হঠাৎ মণিশঙ্কর যেন আর একটা ধাক্কা খেল। কেমন যেন বিব্রত ও হতচকিত মনে হয় তাকে।
পরম বিস্ময়ের সঙ্গে সুদৰ্শন কিরীটীর মণিশঙ্করকে প্রশ্ন ও তার জবাবগুলো শুনছিল। কিরীটী মণিশঙ্করের মুখের দিকে তার শেষ প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়ে তখনো স্থির দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
মিঃ ঘোষাল আমার প্রশ্নের জবাবটা এখনো পাইনি!
মণিশঙ্কর চুপ।
আমি জানি মিঃ ঘোষাল, পরশু গোটা এগারোর সময় আপনি অফিস থেকে বের হয়ে হাডসন অ্যান্ড মেটার অফিসে গেলেও সেখান থেকে আপনি আপনার ফ্ল্যাটে গিয়েছিলেন।
না আমি যাইনি।
গিয়েছিলেন। আপনি-বলুন কেন গিয়েছিলেন?
আমি যাইনি।
আপনার গলার স্বর—আপনার মুখ বলছে আপনি গিয়েছিলেন, আর আমাদের অনুমান যে মিথ্যা নয়। তার প্রমাণ একজন আপনাকে দেখেছিল। ঐ সময় ফ্লট থেকে বের হয়ে আসতে।
কে-কে দেখেছে!
মিঃ স্বামীনাথনকে এ ঘরে আনাও তো সুদৰ্শন।
সুদৰ্শন কিরীটীর নির্দেশে উঠে গিয়ে বাইরে দণ্ডায়মান সার্জেণ্টকে বললে পাশের ঘর থেকে স্বামীনাথকে ডেকে আনতে।
মিঃ ঘোষাল, কিরীটী আবার বলে, সত্য আর গরলকে কখনো চেপে রাখা যায় না। কোনদিন-না-কোনদিন তা প্রকাশ হয়ে পড়েই।
কিন্তু আপনারা বিশ্বাস করুন, মণিশঙ্কর বলে ওঠে, আমি আমার স্ত্রী ও কন্যাকে হত্যা করিনি!
কিন্তু আপনি গত পরশু এগারোটা থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে আপনার সি. আই টির ফ্ল্যাটে গিয়েছিলেন। কিরীটী শান্ত গলায় আবার বলে।
ঐ সময় স্বামীনাথন একজন সার্জেন্টের সঙ্গে ঘরে এসে ঢুকল।
মণিশঙ্করবাবু, একে আপনি চেনেন?
হ্যাঁ, চিনি?
কে উনি?
আমার স্ত্রীর দেশের লোক।
আপনার স্ত্রী অর্থাৎ বিজিতা দেবী তাহলে ওঁকে ভাল করেই চিনতেন?
চিনত।
মধ্যে মধ্যে আপনাদের ফ্ল্যাটে উনি আসতেন?
স্বামীনাথন তীব্র গলায় প্রতিবাদ জানায়, ইট’স এ ড্যাম লাই! মিথ্যা–
মিঃ স্বামীনাথন!
ইয়েস!
আপনি কতদিন ওঁদের ফ্ল্যাটের উপরের তলায় আছেন? কিরীটী প্রশ্ন করে স্বামীনাথনকে।
মাত্র দিন-পনের হবে।
তার আগে কোথায় ছিলেন।
পোলক স্ট্রীটের একটা ফ্ল্যাটে।
কতদিন ছিলেন সেখানে?
প্রায় বছর দুই হবে।
হঠাৎ সেখান থেকে ঐ সি. আই টির ফ্ল্যাটে উঠে এলেন কেন?
ফ্ল্যাটটা ভাল-ভাড়া কম—বেশ সুবিধা—তাই।
তাই, না বিজিতা দেবীর সঙ্গে যাতে সব সময় দেখাসাক্ষাৎ হতে পারে সেইজন্যই ওখানে উঠে এসেছিলেন?
না, সেজন্য নয়; যেজন্য উঠে এসেছিলাম। সে তো বললাম।
বিজিতা দেবীর সঙ্গে আপনার অনেক দিনের আলাপ?
একই শহরে পাশাপাশি বাড়িতে অনেকদিন আমরা ছিলাম।
কলকাতায় কতদিন আছেন?
বছর তিনেক।
তার আগে?
