খুব ভোরেই উঠে-হাত-মুখ ধুয়ে, শেভ করে, চা পান করেই সুদৰ্শন লালবাজার চলে গিয়েছিল।
অফিস-ঘরে ঢুকতেই একজন সার্জেণ্ট এসে স্যালুট করে দাঁড়াল!
কি খবর বিশ্বনাথ?
একটু আগে এখানে একটা ফোন এসেছিল।
ফোন? কার?
আপনার কাছেই এসেছিল ফোন-কলাটা। তবে কে যে ফোন করেছিল জানি না। তবে কালকের সেই সি. আই. টি.-র ফ্ল্যাট বাড়িতে আর একটা খুন হয়েছে।
খুন! সে কি?
হ্যাঁ স্যার—বিকাশবাবু ফোন পেয়েই স্পটে চলে গিয়েছেন।
কিন্তু কে-কে খুন হয়েছে?
তা জানি না, স্যার।
সুদৰ্শন আর দেরি করে না। তখুনি বের হয়ে পড়ে।
অকুস্থলে পৌঁছে দেখল নীচে ফ্ল্যাট বাড়িটার সামনে পুলিসের একটা কালো ভ্যান দাঁড়িয়ে—চার-পাঁচজন কনস্টেবল দাঁড়িয়ে।
সুদৰ্শন তাদেরই একজনকে প্রশ্ন করে, বিকাশবাবু কোথায়?
উপরে স্যার। দোতলায় উঠতেই সিঁড়ির মাথায় একজন সার্জেন্টির সঙ্গে দেখা হল। সুদৰ্শন তাকেই জিজ্ঞাসা করে, কোথায় খুন হয়েছে?
তিনতলার ফ্ল্যাটে, স্যার।
তরতর করে সুদৰ্শন তিনতলায় উঠে যায়।
দুটো ফ্ল্যাট সিঁড়ির ল্যানডিংয়ের দুই দিকে।
একটার দরজায় তালা দেওয়া।
অন্য দরজাটা খোলা—তার সামনে একজন সেপাই দাঁড়িয়ে। দরজার গায়ে ইংরেজীতে নেমপ্লেটে লেখা—শ্ৰীগোপেন বসু, বি. ই.।
ঘরে পা দিতেই চোখে পড়ল সুদর্শনের বীভৎস দৃশ্যটা।
বছর পঞ্চাশ-বাহান্ন হবে একটি ভদ্রলোক-মাথার চুল অনেকটা সাদা হয়ে গিয়েছে— সামনের দিকে টাক-পরনে শ্লিপিং সুট, খালি পা—উপুড় হয়ে পড়ে আছে মেঝেতে দেহটা-কিছু দূরে একটা চশমা পড়ে আছে। ও-দুপটি চপ্পল।
মেঝেতে চাপ-চাপ রক্ত।
বিকাশ মধ্যবয়সী ভৃত্যশ্রেণীর লোকটিকে নানা প্রশ্ন করছিল, আর লোকটা কঁদেছিল।
সুদৰ্শনকে ঢুকতে দেখেই বিকাশ তাকে একটা স্যালুট করে, এই যে স্যার, এসে গেছেন। কাল রাত্রে–কোন এক সময় ব্যাপার ঘটেছে মনে হচ্ছে।
গোপেন বসু?
হ্যাঁ স্যার—
ঐ লোকটা কে?
গোপেনবাবুর চাকর দাশু!
আর কেউ নেই বাড়িতে?
না, গোপেনবাবুর স্ত্রী দিনসাতেক হল মুর্শিদাবাদে তাঁর বাপের বাড়ি গিয়েছেন
ছেলেমেয়েদের নিয়ে।
বাড়িতে তাহলে আর কেউ ছিল না?
