- বইয়ের নামঃ তাতল সৈকতে
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
০১. মানুষের জীবনে এমন এক একটা ঘটনা
মানুষের জীবনে এমন এক একটা ঘটনা দৈবাত ঘটে যায় যা একটা দুঃস্বপ্নের মতই যেন বাকি জীবনে কখনই সে ভুলতে পারে না। ডাঃ সমর সেনও তার জীবনের এক মধ্যরাত্রির অনুরূপ একটি ঘটনা আজ পর্যন্ত ভুলতে তো পারেইনি, এমন কি আজও যেন মধ্যে মধ্যে তার নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটিয়ে তার মনের মধ্যে অদ্ভুত এক আলোড়নের সৃষ্টি করে। মধ্যে মধ্যে আজও নিদ্রার ঘোরে যেন ডাঃ সমর সেনকে সেই দুঃস্বপ্নটা আতঙ্কিত করে তোলে।
মনে হয় অন্ধকারের মধ্যে যেন কে তার দিকে চেয়ে আছে।
পলকহীন, স্থির নিষ্কম্প, বিভীষিকাময় দুই চক্ষুর কঠিন মৌন দৃষ্টি যেন তারই দিকে তাকিয়ে আছে। এ দৃষ্টি যেন এ জগতের নয়, কোন প্রেতলোকের বায়বীয় দেহের।
হাড় জাগানো বলিরেখাঙ্কিত মুখ : ফ্যাকাশে রক্তহীন লোল চর্ম। বিস্ত কাঁচাপাকা চুলগুলি বলিরেখাঙ্কিত কপালের উপরে নেমে এসেছে।
আর ঐ সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে সেই লোকটির বক্ষে সমূলে বিদ্ধ হয়ে আছে একখানি কালো বাঁটওয়ালা ছোরা।
.
ডাঃ সমর সেনের ঘুমটা আজও আবার ভেঙে গেল।
নিস্তব্ধ মধ্যরাত্রি। ঘরের মধ্যে ও বাইরে অন্ধকার থমথম করছে। নিচ্ছিদ্র জমাট কালো কালির মত নিবিড় অন্ধকার।
তারপরই ডাঃ সমর সেন স্পষ্ট শুনতে পায় বদ্ধ দরজার গায়ে মৃদু করাঘাত করতে করতে কে যেন মৃদু কণ্ঠে ডাকছে, ডাক্তার সাব, ডাক্তার সাব–
কে?
সে রাত্রেও ঠিক অমনি শয়নঘরের বন্ধ দরজার গায়ে মৃদু অথচ স্পষ্ট করাঘাতের শব্দে আচমকা ডাক্তারের ঘুমটা ভেঙে গিয়েছিল।
একটা জটিল অপারেশনের ব্যাপারে সমস্তটা দ্বিপ্রহর ও সন্ধ্যা রাত্রি পর্যন্ত ব্যস্ত থেকে পরিশ্রান্ত ডাক্তার তাড়াতাড়িই গিয়ে শয্যা গ্রহণ করেছিল এবং ঘুমিয়ে পড়েছিল।
হঠাৎ দরজায় করাঘাতের শব্দ ও সেই সঙ্গে কে যেন ডাকছে, সাব, ডাক্তার সাব—
একটা বিশ্রী অস্বস্তির সঙ্গে ডাঃ সেন শয্যার উপর উঠে বসে, কে?
সাব আমি শিবু। একটা জরুরী কল এসেছে।
কল! এত রাত্রে জরুরী কল!
একান্ত বিরক্তচিত্তেই ডাঃ সেন শয্যা থেকে মেঝের উপরে নেমে দাঁড়ায়। মাঘের শেষ, তবে বিহার অঞ্চল বলেই শীতের প্রকোপ যেন একটু বেশীই দাঁত বসায়। খাটের বাজু থেকে গরম ড্রেসিং গাউনটা টেনে নিয়ে গায়ে চাপাতে চাপাতে বিরক্তির সঙ্গেই ঘরের দ্বার অর্গলমুক্ত করে বাইরে এসে দাঁড়াল, কে? কোতা থেকে কল এসেছে?
একেবারে গাড়ি নিয়ে এসেছে সাহেব। আমি বাইরের ঘরে বসতে দিয়েছি। বিনীতভাবে ভৃত্য শিবদাস বলে।
শিবদাস ডাক্তারের কমবাইণ্ড হ্যাণ্ড।
ডাঃ সেন বাইরের দিকে পা বাড়ায়।
একতলা বাংলো প্যাটার্নের ছোটখাটো বাড়িটা। সামনে ও পেছনের দিকে নাতিপ্ৰশস্ত বারান্দা, বারান্দা অতিক্রম করে ডাক্তার ঘরের সামনে এসে ভারী পদাটা তুলে ভিতরে ঢুকল।
ঘরের অত্যুজ্জ্বল আলোয় ডাঃ সেন আগন্তুকের প্রতি দৃষ্টিপাত করে।
গলাবন্ধ কালো রঙের একটা কোট গায়ে, মাথায় উলের মাঙ্কি ক্যাপ এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক ঘরের মধ্যে একটা সোফার উপর পা তুলে দিয়ে শীতে জবুথবু ভাবে বসে।
ডাঃ সেনের পদশব্দে লোকটি উঠে দাঁড়ায় : নমস্কার। আপনিই বোধ হয় ডাঃ সেন?
হ্যাঁ।
বলছিলাম কি, এখুনি আজ্ঞে, আপনাকে একটিবার শ্রীনিলয়ে যেতে হবে।
শ্রীনিলয়! কার বাড়ি? ভ্রূকুঞ্চিত করে ডাক্তার প্রশ্ন করে।
বলছিলাম কি, সাত-সাতটা কোল মাইনসের প্রোপাইটার রায় বাহাদুর দুর্যোধন চৌধুরীর নাম শোনেননি আজ্ঞে?
না। শোনবার সৌভাগ্য হয়নি। একটু ব্যঙ্গভরেই যেন জবাবটা দেয় ডাঃ সেন। তা কেষ্টা কি, কারই বা অসুখ?
বলছিলাম কি, অধীন সামান্য তশীলদার। সংবাদ তো জানি না আজ্ঞে, তবে রায়বাহাদুরেরই অসুখ—তিনিই আজ্ঞে রোগী।
হুঁ। এখান থেকে আপনার শ্রীনিলয় কতদূর?
তা মাইল দশেক পথ হবে।
ফিস্ কিন্তু আড়াইশো টাকা নেব।
তাই পাবেন। বলছিলাম কি, একটু তাড়াতাড়ি করলে—
বসুন। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমি আসছি।
ডাক্তার ঘর হতে বের হয়ে গেল।
লোকটিকে বাইরের ঘরে বসতে বলে শয়নঘরে ঢুকে বেশ বদলাতে বদলাতে ডাক্তার কলটির কথাই ভাবছিল।
সত্যি কথা বলতে কি ডাক্তার একটু যেন বিস্মিতই হয়। এ তল্লাটে আড়াইশো টাকা ফিস এক কথায় দিতে রাজী হয়! তাছাড়া ডাঃ সেন বৎসরখানেক হয় এখানে এসে প্র্যাকটিস শুরু করেছে, কিন্তু কই রায়বাহাদুর দুযোধন চৌধুরী বা শ্রীনিলয়ের নাম ইতিপূর্বে কখনও শুনেছে বলে তো মনে পড়ে না। তাই যেন কিছুটা কৌতূহল জাগে মনের মধ্যে।
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই প্রস্তুত হয়ে ডাক্তার পুনরায় বসবার ঘরে ফিরে এসে বলে, চলুন। আগে সেই বৃদ্ধ ও পশ্চাতে ডাঃ সেন তাকে অনুসরণ করে ওরা বাইরে এসে দাঁড়ায়। আকাশে স্বল্প জ্যোৎস্না পাতলা একটা কুয়াশার আবরণের তলায় যেন মৃতি হয়ে পড়ে আছে। কুয়াশাচ্ছন্ন সেই মৃদু জ্যোৎস্নালোকে ডাক্তার দেখতে পায় গেটের অনতিদূরে কালো রঙের একখানা সুবৃহৎ প্যাকার্ড-গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে তূপীকৃত একটা ছায়ার মতই।
বৃদ্ধই এগিয়ে গিয়ে গাড়ির সামনে উপবিষ্ট ড্রাইভারকে সম্বোধন করে বলে, রামনরেশ, দরজাটা খুলে দাও।
ডাক শুনেই ড্রাইভার নিঃশব্দে গাড়ি থেকে নেমে এসে দরজা খুলে দিল।
উঠুন ডাক্তারবাবু।
আগে ডাক্তার ও পশ্চাতে বৃদ্ধ গাড়ির মধ্যে উঠে বসে অতঃপর।
গাড়ির দরজা বন্ধ করে দিয়ে রামনরেশও গাড়িতে উঠে বসে স্টার্ট দিল।
গাড়ি নিঃশব্দ গতিতে অগ্রসর হয়ে দক্ষিণ দিকে বাঁক নিয়ে মেটাল রোডের উপর পড়তেই স্পীড় নেয় প্রায় ঘণ্টায় পঞ্চাশ মাইলের কাছাকাছি।
নিস্তব্ধ মৃদু কুয়াশা ঘেরা, স্বল্প চন্দ্রালোকিত মধ্যরাত্রি।
মেটালে বাঁধানো মসৃণ উঁচু-নীচু পাহাড়ী পথ।
সুতীব্র হেড লাইটের আলো ফেলে গাড়ি ছুটছে হুঁ হুঁ করে গন্তব্যপথে।
ডাক্তার পকেট থেকে চামড়ার সিগার কেসটা বের করে একটা সিগারে অগ্নিসংযোগ করল।
জ্বলন্ত সিগারে গোটা দুই টান দিয়ে পাশে উপবিষ্ট বৃদ্ধের দিকে আড়চোখে একবার তাকিয়ে। মৃদু কণ্ঠে প্রশ্ন করল, আপনার নামটা জানতে পারি কি?
বিলক্ষণ। শ্রীকুণ্ডলেশ্বর শম। ব্রাহ্মণ, বারেন্দ্র শ্রেণী–কাশ্যপ গোত্র–
ভদ্রলোকের নামের সঙ্গে সঙ্গে গোত্রের পরিচয়টা পর্যন্ত পেয়ে ডাক্তার যে একটু বিস্মিত হয়নি তা নয়। তাই কিছুক্ষণ অতঃপর চুপ করেই থাকে। তারপর আবার প্রশ্ন করে, হুঁ, আচ্ছা কুণ্ডলেশ্বরবাবু, রায়বাহাদুরের অসুখটা কি কিছুই জানেন না আপনি?
বলছিলাম কি আজ্ঞে, জানিও বটে আবার জানি নাও বটে।
কুণ্ডলেশ্বরের কথায় ডাক্তার এবার যেন একটু বেশ কৌতূহলী হয়ে ওঠে এবং অন্তরের কৌতূহলটা চেপে রাখতে না পেরে প্রশ্ন করে, কি রকম? জানেন অথচ আবার জানেনও না!
আজ্ঞে তাই।
হুঁ, তা কতদিন রায়বাহাদুরের ওখানে কাজ করছেন?
তা বিশ বৎসর। হ্যাঁ, তা বলছিলাম কি, তাই হবে বইকি।
ওঃ, তবে তো অনেক দিন আছেন। অনেক দিনকার পুরনো লোক আপনি।
তা তো বটেই। তবে বলছিলাম কি আজ্ঞে, নিজে যখন যাচ্ছেন সবই তো আজ্ঞে স্বচক্ষে দেখবেন আর জানতেও পারবেন আজ্ঞে।
ডাঃ সেন বুঝতে পারে যে কোন কারণেই হোক কুণ্ডলেশ্বর রায়বাহাদুরের রোগের সংবাদটি তাকে দিতে ইচ্ছুক নয় আপাততঃ।
এরপর আর পীড়াপীড়ি করাটা শোভন দেখায় না, অতএব নিঃশব্দে সে ধূমপানই করতে থাকে।
.
ইউরোপ থেকে বহু কষ্টে নিজের চেষ্টায় এফ.আর.সি.এস হয়ে এসে কলকাতা শহরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য সচেষ্ট হয় ডাঃ সমর সেন নবীন উদ্যমে ও আশায়, কিন্তু দু বছর ধৈর্য ধরে থেকেও যখন প্র্যাকটিসের ব্যাপারে বিশেষ কোন সুবিধাই করতে পারল না ডাঃ সমর সেন—এবং প্রায় উপবাসের সামিল—অর্থাৎ যে বস্তুটি হলে স্থূলভাবে এ জগতে বেঁচে থাকা চলে সেই অর্থের অনটনটা ক্রমশঃ এমন জটিল হয়ে উঠতে লাগল যে উপবাসও বটে, সেই সঙ্গে অস্তিত্বটুকুও যাবার যোগাড় তখন বিলাতী খেতাবটা পকেটস্থ করে এক প্রকার বাধ্য। হয়েই মহানগরীর মায়া ত্যাগ করেছিল সে। তারপর কিছুদিন ধরে অনেক ভেবে সে কোন এক ধনী বন্ধুর কাছ থেকে হাজার দুই টাকা ধার করে বিহারের এই খনিপ্রধান অঞ্চলে এসে ডেরা বেঁধে প্রাটি শুরু করল।
এবারে বোধ হয় ভাগ্যদেবী সুপ্রসন্ন ছিলেন। বৎসরখানেকের মধ্যেই সুচিকিৎসক হিসাবে সমর সেনের নামটা আশপাশে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
এবং ইতিমধ্যে চার-পাঁচ মাইলের মধ্যে যত ধনী কোল মাইনসের প্রোপাইটার সকলের সঙ্গে অল্পবিস্তর পরিচয় ঘটেছিল কিন্তু আজ পর্যন্ত রায়বাহাদুর দুযযাধন চৌধুরীর নাম তো সে শোনননি।
বিচিত্র কৌতূহলকে কেন্দ্র করে সময়ের মনের মধ্যে নানাবিধ চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল। কুণ্ডলেশ্বর শমা নিস্তব্ধ নিঝুম হয়ে তার পাশেই বসে আছে।
অন্ধকারে আর একবার চোখ ঘুরিয়ে তাকাল সমর কুণ্ডলেশ্বরের দিকে, কিন্তু দেখা গেল লোকটার মুখ। ভদ্রলোকের নামটিও অদ্ভুত। নিঃশব্দ গতিতে দামী গাড়ি মসৃণ রাস্তার উপর দিয়ে যেন হাওয়ার বেগে ছুটে চলেছে। আঁকাবাবাঁকা উচুনীচু পথ। একটানা গাড়ির ইঞ্জিনের একটা চাপা গোঁ গোঁ শব্দ ও হাওয়ার সোঁ সোঁ শব্দের সংমিশ্রণ। মধ্যরাত্রে ঘুম ভেঙে তোলায় চোখের পাতায় ঘুম যেন তখনও জড়িয়ে আছে।
এবং গাড়ির দোলায় কখন একসময় বুঝি ঘুমিয়েও পড়েছিল সমর—হঠাৎ একটা মৃদু ঝাঁকুনি ও একটা দীর্ঘ বিশ্রী চিৎকারে তন্দ্রা ছুটে গেল।
উঁ! উঁ!
কুয়াশাচ্ছন্ন সামান্য যেটুকু চন্দ্রকিরণ প্রকৃতি জুড়ে এতক্ষণ স্বপ্নের মতই বিরাজ করছিল, ইতিমধ্যে সেটুকুও যেন কখন নিভে গিয়েছে।
থমথমে অন্ধকারে বিশ্রী চিৎকারের শব্দটা যেন ভৌতিক এক বিভীষিকার মত রাত্রির অন্ধকারকে চিরে দিয়ে গেল।
সমর চমকে চোখ মেলে তাকায়। ড্রাইভার রামনরেশ ততক্ষণে গাড়ি থামিয়ে নেমে দাঁড়িয়ে হাতল ঘুরিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দিয়েছে।
বলছিলাম কি আজ্ঞে, শ্রীনিলয়ে এসে গেছি ডাক্তারবাবু–নামুন আজ্ঞে।
কুণ্ডলেশ্বরের কথায় সমর গাড়ি থেকে নামে। পোটিকোর নীচে গাড়ি দাঁড়িয়েছে। সামনেই টানা দীর্ঘ বারান্দা লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা।
স্বল্প-শক্তির একটা প্রজ্বলিত বৈদ্যুতিক বাতি পোটিকোর সিলিং থেকে ঝুলছে, তারই মৃদু আলোয় বারান্দার কিয়দংশ ও সম্মুখের পোর্টিকো আলো-আঁধারিতে যেন অদ্ভুত একটা রহস্যে নিবিড় হয়ে উঠেছে।
সমর গাড়ির ভেতর থেকে তার ডাক্তারী ব্যাগটা নামাতে যেতেই কুণ্ডলেশ্বর বাধা দিল, থাক। বলছিলাম কি আজ্ঞে, কৈরালাপ্রসাদই নামিয়ে আনবেখন। চলুন।
কুণ্ডলেশ্বরের ইঙ্গিতে সমর সিঁড়ি অতিক্রম করে বারান্দা-পথে অগ্রসর হয়। আগে কুণ্ডলেশ্বর, পেছনে সমর। দীর্ঘ বারান্দা অতিক্রম করে কুণ্ডলেশ্বরকে অনুসরণ করে একসময় উভয়ে প্রকাণ্ড একটা বন্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়।
দরজার গায়ে কলিং বেল টিপতেই অল্পক্ষণ পরে নিঃশব্দে বৃহৎ দ্বার উন্মুক্ত হল।
চলুন—
প্রকাণ্ড একটা হলঘর। একটি মাত্র স্বল্প-শক্তির নীলাভ বৈদ্যুতিক বাতির আলোয় ঘরটা স্বল্পালোকিত। বারেকের জন্য চোখ তুলে সমর ঘরের চতুর্দিকে একবার দৃষ্টিপাত করল।
ঐশ্বর্যের প্রাচুর্যে সমগ্র ঘরখানি যেন একেবারে ঠাসা, তবে রুচি বা শৃঙ্খলার কোন চিহ্নই পরিলক্ষিত হয় না। মেঝেতে পুরু গালিচা বিস্তৃত: বড় বড় কারুকার্যমণ্ডিত মেহগনি কাঠের আলমারি গোটাচারেক। একপাশে খানপাঁচেক সোফা। একপাশে প্রকাণ্ড একটি শ্বেতপাথরের টেবিল টেবিলের দুদিকে খান আষ্টেক চেয়ার।
এক কোণে একটি ট্যান করা বৃহৎ ব্যাঘ্রমূর্তি জিঘাংসায় ধারাল দন্ত বিকশিত করে আছে। কাঁচের চোখ দুটো ধকধক করে জ্বলছে নীলাভ দ্যুতিতে।
দেওয়ালের সর্বত্র বড় বড় সব বিদেশী নরনারীর তৈলচিত্র।
বেশীর ভাগই ইংরাজ অধীশ্বর ও অধীশ্বরীদের। এক কোণে সুবৃহৎ পাথরের স্ট্যাণ্ডে একটি সুদৃশ্য দামী জামান ক্লক দণ্ডায়মান। ঐ সময় হঠাৎ ঢং ঢং করে রাত দুটো ঘোষণা করল ক্লকটা। ক্লকের সঙ্কেতধ্বনি যেমন গম্ভীর তেমনি মিষ্টি।
ঘড়ির ঘণ্টাধ্বনিটা প্রায় মিলিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই অদ্ভুত বামন আকৃতির এক নেপালী ভৃত্য ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করতেই কুণ্ডলেশ্বর তাকে সম্বোধন করে বলে, সিক্রিটারীবাবুকে সংবাদ দে কৈরালা, ডাক্তারবাবু এসেছেন।
ডাক্তার সাকা উপরমে লে যানে কো হুকুম হায়, কৈরালা বলে।
ও, বলছিলাম কি, তাহলে আজ্ঞে যান ওর সঙ্গেই। আমি আপনার ব্যাগটি পাঠিয়ে দিচ্ছি।
সহসা এমন সময় আবার সেই পূর্বের বিশ্রী চিৎকারটা রাত্রির অন্ধকারে শোনা গেল।
ও কিসের চিৎকার কুণ্ডলেশ্বরবাবু? সমর প্রশ্ন না করে আর পারে না।
আজ্ঞে, নাইটকীপার হুম্ সিং পাহারা দিচ্ছে। আজ্ঞে তাহলে বলছিলাম কি আপনি যান—
নাইটকীপার?
হ্যাঁ, নাইটকীপার হুম্ সিং সারারাত জেগে অমনি করে শ্রীনিলয় পাহারা দেয়।
চলিয়ে ডাক্তার সাব—
কৈরালাপ্রসাদের ডাকে সমরের সম্বিৎ যেন আবার ফিরে আসে। আত্মগত চিন্তায় সে কেমন যেন একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল।
চল—
কৈরালাপ্রসাদকে অনুসরণ করে সমর।
হলঘরটি অতিক্রম করে উভয়ে আর একটি স্বল্পালোকিত দীর্ঘ লম্বা বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। এত বড় বারান্দায় কেবলমাত্র একটি সিলিং থেকে ঝুলন্ত স্বল্প-শক্তির বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলছে, সে আলোয় অন্ধকার তো দূরীভূত হয়ইনি বরং অন্ধকার আরও যেন ঘন ও রহস্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
সমরের কেমন বিস্ময় বোধ হচ্ছিল। এত বড় জাঁকজমকপূর্ণ ধনীর প্রাসাদতুল্য বাড়ি অথচ আলোর ব্যবস্থা এত কম কেন!
আর আলোর ব্যবস্থায় অহেতুক এই কার্পণ্যই বা কেন! এর কারণই বা কি?
