-তোমার নাম মানদা?
—আজ্ঞে বাবু।
—ইনি তোমাদের গিন্নীমা?
–আজ্ঞে–কাঁপা কাঁপা গলায় বলল মানদা। ঘরে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ব্যাপারটা নজরে পড়েছিল তার।
—তোমাদের কর্তাবাবুর সঙ্গে এর কি সম্পর্ক ছিল?
—আজ্ঞে ইনি সুরজিৎবাবুর বিয়ে করা ইস্ত্রী নন।
—বিয়ে করা স্ত্রী নন।
–আজ্ঞে না।
এবার সুশীলবাবু বুঝতে পারেন মহিলাটি সুরজিৎ ঘোষালের রক্ষিতা ছিল। বলেন, তার মানে উনি সুরজিৎবাবুর রক্ষিতা ছিলেন?
—হ্যাঁ।
—এঁর কোন আত্মীয়স্বজন আছে?
–আছে।
–কে?
—ওঁর স্বামী। স্বামী! কোথায় থাকেন তিনি? তাঁর নাম জানো?
–জানি, সুশান্তবাবু—এই বাড়িরই নীচের তলায় থাকেন।
–এখানেই থাকেন?
–হ্যাঁ।
—কোথায় তিনি?
—বোধ হয় নীচে।
–কাল রাত্রে বাড়ি ছিলেন সুশান্তবাবু?
–আজ্ঞে তিনদিন ছিলেন না, আজ সকালেই এসেছেন—
ব্যাপারটা সুশীল চক্রবর্তীর কাছে তখনো পরিষ্কার হয় না। সুশীল চক্রবর্তী আবার প্রশ্ন করলেন, সুরজিৎবাবু কি বোজ আসতেন এখানে?
—তা আসতেন বৈকি।
—আর ওঁর স্বামী?
—এই তো একটু আগে বনু, সে মানুষটার সঙ্গে এর কোন সম্পর্কই ছিল না।
–উনি ওপরে আসতেন না? .
-না। তবে মাঝে-মধ্যে টাকার দরকার হলে, মানে মদ খাবার পয়সা চাইতে আসতেন।
—কত দিন এ বাড়িতে আছ তুমি?
—তা বছর চারের বেশীই হবে। —আর উনি?
—উনি কতদিন এ বাড়িতে আছেন জানি না বাবু, তবে শুনেছি এই বাড়িটা সুরজিৎবাবুই ওঁকে কিনে দিয়েছিলেন।
—গ্যারেজে একটা গাড়ি দেখলাম—
–সুরজিৎবাবু গিন্নীমাকে ওটা কিনে দিয়েছিলেন।
–ড্রাইভার নেই?
–আজ্ঞে না, মা নিজেই গাড়ি চালাতেন।
–রতন কতদিন আছে?
–ও আমার মাস দুই পরে আসে। তার আগে এক বুড়ো ছিল—ভৈরব, সে কাজ ছেড়ে দেবার পর রতন আসে।
–সুরজিৎবাবু কোথায় থাকেন জানো?
–আজ্ঞে কোথায় থাকেন জানি না, তবে ফোন নাম্বারটা জানি।
সুশীল চক্রবর্তী মানদার কাছ থেকে ফোন নাম্বারটা নিয়ে ঘরের কোণে দেওয়ালের ব্র্যাকেটের ওপরে রক্ষিত ফোনটার কাছে গিয়ে রিসিভার তুলে নিয়ে নম্বর ডায়াল করলেন। একজন ভদ্রমহিলা ফোন ধরলেন।
—এটা কি সুরজিৎবাবুর বাড়ি?
–হ্যাঁ।
—তিনি বাড়িতে আছেন?
—আছেন, ঘুমোচ্ছন—আধ ঘণ্টা বাদে ফোন করবেন।
—তাকে একটিবার ডেকে দিন, আমার জরুরী দরকার।
–কে আপনি? কোথা থেকে বলছেন?
—আপনি কে কথা বলছেন?
—আমি তাঁর স্ত্রী।
—শুনুন, বিশেষ জরুরী দরকার, আমি পুলিস অফিসার—একবার তাকে ডেকে দিন।
একটু পরেই অন্য প্রান্ত থেকে ভারি গলা শোনা গেল। সুরজিৎ ঘোষাল বলছি!
—আমি বালিগঞ্জ থানার ও.সি. সুশীল চক্রবর্তী, আপনাদের হিন্দুস্থান রোডের বাড়ি থেকে বলছি, এখুনি একবার এখানে চলে আসুন।
–কি ব্যাপার?
