ঠিক আমি জানি না।–তবে বিজিতার মুখ দেখে তাই মনে হয়েছিল।
তিনি কিছু বলেননি?
না। বিজিতার মত মেয়ে হয় না। এত ভদ্ৰ—এত নম্র-এত শান্ত-অথচ কেন যে মণি একটা কথা বুঝতে পারত না—
কোন কথা?
বিজিতার সমস্ত মন ভরে ছিল মণিশঙ্করই—
মণিশঙ্করের অত্যন্ত সন্দেহবাতিক মন ছিল তাহলে বলুন!
সমীরণ কোন জবাব দেয় না।
আর একটা কথা সমীরণবাবু—
সমীরণ সুদর্শনের মুখের দিকে তাকাল।
আপনি যে সুটকেসটা এইমাত্র সঙ্গে নিয়ে এলেন সেটা একবার আনবেন?
সুটকেসটা!
হ্যাঁ।
কেন?
আনুন না-দরকার আছে–
কিন্তু
নিয়ে আসুন সুটকেসটা।
সমীরণ উঠে গিয়ে পাশের ঘর থেকে সুটকেসটা নিয়ে এল। সুটকেসটা খুলতে গিয়ে দেখল। সুদৰ্শন—গা-তালা বন্ধ সুটকেসের।
সুটকেসের চাবিটা কোথায়? সমীরণের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে সুদৰ্শন।
চাবি!
হ্যাঁ চাবিটা দিন।
চাবি-মানে চাবিটা তো আমার কাছে নেই!
এই সুটকেসের চাবিটা আপনার কাছে নেই?
সমীরণের মুখটা যেন কেমন শুকিয়ে গিয়েছে–কেমন রক্তহীন ফ্যাকাশে।
এই সুটকেসটা আপনারই তো?
হ্যাঁ, মানে, —সমীরণ কেমন যেন তোতলাতে থাকে। তার কথা ভাল করে মুখ দিয়ে বের হয় না।
আপনার নয়। সুটকেসটা?
আপনি—আপনি বিশ্বাস করুন অফিসার—ওই সুটকেসটা সত্যিই আমার নয়।
আপনার নয়!
না। আগে কোন দিন সুটকেসটা আমি দেখিওনি।
তবে আপনার কাছে কি করে এল এটা?
জানি না।
জানেন না!
না। জানি কেউ আমার কথা বিশ্বাস করবে না, কিন্তু সত্যি বলছি-সুটকেসটা জীবনে কখনো আমি আগে দেখিনি। আজ বেলা দশটা নাগাদ আমি বের হয়েছিলাম-আমার রিহার্শেল ছিল—বেলা দুটো নাগাদ ফিরে আসি কারণ বিকেলের প্লেনে আমার বোম্বাই যাবার কথা—
বলুন, থামলেন কেন? তারপর?
কপালে সমীরণের বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে। ঠোঁট দুটো কেমন যেন কাঁপাছে। সমীরণ একটা ঢোক গিলে বলতে থাকে আবার, ঘরে ঢুকে দেখি মানে আমার শোবার ঘরে, বিছানার উপরে ঐ সুটকেসটা পড়ে আছে। একটু অবাক হই। কোথা থেকে এল সুটকেসটা? কে রেখে গোল—সুটকেসটা তো আমার নয়? সুটকেসটা খোলবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু দেখি তালা লাগানো।
তারপর?
আমার বুকের মধ্যে কেমন যেন করতে লাগল।
কেন?
সুটকেসের ভিতরে কি আছে তখনো জানি না, তবু কেন যেন আমার বুকের মধ্যে সিরসির করতে লাগল-সেই সময় ঘরের মধ্যে হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল—তাড়াতাড়ি গিয়ে ফোনটা ধরলাম, হ্যালো–
কে সমীরণবাবু?
হ্যাঁ—আপনি কে?
আমি যেই হই না কেন আপনার তাতে প্রয়োজন নেই-একটা কথা বলবার জন্য ফোন করছি। আপনার শোবার ঘরে একটা সুটকেস আছে—যদি বাঁচতে চান তো যত তাড়াতাড়ি পারেন সুটকেসটার একটা ব্যবস্থা করবেন–
ওই কথাগুলো বলার সঙ্গে সঙ্গেই কানেকশনটা কেটে গেল। আমি যে তখন কি করব বুঝতে পারছি না। অবশেষে ঠিক করলাম সুটকেসটা বাইরে কোথাও গিয়ে ফেলে দিয়ে আসব–
সন্ধ্যার অন্ধকারে বের হলাম সুটকেসটা হাতে নিয়ে, কিন্তু কোন ট্যাক্সিতে চাপতে সাহস হল না— হ্যাঁটতে হ্যাঁটতে এগিয়ে চললাম।
তারপর?