শুধু আলোর ব্যবস্থাই যে কম তাই নয়, সমস্ত বাড়িটা জুড়ে অদ্ভুত একটা স্তব্ধতাও যেন থম থম করছে।
মনে হয় যেন এ কারও কোন বাড়ি বা বাসস্থান নয়, কোলাহলমুখরিত নগরীর দূরপ্রান্তে পরিত্যক্ত ভয়াবহ এক নিঃশব্দ বিরাট কোন এক কবরখানা।
রাত্রির অন্ধকারে সেখানে কালো বাদুড়ের ডানার মত ছড়িয়ে পড়ে নিঃসীম কালো শুন্যতা। অশরীরী প্রেতের নিঃশব্দ পদবিক্ষেপে ও দীর্ঘশ্বাসে সেখানকার বায়ুতরঙ্গ হিমানীর মত ঠাণ্ডা, সবাঙ্গে শিহরণ জাগায়, প্রতি রোমকূপে রোমকূপে ভীতির অনুভূতি তোলে।
বলাই বাহুল্য সিঁড়িপথেও তেমন আলোর ব্যবস্থা নেই। মৃদু আলোছায়াচ্ছন্ন প্রশস্ত সিঁড়িপথ অতিক্রম করে বামন আকৃতির কৈরালাপ্রসাদকে অনুসরণ করে দ্বিতলে অনুরূপ একটি দীর্ঘ বারান্দার প্রান্তে এসে সমর দাঁড়ায় এবং সেখানে পৌঁছেই বামন কৈরালাপ্রসাদ ঘুরে দাঁড়ায় এবং চাপা কণ্ঠে বলে, চলে যান, সামনেই ঘর।
কথা কটি বলে এবং দ্বিতীয় কোন বাক্যোচ্চারণে সমরকে অবকাশ মাত্রও না দিয়ে নিমেষে অত্যন্ত দ্রুতপদে কৈরালাপ্রসাদ সিঁড়িপথ দিয়ে নেমে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ঘটনার অত্যন্ত দ্রুত আকস্মিকতায় সমর যেন কতকটা হতবুদ্ধি ও বিহ্বল হয়ে আলোছায়াচ্ছন্ন বারান্দার প্রান্তে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে।
সম্মুখে পর পর অনেকগুলি ঘরের দরজা। কৈরালাপ্রসাদ বলে গেল সামনের ঘরে যেতে কিন্তু কোন্ ঘরে সে যাবে!
হতবুদ্ধি সমর যন্ত্রচালিতের মতই কতকটা অগ্রসর হয়ে প্রথম বন্ধ দরজাটার গায়ে হাত দিয়ে ঈষৎ ঠেলা দিতেই দরজা খুলে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে মধুর বীণাযন্ত্রসহযোগে অপূর্ব সুমিষ্ট নারীকণ্ঠসঙ্গীতের একটা ঝাপটা কানে এসে প্রবেশ করে : খুল খুল যায় বাজুবন্দ।
সঙ্গীত ও সেই সুরের আকর্ষণে বোধ হয় মন্ত্রমুগ্ধের মত অত্যুজ্জ্বল আলোকোদ্ভাসিত সেই কক্ষের উন্মুক্ত দ্বারপথেই ভিতরে গিয়ে দাঁড়ায় সমর।
উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলোর প্রভায় সমগ্র কক্ষখানি যেন ঝলমল করছিল।
বাড়ির সর্বত্র অন্ধকার অথচ ঐ কক্ষটি যেন আলোয় ঝলমল। তাছাড়া রোগী দেখতে এই মধ্যরাত্রে যে বাড়িতে সে এসেছে সেই বাড়িরই কোন ঘরে ঐ রকম সঙ্গীতের আনন্দ বসবে ব্যাপারটা সহসা যেন কেমন সমর সেনের বোধগম্য হয় না। তাই কতকটা বিস্ময় বিমূঢ় হয়ে সে দাঁড়িয়ে যায়।
সমস্ত মেঝে জুড়ে দামী গালিচা বিস্তৃত এবং মাঝখানে ফরাস বিছানো। সেই ফরাসের উপর অপূর্ব সুন্দরী এক যুবতী কোলের কাছে বীণা নিয়ে বীণে সুরঝঙ্কারের সঙ্গে নিজের মধুস্রাবী কণ্ঠস্বরকে গঙ্গা-যমুনার ধারার মতই মিলিয়ে দিয়েছে।
অদূরে উপবিষ্ট পঞ্চাশের ঊর্ধ্বেই হবে, এক অতীব সুশ্রী ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত শ্যামকান্তি প্রৌঢ় ব্যক্তি।
প্রৌঢ়ের কাঁধের উপর দামী একখানা কাশ্মীরী শাল কাঁধ থেকে মাটিতে নেমেছে। প্রৌঢ়ের হাতে একটি কাঁচের রঙীন সুরা-ভর্তি পাত্র, পেগ গ্লাস।
যন্ত্র ও কণ্ঠের মিলিত সুরধারা যেন সুধাক্ষরণ করছিল কক্ষমধ্যে।
গায়িকার সুরেলা কণ্ঠ তখনও মিনতি করছে বারংবার : খুল খু যায় বাজুবন্দু। সুরের ধারায় সম্মোহিত সমর যেন সব কিছু ভুলে যায়।
সে যেন ভুলে যায় কেন সে এখানে এসেছে। সে যে একজন ডাক্তার এবং বিশেষ একটি রোগীর সঙ্কটময় পরিস্থিতির দরুন তাকে এই মধ্যরাত্রে ঘুম ভাঙিয়ে ডেকে আনা হয়েছে, কিছুই যেন মনে পড়ে না।
কতক্ষণ ঐ ভাবে মন্ত্রমুগ্ধের মত দাঁড়িয়ে ছিল সমর তার নিজেরও মনে নেই হঠাৎ চমকে ওঠে পিঠের ওপর যেন কার অলক্ষিত মৃদু করস্পর্শে।
চমকে তাকায় সমর সেন, তার ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়ে থোগা ডিগডিগে এক ব্যক্তি,দৈর্ঘ্য প্রায় ছ ফুটেরও ইঞ্চিখানেক বোধ হয় বেশী হবে। যেমন দৈর্ঘ্যে সেই অনুপাতে প্রস্থে একেবারে শূন্যের কোঠায় বললেও চলে।
মাথার চুল ছোট ছোট করে কদমছাঁট করা। শকুনের মত দীর্ঘ বাঁকানো নাসিকা ও ক্ষুদ্র গোলাকার চোখ। চোখের দৃষ্টি স্থির ঘষা কাঁচের ন্যায় ফ্যাকাসে প্রাণহীন। সহসা দেখলে প্রেতের চাউনি বলেই মনে হয়।
মুখের দু পাশের হনু দুটি বিশ্রীভাবে সজাগ হয়ে আছে। দাড়ি নিখুঁতভাবে কামানো।
ডান হাতের হাড় বের করা শিরাবহুল তর্জনীটি ওষ্ঠের ওপর স্থাপন করে ইশারায় লোকটি সমরকে কথা বলতে নিষেধ জানাল এবং স্থির ঘষা কাঁচের মত ফ্যাকাসে দৃষ্টি দিয়ে যেন বলে—আমার সঙ্গে আসুন।
কতকটা যন্ত্রচালিতের মতই সমর দ্বিতীয় আর বাক্যব্যয় না করে লোকটিকে অনুসরণ করে বাইরের স্বল্পালোকিত বারান্দায় এসে দাঁড়াল।
স্প্রিং অ্যাকশনে ঘরের দরজাটা পুনরায় ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
০২. মামাকে দেখতে এসেছেন
ও ঘরে নয়। মামাকে দেখতে এসেছেন তো আপনি?
সমর কতকটা বোকার মতই যেন ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি জানায়, হ্যাঁ—
চলুন ঐ ঘরে।
কোন মানুষের কণ্ঠস্বর এতখানি কর্কশ, চাপা ও অস্বাভাবিক হতে পারে সমরের যেন ধারণারও। অতীত ছিল।
অবাক বিস্ময়ে তখনও সমর লোকটির দিকে তাকিয়ে ছিল।
লোকটার পরিধানে পায়জামা ও গায়ে একটা কালো রঙের ভারী গ্রেট কোট।
আশ্চর্য! অমন রোগা লোকটা অতবড় একটা ভারী গ্রেট কোট কেমন করে গায়ে দিয়ে আছে।
আপনি–কি যেন বলবার চেষ্টা করে সমর।
লোকটি পূর্ববৎ কর্কশ গলায় বলে, আমি রায়বাহাদুর দুর্যোধন চৌধুরীর ভাগ্নে। আমার নাম শকুনি ঘোষ।
শকুনি ঘোষ! বিস্মিত হতভম্ব সমর পাল্টা প্রশ্নটা যেন নিজের অজ্ঞাতেই উচ্চারণ করে ফেলে।
হা হা করে লোকটা বিশ্রী কুৎসিত ভাবে একটা চাপা হাসি হেসে ওঠে। মনে হয় যেন করাত দিয়ে কেউ কাঠ চিরছে ঘ্যাস ঘ্যাস শব্দে।
আজ্ঞে, মাতুল দুর্যোধনের ভাগিনেয় শকুনি। কেন, মহাভারত পড়েননি? নামটা আবার আমার ঐ মামারই দেওয়া। চলুন–
আর দ্বিতীয় বাক্যব্যয় না করে এবারে সমর অগ্রসর হয় শকুনিকে অনুসরণ করে, একেবারে বারান্দার শেষ প্রান্তের বদ্ধ দরজাটা ঠেলে খুলতে কতকটা জড়িত চাপা কণ্ঠের একটা চিৎকার সমরের কানে এসে প্রবেশ করল, সম্পত্তি ভোগ করবে! আমার এত কষ্টের সম্পত্তি শালারা বারো ভূতে লুটে খাবে! একটি আধলা পয়সাও নয়। কোন শালাকে একটা কানাকড়িও দেব না।
সমর তখন শকুনির নীরব চোখের ইঙ্গিতে কক্ষের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে।
বড় আকারের হলঘরের মত বেশ প্রশস্ত একখানা ঘর।
ঘরের ঠিক মাঝামাঝি কালো রঙের একটা ভারী পর্দা ঝুলছিল অনেকটা পার্টিশনের মত।
পর্দার ওপাশ থেকে নীলাভ আলোর একটা দ্যুতির চাপা ইশারা পাওয়া যায়। পর্দার ওপাশ থেকেই কণ্ঠস্বরটা শোনা যায় বেশ স্পষ্ট এতক্ষণে। আর একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ডাঃ সেন ঘরের চারদিকে তাকায়। পর্দার এপাশে একটি বেশ বড় সাইজের গোলাকার টেবিলের চারপাশে খানপাঁচেক চেয়ার ও গোটা দুই সোফা, একটা সেলফ-সেলফের তিনটি তাকে নানাবিধ ওষুধপত্রের ছোট-বড় নানা আকারের শিশি, রোগীর খাবার ও ফিডিং কাপ, স্প্রে, ড়ুস-কেনিউলা প্রভৃতি সাজানো রয়েছে।
এবং ডাঃ সেনের নজরে পড়ে ঘরের দুটি সোফা অধিকার করে পাশাপাশি দুজন ভদ্রলোক বসে আছেন নিঃশব্দে। আর তাঁদের সামনে একজন দাঁড়িয়ে।
তাঁদের মধ্যে একজন মনে হয় মধ্যবয়সীই হবেন, প্যান্ট ও সাট পরিধানে, গলায় স্টেথোটি জড়ানো, উনি যে একজন চিকিৎসক বোঝা গেল। দ্বিতীয় ব্যক্তি অল্পবয়সী, তেইশ-চব্বিশের মধ্যে, পরিধানে তার ধুতি ও গায়ে একটি শাল জড়ানো।
তৃতীয় যে দাঁড়িয়ে, তার বয়স চৌত্রিশ-পয়ত্রিশের মধ্যে হবে। মাথার চুল ব্যাক-ব্রাস করা, সযত্নে।
বেশ উঁচু লম্বা চেহারা এবং অতি সুশ্রী। চোখে পুরু লেন্সের কালো সেলুলয়েডের ফ্রেমের চশমা। ভদ্রলোকের পরিধানে ধুতি ও শেরওয়ানী।
শেরওয়ানীর বোতামগুলি খোলা। দণ্ডায়মান ব্যক্তির নজরই ঘরে প্রবেশ করবার পর সর্বপ্রথম সমর ও শকুনির উপরে পড়ল। এবং কেউ কিছু বলবার আগে শকুনিই বলে তার সেই বিশ্রী গলায়, ডক্টর সেন। উপবিষ্ট দুজন সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ান বোধ হয় ডাক্তারকে অভ্যর্থনা জানাতেই। আর ঠিক ঐ সময়ে পর্দার ওপাশ থেকে আবার কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
অত্যন্ত বিরক্তিপূর্ণ চাপা ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর : শালারা ভাবছে আমি কিছু বুঝি না! আমায় slow poison করছে, টের পাচ্ছি না, না? সব—সব জানি। সব বুঝতে পারছি, পুলিশ সাহেব মিঃ দালালকে চিঠি দিয়েছি। Conspiracy—বিরাট ষড়যন্ত্র চলেছে—সব জানিয়েছি তাকে।
কতকটা স্তম্ভিত হয়েই যেন ডাঃ সেন সেই কথাগুলো শুনছিল, হঠাৎ অন্য একটি কণ্ঠস্বরে ডাঃ সেন সামনের দিকে তাকায়। প্যান্ট-কোট পরিহিত ভদ্রলোকটি এগিয়ে এলেন এবং মৃদু মোলায়েম কণ্ঠে বললেন, আসুন ডাঃ সেন। এবং পরক্ষণেই ঘরের মধ্যে উপস্থিত প্রথম ভদ্রলোকটির দিকে নির্দেশ করে বললেন, ইনি ডাঃ সানিয়াল, দাদার attending physician.
উভয়ে উভয়কে নমস্কার ও প্রতিনমস্কার জানায়।
ওপাশে পর্দার আড়ালে অদৃশ্য কণ্ঠস্বর তখন আবার নীরব হয়ে গিয়েছে।
আপনি attending physician, অন্য কোন বড় ডাক্তার রায়বাহাদুরকে দেখেছেন কি?
সমরের কথায় মৃদু হাসির ক্ষীণ একটা আভাস ডাঃ সানিয়ালের ওষ্ঠপ্রান্তে দেখা দিয়েই আবার পরক্ষণেই মিলিয়ে যায়।
তারপর বলেন, বলুন বরং কে রায়বাহাদুরকে আজ পর্যন্ত দেখেননি! কলকাতার হেন বড় ডাক্তার নেই ওঁকে একাধিকবার এসে দেখে যাননি।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। রায়বাহাদুরের একটা ডাক্তার ফোবিয়া আছে বলতে পারেন; এক বছর ধরে এক প্রকার শয্যাগত হয়ে আছেন। আর সেই থেকে আজ পর্যন্ত অ্যানজাইনার সাতটা অ্যাটাক হয়েছে–
বিস্ময়-বিস্ফারিত চক্ষে তাকাল সমর ডাঃ সানিয়ালের মুখের দিকে এবং বলে, বলেন কি?
হ্যাঁ, ডাঃ সানিয়াল বলেন, রায়বাহাদুরের একটা নয়, দশটা নাকি হার্ট আছে। শুধু কি তাই ডাঃ সেন, ভদ্রলোকের বয়স ষাটের কোঠায়। আটবার ডবল নিউমোনিয়ার অ্যাটাক, সাতবার অ্যাকিউট ব্যাসিলারী ডিসেন্ট্রি, তিনবার পারনিসা ম্যালেরিয়া ও দুবার টাইফয়েডে ভুগেছেন। এবারের অ্যাটাকটা হার্ট অ্যাটাক থেকে শুরু হয়, বর্তমানে এক বৎসর শয্যাশায়ী। এখন জেনারেল অ্যানাসারকা উইথ কনজেসটিভ হার্ট ফেলিওর।
হুঁ। তা আমি ওঁকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি—
বেডসোর থেকে গ্যাংগ্রিন হতে চলেছে তাই আপনাকে ডাকা হয়েছে—
ও–কথাটা উচ্চারণ করে সমর চুপ করে যায়।
বুঝতে পারে না ঐজন্য এত রাত্রে এই ভাবে তাকে ঘুম ভাঙিয়ে তুলে আনবার এমন কি জরুরী প্রয়োজন ছিল।
সমর ভাবছিল, শুধু এই বাড়িটা, তার আবহাওয়া ও এখানকার বাসিন্দারাই বিচিত্র নয়, এ-বাড়ির সব কিছুই যেন কেমন বিচিত্র। কোথাও স্বাভাবিকতার যেন লেশমাত্র নেই। শুধু বিচিত্র হলেও বুঝি কথা ছিল, সেই বৈচিত্রের মধ্যে যেন একটা রহস্যের ইঙ্গিত।
ঢং করে রাত্রি আড়াইটে ঘোষণা করে ঘরের দেওয়ালে বসানো একটি ওয়াল-ক্লক ঐ সময়।
এবং সঙ্গে সঙ্গে আবার পর্দার ওপাশ থেকে শোনা গেল সেই পূর্ব কণ্ঠস্বরডাক এল, ডাক্তার!
কণ্ঠস্বরে পূর্বের মতই বিরক্তি।
ডাঃ সানিয়াল হন্তদন্ত হয়ে যেন পর্দার ওপাশে চলে গেলেন।
ওপাশের কথাবাতা স্পষ্টই শোনা যাচ্ছিল। ডাঃ সেন কান পেতে থাকে।
আমাকে ডাকছিলেন রায়বাহাদুর?
কি কর? তুমি-তুমিও ঐ ষড়যন্ত্রের মধ্যে আছ নাকি?
আজ্ঞে–
সব টের পাই। শকুনিও আছে, সে বেটাও ষড়যন্ত্র করছে। তাড়াও। তাড়াও দুঃশাসনকে তাড়াও। জান না he is dangerous
ডাক্তার সানিয়াল বোধ হয় রায়বাহাদুরের কথার কোন জবাব দিলেন না, পার্শ্ববতী নার্সকে সম্বোধন করে বললেন, নার্স, ঘুমের ওষুধটা দিয়েছিলেন?
সঙ্গে সঙ্গে রোগীর তীব্র-তীক্ষ্ণ প্রতিবাদ শোনা গেল, না না—ঘুম পাড়িয়ে তোমরা সকলে মিলে আমাকে খুন করতে চাও। আমি কিছু বুঝি না বটে, না!! Get out বের হয়ে যাও সব এখান থেকে, দূর হও। খাব না, ঘুমের ওষুধ খাব না।
ডাঃ সানিয়ালের কণ্ঠস্বর শোনা যায়। তিনি বলেন, ডাঃ বর্ধন আজ ফোনে বলেছেন ঐ ওষুধটা দিতে
একটা আর্ত যন্ত্রণাকাতর শব্দ শোনা গেল।
পরক্ষণেই আবার শোনা গেল রায়বাহাদুরের কণ্ঠস্বর : বলুক, আমি খাব না—কিন্তু যা বলেছিলাম তা করা হয়েছে? ডাঃ সেনকে কল দেওয়া হয়েছে?
হ্যাঁ, তিনি এসেছেন—
কোথায়? ডাক-ডাক তাকে—
ডাঃ সেন এবারে নিজেই পর্দার দিকে এগিয়ে যায়।
প্রকাণ্ড একটা পালঙ্কের উপরে রবারের গদি ও ব্যারেস্টের সাহায্যে রোগীকে উঁচু করে শয্যার উপরে শোয়ানো আছে।
এক কোণে ত্রিপয়ের ওপর নীল কাঁচের ডোমে ঢাকা স্বল্পশক্তির একটি বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলছে, বাতির নীলাভ আলোয় শয্যার উপরে শায়িত রোগী রায়বাহাদুর দুর্যোধন চৌধুরীর দিকে তাকাল সমর। প্রকাণ্ড উপাধানের উপরে সবঙ্গ সাদা চাদরে আচ্ছাদিত রায়বাহাদুর শুয়ে আছেন। কেবলমাত্র রোগীর মুখখানা দেখা যায় আর সব ঢাকা।
নিরাশা, ক্রোধ, বিরক্তি, বেদনা ও বিতৃষ্ণা সব কিছু যেন একসঙ্গে ফুটে উঠেছে বলিরেখাঙ্কিত রোগীর সেই মুখের ওপরে। হাড় ও চর্মসার মুখখানা, মাথার চুল ছোট ছোট করে ছাঁটা।
সমস্ত হাড়সর্বস্ব মুখখানির মধ্যে দীর্ঘ উন্নত নাসিকা যেন উদ্ধত একটা প্রশ্নের মত জেগে আছে।
চক্ষুর পাতা দুটি মুদ্রিত। পাশে দাঁড়িয়ে ডাঃ সানিয়াল ও মাথার সামনে ওষুধের গ্লাস হাতে স্থিরনির্বাক দাঁড়িয়ে তখনও একটি অল্পবয়সী অত্যন্ত সুশ্রী ক্রিশ্চান বাঙালী নার্স।
ডাঃ সেন এসেছেন—
কথাটা ডাঃ সানিয়াল রায়বাহাদুরকে জানালেন।
চক্ষু মুদ্রিত অবস্থাতেই রায়বাহাদুর প্রশ্ন করেন, কোথায়?
সমর আরও একটু এগিয়ে গিয়ে একেবারে রোগীর শয্যার সামনে দাঁড়াল।
রায়বাহাদুর চোখ খুললেন এবং পূর্ণ দৃষ্টিতে সমরের দিকে তাকালেন।
ডাক্তার সেন? You are Dr. Sen
হ্যাঁ।
কিন্তু you are too late! আর মাত্র দেড় ঘণ্টা সময় আছে।
সমর রায়বাহাদুরের মুখের দিকে চেয়ে থাকে কেমন যেন বোকার মত। রায়বাহাদুরের চোখ ততক্ষণে আবার মুদ্রিত হয়ে গিয়েছে।
তোমরা! You? All of youসাক্ষী থাকবে, ওরা আমায় রাত ঢারটের সময় হত্যা করেছে। কিরীটী—কিরীটীবাবু কই? তাঁকে যে এত করে আমি ডেকে নিয়ে এলাম, তিনি যদি কাছাকাছি না থাকেন তো বুঝবেন কি করে—আমার হত্যারহস্য মীমাংসা করবেন কি করে! ডাক-নার্স—মিঃ রায়কে ডাক–
নার্স বোধ হয় রায়বাহাদুরের আদেশ পালনের জন্যই পর্দার ওপাশে চলে গেল।
আপনার হাতটা একটিবার দেখতে পারি কি?