—এ বাড়িতে একজন খুন হয়েছেন, যত তাড়াতাড়ি পারেন চলে আসুন। বলে সুশীল চক্রবর্তী ফোন রেখে দিলেন।
—ওঁর স্বামী নীচের ঘরে থাকেন বলছিলে না? সুশীলবাবু আবার মানদাকে প্রশ্ন করলেন।
–হ্যাঁ।
—চল তো নীচে।
একজন সেপাইকে ঘরের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রেখে সুশীল চক্রবর্তী মানদাকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামলেন। বাড়িটি দোতলা, ওপরে তিনখানা ঘর, নীচেও তিনখানা ঘর, আর আছে দেড়তলায় একটা ঘর, তার নীচে গ্যারেজ।
সুশীলবাবু যখন ঘরে ঢুকলেন সুশান্ত তখন ঘুমে অচেতন।
সুশীল চক্রবর্তী একবার ঘরটার চারদিকে দৃষ্টি বুলিয়ে নিলেন। একটা বেতের চেয়ার, একটা খাট। এক কোণে দড়ির আলনায় খানকয়েক ময়লা প্যান্ট, শার্ট, লুঙ্গি ঝুলছে আর এক কোণে ছেড়া ময়লা কাবুলী চপ্পল, কাঁচের গ্লাস চাপা দেওয়া একটা জলের কুঁজো। লোকটা শার্ট আর প্যান্ট পরেই ঘুমোচ্ছে।
—শুনছেন, ও মশাই—
কয়েকবার ডাকেও ঘুম ভাঙল না, শেষ পর্যন্ত ধাক্কা দিয়ে সুশান্তর ঘুম ভাঙাতে হল। চোখ রগড়াতে রগড়াতে সুশান্ত উঠে বসল, কে?
–আমি থানা থেকে আসছি, কি নাম আপনার?
–আমার নাম দিয়ে কি হবে আপনার?
—যা জিজ্ঞাসা করছি জবাব দিন-ধমকে উঠলেন সুশীল চক্রবর্তী, কি নাম বলুন?
–সুশান্ত মল্লিক।
—এ বাড়ি আপনার?
–আজ্ঞে না?
—তবে এ বাড়ি কার?
–কে জানে কার।
–জানেন না, অথচ এ বাড়িতে থাকেন, ভারি আশ্চর্য তো! সুরজিৎ ঘোষালকে চেনেন?
—চিনব না কেন?
–কে লোকটা?
—ওপরে গিয়ে মালঞ্চ দেবীকে শুধান না, তিনিই আপনার সব প্রশ্নের জবাব দেবেন।
–মালঞ্চ দেবী কে?
হাসল সুশান্ত, বলল, সুরজিৎ ঘোষালের মেয়েমানুষ।
–আপনি কে হল মালঞ্চ দেবীর?
—কেউ না।
—মিথ্যে কথা বলছেন, মানদা বলছিল উনি আপনার স্ত্রী।
—বাজে কথা, আপনি নিজেই গিয়ে শুধান না ওকে।
–কাকে শুধাব–she is dead.
–তাহলে সত্যি সত্যিই she is dead! জানেন মশাই, ভেবেছিলাম আমিই ঐ মহৎ কর্মটি করব। অর্থাৎ একদিন হত্যা করব ওকে। কিন্তু তা আর হল না, দেখছি, মাঝখান থেকে হালটটাকে আর একজন এসে হত্যা করে গেল। However I am really glad it is don!
—আপনিও এই বাড়িতেই থাকেন?
–হ্যাঁ, মালঞ্চ দেবীর দয়ায়।
–এ বিষয়ে আপনি কিছু জানেন, মানে কে বা কারা তাকে হত্যা করতে পারে?
–না মশাই, আমি আদার ব্যাপারী, আমার জাহাজের সংবাদে কি প্রয়োজন। দেখুন স্যার, তিন রাত আমি ঘুমোইনি। ঘুমে শরীর আমার ভেঙে আসছে, Please, আমাকে একটু ঘুমোতে দিন। বলতে বলতে সুশান্তু আবার খাটের ওপর গা ঢেলে শুয়ে পড়ল।
ঠিক ঐ সময় বাইরে একটা গাড়ি থামার শব্দ শোনা গেল। সুশীল চক্রবর্তী বাইরে এসে দেখলেন, সৌম্য, সুন্দর, হৃষ্টপুষ্ট এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক বিরাট একটা ইমপোর্টেড কার থেকে নামছেন। পরনে পায়জামা-পাঞ্জাবি, পায়ে চঞ্চল।