
শম্ভু এই শস্তু-দরজাটা খুলে রেখেছিস কেন? বলতে বলতে দ্বিতীয় ঘরে পা দিল মণিশঙ্কর। সে ঘরেও কেউ নেই–
শেষে শোবার ঘরে পা দিয়েই অকস্মাৎ একটা আতঙ্কে যেন থমকে দাঁড়িয়ে যায় মণিশঙ্কর।
নতুন মোজেকের ঘষা চকচকে ঘরের মেঝেতে চাপচাপ রক্ত।
উঃ।
মাথাটা যেন সহসা কেমন ঘুরে উঠল মণিশঙ্করের।
শঙ্কিত বিহ্বল দৃষ্টির সামনে যেন দৃশ্যটা স্পষ্ট—বিজিতা আর রুণার রক্তাক্ত দুটো দেহ-কিছুটা ব্যবধানে চাপ-চাপ রক্তের মধ্যে পড়ে আছে।
বিজিতার পরিধেয় শাড়িটার আচিল স্খলিত গা থেকে।
বুকের কাছে বীভৎস চার-পাঁচটা ক্ষত—ঝলকে ঝলকে রক্ত বোধ হয় বের হয়ে এসেছিল সেই ক্ষতমুখ দিয়ে—জামা—শাড়ি-মেঝেতে খালি রক্ত আর রক্ত।
শুধু বুকেই নয়—মুখে, গালে, গলায় হাতে সর্বত্র ক্ষত। প্রত্যেকটি ক্ষতস্থান দিয়ে প্রচুর রক্তপাত হয়েছে।
হঠাৎ ঘর থেকে ছুটে বের হয়ে যায়। মণিশঙ্কর—চিৎকার করবার চেষ্টা করে, কিন্তু গলা দিয়ে কোন স্বর বের হয় না।
সিঁড়ি দিয়ে নামছিল মণিশঙ্কর একপ্রকার পাগলের মতই যেন ছুটতে ছুটতে, ঐসময় দোতলার পাশের ফ্ল্যাটের অন্য ভাড়াটে ইঞ্জিনীয়ার গোপেন বসুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক গোপেনবাবু।
কি কি হয়েছে। মণিবাবু—
খুন–
খুন-কে? কে খুন হলো?
আমার স্ত্রী-আমার মেয়ে—তাদের মেরে ফেলেছে গোপেনবাবু—তাদের মেরে ফেলেছে—বলতে বলতে হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে মণিশঙ্কর।
কোথায়, কোন ঘরে।
উপরে শোবার ঘরে।
চলুন-চলুন দেখি
না, না—আমি যাবো না—রক্তের বন্যা বইছে-না, না—
গোপেন বসুই নীচে গিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে থানায় ফোন করে দিয়েছিল, শীঘ্ৰ আসুন স্যার— বেলেঘাটা নতুন সি. আই. টির ফ্ল্যাটে দুটো খুন হয়েছে।
আপনি কে? থানা-অফিসার রবীন দত্ত জিজ্ঞাসা করেছিলেন।
আমার নাম গোপেন বসু, ঐ বাড়ির উপরের ফ্ল্যাটে আমি থাকি।
রবীন দত্ত ছুটে আসে জীপ নিয়ে। দেরি করে না।
অকুস্থানে দাঁড়িয়ে যখন সরেজমিন তদন্ত করছে ইন্সপেক্টর সুদৰ্শন মল্লিক লালবাজার হোমিসাইডাল স্কোয়াডের একটা পুলিস ভ্যানে চেপে হাজির হলো।
বাড়ির সামনে ও ভিতরে, সিঁড়ির নীচে পুলিস ছিল, তারা সুদর্শকে সেলাম করল।
কোথায় খুন হয়েছে? সুদৰ্শন প্রশ্ন করে।
দোতলার ফ্ল্যাটে স্যার—
সুদৰ্শন সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসে। প্রথম ঘরটাতে একজন লাল-পাগড়ি ছিল— সেই সুদৰ্শনকে ইঙ্গিতে ঘরটা দেখিয়ে বলে, ভিতরের ঘরে স্যার ডেড বডি।
সুদৰ্শন পরের ঘরটা পার হয়ে শেষের ঘরে পা ফেলেই দরজা-পথে থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।
সমস্ত ঘরের মেঝেতে চাপ-চাপ রক্ত। জমাট বেঁধে আছে রক্ত।
আর সেই চাপ-চাপ জমাট বাঁধা রক্তের মধ্যে পড়ে আছে দুটো মৃতদেহ।
০২. তরুণীর মৃতদেহ
একটি বছর ত্রিশ-একত্রিশের তরুণীর মৃতদেহ, অন্যটি একটি বাচ্চা মেয়ের—বছর চার বয়স হবে বড় জোর, গায়ে কোন জামা নেই, কেবল একটা ইজের পরা। তারও পেটে-বুকে নিষ্ঠুর আঘাতের চিহ্ন।
নৃশংস-বীভৎস ভাবে হত্যা করা হয়েছে দুজনকেই।
কোন উন্মাদ যেন এক হত্যা-লালসায় কোন তীক্ষ্ণ ধারালো অস্ত্রের দ্বারা ওদের বার বার আঘাত করে হত্যা করেছে।
সত্যি কথা বলতে কি সুদৰ্শন মল্লিকেরও ঘরের মধ্যে পা ফেলে প্রথমটায় মাথার মধ্যে ঝিমঝিম করে উঠেছিল।
মাত্র মাস দুই হবে সুদৰ্শন প্রমোশন পেয়ে লালবাজারে পোস্টিং পেয়ে এসেছে। ইতিমধ্যে গত দুইমাসে আরো দুটি হত্যার ব্যাপারে তাকে দৌড়া-দৌড়ি করতে হয়েছে, কিন্তু এবারের হত্যা ব্যাপারটা যেন তার তুলনায় যেমনই নিষ্ঠুর তেমনি নৃশংস ও বীভৎস।
মুহুর্তের বিহ্বলতাটা কাটিয়ে ওঠবার পর সুদৰ্শন ভাল করে এককবার ঘরটার মধ্যে চারিদিকে দৃষ্টিপাত করল।
সুন্দর ছিমছাম ভাবে শয়নকক্ষটি যেন সাজানো। জানলায় দরজায় দামী বম্বে প্রিন্টের রঙীন পর্দা। রাস্তার দিকের সব কয়টি জানলাই খোলা।
হাওয়ায় পর্দাগুলো উড়ছিল।
ঘরের একদিকে জানলা ঘেঁষে দুটি পর পর সিঙ্গল বেডে শয্যা—তার উপর দামী বেডকভার।
একধারে ছোট একটি স্টীলের প্রমাণ-আরাশি-বসানো আলমারি। তারই পাশে একটি ড্রেসিং টেবিল। দেওয়াল ঘেঁষে একটি কাবার্ডের উপরে একটি খাপে-ভরা তানপুরা ও একটি বেহালার বাক্স নজরে পড়ে। টেবিলের ওপরে সুন্দরভাবে সাজানো প্রসাধনদ্রব্যগুলি। সামনে ছে টি একটি বসবার টুল।
তার পাশে একটি মোড়া।
অন্যদিকে ঘরের নীচু একটি টেবিলের উপরে একটি দামী রেডিও সেট—তার উপরে কঁ চর ফ্রেমে পাশাপাশি দুটি ফটো।