ডাঃ সমর সেন সামনের দিকে একটু ঝুঁকে প্রশ্ন করে।
পালস দেখবেন? কিন্তু কি হবে দেখে? পালস্ ঠিকই আছে—তাছাড়া যাকে আর দেড় ঘণ্টা বাদে হত্যা করা হবে তার পালস্ দেখে কি বুঝবেন? Not a natural death. Not a case of heart failure.পালস্ দেখে কি সে-মৃত্যুকে আপনি ঠেকাতে পারবেন?
কি করে জানলেন যে আর দেড় ঘণ্টার মধ্যে কেউ আপনাকে হত্যা করবে?
ভাবছেন প্রলাপ বকছি, না হয় পাগল হয়ে গেছি, না ডাঃ সেন? শুধু আপনি কেন, সকলেই তাই ভাবছেন, কিন্তু দেখবেন, এখুনি দেখবেন। দেখতে পাবেন আমার কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য হয় কিনা। দেড় ঘণ্টা আর কতটুকু সময়–
সমর ওষুধের গ্লাসটা, একটু আগে যেটি নার্স কক্ষ থেকে বের হয়ে যাবার সময় সামনের টেবিলের উপর রেখে গিয়েছিল সেটা তুলে নিয়ে বলে, এই ঘুমের ওষুধটা খান তো। আপনার একান্তভাবে এখন ঘুমনো দরকার—একটু ঘুমতো পারলে নিশ্চয়ই সুস্থ বোধ করবেন। জেগে জেগে আপনি যত দুঃস্বপ্ন দেখছেন।
কি বললেন, দুঃস্বপ্ন-আমি জেগে জেগে দুঃস্বপ্ন দেখছি? হুঁ, দুঃস্বপ্নই বটে। দেখছি গত এক বৎসর ধরে। But it is as true as anything, একটু পরেই আপনারা জানতে পারবেন গত এক বৎসর ধরে যে অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর কথাটা আমার কাছে প্রকট হয়ে উঠছে সেটা সত্য—it is coming,—আসছে মৃত্যু, আসছে, ঘুম হবে না জানি আমি কোন ওষুধেই আর ঘুম হবে না, তবু যখন বলছেন দিন কি ওষুধ খেতে হবে। সত্যিই আমি ঘুমোত চাই। Deep, sound sleep
সমর রায়বাহাদুরকে ওষুধটা খাইয়ে দিল।
নার্সের সঙ্গে সঙ্গে এমন সময় কিরীটী রায় এসে পর্দার পাশ দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল।
কে?
আমি কিরীটী, রায়বাহাদুর।
সমর চোখ তুলে আগন্তুকের দিকে তাকায়। কিরীটীর পরিধানে শ্লিপিং পায়জামা ও কিমোনো। দেখলেই বোঝা যায় সদ্য সে শয্যা থেকে বোধ করি উঠে এসেছে।
কোথায় ছিলেন এতক্ষণ?
এই ঘরেই তো ছিলাম।
ঘুমোচ্ছিলেন, না? এমনি করে ঘুমোলেই আপনি আমার হত্যা-রহস্যের কিনারা করেছেন আর কি! সময় যে ঘনিয়ে এল সেদিকে খেয়াল আছে?
কিরীটী মৃদু হেসে শান্ত কণ্ঠে প্রত্যুত্তর দেয়, সে তো আপনার হিসেবমত রাত চারটেয়। এখনও এক ঘণ্টার ওপরে সময় আছে।
আর সময় আছে!
তাছাড়া আপনাকে তো বলেছি, আমি একবার এসে যখন উপস্থিত হয়েছি, প্রাণ থাকতে আপনার আর কোন বিপদ যাতে না ঘটে সেই চেষ্টাই করব।
করুন। যত পারেন চেষ্টা করুন কিন্তু বাধা দিতে পারবেন না এও আমি জানি।
ঢং ঢং ঢং!…
রাত্রি তিনটে ঘোষিত হয় ওয়াল-ক্লকে।
রায়বাহাদুর আবার বলেন, আর এক ঘণ্টা–
আপনি এবারে একটু ঘুমোবার চেষ্টা করুন দেখি রায়বাহাদুর!
কথাটা বলে কিরীটী।
রায়বাহাদুর চোখ বুজে ছিলেন, কিরীটীর কথার কোন জবাব দিলেন না।
ঘুমোবেন না বললে কি হবে—দু-চার মিনিটের মধ্যেই রায়বাহাদুর ঘুমিয়ে পড়েছেন ওষুধের প্রভাবে, বোঝা গেল তাঁর মৃদু নাসিকাধ্বনিতে।
রায়বাহাদুর ঘুমিয়ে পড়েছেন বুঝতে পেরে কিরীটী সকলকে চোখের ইঙ্গিতে ঘর ছেড়ে চলে যেতে বলে।
একমাত্র নার্স বাদে বাকি তিনজনে বাইরে চলে আসে।
পদার এদিকে এসে ওরা দেখে একমাত্র দুঃশাসন চৌধুরী ভিন্ন বাকি দুজন—শকুনি ঘোষ ও অন্য ভদ্রলোকটি ঐ সময় সেখানে উপস্থিত নেই।
ডাঃ সানিয়াল কিরীটী ও ডাঃ সমর সেনকে লক্ষ্য করে বলেন, চলুন আমার ঘরে, আপনাদের সঙ্গে আমার কয়েকটা কথা আছে।
সকলে রোগীর ঘর থেকে বের হয়ে একেবারে লাগোয়া পাশ্ববতী কক্ষের দ্বার ঠেলে ভিতরে গিয়ে প্রবেশ করে।
ছোট্ট একখানি ঘর, রোগীর ঘরের সঙ্গে মধ্যবর্তী একটি দ্বারপথে যোগাযোগ আছে।
একটি লোহার খাটে সাধারণ একটি শয্যা বিস্তৃত। ঘরের কোণে একটি আলনায় কয়েকটি জামাকাপড় এলোমেলো ভাবে ঝুলনো। একটি ছোট্ট টেবিল। একধারে ছোট একটি নেয়ারের খাটে শয্যা বিছানো। খানকতক বই ও খাতাপত্র টেবিলের উপরে বিশৃঙ্খলভাবে ছড়ানো। খাটের নীচে একটি চামড়ার সুটকেস্।
ইলেকট্রিক স্টোভে একটা অ্যালুমিনিয়ামের কেলীতে জল ফুটছিল। খানতিনেক চেয়ারও ঘরে ছিল। বসুন। কফি তৈরি করি একটু, কারও আপত্তি নেই তো-সানিয়াল বলেন। ডাক্তার সেন বা কিরীটী কারোরই আপত্তি ছিল না। দুজনেই তাই জবাব দেয়, বেশ তো! কেলীর জল ফুটে গিয়েছিল।
ডাঃ সমর সেন কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করে, আপনার সঙ্গে পরিচয় নেই আমার কিরীটীবাবু।
কেটলী থেকে গরম জল একটা কাঁচের টি-পটে ঢেলে কফির গুঁড়া মেশালেন ডাঃ সানিয়াল। সমর সেনের প্রশ্নে তার দিকে চেয়ে বললেন, বলেন কি মশাই, অমন একটা লোকের সঙ্গে আজও পরিচয় হয়নি আপনার?
না। মৃদু হেসে সেন বলেন।
রহস্যভেদী কিরীটী রায়। ডাঃ সানিয়াল জবাব দিলেন।
আপনাকেও উনি বুঝি ডেকে এনেছেন? সমর প্রশ্ন করেন।
মৃদু হেসে কিরীটী বলে, হ্যাঁ। শুনলেন না, রায়বাহাদুরের বদ্ধ ধারণা হয়ে গেছে যে তাঁকে হত্যা করবার জন্য তাঁর চারপাশে একটা প্রকাণ্ড ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে এবং আজ রাত্রেই তাঁর মৃত্যু অবধারিত!
হঠাৎ এমন ধারণা হল কেন তাঁর?
ঠিক যে হঠাৎ হয়েছে বললে ভুলই বলা হবে ডাঃ সেন, কিরীটী বলে, তবে–
ইতিমধ্যে ডাক্তার সানিয়াল কফি তৈরী করে কিরীটী ও ডাঃ সেনকে দুকাপ দিয়ে, নিজেও এক কাপ কফি নিয়ে বসলেন।
ডাঃ সানিয়াল কফিতে এক চুমুক দিয়ে ডাঃ সেনের মুখের দিকে চেয়ে বললেন, রায়বাহাদুরকে দেখে আপনার কি মনে হল ডাঃ সেন?
মনে হল যেন একটা illusion-এ ভুগছেন, কিন্তু কতদিন থেকে এরকম হয়েছে? ডাঃ সেন বললেন।
দিন সাতেক হবে। দিন সাতেক আগে থেকেই ঐ কথাটা প্রায় বলছেন, আজকের তারিখে রাত চারটের সময় নাকি উনি নিহত হবেন।
এর আগে কখনও এ ধরণের কথা বলেননি?
না। আমি তো প্রায় মাস আষ্টেক হল এখানে আছি attending physician হয়ে—
I see—তা, আর ঐ যে সব ষড়যন্ত্রের কথা কি বলছিলেন? এবারে প্রশ্নটা করে সমর সেনই।
আপনি তো অনেকদিন এখানে আছেন, হঠাৎ এরকম ধারণা ওঁর হল কেন কিছু বলতে পারেন ডাঃ সানিয়াল?
কিরীটী এবার প্রশ্ন করল।
না। বরং আমি তো দেখতে পাচ্ছি রায়বাহাদুরের আত্মীয়স্বজনেরা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন সর্বদা কি ভাবে ওঁকে একটু সুস্থ ও নিশ্চিন্ত রাখতে পারবেন। এ ধরণের সন্দেহ যে কি করে আসে–
ডাঃ সেন এবারে বলে, আমার কি মনে হচ্ছে জানেন, অভিশাপ—এটা একটা অর্থের, অভিশাপ ডাঃ সানিয়াল। অর্থ জিনিসটাই এমন যে না থাকলেও শান্তি নেই, আবার থাকলেও শান্তি নেই। শাঁখের করাত, এগুতেও কাটে পিছুতেও কাটে।
কিরীটী কথাটা শুনে মৃদু হাসে।
নিঃশেষিত কফির পেয়ালাটা নামিয়ে রেখে কিমোনোর পকেট থেকে একটা সিগার বের করে দেশলাই সহযোগে অগ্নিসংযোগ করল কিরীটী।
কিছুক্ষণ নিঃশব্দে ধূমপান করবার পর কিরীটী বলে, গত দশ বৎসর থেকে রায়বাহাদুরকে চিনি। A self-made man. প্রথম জীবনে কুলি রিক্রুটিং থেকে শুরু করে ক্রমে নিজের অসাধারণ চেষ্টা ও অধ্যবসায়ের দ্বারা প্রচুর অর্থের মালিক হয়েছেন। সাত-সাতটা কোল মাইনসূয়ের প্রোপাইটর হয়েছেন।
বলেন কি! ডাঃ সেন বলেন।
হ্যাঁ সত্যিই বিচিত্র মানুষটা, শুধু যে উপায়ই করেছেন তা নয়—রায়বাহাদুর শুনেছি জীবনে দানধ্যানও করেছেন প্রচুর। কথাটা বললেন ডাঃ সানিয়াল।
উঁ আমিও শুনেছি, বহু প্রতিষ্ঠানে ওঁর বহু দান আছে। জবাব দিল কিরীটী।
ডাঃ সমর সেন ও আসরে যেন নির্বাক শ্রোতা। অবাক বিস্ময়ে বিচিত্র অদ্ভুত রায়বাহাদুরের কাহিনী শুনছিল।
দরজার গায়ে এমন সময় সহসা মৃদু করাঘাত শুনতে পাওয়া গেল।
কে? ডাঃ সানিয়ালই প্রশ্ন করলেন এবং এগিয়ে গিয়ে দ্বার খুলে দিলেন।
ঘরে প্রবেশ করলেন রায়বাহাদুরের ভাই দুঃশাসন চৌধুরী।
এবং কক্ষের মধ্যে উপবিষ্ট কিরীটী ও ডাঃ সমর সেনকে লক্ষ্য না করেই ডাঃ সানিয়ালকে বলেন, ডাক্তার, আমাকে একটা ঘুমের ওষুধ দিতে পার? কিছুতেই ঘুমোতে পারছি না। ঘুম আসছে না। এ আর তো পারি না—এক মাস হল, আর কত না ঘুমিয়ে কাটাব–
এখানে তো আমি কোন ওষুধ রাখি না মিঃ চৌধুরী। ও-ঘরে অনেক রকমের ঘুমের ওষুধ আছে। আমার নাম করে নার্সের কাছে চান গিয়ে, সে দেবেখন।
ওসব সাধারণ বারবিউটন গ্রুপ অফ ড্রাগসূয়ে আমার কিছু হবে না। সব খেয়ে দেখেছি। বরং যদি আমাকে একটু মরফিয়া injection করে দাও হাফ গ্রেন
মরফিয়া! বিস্মিত ডাঃ সানিয়াল যেন কতকটা আত্মগত ভাবেই কথাটা উচ্চারণ করেন।
হ্যাঁ, মরফিয়া। আচ্ছা থাক, আজও যা হোক একটা কিছু খেয়েই দেখিবলতে বলতে দুঃশাসন চৌধুরী প্রস্থান করলেন।
ওঁরা আবার গল্প শুরু করলেন।
.
আরও আধ ঘণ্টাটাক পরে।
সহসা কতকটা যেন ঝড়ের বেগেই বৃদ্ধগোছের একটি ভৃত্য ঘরের দরজার সামনে এসে উদ্বেগাকুল কণ্ঠে বলে ওঠে, ডাক্তারবাবু! ডাক্তারবাবু! শীগগিরি আসুন! কর্তাবাবুকর্তাবাবু
কিরীটী ততক্ষণে চেয়ার থেকে কতকটা যেন লাফিয়েই উঠে ছুটে দরজার গোড়ায় এসে দাঁড়ায়।
কি — হয়েছে কতবাবুর?
খুন–খুন হয়েছেন কাবাবু!
সে কি! বিস্মিত একটা চিৎকারের মতই যেন কথাটা ডাঃ সানিয়ালের কণ্ঠ হতে নির্গত হয়।
হ্যাঁ, শীগগিরি আসুন।
সকলের আগে কিরীটী যেন ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে গেল এবং তার পশ্চাতে ডাঃ সেন, ডাঃ সানিয়ালও বের হয়ে গেলেন।
রায়বাহাদুরের ঘরের দরজা খোলাই ছিল। কিরীটী সর্বপ্রথম ঘরের মধ্যে গিয়ে পা দিল এবং ঠিক সেই সঙ্গে সঙ্গেই ঘরের ওয়াল-ক্লকটা রাত্রি চারটে ঘোষণা করল।
ঢং ঢং ঢং ঢং…
রাত চারটে।
কিরীটীর বুকের ভেতরটা যেন ধক করে ওঠে। তাহলে সত্যিসত্যিই রায়বাহাদুরের নিজের মৃত্যুর ব্যাপারে নিজের ভবিষ্যৎবাণীটা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল!
কয়েকটা মুহূর্ত অতঃপর কিরীটী কেমন যেন বিহ্বল বিভ্রান্ত ভাবে ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে, কোন কথাই তার মুখ দিয়ে বের হয় না।
০৩. ঘরের মধ্যে ঐ সময়
ঘরের মধ্যে ঐ সময় ওরা তিনজন ছাড়াও দুঃশাসন ও বৃহন্নলা চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন। উভয়ের চোখেমুখেই একটা অসহায় ভীতিবিহ্বল ভাব। নির্বাক এবং কেমন যেন বিস্ময়াবিভূত সকলে।
ওয়াল-ব্লকের গম্ভীর সঙ্কেতধ্বনিটা যেন নিষ্ঠুর হত্যার কথাটাই জানিয়ে দিয়ে গেল। মৃত্যু আছেই। কে কবে মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পেয়েছে—এবং আসে যখন অমোঘ পরোয়ানা হাতেই এসে হাজির হয়। তবু রায়বাহাদুরের মৃত্যুটা যেন অকস্মাৎ একটা ধাক্কা দিয়েছে সবার মনেই। কোন কথা না বলে কিরীটী অতঃপর ঘরের মধ্যের পদটিা তুলে রায়বাহাদুর যেখানে শায়িত সেখানে এসে দাঁড়াল। অন্যান্য সকলেও তাকে অনুসরণ করে ওর আশেপাশে এসে দাঁড়ায়।
অদূরে সর্বপ্রথম সকলেরই দৃষ্টি পড়ে রোগীর শিয়রের কাছে, চেয়ারের উপরে উপবিষ্ট নার্সের মাথাটা চেয়ারের উপরে একপাশে হেলে রয়েছে।
।আর—আর শায়িত মুদ্রিতচক্ষু রায়বাহাদুরের বুকের ঠিক মাঝখানে সুদৃশ্য কালো বাঁটওয়ালা একটা ছোরা সমূলে বিদ্ধ হয়ে আছে—যেন নিষ্ঠুর মৃত্যুর ভয়াবহ প্রত্যক্ষ সাক্ষী দিচ্ছে।
রায়বাহাদুরের গায়ের উপরে যে সাদা চাদরটি ছিল সেই চাদর সমেতই ছোরাটা ভেদ করে গিয়েছে। কিন্তু ছোরাটার কালো বাঁটের চার পাশে লাল রক্তচিহ্ন শুভ্র চাদরের উপরে যেন ভয়াবহ একটা বিভীষিকার মত মনে হয়।
কোন প্রয়োজন ছিল না, তথাপি ডাঃ সানিয়াল প্রথমেই রায়বাহাদুরের পালস্টা দেখলেন, সব শেষ! অনেকক্ষণ মারা গেছেন।
কিরীটী প্রথমে নার্সের নাম ধরে ডাকে, কিন্তু সাড়া না পেয়ে এগিয়ে উপবিষ্ট ও নিদ্রিত নার্সকে ঠেলে জাগাতে গিয়ে দেখে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন নার্স।
কিরীটীর বুঝতে কষ্ট হয় না যে স্বাভাবিক ঘুম নয়। কোন তীব্র ঘুমের ওষুধের সাহায্যেই নার্সকে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন করা হয়েছে, সম্ভবতঃ ইচ্ছে করেই।
ডাক্তার দুজনও ইতিমধ্যে নার্সের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে ডাঃ সানিয়াল ঘুমন্ত নার্সকে পরীক্ষা করতে উদ্যত হন, কিরীটী সরে দাঁড়ায়।
অপলক দৃষ্টিতে কিরীটী নিহত, মুদ্রিতচক্ষু রায়বাহাদুরের মুখের দিকে চেয়ে ছিল। সমস্ত মুখখানা জুড়ে যেন ফুটে উঠেছে একটা নিষ্ঠুর অবজ্ঞার চিহ্ন।
অদূরে টেবিলের উপরিস্থিত নীলাভ দ্যুতিতে মুখখানার মধ্যে যেন কেমন এক নিদারুণ বিভীষিকা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
ঘরের মধ্যে সকলেই নিস্তব্ধ, কারও মুখে টু শব্দটি পর্যন্ত নেই।
কেবল পর্দার ওপাশের ওয়াল-ক্লকটা একঘেয়ে শব্দ করে চলেছে। মন্থর বিশ্রী টক্ টক টক্ শব্দ সেই নিশ্চলতার মধ্যে।
উঃ, কি ভয়ানক!
সকলেই যুগপৎ ঐ কথাগুলি সহসা উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে তাকাল। কথাটা বলেছিলেন দুঃশাসন চৌধুরী। কথাটা বলেই তিনি দুহাতে নিজের মুখখানা ঢাকেন।
ডাঃ সানিয়াল যেন কি একটা কথা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু বলা হল না, ঠিক ঐসময় একটা ভারী জুতোর মচমচ শব্দ সকলের কানে প্রবেশ করে।
মচমচ শব্দে জুতো পায়ে কে যেন এই কক্ষের দিকেই এগিয়ে আসছে। মচমচমচ। জুতোর শব্দ এসে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল। কিরীটীই সর্বাগ্রে পর্দার ওদিকে পা বাড়িয়েছিল এবং পর্দার এদিকে আসতেই দেখতে পেল পুলিসের ইউনিফর্ম পরিধানে হৃষ্টপুষ্ট ভারিক্কী চেহারার এক অফিসার ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে। বারেক কিরীটী ও পুলিস অফিসারটি দুজনে দুজনের দিকে অনুসন্ধানী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। কিরীটী প্রথমে কথা বলে, আপনিই বোধ হয় এখানকার এস.পি. মিঃ দালাল?
হ্যাঁ। আপনি?
আমি! আমার নাম কিরীটী রায়। আসুন, এইমাত্র আমরা জানতে পেরেছি রায়বাহাদুর নিহত হয়েছেন।
কি বললেন! রায়বাহাদুর–উৎকণ্ঠা মিশ্রিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন পুলিশ সুপার মিঃ দালাল।
হ্যাঁ। চলুন, এই ঘরের পর্দার ওপাশে মৃতদেহ।
স্তম্ভিত নির্বাক এস.পি.দালাল যন্ত্রচালিতের ন্যায় কিরীটীকে অনুসরণ করলেন।
পর্দার এপাশে এসে পা দিতেই এবং মৃতের বক্ষে ছুরিকাবিদ্ধ রায়বাহাদুরের প্রতি নজর পড়তেই অস্ফুট কণ্ঠে আবার দালাল সাহেব বলে ওঠেন, উঃ, What a horrible sight! কি ভয়ানক! Then really he has been killed!