ঘণ্টা তিনেক ধরে এ-রাস্তা সে-রাস্তা—লেক অঞ্চল রেল স্টেশন ঘুরে ঘুরে বেড়ালাম সুটকেশটা হাতে ঝুলিয়ে। চারিদিকে কেবল মানুষ আর মানুষ। কোথায় সুটকেসটা ফেলব— কারো নজরে পড়ে যাব।—এই ভয়ে রাত্ৰিতে আবার বেরুব ঠিক করে ফিরে এলাম। আমি জানি, আপনি নিশ্চয় আমার কথা বিশ্বাস করবেন না। কিন্তু যা বললাম এক বৰ্ণও তার মিথ্যে নয়। সুটকেসটা আমার নয়, জানিও না করি। জানি না কি ওর ভেতরে আছে, কোথা থেকে এল, কেমন করেই বা এল-বলতে বলতে সমীরণের গলার স্বরটা যেন বুজে এল।
আপনি যখন বাড়ি থেকে দশটা নাগাদ বের হয়েছিলেন, তখন দরজায় তালা দিয়ে যাননি? সুদৰ্শন জিজ্ঞাসা করে।
গিয়েছিলাম।
ফিরে এসে দরজায় তালা দেওয়াই আছে দেখেছিলেন?
হ্যাঁ।
গডরেজের লক?
না। সাধারণ একটা দেশী গা-তালা। তাহলেও তালাটা ভাল জাতের।
তবে? যদি কেউ এসেই থাকে। তবে সে খুলল কি করে?
জানি না।
আপনার কোন চাকর-বাকির দেখছি না-নেই নাকি?
চাকরিটা মাসখানেক হল ছুটি নিয়ে দেশে গিয়েছে। একটা ঠিকা-ঝি সব করে দিয়ে যায়।
রান্নাবান্না?
যাহোক কিছু ফুটিয়ে নিই-একা মানুষ–
বিয়ে-থা করেননি?
না।
মা-বাপ, ভাই-বোন নেই?
সবাই আছে।
কোথায় থাকে তারা?
এই কলকাতাতেই।
তবে?
কেউ আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখেনি।
কেন?
ভালভাবে ইকনমিক্স-এ এম. এ. পাস করেও কোন চাকরি-বাকরি করলাম না-গানবাজনা নিয়েই আছি—বাবার সঙ্গে তাই মতবিরোধ হতে লাগল সৰ্ব্বক্ষণ, বাড়ি ছেড়ে তাই চলে এলাম।
কবে?
তা বছর পাঁচেক হবে।
বছর পাঁচেক এই বাসাতেই আছেন?
হ্যাঁ।
কিছু মনে করবেন না, আপনার ইনকাম কি রকম?
যা পাই—আমার তাতে ভাল ভাবেই চলে যায়। উদ্ধৃত্তিও থাকে না-অভাবও নেই।
০৬. রক্তমাখা কাপড়
ছুরি আছে?
ছুরি!
হ্যাঁ।
আছে—তবে কি হবে ছুরি দিয়ে?
নিয়ে আসুন একটা ছুরি।
সমীরণ একটা ছুরি নিয়ে এল—তারই সাহায্যে তালা ভেঙে সুটকেসটা খুলে ফেলল সুদৰ্শন।
আর খুলতেই যেন ও চমকে ওঠে।
রক্তমাখা কাপড়!
টেনে বের করল। সুদৰ্শন। রক্তমাখা ধুতি-পাঞ্জাবি-গেঞ্জি—আর কাপড়ের মধ্যে জড়ানো ছিল একটা ধারালো বড় ছোরা।
ছোরাটার গায়েও রক্তের দাগ শুকিয়ে আছে।
সমীরণ যেন বোবা হয়ে গিয়েছে। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে রক্তমাখা জামাকাপড়ের দিকে।
সুদৰ্শনের মুখ দিয়ে কয়েকটা মুহুর্ত কোন কথা বের হয় না।
এই ধুতি আর পাঞ্জাবি-চিনতে পারছেন?