না। স্যার, ঐ দাশু আর গোপেনবাবু।
০৭. মৃতদেহের দিকে এগিয়ে গেল
সুদৰ্শন মৃতদেহের দিকে এগিয়ে গেল।
নীচু হয়ে বসে মৃতদেহের সামনেটা উল্টে দিল সুদৰ্শন। বুকে ও পেটের ক্ষতস্থান দুটো চোখে পড়ল। পেটের খানিকটা ইনটেসটিন বের হয়ে এসেছে—দুহাতের পাতায় রক্ত শুকিয়ে আছে। বুকের ক্ষতটাও প্রায় ইঞ্চি-দুই চওড়া।
চোখে-মুখে অসহ্য একটা বিস্ময় ও যন্ত্রণার চিহ্ন তখনো যেন স্পষ্ট।
সুদৰ্শনের বুঝতে কষ্ট হয় না প্রথমে হয়তো পেটে কোন তীক্ষ্ণধার অস্ত্রের সাহায্যে আঘাত করা হয়েছিল, তারপর বক্ষস্থলে দ্বিতীয় আঘাত করা হয়েছে।
মোক্ষম দুটি আঘাত।
হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে।
ভদ্রলোক চেচাবার বা লোক ডাকবারও সময় পাননি।
ঘরের ঠিক দরজার সামনেই অনেকটা রক্ত কালো হয়ে জমাট বেঁধে আছে। হয়তো ভদ্রলোক ঘুমোচ্ছিলেন বা ঘুমোবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন, ঐ সময় আততায়ী এসে দরজায় ধাক্কা দেয়। ভদ্রলোক দরজার গায়ে ধাক্কা শুনে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই আততায়ী সঙ্গে সঙ্গে তাকে অতর্কিতে প্রথমে তার পেটে আঘাত করে, তারপর বুকে।
দেহে রাইগার মরটিস সেট-ইন করেছে।
ঘণ্টা ছয়-সাত আগেই হয়তো মৃত্যু হয়েছে।
নিষ্ঠুর নৃশংস বীভৎস হত্যা।
মাত্র কয়েক ঘণ্টা ব্যবধানে পর পর তিনটি বীভৎস হত্যা একই বাড়ির দুই ফ্ল্যাটে উপরের ও নীচের ফ্ল্যাটে। হত্যা-পদ্ধতিও এক। কোন ধারালো তীক্ষ্ণ অস্ত্রের সাহায্যে।
হঠাৎ মনে পড়ে সুদর্শনের পূর্বে যে অস্ত্রের সাহায্যে হত্যা করা হয়েছে সেটা পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু এবারে যে অন্ত্রের সাহায্যে হত্যা করা হয়েছে সেটি কোথায়?
সুদৰ্শন আবার উঠে দাঁড়াল।
ঠিক দোতলার ফ্ল্যাটের মতই উপরের তলার ঐ ফ্ল্যাটটিতেও ব্যবস্থা—ততে চারটি ঘর এবং দুটি বেডরুম।
প্রত্যেক ঘরেই দামী দামী আসবাব।
একটি শোবার ঘরে পাশাপাশি দুটি শয্যা—একটি রাত্রে ব্যবহৃত হয়েছে বলে মনে হয় না। সেই ঘরে একটি গডরেজের আলমারি-তার পাশে একটি দামী ড্রেসিং টেবিল। সেই ঘরটি একেবারে কোণের ঘর-তার আগের ঘরে একটি সিঙ্গল বেডে শয্যা।
সে শয্যাটি দেখলেই বোঝা যায় রাত্ৰে শয্যাটি ব্যবহৃত হয়েছে। ঐ ঘরটি বসবার ঘরের ঠিক পরের ঘর।
শেষোক্ত ঘরের মধ্যে একটি বুক-সেলফ-পাশে ইংরাজী ও বাংলা বই সাজানো।
সেলফের উপরে একটি ফটো। ফ্রেমে একটি ফ্যামিলি-ফটো। দেখলেই বোঝা যায় গোপেন, বসুর ফ্যামিলির ফটো।
গোপেনবাবু, তাঁর পাশে মোটাসোটা মধ্যবয়সী একটি ভদ্রমহিলা, পনের-ষোল বছরের একটি মেয়ে, আঠার-উনিশ বছরের একটি যুবক ও দশ থেকে বারো বছরের মধ্যে দুটি ফ্রক পরা মেয়ে।
ব্যবহৃত শয্যার পাশে ছোট একটি ত্ৰিপায়ের উপর একটি টেবিল-ক্লক। এক প্যাকেট সিগারেট-একটা ম্যাচ ও ছাইভর্তি একটি কাচের অ্যাশট্রে ও একটা টেবিল ল্যাম্প।
ল্যাম্পটা তখনো জ্বলছিল।
বোতাম টিপে টেবিল-ল্যাম্পটা নিভিয়ে দিল সুদৰ্শন।
ঘরে দক্ষিণ কোণে একটি মাঝারি সাইজের রাইটিং-টেবিল।
কিছু ফাইলপত্ৰ—একটা ঝর্ণ কলম। আর একটা চাবির রিং। রিংয়ের মধ্যে একগোছা চাবি। টেবিলটার পাশেই একটা ষ্টীলের আলমারি।
রাইটিং-টেবিলের ড্রয়ারগুলো ও আলমারিটা সেই রিংয়ের চাবির সাহায্যে একে একে খুলে দেখল। সুদৰ্শন।–