সত্যিই ভয়ানক! যেন পূর্বাপর সমস্ত ব্যাপারটাই একটা চরমতম বিস্ময়। একটা ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন। মাত্র ঘণ্টাখানেক আগেও যে লোকটি জীবিত ছিলেন, প্রাণস্পন্দনের মধ্যে দিয়ে নিজের সত্তাটাকে ঘোষণা করছিলেন, এই মুহূর্তে অসহায় মৃত্যুর মধ্যে যেন নিঃশেষে লোপ পেয়েছেন। নিশ্চিহ্ন হয়ে মুছে গিয়েছেন জীবনসমুদ্রের বুক থেকে। এবং এই ঘটনার মধ্যে সর্বাপেক্ষা ঘনীভূত রহস্য হচ্ছে এই যে, ঐ ছুরিকাবিদ্ধ মৃত লোকটি কেমন করে না-জানি অবধারিত অবশ্যম্ভাবী তাঁর মৃত্যুর সংবাদটি পূর্বাহ্নেই জানতে পেরেছিলেন কোন এক আশ্চর্য উপায়ে। কিন্তু সত্যিই কি জানতে পেরেছিলেন, না সেটা ডাক্তারের ভাষায় একটা সত্যিই ইলিউশন মাত্র! না, ব্যাপারটা তাঁর অসুস্থ মস্তিষ্কের উত্তেজনাপ্রসূত একটা কল্পনা মাত্র!
নার্স সুলতা করের জ্ঞান আরও আধ ঘণ্টা পরে ফিরে আসে একটু একটু করে।
ওষুধের প্রভাব হতে মুক্ত হয়ে সে ঘুম থেকে জেগে উঠল। প্রথমটায় সে কিছুই বুঝতে পারে না। চোখের ঘুম ও মনের নিষ্ক্রিয়তাটুকু যেন কেটেও কাটতে চায় না। একটা নেশার ঘোরের মত সমস্ত চেতনাকে তার এখনও আচ্ছন্ন করে আছে যেন। কিরীটীর পরামর্শে এক কাফ স্ট্রং কফি পান করার পর সুলতা যেন কতকটা ধাতস্থ হয়।
কিন্তু তাকে নানাভাবে প্রশ্ন করেও তার বক্তব্য হতে এমন কিছুই পাওয়া গেল না যা রায়বাহাদুরের মৃত্যু-রহস্যের উপরে আলোকসম্পাত করতে পারে।
সুলতা কর বললে, রাত্রি দুটো নাগাদ ডাক্তার সানিয়ালের কফি তৈরী হয়েছিল। সেই কফি পান করবার পর হতেই তার বিশ্রীরকম ঘুম পায় এবং সে ঘুমিয়ে পড়ে।
কিরীটী তখন প্রশ্ন করে, রায়বাহাদুর কি তখন জেগে ছিলেন?
না—সুলতা বলে। রায়বাহাদুরকে ডাঃ সেন ঘুমের ওষুধ খাইয়ে আসবার পর কিছুক্ষণের মধ্যে রায়বাহাদুর ঘুমিয়ে পড়েন।
সাধারণতঃ দীর্ঘকাল ধরে, বলতে গেলে প্রায় নিয়মিতই ঘুমের ওষুধ সেবন করবার ফলে ইদানীং কোন ঘুমের ওষুধেই সহজে রায়বাহাদুরের নিদ্রাকর্ষণ হচ্ছিল না।
অথচ আশ্চর্য, আজ ঘুমের ওষুধ পান করবার কিছুক্ষণের মধ্যেই রায়বাহাদুরের নিদ্রাকর্ষণ হয় এবং শীঘ্রই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন।
রায়বাহাদুরকে নিদ্রিত দেখে সুলতা করেরও দু চোখের পাতায় ঢুলুনি নেমে আসতে চায়। এবং কখন একসময় সে নিজেই ঘুমিয়ে পড়েছে কিছুই তার মনে নেই।
সুলতা কর কথা বলছিল কিন্তু কিরীটীর মনে হয় তার কথাবার্তায় একটা ভীতির ভাব যেন সুস্পষ্ট প্রকাশ পাচ্ছে।
প্রথমতঃ ডিউটি দিতে দিতে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল, দ্বিতীয়ত সেই ঘুমন্ত অবস্থার মধ্যেই নিষ্ঠুর আততায়ীর হস্তে রায়বাহাদুর নিহত হয়েছেন—নিঃসন্দেহে ব্যাপারটা তার গাফিলতি, তাই কি তার ঐ ভীতি?
কিন্তু কিরীটী নার্স সুলতা করের ঐ ভীতির ব্যাপারটা যেন বুঝেও ইচ্ছে করেই বিশেষ আমল দেয় না।
দালাল সাহেব যখন বারংবার নানাবিধ প্রশ্নবাণে ভীত সুলতা করকে নানা ভাবে জেরার পর জেরা করে চলেছেন, কিরীটীর মনের মধ্যে তখন সম্পূর্ণ অন্য একটি চিন্তা আবর্ত রচনা করে ফিরছিল যেন।
সত্যি কথা বলতে কি, রায়বাহাদুরের বিশেষ অনুরোধে তাঁর গৃহে এলেও ব্যাপারটার মধ্যে আদৌ কোন গুরুত্ব দেয়নি এতক্ষণ পর্যন্ত। কিন্তু এখন তার মনে হচ্ছে,রায়বাহাদুর যেমন করেই হোক ব্যাপারটা বুঝতে পেরে থাকুন না কেন ব্যাপারটা একটা নিষ্ঠুর পূর্বপরিকল্পিত প্ল্যান অনুযায়ী সংঘটিত হয়েছে, সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকে না এখন আর।
বেচারী সুলতা করের কোন দোষ বা অপরাধ নেই বুঝতে পারে কিরীটী। এবং হত্যাকারী যে ধূর্ত ও অত্যন্ত ক্ষিপ্র সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ মাত্রও নেই।
কারণ প্রথমতঃ সে পূর্বাহ্নেই ঘোষণা করে ও প্ল্যান এঁটে রায়বাহাদুরকে হত্যা করেছে।
দ্বিতীয়তঃ ঠিক হত্যার সময়টিতে বা পূর্বে এ বাড়ির সকলের মধ্যে যার রোগীর সবাপেক্ষা নিকট উপস্থিত থাকবার সম্ভাবনা ছিল, সেই সুলতা করকে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই কৌশলে কফির সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে, যাতে করে তার দিক থেকে কোন বাধা না আসে।
তৃতীয়তঃ যাকে হত্যা করবে বলে হত্যাকারী স্থির করেছিল তাকে পর্যন্ত তীব্র ঘুমের ওষুধ পান করিয়ে আগেই ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিল।
এই তো গেল হত্যাকারীর দিকটা।
নিহত রায়বাহাদুরের দিকটাও রীতিমত যাকে বলে জটিল। পূর্বাহ্নে তিনি তো নিজের হত্যার কথা জানতে পেরেছিলেনই, তা সে যেমন করেই হোক এবং যেজন্য তিনি কলকাতা থেকে কিরীটীকে নিজের কাছে এনে রেখেছিলেন ও এস.পি. দালাল সাহেবকেও কথাটা আগে থাকতেই জানিয়ে রেখেছিলেন। সেদিক দিয়ে হত্যাকারীকে বিচার করলে নিঃসন্দেহে হত্যাকারী প্রচুর রিস্ক নিয়েছে, যেহেতু আগে থাকতে আটঘাট বেঁধে কাজ করে থাকলেও সে শুধু চতুর নয়, দুঃসাহসীও বটে। কিন্তু কথা হচ্ছে সে কেমন করে এতগুলো লোকের উপস্থিতির মধ্যে ধোঁকা দিয়ে সকলকে বোকা বানিয়ে দিল!
কিরীটী আরও ভাবছিল, ছোরার সাহায্যে যখন রায়বাহাদুরকে হত্যা করা হয়েছে তখন এটা অত্যন্ত স্পষ্ট যে হত্যাকারী এই কক্ষে সশরীরে প্রবেশ করেছিলই।
কিন্তু কথা হচ্ছে, ঠিক ঐ সময়টিতে এই কক্ষের মধ্যে নিদ্রিতা নার্স সুলতা কর ও ঘুমন্ত রায়বাহাদুর ব্যতীত তৃতীয় কোন ব্যক্তি বা প্রাণী উপস্থিত ছিল কিনা। এবং উপস্থিত থাকলে কে উপস্থিত ছিল—এই বাড়ির মধ্যে আর কারই বা উপস্থিত থাকা সম্ভব!
মনে মনে অত্যন্ত দ্রুত কিরীটী চিন্তা করে নেয় এই বাড়ির সমস্ত লোকগুলিকে।
মৃত রায়বাহাদুর ছাড়া ঐ সময় বাড়ির মধ্যে উপস্থিত ছিল তাঁর সহোদর ভাই দুঃশাসন চৌধুরী, রায়বাহাদুরের খুল্লতাত অবিনাশ চৌধুরী, ভাগ্নে শকুনি ঘোষ, রায়বাহাদুরের একমাত্র পুত্র বৃহন্নলা চৌধুরী, বৃহন্নলার স্ত্রী নমিতা চৌধুরী, বৃহন্নলার একমাত্র একাদশ বর্ষীয় বালকপুত্র বিকর্ণ ও রায়বাহাদুরের বোনের মেয়ে রুচিরা দেবী, রায়বাহাদুরের বিধবা বোন ও রুচিরার মা গান্ধারী দেবী। এই আটজন বাড়ির ভেতরের লোক।
বাইরের কর্মচারীদের মধ্যে অন্দরে যাদের অবাধ যাতায়াত ছিল, ম্যানেজার নিত্যধন সাহা, তশীলদার বৃদ্ধ কুন্ডলেশ্বর শমা ও পুরাতন নেপালী ভৃত্য কৈরালাপ্রসাদ ও ডাক্তার সানিয়াল এবং কিছুক্ষণ আগে এসেছেন ডাঃ সমর সেন, বৃন্দাবন, ঝি সৈরভী ও ননীর মা। এবং যাদের ছিল না তারা হচ্ছে ড্রাইভার রামনরেশ ও ভৈরব, নাইটকিপার হুম্ সিং, দারোয়ান বলদেব ও দুধনাথ। এদের মধ্যে অর্থাৎ যাদের অন্দরে যাতায়াত ছিল না তাদের বাদ দিয়ে ঐ বারোজনের মধ্যে কেউ যদি হত্যাকারীকে সাহায্য করে থাকে তাহলে হয়ত তাকে খুঁজে বের করতে পারলে রহস্যের ব্যাপারে কিছুটা কিনারা হতে পারে! এখন কাকে কাকে ঐ বারোজনের মধ্যে বিশেষভাবে সন্দেহ করা যেতে পারে! সেদিক দিয়ে একমাত্র আত্মীয়-পরিজনদের মধ্যে রায়বাহাদুরের পুত্র বৃহন্নলা চৌধুরীর একাদশ-বর্ষীয় বালকপুত্রকে সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যেতে পারে।
বাকি সকলকে সন্দেহের তালিকার মধ্যে ধরা যেতে পারে, কারণ বাকি সকলের প্রত্যেকেরই মৃত রায়বাহাদুরের মৃত্যুতে লাভবান হবার সম্ভাবনা।
কাজেই প্রত্যেকের পক্ষেই রায়বাহাদুরকে হত্যা করা এমন কিছুই অসম্ভব নয় বা ছিল না।
কিরীটীর চিন্তাজাল হঠাৎ ছিন্ন হয়ে গেল।
ঐ সময় সুপার দালাল সাহেব সুলতা করের জবানবন্দি শেষ করে দুঃশাসন চৌধুরীকে জেরা শুরু করেছেন।
আপনি বলেছেন দীর্ঘ পাঁচ বছর আপনি বাড়িছাড়া থাকবার পর মাত্র দিন দশেক আগে এখানে ফিরে এসেছেন, কেমন কিনা?
হ্যাঁ। দালাল সাহেবের প্রশ্নের জবাবে জানান দুঃশাসন চৌধুরী।
এই পাঁচ বছর আপনি কোথায় ছিলেন?
বর্মামুলুকে মৌচিতে—
মৌচি–কেন?
মৌচিতে আমার মাইকার বিজনেস ছিল—
মাঝখান থেকে কিরীটী এবারে প্রশ্ন করে, কয়েকটা কথা আমি জিজ্ঞাসা করতে চাই মিঃ দালাল মিঃ চৌধুরীকে, যদি অবশ্য আপনি অনুমতি দেন।
একটু যেন বিরক্তি ও অনিচ্ছার সঙ্গেই দালাল সাহেব বলেন, বেশ তো, করুন।
মিঃ চৌধুরীর কি মাইকার সেই বিজনেস এখনও আছে? কিরীটী এবারে প্রশ্ন করে দুঃশাসন চৌধুরীকে।
না। দাদার অনুরোধে সমস্ত বিজনেস তুলে দিয়েই একেবারে চলে এসেছি।
বিজনেস কেমন চলছিল আপনার?
খুব ভালই চলছিল। তাই আমারও বিজনেস তুলে দেবার কোন ইচ্ছাই ছিল না। গত বছর দেড়েক ধরে দাদা অনবরত আমাকে ওখানকার বিজনেস তুলে দিয়ে দেশে ফিরে আসবার জন্য অনুরোধ করছিলেন চিঠির পর চিঠি দিয়ে। তাছাড়া এখানকার এত বড় কলিয়ারী বিজনেস বৃহন্নলা একা একা ম্যানেজ করে উঠতে পারছিল না–
কেন, আমি তো যতদূর জানি ইদানীং অসুস্থ অবস্থাতেও দুমাস আগে পর্যন্ত বিছানায় শোয়া অবস্থাতেই রায়বাহাদুর নিজে বিজনেস দেখাশুনা করতেন। তাছাড়া আপনার ছোটকাকা অবিনাশবাবুও তো বিজনেস দেখাশুনা করতেন বলেই শুনেছি—কিরীটী এবারে বলে।
কিরীটীর কথায় দুঃশাসন চৌধুরী বিশেষ অর্থপূর্ণ একটু হাসি হেসে বলেন, কে দেখাশুনা করতেন বললেন, আমাদের কাকা সাহেব?
হ্যাঁ।
হুঁ, তা দেখতেন বটে। তবে এতই যখন আপনার জানা আছে—এও নিশ্চয়ই আপনি জানেন, কাকা সাহেবের আসল বিজনেসের চাইতে গানবাজনার ব্যাপারেই বরাবর বেশী ঝোঁক এবং সেই কারণেই বরাবর দাদাকে না হোক মাসে হাজার দেড় হাজার করে অর্থ আত্মীয়তার আক্কেলসেলামী বাবদ জলে ফেলতে হত। বলতে বলতে কণ্ঠের মধ্যে আরও তাচ্ছিল্য ও অবহেলার ভাব এনে বললেন, হুঁ, তিনি দেখবেন বিজনেস! এই যে বাড়ির মধ্যে এত বড় একটা ব্যাপার ঘটে গেছে, দেখুন গিয়ে কাকা সাহেব দিব্যি খোসমেজাজে বাঈজীর গান শুনছেন এখনও তাঁর ঘরে আসর জমিয়ে।
কিরীটী দুঃশাসন চৌধুরীর কথায় কোনরকম গুরুত্ব না দিয়ে অত্যন্ত ধীর শান্ত কণ্ঠে জবাব দেয়, দেখুন দুঃশাসনবাবু, আজ গত সাত বছর ধরে রায়বাহাদুরের সঙ্গে এবং আপনাদের এই ফ্যামিলির সঙ্গে আমার একান্ত ঘনিষ্ঠ ভাবেই পরিচয়। আপনাদের কাকা সাহেব অবিনাশধাবুর সমস্ত কিছুই আমার জানা, তিনি আমার আদৌ অপরিচিত নন। একটা কথা আপনি হয়ত ভুলে যাচ্ছেন দুঃশাসনবাবু, রায়বাহাদুরের বর্তমান সুবিপুল সম্পত্তি অর্জনের মূলে আপনাদের কাকা সাহেবের দীর্ঘ বারো বৎসরের পরিশ্রম ও অধ্যবসায় আছে। সেদিক দিয়ে আমি যতদূর জানি, রায়বাহাদুরই ইদানীং বৎসর তিনেক হল আপনাদের কাকা সাহেবের জন্য মাসিক দেড় হাজার টাকা মাসোহারার পাকাপাকি একটা ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন ইচ্ছে করেই
শ্লেষাত্মক কণ্ঠে এবারে দুঃশাসন চৌধুরী জবাব দিলেন, আপনি দেখছি অনেক কিছুই জানেন মিঃ রায়, তাই একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করার লোভটা দমন করতে পারছি না। এতই যখন আপনি জানেন, এও আপনার নিশ্চয়ই অজানা নয় যে কোথাও কোন কাগজপত্রে এ সম্পকে কোন নির্দেশ আছে, না এটা একটা উভয়ের মধ্যে তাদের মৌখিক ব্যবস্থাই হয়েছিল!
বৎসর দুই আগে রায়বাহাদুরের সঙ্গে যখন একবার আমার কলকাতায় দেখা হয়, কথায় কথায় সেই সময়েই রায়বাহাদুর আমাকে বলেছিলেন—লিখিত ভাবে তাঁর উইলের মধ্যেও–
উইল! দাদার উইল! পরম বিস্ময়ের সঙ্গেই যেন দুঃশাসন চৌধুরী কথা কটা উচ্চারণ করেন কিরীটীকে বাধা দিয়ে।
হ্যাঁ। উইলেই সে রকম লিখে দিয়েছেন তিনি, তাই আমাকে বলেছিলেন—
এবারে সত্যিই আমাকে হাসালেন মিঃ রায়। দাদার উইল! যতদূর আমার জানা আছে। তাঁর তো কোন উইলই নেই।
পাকাপোক্ত রেজিস্টার্ড উইল একটা না থাকলেও—উইল তাঁর একটা ছিল আমি জানি—বেশ জোরের সঙ্গেই জবাব দিল এবার কিরীটী।
ভুল শুনেছেন। কাঁচা পাকা কোন উইলই তাঁর নেই।
ইতিমধ্যে একসময় রায়বাহাদুরের পুত্র বৃহন্নলা চৌধুরীকেও দালাল সাহেব ঐ কক্ষের মধ্যে ডেকে এনেছিলেন।
পিতার আকস্মিক নিষ্ঠুর মৃত্যুতে বৃহন্নলা চৌধুরী যেন শোকে মুহ্যমান হয়ে পাথরের মতই একপাশে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে ছিল।
তার দিকে তাকিয়ে কিরীটী বলে, বৃহন্নলাবাবু, আপনার বাবার কোন উইল বা ঐজাতীয় কোন কিছু লেখা কি নেই?
না। আমি যতদূর জানি বাবার কোন উইল ছিল বলে আমি শুনিনি অন্ততঃ—
আছে। কে বললে নেই! আছে, আলবৎ হ্যায়।
অকস্মাৎ অন্য একটি পুরুষের সুমিষ্ট কণ্ঠস্বরে ঘরের মধ্যে উপস্থিত সব কটি প্রাণীই যুগপৎ বিস্মিত দৃষ্টিতে ফিরে তাকায় বক্তার দিকে।
কোন পুরুষের কণ্ঠস্বর এমন মধুস্রাবী হতে পারে এ যেন ধারণাও করা যায় না—ডাঃ সেনের মনে হল।
সত্যি অপূর্ব মিষ্টি কণ্ঠস্বর বক্তার।
এ তো কণ্ঠস্বর নয়, সঙ্গীতের সুর বুঝি।
সঙ্গীতের জন্যই যেন ভগবান ঐ কণ্ঠস্বরটি সৃষ্টি করেছেন।
০৪. গানের মতই মিষ্টি কণ্ঠস্বর
সত্যি গানের মতই মিষ্টি কণ্ঠস্বর।
উঁচু বলিষ্ঠ পুরুষোচিত গঠন।
কালো গায়ের রঙ হলেও, মুখ-চোখের গঠন ও দেহের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সব কিছু নিয়ে যেন অপূর্ব একটা শ্রী ও সৌন্দর্যের সমন্বয় যা সাধারণতঃ বড় একটা চোখে পড়ে না।
পরিধানে মিহি কালোপেড়ে ফরাসডাঙার গিলে-করা কোঁচানো ধুতি। ধুতির কোঁচা পায়ের পাতার উপরে লুটুচ্ছে।
গায়ে একটা হাফ-হাতা গরম পাঞ্জাবি। কাঁধের উপরে দামী কল্কার কাজ করা কমলালেবু রঙের কাশ্মীরী শাল। পায়ে ঘাসের চটি।
কাকা সাহেব! যেন কতকটা আত্মগতভাবেই কথাটা উচ্চারণ করেন দুঃশাসন চৌধুরী।
এ বাড়ির কাকা সাহেব অবিনাশ চৌধুরী।
কাকা সাহেব অবিনাশ চৌধুরী সত্যিই ঐ বাড়ির একটি বিশেষ ব্যতিক্রম যেন। শুধু মাত্র চেহারা ও বেশভূষাতেই নয়, চালচলনে আদবকায়দায় কথাবার্তায় এ বাড়ির কারও সঙ্গে যেন অবিনাশ চৌধুরীর কোন মিল নেই। শুধু আজ বলেই নয়, কোন কালেই বুঝি ছিল না।
প্রথম যৌবনে ছিলেন কাকা সাহেব অবিনাশ চৌধুরী লোকটি উগ্র সাহেব। তারপর বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সেই উগ্র সাহেবিয়ানার বদলে তাঁর সব কিছুর মধ্যে দেখা দিয়েছিল একটা বাদশাহী আভিজাত্য। যেমন দিলদরিয়া তেমনি স্ফুর্তিবাজ। বিয়ে করেননি, তাই বলে ব্রক্ষ্মচারীর চরিত্রও নয়।
সুরা নারী সঙ্গীত অভিনয় ও শিকার এই ছিল লোকটির জীবনের সব কিছু। রায়বাহাদুরের মুখেই কিরীটী শুনেছিল, এককালে ঐসব খেয়ালে দুহাতে লোকটি অর্থ উড়িয়েছেন। এখন
অবিশ্যি সঙ্গীতসাধনা নিয়েই ঘরের মধ্যে নিজেকে সর্বদা ব্যস্ত রাখেন।
প্রথম যৌবনের সাহেবী আচরণের জন্যই সকলে তাঁকে কাকা সাহেব বলে সম্বোধন করত। এখনও সেই সম্বোধনেই তিনি পরিচিত।
অবিনাশ চৌধুরীর বয়স পঞ্চাশের ঊর্ধ্বে এবং বয়স তাঁর যতই হোক না কেন, অতি পরিপাটি ও পরিচ্ছন্ন দেহের মধ্যে এতটুকুও তার ছাপ যেন দেখা যায় না।
আছে! আছে—আলবৎ আছে— দুবছর আগে দুর্যোধন উইল করে রেখেছিল।
কটি কথা বলে এবারে অবিনাশ চৌধুরী বারেকের জন্য সকলের দিকে একবার চেয়ে বৃহন্নলার প্রতি দৃষ্টি স্থাপন করে বললেন, সত্যিই কি দুর্যোধন মারা গেছে নাকি, বিনু? এরা গিয়ে এইমাত্র আমাকে সংবাদ দিল।
কিরীটী অবিনাশ চৌধুরীর মুখের দিকে তাকাল।
সে যেন ঠিক বুঝতে পারে না—কে এইমাত্র অবিনাশ চৌধুরীকে গিয়ে দুর্যোধন চৌধুরীর মৃত্যুসংবাদটা দিল!
