না, কাঁপেনি—হঠাৎ মণিশঙ্কর বলে ওঠে, সী ওয়াজ এ হারলট-বিশ্বাসঘাতিনী, আর ঐ সন্তানও আমার নয়, সমীরণের-আমি জানি, আমি জানি—ঠিক সমীরণের গায়ের রঙ— ঠিক ওরই মত চোখ-মুখ—
মণিশঙ্কর!
অস্ফুট কণ্ঠে যেন আর্তনাদ করে ওঠে সমীরণ হঠাৎ।
হ্যাঁ—হ্যাঁ, তুমি-তুমিই, আমার ঘরে আগুন জ্বেলে দিয়েছ সমীরণ-তোমার জন্য বিজিতা কোন দিনই আমাকে ভালবাসতে পারেনি—আমার বুকে মাথা রেখে সে তোমারই কথা ভেবেছে–
না, না—মণি, না—আমি–
দিনের পর দিন তুমি তাকে চিঠি লিখেছ—আমার মানা সত্ত্বেও সে লুকিয়ে তোমার সঙ্গে গিয়ে দেখা করেছে ফ্ল্যাটে—বল, বল সমীরণ সেও মিথ্যে—সেও ভুল!
ভুল হ্যাঁ, ভুল তোমার—সব মিথ্যা—
না, ভুল নয়—বিশ্বাসঘাতিনী স্ত্রীকে চিনতে কোন স্বামীরই ভুল হয় না কোন দিন। তুমি আমার মনের শান্তি—ঘুম সব কেড়ে নিয়েছিলে, কিন্তু পরশু আর কাল রাত্রে অনেকদিন পরে আমি ঘুমিয়েছি—আর জান, তোমারই একদা প্রেজেন্টেশান করা মহীশূর থেকে আমার জন্য আনা ছোরা দুটোর একটা দিয়ে তোমার বিজিতাকে আমি হত্যা করেছি!
কিন্তু মিঃ বোসকে আপনি হত্যা করলেন কেন? কিরীটী হঠাৎ প্রশ্ন করে।
সে আমায় বাড়িতে ঢুকতে দেখেছিল—
তাই তাকেও হত্যা করলেন?
হ্যাঁ, ইচ্ছা ছিল ওকেও ঐ সমীরণকে হত্যা করব, সেই কারণেই অন্য ছোরাটা আমি–রেখে দিয়েছিলাম-কিন্তু ওর বাড়িতে গিয়ে শুনলাম ওকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে আসা হয়েছে; আমি যা করেছি। স্বেচ্ছায় করেছি—অ্যান্ড আই কিল্ড দেম ডেলিবারেটলি! ফাঁসির কথা বলছিলেন না? নাউ আই অ্যাম রেডি ফর দ্যাট!
সুদৰ্শন বলে ওঠে, হাউ ফ্যানটাস্টিক—হাউ হরিবল!
হাঃ হাঃ করে হঠাৎ ঐ সময় পাগলের মতই যেন হেসে ওঠে মণিশঙ্কর, তারপর বলে, খুব অবাক হয়ে গিয়েছেন ইন্সপেক্টর, তাই না?
কথাটা বলে মণিশঙ্কর সুদর্শনের দিকে তাকাল। মণিশঙ্করের চোখেমুখে তখনো হাসি।
সুদৰ্শন ভাবে, লোকটা বিকৃতমস্তিক নয় তো!
মে আই হ্যাভ এ সিগারেট? একটা সিগারেট খেতে পারি স্যার? মণিশঙ্কর বলল।
খান—সুদৰ্শন বলে। মণিশঙ্কর পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরালো, কিন্তু গোটা দুই টান দিতেই টলে পড়ে গেল। সবাই ব্যস্ত হয়ে ওঠে।
মণিশঙ্কর বলে, চললাম স্যার, গুড বাই—মণিশঙ্করের চোখ বুজল।
১১. মানুষের চরিত্র সত্যিই আশ্চর্য
সুদৰ্শন বাসাতে বসে পরের দিন সন্ধ্যায় সি. আই. টি. র ফ্ল্যাটের হত্যা-ব্যাপারটা নিয়েই কিরীটী আলোচনা করছিল। সামনে পাশাপাশি একটা সোফায় বসে সাবিত্রী ও সুদৰ্শন।
একসময় সুদৰ্শন বললে, প্রথম থেকেই কি আপনার মণিশঙ্করের ওপরে সন্দেহ পড়েছিল দাদা?