মাদ্রাজে একটা অফিসে চাকরি করতাম।
বিজিতা দেবী শান্তিনিকেতনে চলে আসার পর আপনাদের পরস্পরের মধ্যে চিঠিপত্রের দেওয়া-নেওয়া ছিল?
ছিল।
মধ্যে মধ্যে শান্তিনিকেতনে গিয়েছেন?
গিয়েছি, দুবার।
সমীরণ দত্ত—বিখ্যাত গাইয়েকে আপনি চেনেন?
চিনি।
আপনি বিজিতা দেবীকে ভালবাসতেন—তাই না?
স্বামীনাথন মাথাটা নীচু করে।
বলুন, এতে লজ্জা পাবার কিছু নেই। ভালবাসার মধ্যে কোন অপরাধ নেই।
স্বামীনাথন তবু কোন জবাব দেয় না।
কিরীটীর হঠাৎ নজরে পড়ল, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। মণিশঙ্কর ঘোষাল স্বামীনাথনের মুখের দিকে।
বলুন! কিরীটী আবার বলে।
বাসতাম। কিন্তু—, থেমে গেল স্বামীনাখন!
কি, থামলেন কেন, বলুন?
যেদিন জানতে পেরেছিলাম মণিশঙ্করকে সে ভালবাসে, সেইদিন থেকেই নিজেকে আমি গুটিয়ে নিয়েছিলাম।
তাই যদি হবে তো ঐ একই ফ্ল্যাটে অত কাছাকাছি আবার এসে উঠেছিলেন কেন মিঃ স্বামীনাথন? কিরীটী প্রশ্নটা করে ওর মুখের দিকে তাকাল।
আজ বুঝতে পারছি। ভুল করেছি।
ভুল?
তাই। হয়তো আমি ওইভাবে ওখানে এসে না উঠলে তাকে আজ আমন পৈশাচিক নৃশংস মৃত্যু বরণ করতে হত না।
মিঃ স্বামীনাথন, গত পরশু বেলা দশটা থেকে বেলা দেড়টা পর্যন্ত আপনি কোথায় ছিলেন? কিরীটী এবারে প্রশ্ন করল।
আগেই তো বলেছি, আমি পরশু কলকাতার বাইরে ছিলাম। স্বামীনাথন বললে।
কিন্তু আমি যদি বলি আপনি মিথ্যে বলছেন!
মিথ্যে?
হ্যাঁ, ওই সময়টা আপনি আপনার ফ্ল্যাটেই ছিলেন।
না, না-আই ওয়াজ আউট অফ ক্যালকাটা!
না—স্টীল ইউ আর ডিনাইং দি ফ্যাক্টস! এখনো সত্য বলুন?
আ-আমি আগের দিনই সকলে বের হয়ে যাই—
হয়তো গিয়েছিলেন, তবে আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয় তো গত পরশু আবার ফিরে এসেছিলেন। দেখুন। মিঃ স্বামীনাথন, হাজারটা মিথ্যে দিয়েও একটা নিষ্ঠুর সত্যকে আপনি চাপা দিতে পারবেন না। পুলিসের পক্ষে জানা অসম্ভব হবে না। সত্যিই ওই সময়টায় আপনি কোথায় ছিলেন, আজ বা কাল তারা সেটা জানতে পারবেই। হত্যাকারী যে-সময় বিজিতা দেবী ও তার শিশুসন্তানকে হত্যা করে বের হয়ে যায়, আপনি তাকে সিঁড়িতে দেখেছিলেন। তাই নয় কি? চুপ করে থাকবেন না, বলুন speak out!
হ্যাঁ, একজনকে আমি দেখেছি।
তাহলে গত পরশু সময়টাতে আপনি ফ্ল্যাটেই ছিলেন?
না।
ছিলেন না?
না, আমি পৌনে একটা নাগাদ ফিরে এসে যখন সিঁড়ি দিয়ে তিন তলায় উঠেছি তখন একজনকে দ্রুত আমার পাশ কাটিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যেতে দেখেছিলাম।
কে সে?
ঠিক চিনতে পারিনি।
তার পরনে কি ছিল?
সুট পরা ছিল।
লম্বা না বেঁটে?
লম্বাই হবে সে।
সত্যিই তাকে আপনি চিনতে পারেন নি?
না।
১০. কিছু নাটক সৃষ্টি
কিরীটী একটুক্ষণ চুপ করে থেকে সুদর্শনের দিকে তাকিয়ে বললে, এবারে সমীরণ দত্তকে নিয়ে এস, সুদৰ্শন।–