কিন্তু অবিনাশ চৌধুরীর কথার কেউই কোন জবাব দেয় না।
ব্যাপার কি, তোমরা যে সবাই মুখে ছিপি এঁটে দিয়েছ বলে মনে হচ্ছে! কথা বলছ না কেন—বলতে বলতে প্রৌঢ় অবিনাশ চৌধুরীর পাশেই দণ্ডায়মান পুলিশ-সুপার দালাল সাহেবের প্রতি নজর পড়তেই মুহূর্তে কি একটা বিরক্তিতে যেন মুখটা তাঁর কুঞ্চিত হয়ে ওঠে।
এবং সকলকে যেন কতকটা বিস্মিত ও বিব্রত করেই দালাল সাহেবের মুখের দিকে চেয়ে এবারে রুক্ষ কণ্ঠে অবিনাশ বললেন, এ সময় দালাল সাহেব আপনি এখানে কেন? আপনি কেন এসেছেন?
রায়বাহাদুর নিজে আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।
কি বললেন, দুযযাধন আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছিল? কেন? নিশ্চয়ই এ বাড়িতে কোন চুরি-ডাকাতির কিনারা করতে নয়?
গম্ভীর কণ্ঠে দালাল সাহেব বললেন, তার চাইতেও গুরুতর ব্যাপারে চিঠি লিখে আমার সাহায্য প্রার্থনা করে আসতে বলেছিলেন।
গুরুতর ব্যাপারে! গুরুতর ব্যাপারটা কি শুনি?
তিনি–রায়বাহাদুর যে আজ রাত্রে নিহত হবেন, যে করেই হোক ব্যাপারটা তিনি পূর্বাহ্নে বুঝতে পেরে আমাকে সাহায্য করবার জন্য ডেকে পাঠিয়েছিলেন। এবং এখন দেখতে পাচ্ছি তাঁর সে অনুমান মিথ্যে নয়। সত্যি-সত্যিই তিনি নিষ্ঠুর ভাবে নিহত হয়েছেন।
হুঁ, সত্যি-সত্যিই তাহলে দুর্যোধন নিহত হয়েছে! ব্যাপারটার মধ্যে যেন এতটুকু গুরুত্বও নেই এইভাবে কথা কটি উচ্চারণ করে ধীরে শান্ত ও মৃদু পদবিক্ষেপে ঘরের অন্যাংশে পর্দার ওপাশে এগিয়ে গেলেন অবিনাশ চৌধুরী।
কিরীটী ও দালাল সাহেব নিঃশব্দে অবিনাশ চৌধুরীকে অনুসরণ করে।
শয্যার উপর রায়বাহাদুরের মৃতদেহ ঠিক পূর্বের মতই পড়ে আছে দেখা যায়।
অবিনাশ একেবারে মৃতদেহের সামনে শয্যার পাশে এসে দাঁড়ালেন এবং নিষ্পলক দৃষ্টিতে কয়েক মুহূর্ত সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্যের দিকে চেয়ে অস্ফুট স্বরে বললেন, দুযযাধন! Poor boy! সত্যি-সত্যিই তুই তাহলে মরলি! আশ্চর্য, তুই যে মরবি এ কথা তুই জেনেছিলি কি করে!
সহসা এমন সময় কিরীটীর প্রশ্নে অবিনাশ চৌধুরী ফিরে তীব্র দৃষ্টিতে কিরীটীর দিকে তাকান।
কিরীটী প্রশ্ন করে, আপনিও তাহলে সে কথা জানতেন অবিনাশবাবু?
Who are you? অবিনাশ চৌধুরী প্রশ্ন করেন।
চিনতে পারছেন না আমাকে, আমার নাম কিরীটী রায়!
কিরীটী রায়! ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। আমাদের সেই দলিল জালের একটা ব্যাপারে বছর দুই আগে তুমিই না সব ধরে দিয়েছিলে?
হ্যাঁ।
হুঁ, তা কি বলছিলে, আমি সে কথা জানলাম কি করে, না? নতুন কথা তো নয়, দুনিয়াসুদ্ধ লোকেই তো শুনলাম জানতো। দুর্যোধন তো কথাটা বলে বেড়িয়েছে সকলকে শুনেছি।
আপনাকেও তাহলে তিনি বলেছিলেন?
হুঁ।
কবে?
দিন পনের আগে ও একবার বলেছিল—
এর মধ্যে আর বলেননি?
না। বলবে কখন—দেখাই তো হয়নি!
দেখাই হয়নি!
না।
কত দিন দেখা হয়নি?
তা দিন পনেরো হবে।
এই দিন পনেরোর মধ্যে একবারও ওঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেননি?
না।
উনি যে অসুস্থ তা আপনি জানতেন?
জানব না কেন!
তবে?
তবে আবার কি! ওসব বড়লোকের রোগফোবিয়া আমার দু-চক্ষের বিষ, I cant stand them.
রায়বাহাদুরের এই দীর্ঘদিনের রোগটা তাহলে আপনার মতে একটা ফোবিয়া ছাড়া কিছু নয়? কিরীটী বলে।
নিশ্চয়ই না।
কি বলছেন আপনি! এত বড় বোগ, এত ডাক্তার, সব ছিল তাঁর একটা ফোবিয়া? প্রশ্ন করলেন এবারে দালাল সাহেব।
হ্যাঁ, তাছাড়া আর কি! সাত-সাতটা হার্ট অ্যাটাক হলে কোন ভদ্রলোক উঠতে পারে বলে তো কখনও শুনিনি। আসলে ও হার্ট অ্যাটাক নয়।
অবাক বিস্ময়ে কিরীটী অবিনাশ চৌধুরীর মুখের দিকে তাকিয়ে তাকে।
অবিনাশ চৌধুরী তখনও বলে চলেছেন, বুঝলেন, আসলে ওসব কিছু নয়, ওকে পেয়েছিল মেলানকোলিয়ায়, বেটসা অর্থাৎ সুরমার মৃত্যুর পর হতেই ও মেলানকোলিয়ায় ভুগছিল। ইদানীং আবার গোদের ওপর বিষফোড়া হয়েছিল, মেলানকোলিয়াই গিয়ে শেষ সিজোফ্রেনিয়াতে দাঁড়িয়েছিল। ভারি তো দুছটাক সম্পত্তি আর সামান্য কয়েক লক্ষ টাকার ব্যাঙ্ক-ব্যালেন্স, তার জন্যে লোকে ওকে হত্যা করবে! যত সব—
বড় বড় রোগের নাম উচ্চারিত হতে শুনেই ডাঃ সমর সেন ও ডাঃ সানিয়াল উভয়েই কৌতূহলী হয়ে অবিনাশ চৌধুরীর মুখের দিকে তাকান।
উভয়েরই বাক্যস্ফুর্তি হয় না অবিনাশ চৌধুরীর কথা শুনে।
অবিনাশ চৌধুরী বললেন, অপঘাতে মৃত্যু! এইবার সব ধসে পড়বে। দীর্ঘদিন ধরে অনেক পরিশ্রম করে দুর্যোধন আর আমি সব গড়ে তুলেছিলাম, এইবারে সব যাবে। অভিশাপ-—সতীসাধ্বীর অভিশাপ!
বলতে বলতে অবিনাশ চৌধুরী বোধ হয় ফিরে যাওয়ার জন্যই পা বাড়িয়েছিলেন।
দালাল সাহেব সহসা বাধা দিলেন, অবিনাশবাবু!
তুমি আবার কে?
আমি এখানকার এস.পি.।
I see—তা তোমার কিছু বক্তব্য আছে নাকি?
ভ্রূ কুঞ্চিত করে তীব্র দৃষ্টিতে তাকান অবিনাশ চৌধুরী দালাল সাহেবের মুখের দিকে।
পালটা প্রশ্নে দালাল সাহেব কেমন যেন থতমত খেয়ে তাকিয়ে থাকেন।
এই সময় কিরীটী কথা বলে আবার।
সে অবিনাশ চৌধুরীকে প্রশ্ন করে, একটা কথা অবিনাশবাবু–
বলুন!
একটু আগে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে আপনি যে বলছিলেন দু বৎসর আগেই রায়বাহাদুর উইল করেছিলেন—
হ্যাঁ, করেছিলই তো।
সেটা অবিশ্যি আমিও শুনেছিলাম, কিন্তু সেটা কি রেজিস্টার্ড উইল?
রেজিস্ট্রি করেছিল কিনা উইলটা তা জানি না তবে একটা উইল তার আছে। আগে যে ঘরে দুর্যোধন শুত সেই ঘরের আয়রন চেস্টেই বোধ হয় তার সে উইল আছে, যতদূর আমি জানি। তবে সে উইল শেষ পর্যন্ত পাওয়া যাবে বলে আর আমার এখন মনে হচ্ছে না।
কেন? কিরীটী প্রশ্ন করল।
কেন! এমনি অপঘাত মৃত্যু, তার ওপরেও সে উইল পাওয়া যাবে বলে আপনি মনে করেন মিঃ রায়? তাছাড়া আমি তো জানি সে উইলে এই যারা সব পরমাত্মীয়ের দল ঘরের মধ্যে এসে ভিড় করেছে তারা কেউই কিছু পায়নি।
কি বলছেন আপনি? কিরীটীই আবার প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ, উইলটা যদি খুঁজে পান তো সেটা খুললেই আমার কথার সত্যি-মিথ্যে নিজের চোখেই দেখতে পাবেন।
অতঃপর দ্বিতীয় আর বাক্যব্যয় না করে অবিনাশ চৌধুরী কক্ষত্যাগ করে চলে গেলেন নিঃশব্দে।
অবিনাশ চৌধুরীর শেষের কথায় ও তাঁর কক্ষ হতে প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গেই যেন সমগ্র কক্ষের মধ্যে একটা বিশ্রী থমথমে ভাব জমাট বেঁধে ওঠে।
অভাবনীয় পরিস্থিতি। কারও মুখেই কোন শব্দটি পর্যন্ত নেই। নিচুপ সকলেই।
অবিনাশ চৌধুরীই যেন সকলকে অকস্মাৎ মূক করে দিয়ে গিয়েছেন। ওদিকে রাত্রি প্রায় শেষ হয়ে আসছিল।
আকাশের বুকে শেষ অন্ধকারের পাতলা পদাটা আসন্ন আলোর ছোঁয়ায় যেন থির থির করে কাঁপছিল।
নাইট-কীপার হুম্ সিংহের খবরদারির চিৎকার সে রাত্রির মত থেমে গিয়েছিল বোধ হয়।
সারারাত্রির জাগরণক্লান্ত হুম্ সিং বাগানের মধ্যে ছোট্ট টালির শেষ্টার মধ্যে এতক্ষণ গিয়ে হয়ত ঢুকেছে।
এখন টানা ঘণ্টা চারেক ঘুমোবে। বেলা দশটা সাড়ে দশটা নাগাদ একবার জেগে নিজ হাতে উনুন ধরিয়ে এক মগ কড়া চা তৈরী করে পান করে আবার বেলা বারোটা পর্যন্ত ঘুমোবে।
তারপর কিছু রুটি ও ডাল আহার এবং আবার সূযাস্ত পর্যন্ত একটানা নিদ্রা।
জাগবে সে ঠিক সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার যখন প্রকৃতির বুকে একটু একটু করে ঘন হয়ে উঠবে।
.
কিরীটীই ঘরের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে।
দালাল সাহেবের দিকে চেয়ে বলে, আপনার জবানবন্দি নেওয়া শেষ হল দালাল সাহেব?
না, এই যে শুরু করি—
দালাল সাহেব আবার তাঁর জবানবন্দি নিতে শুরু করেন।
.
রায়বাহাদুরের ভাই দুঃশাসন চৌধুরীর জবানবন্দি নেওয়া তখনও শেষ হয়নি, আকস্মিকভাবে ঘরের মধ্যে অবিনাশ চৌধুরীর আবির্ভাব ঘটে।
কিরীটীর নির্দেশে বোধ হয় তারই পূর্ব প্রশ্নের জের টেনে দালাল সাহেব দুঃশাসন চৌধুরীর দিকে চেয়ে পুনরায় প্রশ্ন করলেন, তাহলে আপনি এই তো বলতে চান যে রায়বাহাদুরের কোন প্রকার উইলই ছিল না?
আমি তো মশাই সেই রকমই জানি।
তবে আপনার কাকা সাহেব যে সব কথা বলছিলেন—
ছেড়ে দিন না মশাই। একটা অর্ধ-উন্মাদ লোক—ওঁর কথা কেউ বিশ্বাস করবে নাকি? তাছাড়া দিবারাত্রি গান আর বাইজী নিয়েই তো পড়ে আছেন।
কিরীটীই এবার প্রশ্ন করে, অর্ধ-উন্মাদ নাকি অবিনাশবাবু?
তাছাড়া আর কি! আর এখানে সকলেই তো সে কথা জানে। খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন বছর পাঁচেক আগেই প্রথম ওঁর মাথা খারাপের লক্ষণ প্রকাশ পায়। সেই সময় অনেক চিকিৎসা করা হয়, এমন কি কিছুদিন তাঁকে মেন্টাল হসপিটালেও ওঁকে রাখা হয়েছিল।
আপনি তো দীর্ঘকাল ধরে বিদেশে ছিলেন এবং রায়বাহাদুরের মুখেই আমি শুনেছি আপনার সঙ্গে এ বাড়ির কখনও পত্র বিনিময়ও ছিল না। এসব কথা তবে আপনি জানলেন কি করে?
এখানে এসেই শুনেছি।
হুঁ। বলতে বলতে হঠাৎ বৃহন্নলা চৌধুরীর দিকে ফিরে চেয়ে কিরীটী প্রশ্ন করে, বৃহন্নলাবাবু, সত্যিই কি আপনার দাদুর মাথার গোলমাল ঘটেছিল?
হ্যাঁ, দাদুকে কিছুদিন রাঁচীতে কাঁকে মেন্টাল হসপিটালে ইউরোপীয়ান ওয়ার্ডে রাখা হয়েছিল।
কতদিন হাসপাতালে তিনি ছিলেন?
তা বছর দেড়েক তো হবেই।
সেখান থেকে কি পরে তাঁকে তারাই ডিসচার্জ করে দেয়, না আপনারাই ওঁকে ছাড়িয়ে আনেন?
ভাল হয়ে যাওয়ায় আমরাই ওঁকে ছাড়িয়ে আনি।
অসুখটা কি হয়েছিল ওঁর জানেন কিছু?
না।
.
দালাল সাহেব আবার প্রশ্ন শুরু করেন দুঃশাসন চৌধুরীকে।
রাত্রি ঠিক সাড়ে তিনটে থেকে রায়বাহাদুরের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে এ ঘরে আসবার পূর্ব পর্যন্ত সময়টা আপনি কোথায় ছিলেন এবং কি করছিলেন দুঃশাসনবাবু?
মাস তিনেক ধরে রাত্রে আমার একেবারেই বলতে গেলে ঘুম হয় না। তবে আজ নার্স আমাকে একটা স্ট্রং ঘুমের ওষুধ দিয়েছিল তাতেই বোধহয় একটু ঝিম মত এসেছিল। বোধ হয় তো কিছুক্ষণের জন্য ঘুমিয়েও পড়েছিলাম।
হুঁ। তা রায়বাহাদুর যে মারা গেছেন টের পেলেন কি করে?
সত্যি কথা বলতে কি-দাদার আজ কদিনকার কথা শুনে আজকের রাত্রে ঐ সময়ে যে একটা বিপদ ঘটতে পারে আর কেউ বিশ্বাস না করলেও যেন কেন আমার মন বলেছিল, একবারে অবিশ্বাস করে ব্যাপারটা উড়িয়ে দেবার নয়। তাছাড়া আমি তো এই পাশের ঘরেই থাকি, তাই চারটে বাজবার মিনিট চার-পাঁচ আগেই হঠাৎ তন্দ্রা ভেঙে এ ঘরে এসেছি
এসে কি দেখলেন?
দেখলাম ঘরের মধ্যে একা দাদার চাকর দাঁড়িয়ে আছে। ওর চোখে-মুখে একটা ভয়ের চিহ্ন ফুটে উঠেছে। আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই ও হাউ হাউ করে কেঁদে উঠে বললে, বাবু নেই। পর্দার ওপাশে গিয়ে দেখলাম, সত্যিই–
তারপর?
তখন আমিই ওকে আপনাদের ডাকতে বলি ডাক্তারের ঘর থেকে।
হঠাৎ ঐ সময় কিরীটী নার্স সুলতা করের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করে, দুঃশাসনবাবুকে কি ঘুমের ওষুধ দিয়েছিলেন সুলতা দেবী?
ডাঃ সানিয়ালের ইনস্ট্রাকসন ছিল একটা লুমিনল ট্যাবলেট দিতে, তাই দিয়েছিলাম।
মৃদু কোমল কণ্ঠে সুলতা কর জবাব দিল।
কিরীটী লক্ষ্য করে, সুলতা কর ঐ বলার সঙ্গে সঙ্গেই ডাঃ সমর সেন ও ডাঃ সানিয়াল যুগপৎ যেন নার্স সুলতা করের মুখের দিকে তাকাল।
ডাঃ সানিয়াল কি যেন বলবারও চেষ্টা করেন কিন্তু বলার সময় পান না—দালাল সাহেব তাড়াতাড়ি বলেন, আচ্ছা এবারে আপনি আপনার ঘরে যেতে পারেন দুঃশাসনবাবু। তবে একটা কথা—আমার জবানবন্দি না শেষ হওয়া পর্যন্ত এবং আমার পারমিশন ব্যতীত এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেন যাবেন না।
দুঃশাসন চৌধুরী দালাল সাহেবের নির্দেশ শুনে ফিরে তাকায়, তার মানে আমাকে কি নজরবন্দী রাখা হচ্ছে?
না, নজরবন্দী নয়। শুধু একা আপনি নন, এ বাড়িতে যাঁরা যাঁরা এখন আছেন প্রত্যেকের প্রতি আমার ঐ আদেশ।
বেশ।
দুঃশাসন চৌধুরী অতঃপর ঘর হতে বেরিয়ে গেলেন এবং স্পষ্টইবোঝা গেল দালাল সাহেবের কঠোর নির্দেশে তিনি আদপেই সন্তুষ্ট হতে পারেননি।
এবং শুধু দুঃশাসন চৌধুরীই নয়, সকলেই যে একটু মনঃক্ষুন্ন হয়েছে, সকলের মুখেই যেন তার আভাস পাওয়া গেল।
কিন্তু দালাল সাহেব কোন ভ্রুক্ষেপই করলেন না।
তিনি এবার বৃহন্নলা চৌধুরীর দিকে চেয়ে বললেন, বৃহন্নলাবাবু, এবারে আপনাকে আমি কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই।
০৫. বৃহন্নলা চৌধুরী কেমন যেন
বৃহন্নলা চৌধুরী কেমন যেন বিহ্বল দৃষ্টিতে দালাল সাহেবের মুখের দিকে চেয়ে বলে, বলুন!
আশা করি আপনাকে যা যা জিজ্ঞাসা করব তার সঠিক জবাব পাব।
নিশ্চয়ই।
গলার স্বরটা মৃদু।
রাত তিনটে থেকে এ ঘরে আসবার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত আপনি কি আপনার ঘরেই ছিলেন?
হ্যাঁ। সন্ধ্যে থেকেই শরীরটা আমার আজ ভাল ছিল না। তাছাড়া ডাঃ সানিয়াল বলেছিলেন ভয়ের কোন কারণ নেই, তাই নিজের ঘরেই ঘুমিয়ে ছিলাম।
সে ঘরে আর কেউ ছিল?
না। আমি একাই এক ঘরে শুই বছরখানেক যাবৎ।
আপনার স্ত্রী ও ছেলে।
পাশের ঘরে তারা শোয়।
কার কাছে এ দুঃসংবাদ প্রথমে পেয়ে তাহলে আপনি এঘরে আসেন?
কাকাই গিয়ে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে সব কথা বলেন।
কাকা মানে দুঃশাসনবাবু?
হ্যাঁ।
এবারে কিরীটী প্রশ্ন করে, হুঁ, আচ্ছা বৃহন্নলাবাবু, আপনার বাবা যে রাত্রে মারা যাবেন এ কথা আপনাকে বলেছিলেন কি কখনও?
বলেছিলেন। কিছুদিন থেকে প্রত্যেকের কাছেই তো ও কথা বলেছেন তিনি।
আচ্ছা হঠাৎ ঐ ধরনের কথা বলবার তাঁর কোন সঙ্গত কারণ থাকতে পারে বলে আপনার মনে হয় কি বৃহন্নলাবাবু? দালাল সাহেব প্রশ্ন করেন।
কি জানি, আমি তো দেখতে পাই না।
এমন সময় ঘরের মধ্যে সকলকে বিস্মিত ও সচকিত করে অপূর্ব একটি নারীকণ্ঠ শোনা গেল।
বৃহন্নলা! দাদাকে নাকি সত্যিসত্যিই কে খুন করেছে?