কিরীটী বললে, বলতে পার তোমার মুখে সব কথা শোনবার পরই মণিশঙ্করের ওপর আমার সন্দেহ জাগে মনে–
কেন?
প্রথমতঃ মণিশঙ্করের অতগুলো চাবিসমেত চাবির রিংটাই রীতিমত একটা খট্কা জাগায় আমার মনে, যেটা তার পকেট থেকে বের হয় ও সে বলে সেটা একটা ড়ুপলিকেট চাবির রিং। ঐ চাবির রিংয়ের মধ্যেই ছিল দুটো চাবি অর্থাৎ একটা আলমারির ও অন্যটা সদর দরজার। মনে করে দেখ–
হ্যাঁ, মনে পড়ছে–
মণিশঙ্কর বলেছিল, চাবি তার স্ত্রীর কাছেই থাকত। কথাটা হয়তো মিথ্যা নয়—সেটাই স্বাভাবিক। এবং ড়ুপলিকেট চাবি থাকলেও একমাত্র সদর দরজার চাবিই থাকত, তাই বলে রিংয়ের মধ্যে অন্যান্য চাবিও থাকবে কেন, বিশেষ করে ঘরের আলমারির চাবি-কাজেই ঐ চাবির রিং মণিশঙ্করের সঙ্গে করে অফিসে নিয়ে যাবার কোন যুক্তিও নেই। সেদিন অর্থাৎ দুর্ঘটনার দিন দ্বিপ্রহরে মণিশঙ্কর আসে তার ফ্ল্যাটে তার পূর্ব-পরিকল্পনা মত—বিজিতা দেবীর মনে তার ঐভাবে হঠাৎ আসার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নিশ্চয় জাগেনি এবং সে কল্পনাও করতে পারেনি যে তার স্বামী তাকে হত্যা করবার জন্যেই এসেছে, বিশেষ করে ঐ সময়, নিষ্ঠুর একটা সংকল্প নিয়ে। মণিশঙ্কর অতর্কিতে বিজিতাকে আঘাত করে হত্যা করে হয়তো পিছন থেকে—তারপর শিশুটি পাছে সব কথা প্রকাশ করে দেয়। সেই ভয়ে তাকেও হত্যা করে। হত্যার পর সে বেশ বদলিয়ে রক্তাক্ত জামা-কাপড় সুটকেসটায় নিয়ে ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে যায়। সে স্বামীনাথনের গাড়িটা আগেই গ্যারেজ থেকে delivery নিয়েছিল— সব দোষটা তার ঘাড়ে চাপানোর জন্য—এবং তা না হলে সমীরণের ঘাড়ে চাপানোর জন্য সে সুটকেসটা তার ফ্ল্যাটে রেখে এসেছিল; কিন্তু একটা মারাত্মক ভুল সে করল যেটা আমার তাকে দ্বিতীয় সন্দেহের কারণ—
ভুল!
হ্যাঁ, চাবির রিংটা সঙ্গে নিয়ে গিয়ে! চাবির রিংটা যদি সে সঙ্গে না নিয়ে যেত, হয়তো ব্যাপারটা এত শীঘ্ৰ আমার সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠত না। এবং ব্যাপারটা যে কোনরকম বার্গালারি নয় যখনই বুঝতে পারলাম তোমার কথায়, তখুনি বুঝেছিলাম এটা স্পষ্ট একটা নিষ্ঠুর হত্যার ব্যাপার। তোমারও সন্দেহ হওয়া উচিত ছিল, অবিশ্যি—
সন্দেহ যে একেবারে হয়নি তা নয়, হয়েছিল-কিন্তু—
তুমি ভাবতে পারনি যে স্বামী হয়ে নিজের স্ত্রী ও কন্যাকে হত্যা করতে পারে কেউ, তাই না!
তাই, দাদা।
কিন্তু সন্দেহের মত বিষ আর নেই ভাই, বিশেষ করে স্ত্রী-পুরুষের সম্পর্কের ব্যাপারে এ দুনিয়ায়। মনের মধ্যে একবার সন্দেহ জাগলে কোন একজনের, তার বিষ সমস্ত মনকে বিষাক্ত করে তোলে-তাই যখন মণিশঙ্কর হত্যা করেছিল তার নিজের স্ত্রী ও কন্যাকে তখন তার সমস্ত শুভবুদ্ধি ও বিচার-বিবেচনা লোপ পেয়েছিল। যার ফলে তার মধ্যে momentary insanity dovelop করেছিল—তারপরই সে ঐ নিষ্ঠুর কাজে লিপ্ত হয়।