যুগপৎ ঘরের মধ্যে উপস্থিত সব কটি প্রাণীই সেই নারীকণ্ঠ শুনে ফিরে তাকায়।
মধ্যবয়সী অপূর্ব সুন্দরী এক নারী ও তার পার্শ্বে এক অপূর্ব সুন্দরী কুড়ি-একুশ বৎসর বয়স্কা যুবতী।
শুধু অপূর্ব সুন্দরীই নয় সেই যুবতী, রূপের যেন তার সত্যিই তুলনা নেই।
কি রূপ!
চিত্রকরের আঁকা যেন একখানা ছবি।
চোখের দৃষ্টি যেন ফেরানো যায় না।
দুটি অসমবয়েসী নারীমূর্তিকে দেখে বুঝতে কষ্ট হয় না যে একে অন্যের প্রতিচ্ছায়া। অর্থাৎ মা ও মেয়ে।
সকলেই বর্ষীয়সী নারীর প্রশ্নে স্তম্ভিত, নির্বাক।
বৃহন্নলা চৌধুরীই কথা বলে প্রথমে, পিসিমা!
কিরীটী এতক্ষণে চিনতে পারে, ইনিই দুর্যোধন চৌধুরীর বিধবা ভগিনী গান্ধারী দেবী। বৃহন্নলার পিসিমা এবং তাঁর পার্শ্বে দাঁড়িয়ে গান্ধারী দেবীর একমাত্র কন্যা রুচিরা দেবী।
রুচিরার অপূর্ব রূপলাবণ্যের কথা কিরীটী রায়বাহাদুরের মুখে ইতিপূর্বে শুনেছিল বটে তবে ভাবতে পারেনি যে রুচিরা সতিসত্যিই অমনি রূপবতী।
মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে কিরীটী রুচিরার দিকে এবং শুধু কিরীটীই নয়, ডাঃ সমর সেনও বিস্ময়ে যেন অভিভূত হয়ে রুচিরার দিকে চেয়ে ছিল পলকহীন দৃষ্টিতে।
আপনিই রায়বাহাদুরের বোন? সহসা কিরীটী গান্ধারী দেবীর দিকে চেয়ে প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ। মৃদুকণ্ঠে গান্ধারী দেবী প্রত্যুত্তর দেয়।
আপনার দাদা রায়বাহাদুর যে নিহত হয়েছেন কার মুখে শুনলেন?
রুচি আমাকে একটু আগে গিয়ে বলল।
কে? রুচিরা দেবী, মানে আপনার মেয়ে?
হ্যাঁ।
এবারে কিরীটী রুচিরার মুখের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল, আপনি বলেছেন আপনার মাকে যে আপনার মামা নিহত হয়েছেন?
হ্যাঁ।
আপনি কি করে জানলেন সে কথা?
আমি–রুচিরা একবার মার মুখের দিকে চেয়ে কিরীটীর মুখের দিকে ফিরে তাকিয়ে কেমন যেন ইতস্তত করে।
হ্যাঁ, আপনি জানলেন কি করে? আমি তো জানি আপনারা দক্ষিণের মহলে থাকেন, তাই না?
হ্যাঁ।
তবে?
আমাকে ছোটমামাবাবুই তো গিয়ে বলে এসেছেন।
কি বললি, আমি বলে এসেছি? বিশ্বাস করবেন না, মিথ্যে কথা—দুঃশাসন চৌধুরী হঠাৎ রূঢ়-কঠিন প্রতিবাদে চিৎকার করে ওঠেন এবং যুগপৎ সকলেই তাঁর মুখের দিকে তাকায়।
মিথ্যে কথা বলছি? কি বলছ ছোটমামাবাবু? একটু আগে গিয়ে তুমি আমাকে বলে আসোনি যে বড়মামাবাবুকে ছোরা দিয়ে কে যেন খুন করেছে! সেই কথা শুনেই তো আমি মাকে গিয়ে খবর দিয়েছি।
Its a damn lie! ডাহা মিথ্যে কথা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দুঃশাসন চৌধুরী আবার প্রতিবাদ জানায়, কখন তোর ঘরে আমি গিয়েছিলাম রে মিথুক? আমি তো বৃহন্নলাকে ডাকতে গিয়েছিলাম। তার ঘরেই ছিলাম।
ছোটমামা, মিথ্যে কথা বলে কোন লাভ নেই। তোমার কীর্তির কথা জানতে তো আর কারও বাকি নেই।
রুচিরা!
বিশ্রী কণ্ঠে দুঃশাসন চৌধুরী গর্জন করে ওঠেন। সামান্য একটা কথাকে কেন্দ্র করে বাদ-প্রতিবাদে মুহূর্তে কক্ষের মধ্যে যেন একটা বিষের হাওয়া জমাট বেঁধে ওঠে।
কিরীটী দেখল তিক্ত ব্যাপারকে আর বেশীদূর গড়াতে দেওয়া উচিত হবে না।
সে ধীর শান্ত কণ্ঠে বলে, দুঃশাসনবাবু, বাদানুবাদের কোন প্রয়োজন নেই। সত্যকে কেউই আপনারা গোপন করে রাখতে পারবেন না, সময়ে সবই জানা যাবে। তারপর দুঃশাসন চৌধুরীর দিকে ফিরে বলে, দুঃশাসনবাবু, আপনি কিছুক্ষণের জন্য যদি একটু স্থির হয়ে ওই চেয়ারটায় বসেন—আমি রুচিরা দেবীকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই।
কিন্তু রুচিরাকে দুঃশাসন চৌধুরী কি যেন প্রতিবাদ জানাতে শুরু করতেই কিরীটী তাঁকে। পুনরায় বাধা দিল, না, এখন আর একটি কথাও নয়। আপনাকে যখন আমি প্রশ্ন করব আপনার। যা বলবার বলবেন।
বেশ। তাই হবে। গজগজ করতে করতে দুঃশাসন চৌধুরী অনতিদূরে রক্ষিত চেয়ারটার উপরে গিয়ে উপবেশন করলেন।
রুচিরাকে প্রশ্ন করবার আগে একটা ব্যাপার কিরীটীর চোখে পড়েছিল। রুচিরা ঘরে ঢোকার পর হতেই ডাঃ সমর সেনের দিকে মধ্যে মধ্যে আড়চোখে সে তাকাচ্ছিল। এবং শুধু সে নয়, ডাক্তার সেনও।
কিন্তু কিরীটী যেন ব্যাপারটা আদৌ লক্ষ্য করেনি এইভাবে রুচিরাকে অতঃপর প্রশ্ন শুরু করে।
রুচিরা দেবী, বলুন তো এবারে, ঠিক কতক্ষণ আগে আপনার ছোটমামা দুঃশাসন চৌধুরী আপনাকে গিয়ে রায়বাহাদুরের মৃত্যুসংবাদ দিয়েছিলেন?
তা ঘণ্টাখানেক!
বলতে বলতে কিরীটী একটিবার নিজের হাতঘড়িটার দিকে চেয়ে বললে, বেশ, এখন বলুন exactly, দুঃশাসনবাবু আপনাকে গিয়ে কি বলেছিলেন?
ছোটমামাবাবু আমার ঘরে গিয়ে বললেন, সর্বনাশ হয়ে গেছে, বড়মামাবাবুকে নাকি ছোরা মেরে কে খুন করেছে!
ঐ কথা বলেই তিনি চলে আসেন, না তারপরেও ঘরে ছিলেন?
চলে আসেন।
হুঁ। এক ঘণ্টা আগে যদি দুঃশাসনবাবু আপনাকে খবরটা দিয়ে থাকেন, চারটে বাজবার কয়েক মিনিট আগেই বলুন খবরটা উনি আপনাকে দিয়েছেন, তাই নয় কি?
হ্যাঁ, তাই হবে।
বেশ। আচ্ছা একটা কথা রুচিরা দেবী, দুঃশাসনবাবু যখন আপনার ঘরে যান আপনার ঘরের দরজা কি খোলা ছিল?
হঠাৎ কিরীটীর শেষ প্রশ্নে রুচিরা দেবী কেমন যেন একটু থতমত খেয়ে যায়।
কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, ঘরের দরজা বন্ধ ছিল।
ঘরের আলো জ্বালা ছিল, না নেভানো ছিল?
আর একবার চমকে ওঠে রুচিরা, মৃদু কণ্ঠে বলে, জ্বালানোই ছিল।
আপনি জেগে, না ঘুমিয়ে ছিলেন?
ঘুমিয়ে ছিলাম।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিরীটী রুচিরা দেবীর মুখের দিকে তাকায়।
ঠিক আছে রুচিরা দেবী, আপনি আপাততঃ আপনার ঘরে যেতে পারেন। পরে প্রয়োজন হলে আপনাকে আমরা খবর দেব।
নিঃশব্দে রুচিরা কক্ষ ত্যাগ করে চলে গেল।
এবং ঘর ছেড়ে যাবার আগে কিরীটী লক্ষ্য করে আর একবার ডাঃ সেনের দিকে নিমেষের জন্যে তাকাল।
কিরীটী একবার মৃত রায়বাহাদুরের বোনের দিকে তাকিয়ে মৃদু কণ্ঠে ডাকে, গান্ধারী দেবী!
কিরীটীর ডাকে রুচিরার মা একটু যেন চমকে উঠেই কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন।
এখানে আপনি কতদিন আছেন?
বছর মোল হবে। আমার স্বামীর মৃত্যুর পর থেকেই দাদা এখানে আমাকে নিয়ে এসে রেখেছেন—বলতে বলতে গান্ধারীদেবীর চোখের পাতা দুটো যেন অশ্রুতে ঝাপসা হয়ে আসে।
আপনারা কয় বোন?
আমি আর কুম্ভী।
কুন্তী দেবীও কি এখানে আছেন?
না, সে বহুদিন আগে মারা গেছে, তার একমাত্র ছেলে ঐ শকুনি।
শকুনি! ঠিক তো, শকুনিবাবুকে দেখছি না! তা তিনি কোথায়? সঙ্গে সঙ্গে দালাল সাহেব বলে ওঠেন।
ডাঃ সমর সেনেরও শকুনির কথা সঙ্গে সঙ্গেই মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে যায় তার সেই কথা, আজ্ঞে মাতুল দুযযাধনের ভাগিনেয় শকুনি।
দুঃশাসন চৌধুরী হঠাৎ বলে ওঠেন, ডেকে আনব সে হতভাগাটাকে দালাল সাহেব?
না, আপনি বসুন। ডাকা যাবেখন। কিরীটী শান্ত স্বরে জবাব দিল এবং গান্ধারী দেবীর দিকে অতঃপর আবার তাকিয়ে বললে, আচ্ছা গান্ধারী দেবী, আপনার মেয়ে রুচিরার বিয়ের কোন চেষ্টাচরিত্র করছেন না?
রুচির বিয়ের সব কিছু তো একপ্রকার ঠিকই হয়ে আছে।
ঠিক হয়ে গেছে তাহলে?
হ্যাঁ।
কোথায়? কার সঙ্গে?
সমীরের সঙ্গে, আর সমীর তো এখন এই বাড়িতেই আছে।
সমীর! বিস্মিত কিরীটী যেন গান্ধারী দেবীকে পাল্টা প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ–সমীর বোস। ওদের কয়লার ব্যবসা আছে, অবস্থা খুব ভাল। দাদাই এ বিয়ের সব ঠিকঠাক করেছিলেন নিজে পছন্দ করে।
কিরীটী এবারে দুঃশাসন চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলে, কাউকে পাঠিয়ে দুঃশাসনবাবু সমীরবাবুকে একবার ডেকে আনুন না দয়া করে এখানে।
নিশ্চয়ই। বলে দুঃশাসন চৌধুরী একজন ভৃত্যকে তখুনি সমীরকে ডেকে দিতে বললেন।
কিরীটী আবার গান্ধারী দেবীর দিকে ফিরে প্রশ্ন শুরু করে, আচ্ছা গান্ধারী দেবী, আপনি আর রুচিরা দেবী কি একই ঘরে শোন?
না। পাশাপাশি দুটো ঘরে দুজনে শুই, তবে দুঘরের মধ্যে যাতায়াতের জন্য মাঝখানে একটা দরজা আছে।
রুচিরা দেবী যখন আপনাকে গিয়ে রায়বাহাদুরের মৃত্যু সংবাদ দেন তখন আপনি জানেন কিছু? আপনি কি ঐ সময় জেগে ছিলেন?
না। ঘুমিয়ে ছিলাম। তাছাড়া ঘুম আমার চিরদিনই একটু বেশী গাঢ়। ডাকাডাকি না করলে বড় আমার একটা ঘুম ভাঙে না।
তাহলে রুচিরা দেবীই—মানে আপনার মেয়েই আপনাকে ডেকে তুলেছেন ঘুম থেকে?
হ্যাঁ।
আপনাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে আপনাকে তিনি ঠিক কি কথা বলেছিলেন আপনার মনে আছে?
হ্যাঁ, রুচি বললে দাদাকে নাকি কে ছোরা মেরে খুন করেছে।
তা নয়, আমি জানতে চাই, ঠিক রুচিরা দেবী আপনাকে কি কথা বলেছিলেন? মনে করে বলুন।
রুচি বলেছিল—
হ্যাঁ বলুন—ঠিক তিনি কি কথাগুলো আপনাকে বলেছিলেন?
ও বলেছিল, মা, শীগগির এস। বড় মামাবাবু নাকি খুন—
আর কিছু তিনি বলেননি?
না।
আচ্ছা আর একটা কথা, ইদানীং কিছুদিন ধরে যে রায়বাহাদুরের ধারণা হয়েছিল আজ রাত চারটের সময় কেউ তাঁকে হত্যা করবে, এ কথাটা কি আপনি জানতেন? মানে আপনি কি শুনেছেন তাঁর মুখ থেকে কখনও?
হ্যাঁ, শুনেছি বৈকি।
হুঁ, আচ্ছা আর দুটি প্রশ্ন কেবল আপনাকে আমি করতে চাই গান্ধারী দেবী। তারপর একটু থেমে বলে, বলতে পারেন রায়বাহাদুরের কেন ইদানীং ধারণা হয়ে গিয়েছিল ঐ রকমের একটা যে তাঁকে সকলে হত্যা করবার ষড়যন্ত্র করছে?
না, বলতে পারি না। আমার তো মনে হয় এমন কোন কারণই থাকতে পারে না। তাছাড়া তাঁকে এ বাড়ির মধ্যে তাঁর আত্মীয়স্বজনরা কেউ কেনই বা হত্যা করতে যাবে! দাদাও যেমন সকলকে ভালবাসতেন, সকলেও তেমনি দাদাকে ভালবাসত।
হুঁ। আচ্ছা আপনার দাদা রায়বাহাদুরের কোন উইল ছিল বলে জানেন বা কিছু কখনও শুনেছেন?
হ্যাঁ, যতদূর জানি দাদার বোধ হয় একটা উইল আছে।
সে উইল সম্পর্কে অর্থাৎ সে উইলের মধ্যে কি লেখা আছে বা না আছে, সে সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন?
না।
আচ্ছা আপনি এখন যেতে পারেন।
গান্ধারী দেবী নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
অতঃপর কিরীটী পুলিস-সুপার দালাল সাহেবের সঙ্গে অন্যের অশ্রুতভাবে কিছুক্ষণ যেন কি মৃদুকণ্ঠে আলোচনা করে।
এবং মধ্যে মধ্যে দালাল সাহেব মাথা নেড়ে সম্মতি জানান।
.
বাইরে আবার পদশব্দ শোনা গেল।
এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আটাশ-ঊনত্রিশ বৎসরের একজন সুশ্রী যুবক ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করল। যুবকের পরিধানে স্লিপিং পায়জামা ও গায়ে জড়ানো একটা পাতলা কমলালেবু রংয়ের কাশ্মীরী শাল।
মাথায় বিস্রস্ত কেশে ও চোখে-মুখে সুস্পষ্ট একটা নিদ্রাভঙ্গের ছাপ যেন তখনও লেগে আছে।
দুঃশাসন চৌধুরীই তাকে সবাগ্রে আহ্বান জানালেন, এস সমীর। তুমি কি ঘুমোচ্ছিলে নাকি?
হ্যাঁ। কিন্তু ব্যাপার কি? হঠাৎ? উদ্বিগ্ন সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে বারেকের জন্য দুঃশাসন চৌধুরীর মুখের দিকে চেয়ে সমীর ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলের মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করল।
শোননি কিছু?
না তো! খুবই দুঃসংবাদ, দাদা খুন হয়েছেন।
খুন! যেন একটা আর্ত চিৎকারের মতই শব্দটা সমীরের কণ্ঠ হতে নির্গত হয়।
হ্যাঁ। দাদাকে কে যেন খুন করেছে।
আপনারই নাম সমীর বোস? ঐ সময় কিরীটী বাধা দেয়।
কিরীটীর প্রশ্নে সমীর মুখ তুলে তাকায়।
হ্যাঁ। আপনি?
আমার নাম কিরীটী রায়। এ কদিন আমি এখানে আছি, কিন্তু কই আপনাকে তত আমি দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না।
আমি তো আজই রাত আটটার গাড়িতে কলকাতা থেকে এসেছি।
ওঃ!
ডাঃ সমর সেন সমীর বোসকে চিনতে পেরেছিলেন।
এই ঘরের মধ্যে ঢুকে দুঃশাসন চৌধুরী ও ডাঃ সানিয়েলের সঙ্গে সমীর বোসকেই তিনি দেখেছিলেন।
কিরীটী আবার বলে, বসুন সমীরবাবু, কতক্ষণ এ ঘরে ছিলেন আপনি আজ রাত্রে?
সমীর চেয়ারের ওপরে উপবেশন করল। এবং মৃদুকণ্ঠে বলে, রাত তিনটে পর্যন্ত তো আমি এই ঘরেই ছিলাম। ডাঃ সেন আসবার পর আমি শুতে যাই।
আপনারও তো শুনেছি কয়লার খনি আছে, তাই না মিঃ বোস?
হ্যাঁ।
কোথায়?
ঝরিয়াতে ও সিঁজুয়াতে।
রায়বাহাদুরের ভাগ্নী রুচিরা দেবীর সঙ্গে তো আপনার বিয়ের সব কথাবার্তা হয়ে গেছে, তাই না?
কথাবার্তা হয়েছে বটে একটা, তবে এখনও final কিছুই স্থির হয়নি।
রুচিরা দেবীর সঙ্গে আপনার পরিচয় নিশ্চয়ই আছে?
হ্যাঁ।
কত দিনের পরিচয়?
তা অনেক দিনের হবে। কলেজের একটা ফাংশনে বছরখানেক আগে রুচির সঙ্গে আমার আলাপ হয়।
একটা কথা মিঃ বোস, ঐ বিয়ে সম্পর্কে কথাবাতার জন্যই কি আপনি এখানে এসেছেন। কাল?
না। রায়বাহাদুরের একটা মাইন আমি কিনব, কয়েক মাস যাবৎ কথাবার্তা চলছিল। সেই সম্পর্কেই একটা পাকাপাকি ব্যবস্থা করবার জন্য বিশেষ করে এবারে আমার এখানে আসা।
কথাবাতা কিছু হয়েছিল সে সম্পর্কে?
হ্যাঁ। রাত্রেই সব ফাইনাল হয়ে গিয়েছে। সইও হয়ে গিয়েছে, এখন কেবল রেজিস্ট্রী করা বাকি।
আপনি এখান থেকে একেবারে সোজা আপনার ঘরেই গিয়েছিলেন, তাই না মিঃ বোস?
হ্যাঁ। বড্ড ঘুম পাচ্ছিল তাই সোজা গিয়ে বিছানায় শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
আপনার সঙ্গে রায়বাহাদুরের ব্যবসা ছাড়া আর অন্য কোন কথা হয়েছিল কি মিঃ বোস?
না। রায়বাহাদুর যে গত রাত্রে ভোর চারটের সময় নিহত হবেন, সে ধরণের কোন কথাও আপনাকে তিনি বলেননি?
না।
চাকর কে আপনাকে ডাকতে গিয়েছিল?
কৈরালাপ্রসাদ।
আচ্ছা এবারে আপনি যেতে পারেন মিঃ বোস। তবে একটা অনুরোধ, আমাকে না জিজ্ঞাসা করে কিন্তু আপনি এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবেন না।
বেশ।
সমীর বোস অতঃপর ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
কিরীটী এবারে দালাল সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললে, মৃতদেহটা তাহলে ময়না তদন্তের জন্য সিভিল সার্জেনের কাছে পাঠাবার ব্যবস্থা করুন।
হ্যাঁ, সেটা করতে হবে বৈকি। দালাল সাহেব বলেন, নীচে গাড়িতে আমার এ.এস.আই আছে মিঃ মিত্র, তাকেই ইনস্ট্রাকশনটা দিয়ে আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।
দালাল সাহেব ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
০৬. আরও প্রায় আধ ঘণ্টা পরে
আরও প্রায় আধ ঘণ্টা পরে। ঘরের বন্ধ জানালাগুলো খুলে দিতেই প্রথম ভোরের স্নিগ্ধ আলো ঘরের মধ্যে এসে অবারিত প্রসন্নতায় যেন চারিদিক ভরিয়ে দেয়।
পুলিসের গাড়িতে করেই ইতিমধ্যে মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়ে গিয়েছে।
দুঃশাসন চৌধুরী, দালাল সাহেব, ডাঃ সানিয়াল ও ডাঃ সমর সেন ব্যতীত সকলকেই কিরীটী বিদায় দিয়েছে।
কিরীটী তার ঘরে বসে কথা বলছিল দুঃশাসন চৌধুরীর সঙ্গে।
রুচিরা দেবীকে তাহলে আপনিই রায়বাহাদুরের মৃত্যুসংবাদটা দিয়েছিলেন, মিঃ চৌধুরী?
নিশ্চয়ই না। সত্যি, আমি এখনও ভেবে পাচ্ছি না এত বড় ডাহা মিথ্যে কথাটা মেয়েটা বলে গেল কি করে!
দালাল সাহেব হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, রুচিরা দেবীর সঙ্গে আপনাদের কোন মনোমালিন্য নেই তো দুঃশাসনবাবু?
একটা পুঁচকে ফাজিল প্রকৃতির মেয়ের সঙ্গে আমার মনোমালিন্যের কি কারণ থাকতে পারে বলুন তো দালাল সাহেব! চিরটাকাল গান্ধারী আর তার স্বামী হৃষিকেশ দাদার ঘাড়ে বসে খেয়েছে। হৃষিকেশের সঙ্গে গান্ধারীর বিয়েতে মোটেই আমার মত ছিল না। এককালে ওরা ধনী ছিল কিন্তু হৃষিকেশের সঙ্গে যখন গান্ধারীর বিয়ে হয় তখন ওদের দুবেলা ভাল করে আহার জুটত না। থাকবার মধ্যে ছিল পৈতৃক আমলের একটা নড়বড়ে পুরনো বাড়ি আর দেহে ব্যাধি-দুষ্ট রূপ–
ব্যাধি-দুষ্ট রূপ!
তাছাড়া কি! ঐ রূপই ছিল, আর সেই সঙ্গে ছিল অতীত ধনদৌলতের মিথ্যে উগ্র একটা অহঙ্কার। এবারে এসে যখন দেখলাম এখনও ওরা দাদার ঘাড়েই চেপে বসে আছে, দাদাকে বলেছিলাম ওদের একটা ব্যবস্থা করে এখান থেকে অন্যত্র সরিয়ে দিতে। তা দাদা কি আমার কথা শুনলেন!
আচ্ছা এবারে আপনি তাহলে যেতে পারেন দুঃশাসনবাবু।
দুঃশাসন চৌধুরী ঘর থেকে চলে গেলেন কিরীটীর অনুমতি পেয়ে।
.
একটু চা পেলে মন্দ হত না—কিরীটী বলে ঐ সময়।
ডাঃ সানিয়াল বললেন, চলুন না আমার ঘরে।
তাই চলুন।
কিরীটী, দালাল সাহেব, ডাঃ সানিয়াল ও ডাঃ সেন অতঃপর সকলে ডাঃ সানিয়ালের ঘরে এসে প্রবেশ করে।
ডাঃ সানিয়াল ইলেকট্রিক স্টোভে কেতলীতে জল চাপিয়ে দিলেন।
হঠাৎ কিরীটী বলে, আপনারা বসুন, আমি দুমিনিটের মধ্যে আসছি। চা হতে হতেই আমি এসে পড়ব।
কিরীটী কথাটা বলে ডাঃ সানিয়ালের ঘর থেকে বের হয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে কি ভেবে যেন ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিল।
শকুনি ঘোষ!
একবার শকুনির খোঁজটা নেওয়া দরকার। শকুনির ঘরটা কিরীটীর চেনা।
দোতলারই শেষ প্রান্তের ঘরটায় শকুনি থাকে।
কিরীটী বারান্দা অতিক্রম করে শকুনির ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়।
ঘরের দরজা বন্ধ। কি ভেবে হাত দিয়ে ঈষৎ ধাক্কা দিতেই দুয়ার খুলে গেল—দরজা ভেজানো ছিল।
মাঝারি আকারের ঘরটি। খোলা জানালাপথে ভোরের পর্যাপ্ত আলো ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করেছে।
সেই আলোয় কিরীটী দেখল, অদূরে শয্যার ওপরে শকুনি অকাতরে তখনও ঘুমোচ্ছ।
সত্যিই শকুনি ঘুমোচ্ছিল। সমস্ত ঘরের মধ্যে একটা এলোমেলো বিশৃঙ্খলা। একটা ছন্নছাড়া শ্রীহীন বিপর্যয়ের মধ্যে যেন পরম নির্বিকার ভাবেই একান্ত নিশ্চিন্তে অঘোরে নিদ্রাভিভূত শকুনি ঘোষ। বাড়ির মধ্যে যে কিছুক্ষণ মাত্র পূর্বে একটা নৃশংস হত্যাকান্ড ঘটে গিয়েছে—ওর নিদ্রায় তাতে কোন ব্যাঘাত ঘটেনি।
পরম নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে শকুনি ঘোষ। গায়ের ওপরে একটা কম্বল চাপানো।
ঘরের একধারে একটা চেস্ট-ড্রয়ার, কপাট দুটো তার খোলা।
একরাশ জামাকাপড় এলোমেলো ভাবে সেই চেস্ট-ড্রয়ারটার মধ্যে স্তুপীকৃত করা আছে।
একটা বেহালা দেওয়ালের গায়ে পেরেকের সঙ্গে ঝুলছে।
ঘরের এক কোণে একটা জলের কুঁজো এবং তার আশপাশের মেঝে জলে যেন থৈ থৈ করছে।
কিরীটী তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে চারিদিকে চেয়ে চেয়ে দেখে।
হঠাৎ নজরে পড়ে, একটা ব্যবহৃত ধুতি ও একটা মলিন তোয়ালে ঘরের কোণে পড়ে আছে।
কিরীটী নিঃশব্দ পদসঞ্চারে নিদ্রিত শকুনির শয্যার একেবারে সামনেটিতে এসে দাঁড়ায়।
আবার কি ভেবে সেখান থেকে এগিয়ে গেল—যেখানে ক্ষণপূর্বে তার নজরে পড়েছিল একটা ব্যবহৃত ধুতি ও মলিন একখানা তোয়ালে।
ঈষৎ নিচু হয়ে কিরীটী মেঝে হতে প্রথমে তোয়ালেটা তুলে নিল হাতে।
স্থানে স্থানে তোয়ালেটা তখনও ভিজে বলে মনে হয় কিরীটীর। বুঝতে কষ্ট হয় না তার, রাতেই কোন একসময় ঐ তোয়ালেটা নিশ্চয়ই ব্যবহার করা হয়েছে। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিঃশব্দে তোয়ালেটা কিরীটী চোখের সামনে মেলে ধরে পরীক্ষা করতে থাকে।
সহসা কিরীটীর দুচোখের দৃষ্টিতে যেন একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল চকিতে। তোয়লের সিক্ত অংশগুলিতে একটা মৃদু লালচে আভা যেন।
সিক্ত অংশের ঈষৎ লালচে আভা যেন কিসের এক ইঙ্গিত দেয়।
বেশ কিছুক্ষণ ধরে সেই সিক্ত অংশগুলি পরীক্ষা করে একসময় আবার কিরীটী তোয়ালেটা ফেলে ধুতিটা হাতে তুলে নিল।
তোয়ালেটার মত অতঃপর ধুতিটাও ভাল করে পরীক্ষা করে দেখল।
ধুতিরও কোন কোন অংশ তখনও ঈষৎ সিক্ত বলেই মনে হয় এবং সেই সিক্ত অংশগুলিতে অস্পষ্ট একটা রক্তিমাভা যেন পরিষ্কার চোখের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে।
কিরীটী অতঃপর একটা দুঃসাহসিক কাজ করে, ধুতির ঈষৎ লালিমাযুক্ত ভিজে অংশ হতে একটা টুকরো ছিঁড়ে নিজের পকেটে রেখে দিল।
আর ঠিক ঐ সময় মৃদু একটা শব্দ ওর কানে প্রবেশ করতেই মুহূর্তে ও ফিরে তাকাল।
শকুনির ঘুম ভেঙেছে।
এবং নিদ্রাভঙ্গে শকুনি ইতিমধ্যে কখন যেন শয্যার ওপরে উঠে বসেছে।
এবং কেমন যেন বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে আছে শকুনি।
প্রথমটায় কিরীটীও যে একটু বিব্রত হয়ে পড়েনি তা নয়, কিন্তু অসাধারণ প্রত্যুৎপন্নমতিত্বই তাকে যেন উপস্থিত পরিস্থিতিতে সজাগ ও সক্রিয় করে দেয়।
মৃদু হেসে যেন কিছুই হয়নি এইরকম একটা ভাব দেখিয়ে কিরীটী শয্যার ওপরে সদ্য নিদ্রাভঙ্গে উপবিষ্ট শকুনির দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল, ঘুম ভাঙল মিঃ ঘোষ?
শকুনি মৃদু কণ্ঠে জবাব দেয়, হ্যাঁ। আপনি?
আপনার খোঁজেই এসেছিলাম আপনার ঘরে। দেখলাম আপনি ঘুমোচ্ছেন তাই—
আমার খোঁজে এসেছিলেন? কেন?
কয়েকটা কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করবার ছিল।
কথা? কি কথা?
গতকাল রাত্রে রায়বাহাদুরের ঘর থেকে হঠাৎ যে আপনি কোথায় উধাও হয়ে গেলেন আপনার আর দেখাই পেলাম না!
হ্যাঁ। বড্ড ঘুম পাচ্ছিল তাই ঘরে এসে শুয়ে পড়েছিলাম।
কখন শুতে এসেছিলেন? কিরীটী দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করে।
তা রাত তখন গোটাতিনেক হবে বোধ করি। আগের রাত্রে মামার ঘরে জেগেছিলাম। মামার খবর কিছু জানেন–কেমন আছেন তিনি?
কিরীটী শকুনির প্রশ্নে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল শকুনির মুখের দিকে।
শকুনির মুখ একান্ত, নির্বিকার। দুচোখের দৃষ্টি একান্ত সহজ ও সরল।
কোন পাপ দুরভিসন্ধি বা দুস্কৃতির চিহ্নমাত্রও যেন তার চোখ-মুখের মধ্যে কোথাও নেই।
সহজ সরল নিস্পাপ দৃষ্টি।
মামার সেই দুঃস্বপ্নটা নিশ্চয়ই এখন আর অবশিষ্ট নেই—শকুনি বলে।
দুঃস্বপ্ন?
হ্যাঁ। শকুনি মৃদু হেসে বলে, তাঁর সেই দুঃস্বপ্নের কথা আপনি তো জানেন। কাল রাত্রে ঠিক চারটের সময় নাকি তিনি নিহত হবেন, তাঁর সেই ফোরকাস্ট—ভবিষ্যদ্বাণী নিজের মৃত্যু সম্পর্কে! আজ কয়েকদিন ধরে কি যে তাঁর মাথার মধ্যে চেপে বসেছিল আর সেজন্য কিই না এ কদিন ধরে তিনি করেছেন। এমন কি আপনাকে পর্যন্ত তিনি তাঁর পরিকল্পিত হত্যা-রহস্যের মীমাংসা করবার জন্য ডেকে এনেছেন। তা এখন তাঁর সে ভয় কেটেছে তো?
মৃদু কণ্ঠে কিরীটী জবাব দিল, হ্যাঁ।
ভেবে দেখুন একবার ব্যাপারটা মিঃ রায়, মামার মত একজন বুদ্ধিমান বিচক্ষণ ব্যক্তি, তাঁর মাথার মধ্যেও কি সব উদ্ভট কল্পনা!
উদ্ভট কল্পনা? কিরীটী শকুনির মুখের দিকে তাকায়।
তাছাড়া আর কি বলি বলুন! কোন সেই ম্যানের পক্ষে এটা চিন্তা করাও তো যায় না। এমন কথা কস্মিনকালেও শুনেছেন কখনও যে মানুষ তার হত্যার কথা পূর্বাহ্নেই জানতে পেরেছে!
হঠাৎ যেন কিরীটীর কণ্ঠস্বরে প্রত্যুত্তরটা বজ্রের মতই ঘোষিত হল, গম্ভীর কণ্ঠে কিরীটী বলে, শকুনিবাবু, দুঃস্বপ্নই হোক বা অন্য কিছুই হোক, নিষ্ঠুর নির্মম সত্য হয়েই ব্যাপারটা গতকাল রাত্রে কিন্তু প্রমাণিত হয়ে গিয়েছে।
অ্যাঁ! কি বলছেন আপনি? কতকটা যেন একটা চাপা আর্ত কণ্ঠেই শকুনি ঘোষ কথা উচ্চারণ করে বিস্ময়-বিস্ফারিত দৃষ্টিতে সম্মুখে দণ্ডায়মান কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়।
হ্যাঁ, সত্যিসত্যিই গতকাল ঠিক রাত্রি চারটের সময়েই আপনার মামা রায়বাহাদুর নিহত হয়েছেন।
বলেন কি মিঃ রায়! সত্যি?
হ্যাঁ, সত্যি। তিনি নিহত হয়েছেন।
আমি—আমি যে কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না মিঃ রায়। মামা নিহত হয়েছেন? কে-কে তাঁকে হত্যা করল?
নিহত যখন হয়েছেন নিশ্চয়ই তখন কেউ না কেউ তাঁকে হত্যা করেছে এ অবধারিত।
মামা নেই! সহসা শকুনি ঘোষের দুটি চোখ অশ্রুতে টলমল করে এবং কং ষরটা যেন বুজে আসে।
কিরীটী নির্নিমেষ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে শকুনি ঘোষের মুখের দিকে, অশ্রুপ্লাবিত তার দুটি চোখের দিকে।
বেদনাক্লিষ্ট অশ্রুসিক্ত দুটি চোখের দৃষ্টি ও সমগ্র মুখখানি যেন সত্যিই বিষণ্ণ-কাতর একটি অনির্বচনীয় ভাবাবেগে নিবিড় হয়ে উঠেছে।
রায়বাহাদুরের হত্যাসংবাদটা যে একান্ত মর্মান্তিক ভাবেই শকুনি ঘোষকে একটা আঘাত দিয়েছে সে বিষয়ে যেন কোন সন্দেহ তার আর থাকে না।
সহসা শকুনি ঘোষ দুহাতে মুখটা ঢেকে বোধ হয় অদম্য ক্রন্দনের বেগকে বোধ করবার প্রয়াসে সচেষ্ট হয়ে ওঠে।
কিরীটী চেয়ে থাকে কেবল শকুনি ঘোষের মুখের দিকে।
অনেক প্রশ্নই তার মনের মধ্যে ঐ মুহূর্তে আনাগোনা করছিল।
কিন্তু সে নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে থাকে যেন।
কারণ কিরীটীর ইচ্ছে কিছু প্রশ্ন তার দিক থেকে উচ্চারিত না হয়ে শকুনির দিক থেকেই প্রথমে আসুক।
যা বলবার শকুনিই স্ব-ইচ্ছায় প্রথমে বলুক, তারপর যা বলবার সে বলবে।
ধীরে ধীরে শকুনি নিজেকে যেন কিছুটা সামলে নেয় এক সময়।
তারপর ধীরে ধীরে মুখ থেকে হাত সরিয়ে যখন কিরীটীর মুখের দিকে তাকায় তখনও তার অশ্রুসিক্ত চোখের দৃষ্টিতে যেন একটা মর্মঘাতী বেদনাই প্রকাশ পাচ্ছিল।
সত্যি মিঃ রায়, এখনও যেন আমি ভাবতেই পারছি না এত বড় একটা দুর্ঘটনা সত্যিসত্যিই ঘটে গেছে। উঃ, কি ভয়ানক! মামা নেই? মামাকে হত্যা করা হয়েছে, এ যেন এখনও। আমার কল্পনাতেও আসছে না।
কিন্তু যা হবার, যতই মর্মান্তিক বা দুঃখের হোক ঘটে গিয়েছে মিঃ ঘোষ। এখন যদি আমরা সেই হত্যাকারীকে ধরে আইনের হাতে তুলে দিতে পারি, তবেই না আমাদের দুঃখের কিছুটা সান্ত্বনা মিলবে!
হত্যাকারীকে?
হ্যাঁ। হত্যাকারীকে যেমন করে হোক আমাদের ধরতেই হবে।
কিন্তু–
এর মধ্যে কোন কিন্তু নেই মিঃ ঘোষ। হত্যাকারীকে আমরা ধরবই, তবে তাকে ধরতে হলে সর্বাগ্রে আমাদের যে বস্তুটির প্রয়োজন সেটা হচ্ছে আমাদের পরস্পরকে পরস্পরের সহযোগিতা করা। এক্ষেত্রে পরস্পর আমরা পরস্পরের সহযোগী না হলে আপনার মামা রায়বাহাদুরের নিষ্ঠুর মৃত্যুরহস্যের কোন কিনারাই করতে পারব না জানবেন।
কিরীটীর কথার শকুনি কোন জবাবই দেয় না, নিঃশব্দে বসে থাকে সামনের দিকে শূন্য
দৃষ্টিতে তাকিয়ে।
আবার একসময় কিরীটীই কথা বলে, মিঃ ঘোষ?
অ্যাঁ! শকুনি যেন চমকে কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়।
এ বাড়ির মৃত রায়বাহাদুরের সমস্ত আত্মীয়-পরিজন আপনাদের সকলের সাহায্যই আমি চাই শকুনিবাবু।
সাহায্য!
হ্যাঁ, সাহায্য। এ হত্যারহস্যের মীমাংসার ব্যাপারে আপনারা সকলেই যে যতটুকু জানেন সমস্ত কথা অকপটে বলে আমাকে যদি না সাহায্য করেন, বুঝতেই পারছেন আমার পক্ষে এ রহস্যের কিনারা করা কতখানি কষ্টকর হবে।
কিন্তু কি ভাবে আপনাকে আমি সাহায্য করতে পারি মিঃ রায়? আমি তো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না?
একটা কথা আপনার জানা দরকার শকুনিবাবু, আপনার মামা রায়বাহাদুরকে বাইরে থেকে কেউ এসে হত্যা করেনি বলেই আমার ধারণা।
কিরীটীর কথায় শকুনি ঘোষ যেন দ্বিতীয়বার চমকে ওঠে।
এবং বিস্ফারিত দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, কি বলছেন আপনি মিঃ রায়!
ঠিকই বলছি। বাইরে থেকে কেউ এসে তাঁকে হত্যা করেনি।
তার মানে আপনি বলতে চান—
তাই বলতে চাই শকুনিবাবু, এ বাড়ির মধ্যেই কেউ-না-কেউ তাঁকে হত্যা করেছে।
সত্যিই আপনি একথা বিশ্বাস করেন মিঃ রায়?
করি। এবং আমার বিশ্বাস যে মিথ্যা নয় শীঘ্রই তা প্রমাণিতও হবে।
কেউ এ বাড়িরই বলতে ঠিক আপনি কাকে মীন করছেন মিঃ রায়, মানে কে ঐ নিষ্ঠুর হত্যার জন্য দায়ী?
বলতে দুঃখ ও লজ্জাই হচ্ছে আমার মিঃ ঘোষ। এই বাড়ির মধ্যে যাঁরা রায়বাহাদুরের আত্মীয় বলে পরিচিত তাঁদের মধ্যেই কেউ-না-কেউ সুনিশ্চিতভাবে এ কাজ করেছেন।
আমি! কথাটা যেন কতকটা অজ্ঞাতেই নিজের কণ্ঠ হতে শকুনির বের হয়ে আসে।
হ্যাঁ, আপনিও করতে পারেন বৈকি।
কি বলছেন আপনি মিঃ রায়! শকুনি যেন আর্তকণ্ঠে একটা চিৎকার করে ওঠে।
কিছুই অসম্ভব বলছি না মিঃ ঘোষ। আপনার পক্ষেও রায়বাহাদুরকে হত্যা করা এতটুকুও অসম্ভব বলে আমি মনে করি না। অত্যন্ত স্বাভাবিক।
এরপর শকুনি ঘোষ কিছুক্ষণ যেন ফ্যালফ্যাল করে একান্ত বোকার মতই কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
একটি কথাও যেন উচ্চারণ করতে পারে না।
একটি শব্দও কিছুক্ষণ যেন তার কণ্ঠ হতে বের হয় না।
কিরীটী বলে, মানুষ স্বার্থের খাতিরে কখন যে কি করতে পারে আর না পারে, সে মানুষও নিজে অনেক সময় বোধ হয় চিন্তাও করতে পারে না, স্বপ্নেও ভাবতে পারে না মিঃ ঘোষ। জানেন না তো আপনি, এ পৃথিবীটাই একটা বিচিত্র জায়গা! সময় সময় তুচ্ছ—অতি তুচ্ছ প্রয়োজনের তাগিদে আজও সভ্যজগতের মানুষ যে কি ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতারই পরিচয় দিতে পারে আমি বহুবার স্বচক্ষে দেখেছি। যাক সে কথা। এখন আপনি যদি আমার কয়েকটি প্রশ্নের জবাব দেন তবে সুখী হব। ডাঃ সানিয়ালের ঘরে আমাকে এখুনি আবার যেতে হবে। তাঁরা আমার জন্য অপেক্ষা করছেন।
বলুন কি জানতে চান? নিস্তেজ নিম্নকণ্ঠে শকুনি ঘোষ প্রত্যুত্তর দিল।
০৭. ব্যস্ত হবেন না মিঃ ঘোঘ
ব্যস্ত হবেন না মিঃ ঘোঘ, আপনি বসুন ঐ খাটে।
শকুনি ধীরে ধীরে তার খাটের ওপর বসে। কিরীটী তখন প্রশ্ন শুরু করে।
এবারে বলুন, কাল রাত্রে ঠিক কটার সময় আপনি শুতে আসেন?
রাত তখন গোটাতিনেক হবে সে কথা তো একটু আগেই আপনাকে বললাম।
আপনি আমার মুখ থেকে আপনার মামার হত্যার সংবাদ শোনবার পূর্ব পর্যন্ত তাহলে সত্যিই। কিছুই শোনেননি বা জানতে পারেননি ঐ সম্পর্কে, এই কি সত্যি?
হ্যাঁ।
আচ্ছা আপনি বিছানায় শোয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন কাল রাত্রে?
কিরীটীর প্রশ্নে শকুনি ঘোষ প্রথমটায় কেমন যেন একটু ইতস্তত করে, তারপর মৃদুকণ্ঠে বলে, ঠিক সঙ্গে সঙ্গেই ঘুম আসেনি। তবে বেশীক্ষণ জেগে যে ছিলাম না এও ঠিক।
হুঁ। সেই সময় কেউ আপনার ঘরে আসেনি?
শকুনি আবার কিছুক্ষণ যেন চুপ করে থাকে, একটু বিব্রত ও চিন্তিত সে। কিরীটী চেয়ে আছে শকুনির মুখের দিকে।
এবং তারপর যেন কতকটা দ্বিধাগ্রস্ত ভাবেই শকুনি বলে, না।
আবার কিরীটী কথাটার যেন পুনরুক্তি করে, কেউ আসেনি ঠিক বলছেন?
তাই।
ঠিক আপনার মনে আছে?
হ্যাঁ।
বাইরে ঠিক ঐ সময় যেন একটা দ্রুত পদশব্দ শোনা গেল। কে যেন এই ঘরের দিকেই আসছে মনে হল।
কিরীটী ঘরে ঢুকেই ভেতর থেকে ঘরের কপাট দুটো ভেজিয়ে প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিল, সেই প্রায়-বন্ধ কপাটের দিকে চোখ তুলে তাকাল কিরীটী।
সহসা প্রায়-বন্ধ কপাট দুটি খুলে গেল এবং পরক্ষণেই উন্মুক্ত দ্বারপথে যে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল তার দিকে তাকিয়ে কিরীটী যেন বেশ একটু বিস্মিতই হয়।
কেবল আগন্তুককে দেখেই কিরীটী ততটা বিস্মিত হয়নি, যতটা হয়েছিল আগন্তুকের সমগ্র চোখেমুখে একটা ভীতি ও উৎকণ্ঠা মিশ্রিত চাঞ্চল্য দেখে।
আগন্তুক বোধ হয় কক্ষে প্রবেশ করেই কিরীটীকে দেখতে পায়নি, কারণ কিরীটী ঘরের একপাশে দাঁড়িয়েছিল সেই সময়।
শেকো, শুনেছিস কি সর্বনাশ হয়ে গেছে!
একরাশ উৎকণ্ঠা আগন্তুকের কণ্ঠস্বরে যেন ঝরে পড়ে।
কিরীটী নিঃশব্দ পদসঞ্চারে আরও একটু পিছিয়ে গেল।
আগন্তুক কিরীটীকে তখনও দেখতে পায়নি। বলে, তোরা কেউ বিশ্বাস করিসনি বটে তবে এ যে হবে তা কিন্তু আমি প্রথম থেকে দাদার কথা শুনেই বুঝতে পেরেছিলাম। আর এও তো জানা কথা এ কার কাজ–
আগন্তুকের বাকি কথাগুলো শেষ হল না, উপবিষ্ট নির্বাক স্থিরদৃষ্টি শকুনির দিকে চেয়ে এতক্ষণে বোধ হয় কেমন একটু মনে মনে সন্দিগ্ধ হয়ে পাশের দিকে তাকাতেই অদূরে দণ্ডায়মান নির্বাক কিরীটীর স্থির দুটি জিজ্ঞাসু দৃষ্টির সঙ্গে নিজের চোখের দৃষ্টি মিলিত হয়ে গেল।
মুহূর্তে বক্তার সমগ্র শরীরের স্নায়ু ও উপস্নায়ু দিয়ে একটা তীব্র বিদ্যুৎ-তরঙ্গ বুঝি খেলে গেল।
কথাটা যা বলছিলেন গান্ধারী দেবী, হঠাৎ বলতে বলতে থেমে গেলেন কেন? কিরীটী প্রশ্ন করে।
মৃত রায়বাহাদুরের অপরূপ সুন্দরী বিধবা ভগিনী গান্ধারী দেবীই আগন্তুক।
মুহূর্তে যেন একটা বিপর্যয় ঘটে গিয়েছে, প্রচন্ড একটা বৈদ্যুতিক শক্তি নিমেষে সমগ্র স্নায়ুতে আঘাত দিয়ে গান্ধারী দেবীর সমস্ত বাক্ ও বোধশক্তিকে যেন মুহূর্তে হরণ করেছে।
গান্ধারী দেবী যেন প্রাণহীন একটা পাথরে পরিণত হয়েছেন অকস্মাৎ।
মূক অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন গান্ধারী দেবী কিরীটীর মুখের দিকে।
বসুন গান্ধারী দেবী। আপনার যা বলবার বা শকুনিবাবুকে যা বলতে এসেছিলেন নির্ভয়ে বলুন। কোন ভয় নেই আপনার, আমি কথা দিচ্ছি আপনাকে বিশ্বাস করুন, তৃতীয় কোন ব্যক্তিই এসব কথা জানতে পারবে না।
গান্ধারী দেবী তথাপিও কিন্তু নিরুত্তর।
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকেন গান্ধারী দেবী কিরীটীর মুখের দিকে।
বসুন গান্ধারী দেবী। ঐ চেয়ারটায় বসুন। কিরীটী পুনরায় আহ্বান জানায় গান্ধারী দেবীকে।
অত্যন্ত সহজ ভাবে কিরীটী কথাগুলো উচ্চারণ করলেও কণ্ঠস্বরে একটা সুস্পষ্ট নির্দেশের সুর যেন প্রকাশ পায়।
এ শুধুমাত্র অনুরোধই নয়, আদেশও।
এবং সে আদেশকে লঙঘন করা অনেকের পক্ষেই দুঃসাধ্য।
তথাপি কিন্তু গান্ধারী দেবী নিশ্চপ, পাষাণ-প্রতিমার মতই যেমন দাঁড়িয়ে ছিলেন তেমনি দাঁড়িয়ে রইলেন।
কিরীটী আবার বলে স্থির অপলক দৃষ্টিতে গান্ধারী দেবীর চোখের দিকে চেয়ে, বসুন গান্ধারী দেবী!
এবারে সত্যিসত্যিই গান্ধারী দেবী কতকটা মন্ত্রমুগ্ধের মতই যেন সামনের চেয়ারটার ওপর গিয়ে বসলেন
হ্যাঁ বলুন এবারে—একটু আগে যা বলতে বলতে থেমে গিয়েছিলেন!
কি বলব? ক্ষীণ কণ্ঠে এতক্ষণে গান্ধারী দেবী কথা কটি বলেন।
রায়বাহাদুরের হত্যাকারী সম্পর্কে নিশ্চয়ই আপনার মনে কোন সুস্পষ্ট ধারণা হয়েছে—আরও সোজা করে বলতে গেলে বলা যায়, নিশ্চয়ই আপনি কাউকে এ ব্যাপারে সন্দেহ করেছেন, তাই নয় কি?
সন্দেহ করেছি!
হ্যাঁ। একটু আগে তো সেই কথাই শকুনিবাবুর কাছে আপনি বলতে বলতে থেমে গেলেন।
আমি–
শুনুন গান্ধারী দেবী, আপনি নিজেই আপনার কথার ফাঁদে আটকে পড়েছেন। এখন আর উপায় নেই। কিন্তু তারও আগে একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করতে চাই।
কি?
আপনি নিশ্চয়ই চান যে রায়বাহাদুর—আপনার ভাইকে যে অমন নিষ্ঠুরভাবে গতকাল হত্যা করেছে, সেই নৃশংস শয়তান হত্যাকারী ধরা পড়ুক এবং তার সমুচিত শাস্তিবিধান হোক।
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই চাই।
এবং এও আপনারা সকলেই জানেন সেই নিষ্ঠুর ব্যাপারের মীমাংসাই আমি করতে চাই।
হ্যাঁ।
এও নিশ্চয়ই তাহলে স্বীকার করবেন যে, নিষ্ঠুর ঐ হত্যারহস্যের মীমাংসা করতে হলে আমাকে আপনাদের—এ বাড়ির সকলেরই সাহায্যের প্রয়োজন অল্প-বিস্তর? অন্যথায় ব্যাপারটা একটু জটিলই হবে?
কিন্তু–
তাহলে বলুন আপনি যা জানেন। অকপটে সব আমার কাছে খুলে বলুন কিছু গোপন করবেন না!
কি বলব?
কাকে আপনি এ ব্যাপারে সন্দেহ করছেন খুলে বলুন?
আবার গান্ধারী দেবী নিরুত্তর, চোখেমুখে তাঁর যেন সুস্পষ্ট একটা চিন্তা ও উদ্বেগের ছায়া ঘনিয়ে ওঠে।
বলুন—চুপ করে থাকবেন না!
ক্ষমা করবেন কিরীটীবাবু, আমি–মানে আপনি আমার কথা ঠিক বুঝতে পারেননি। শকুনিকে আমি ঠিক তা বলতে চাইছিলাম না—
বিচিত্র একটা হাসি যেন কিরীটীর ওষ্ঠপ্রান্তে মুহূর্তে জেগে উঠেই মিলিয়ে গেল। এবং কৌতুকে চোখের তারা দুটি ঝকঝক করতে লাগল।
গান্ধারী দেবী, আমি কিরীটী রায়। আমার সত্যিকারের পরিচয়টা হয়ত আপনার জানা নেই, নচেৎ বুঝতে পারতেন মানুষের মনের গোপন কথাকে টেনে বের করবার একটা শক্তি ঈশ্বর আমায় দিয়েছেন। আপনার গলার স্বরকে আপনি মূক করে রাখলেও আপনার দুটি চক্ষু, স্থিরনিবদ্ধ দুটি ওষ্ঠ অনেক কিছুই এই মুহূর্তে আমার কাছে সুস্পষ্টভাবেই ব্যক্ত করছে। আপনি আপনার গত রাত্রের জবানবন্দিতে যে বলেছিলেন—আপনি ঘুমিয়ে ছিলেন এমন সময় আপনার মেয়ে রুচিরা দেবী এসে আপনার ঘুম ভাঙিয়ে আপনাকে রায়বাহাদুরের মৃত্যুসংবাদটা দেন, কথাটা যে সম্পূর্ণ মিথ্যে তা আর কেউ না জানলেও আমি কিন্তু ঠিকই ধরেছিলাম গতকালই।
মিথ্যে! কথাটা উচ্চারণ করে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে গান্ধারী দেবী কিরীটীর চোখের দৃষ্টির সঙ্গে নিজের দৃষ্টি মেলান।
হ্যাঁ, সম্পূর্ণ মিথ্যে। কিরীটীর দুচোখের দৃষ্টিতে আবার সেই শানিত ছুরির ফলার মতই তীক্ষ্ণতা ঘনিয়ে ওঠে।
এ আপনি কি বলছেন মিঃ রায়! পুনরায় প্রশ্ন করেন গান্ধারী দেবী।
হ্যাঁ, মিথ্যে। কারণ আমি জানি সে-সময় আপনি জেগেই ছিলেন এবং শুধু তাই নয়, পাশের ঘরে—মানে আপনার মেয়ের ঘরে কিছুক্ষণ পূর্বে যে সব কথাবার্তা হয়েছিল তার প্রত্যেকটি কথাই আপনার কানে গিয়েছিল।
এসব কি বলছেন আপনি মিঃ রায়!
মিথ্যে বা কল্পিত কিছুই বলছি না নিশ্চয়ই। সেটা অবশ্যই আমার চাইতেও আপনি ভালই বুঝতে পারছেন গান্ধারী দেবী।
কিন্তু আমার মেয়ে রুচিরাও কি আপনাকে বলেনি যে সে এসে আমাকে ঘুম হতে উঠিয়ে
হ্যাঁ বলেছিলেন, তবে ঘুম তো নয় সেটা আপনার গান্ধারী দেবীবলতে পারেন ঘুমের ভান মাত্র।
চকিতে শকুনি ঘোষ একবার গান্ধারী দেবী ও একবার কিরীটীর মুখের দিকে তাকায় ঐ সময়।
কিরীটীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিকে কিন্তু সেটুকুও ফাঁকি দিতে পারে না।
কিন্তু কিরীটীর চোখে মুখে তার কোন লক্ষণই প্রকাশ পায় না।
ঘুমের ভান! আমি ঘুমোইনি—ঘুমের ভান করে ছিলাম?
ঠিক তাই। কারণ ঐভাবে জেগে ঘুমোনোর হয়ত আপনার বহু সময়েই প্রয়োজন হয়, অবশ্য আপনার মেয়ে রুচিরা দেবীর পক্ষে সেটা না জানাই সম্ভব।
না জানাই সম্ভব!
হ্যাঁ। অন্যথায় নিশ্চয়ই রুচিরা দেবী আপনার সম্পর্কে সজাগ হয়ে থাকতেন এবং যথাবিহিত সতর্কতাও হয়ত অবলম্বন করতেন।
কিরীটীবাবু!
একটা রুক্ষ তীক্ষ্ণতা যেন গান্ধারী দেবীর কণ্ঠস্বরে ঐ মুহূর্তে প্রকাশ পায়।
গান্ধারী দেবী, কিরীটী রায়ের এই দুজোড়া চোখ ছাড়াও আর এক জোড়া চোখ—অদৃশ্যও বলতে পারেন, সদা এমন সতর্ক থাকে যে তার দৃষ্টিকে এড়িয়ে যাওয়া অনেকের পক্ষেই খুব সহজসাধ্য নয়। শুনুন তবে, গতরাত্রে আপনি যখন রায়বাহাদুরের ঘরে উঠে এসেছিলেন সে সময় আপনার চোখের পাতায় কোথাও আপনার ক্ষণপূর্বে কথিত নিদ্রার বিন্দুমাত্রও আমি দেখতে পাইনি। শুধু তাই নয়, আপনার মাথার চুল ও বেশভূষায় এমন একটা নিখুঁত পারিপাট্য ছিল যা অন্ততঃ কোন সদ্য-নিদ্রোথিত ব্যক্তির মধ্যে পাওয়া যেতে পারে না। বিশেষ করে যাঁকে একটু আগে ঘুম থেকে ডেকে তুলে একটা দুঃসংবাদ দেওয়া হয়েছে এবং যার জন্য অন্ততঃ তিনি পূবাহ্নে আদপেই প্রস্তুত ছিলেন না। আরও একটা ব্যাপার যেটা হয়ত আপনার ভাববারও প্রয়োজন হয়নি এবং আপনার নজর দেওয়ারও অবকাশ হয়নি, আপনি কাল যখন রায়বাহাদুরের ঘরে এসে প্রবেশ করেছিলেন, আপনার গায়ে একটা ফুলহাতা গরম-জামা ছিল। নিশ্চয়ই গরম-জামা গায়ে দিয়েও যেমন আপনি নিদ্রা যান না তেমনি ও ঘরে আসবার পূর্বেও অত বড় একটা দুঃসংবাদ শোনবার পর গরম-জামাটা গায়ে দিয়ে আসবার কথাটাও আপনার মনে আসবার কথা নয় এবং স্বাভাবিকও নয়।
গান্ধারী দেবী কিরীটীর কথায় যেন সত্যিই একেবারে বোবা হয়ে যান।
তাহলেই এখন বুঝতে পারছেন তো কেন আমি আপনার নিদ্রা সম্পর্কে সন্দিহান?
এবারেও গান্ধারী দেবী কিরীটীর কথার কোন প্রত্যুত্তর দিলেন না।
গান্ধারী দেবী, মিথ্যে আপনি সব কথা আমার কাছে গোপন করবার চেষ্টা করছেন এখনও!
সহসা এবারে গান্ধারী দেবী একটু যেন রূঢ় কণ্ঠেই জবাব দিলেন, আমি কিছুই জানি না কিরীটীবাবু। কেবল এইটুকু বলতে পারি, সম্পূর্ণ একটা ভুল ধারণার বশবর্তী হয়েই মিথ্যে আপনি আমাকে জেরা করছেন।
যদি তাই হয়, তবে একটু আগে এই ঘরে ঢোকবার মুহূর্তে শকুনিবাবুকে যে কথাটা বলতে গিয়ে তৃতীয় ব্যক্তি আমাকে এখানে দেখেই হঠাৎ চুপ করে গেলেন—সে কথাটা কি? কি কথা ওঁকে বলতে যাচ্ছিলেন—সেটা অন্ততঃ জানতে পারি কি?
না।
যেন একটা রূঢ় কঠিন আঘাতের মতই না শব্দটি কিরীটীর মুখের ওপর এসে পড়ে তাকেও নিশ্চুপ করে দিল।
ক্ষণকাল গভীর অনুসন্ধানী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিরীটী গান্ধারী দেবীর মুখের দিকে চেয়ে থেকে হঠাৎ বলে ওঠে, গান্ধারী দেবী, একটা কথা—সমীরবাবুর সঙ্গে সত্যিসত্যিই কি আপনার মেয়ে রুচিরা দেবীর বিবাহ-ব্যাপারটা স্থির হয়ে গিয়েছে?
হ্যাঁ। ধীর কণ্ঠে গান্ধারী দেবী এবারে জবাব দিলেন।
আপনার নিশ্চয়ই এ বিবাহে খুব মত আছে?
আছে।
আপনার মেয়ে রুচিরা দেবীর?
কিরীটীবাবু, এটা সম্পূর্ণ আমাদের পারিবারিক ও ব্যক্তিগত ব্যাপার। এর সঙ্গে দাদার মৃত্যুর কোন সংস্পর্শ আছে বলেই আমি মনে করি না। অতএব একান্তই অবান্তর নয় কি প্রশ্নটা আপনার?
ব্যক্তিগত ও পারিবারিক হলেও আমি এ প্রশ্নটার জবাব চাই গান্ধারী দেবী!
আর যদি না দিই?
তাহলে বলব মিথ্যেই আপনি সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে জেদাজেদি করছেন, কারণ আপনি ঢাকবার বা গোপন করবার চেষ্টা করলে কি হবে আমি আগেই জেরা করে রুচিরা দেবীর কাছ থেকে তাঁর কথাতেই জেনেছি।
কি–কি জেনেছেন আপনি? নিরতিশয় উৎকণ্ঠা ও ব্যাকুলতা যেন গান্ধারী দেবীর কণ্ঠস্বরে ও চোখেমুখে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
বললাম তো, যা জানবার তাই জেনেছি।
কি জেনেছেন আপনি? কি রুচিরা আপনাকে বলেছে?
মাপ করবেন গান্ধারী দেবী, সেটা আমার অনুসন্ধানের ব্যাপারে একান্ত ব্যক্তিগত ও গোপনীয় ব্যাপার।
আপনি বলতে চান রুচি আপনাকে বলেছে যে সে সমীরকে পছন্দ করে না, বিবাহ সে করবে না?
বললাম তো গান্ধারী দেবী, তিনি রুচিরা দেবী আমাকে কি বলেছেন বা না বলেছেন। বা আমি কি বলতে চাই বা না চাই সেটা প্রকাশ করতে আপনার কাছে আমি বাধ্য তো নই-ই, ইচ্ছুকও নই।
আমি বিশ্বাস করি না কিরীটীবাবু, রুচি ঐ ধরনের কোন কথা আপনাকে বলতে পারে আর যদি সে বলে থাকেও এ কথাটা যেন সে ভুলে না যায় যে, এখনও আমি তার মাথার ওপরে বেঁচে আছি। খুশিমত তাকে আমি চলতে দেব না।
হঠাৎ কিরীটী হেসে ফেলে এবং হাসতে হাসতেই বলে, গান্ধারী দেবী, এবারে আপনাদের কাছ থেকে আমি আপাততঃ বিদায় নেব। কারণ আমার কফি বোধ হয় ঠাণ্ডা-হয়ে গেল সত্যিসত্যিই এতক্ষণে। আচ্ছা আসিনমস্কার
বলতে বলতে কিরীটী দ্বিতীয় আর কোন কথা না বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
স্তম্ভিত বিস্ময়ে শকুনি ও গান্ধারী দেবী কিরীটীর গমনপথের দিকে চেয়ে রইল।
০৮. সেতারে ভৈরো আলাপ
বাঈজী সেতারে ভৈরো আলাপ করছিল ও চাপা কণ্ঠে গুনগুন সুর ভাঁজছিল।
আর অবিনাশ চৌধুরী সেই ঘরের বিস্তৃত গালিচার ওপরে একটা জাপানী ঘাসের চটি পায়ে ইতস্তত পায়চারি করছিলেন এবং নিম্নস্বরে আপন মনে আবৃত্তি করছিলেন :
নারায়ণ! নারায়ণ বল কত বাকী
আর। শত পুত্রহারা কাঁদিছে গান্ধারী,
শত পুত্রবধূ তার! রক্ত শবে পরিকীর্ণ
কুরুক্ষেত্র ভূমি! অক্ষৌহিণী নারায়ণী
সেনা হয়েছে নিঃশেষ।
মুষ্টিবদ্ধ হাত দুটি পিছনে রেখে অবিনাশ চৌধুরী পায়চারি করছিলেন।
ভোরের প্রসন্ন আলো মুক্ত বাতায়নপথে ঘরের মধ্যে বিস্তৃত রক্তবর্ণ গালিচার উপরে এসে লুটিয়ে পড়েছে।
সহসা একসময় বাঈজীর দিকে ফিরে চেয়ে অবিনাশ চৌধুরী বলেন, মুন্নাবাঈ, এখন গান থাক! আজকে তোমার বিশ্রাম— তুমি যাও।
বারেকের জন্য মাত্র অবিনাশ চৌধুরীর দিকে চেয়ে ধীরে ধীরে মুন্নাবাঈ নিঃশব্দে সেতারটা একপাশে গালিচার ওপরে নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়াল।
খেয়ালী অবিনাশ চৌধুরীর বিচিত্র মতিগতির সঙ্গে সে বিশেষ পরিচিত।
এবং নিঃশব্দেই সে তার নির্দিষ্ট ঘরে যাবার জন্য দরজার দিকে পা বাড়ায়।
পাশেরই সংলগ্ন একটি নাতিপ্ৰশস্ত ঘর মুন্নাবাঈয়ের জন্য নির্দিষ্ট।
মুন্নাবাঈ তার ঘরে এসে প্রবেশ করল।
আধুনিক রুচিসম্মত ভাবে ঘরটি তার সুসজ্জিত।
মুন্নার সমস্ত অন্তরের মধ্যেই তখনও যেন ভৈরো রাগের একটা সুর-মন্থন চলেছে।
প্রত্যুষের প্রসন্ন আলোয় সমস্ত অন্তর জুড়ে তার তখন যেন ভৈরো রাগের রঙ লেগেছে। জেগেছে সুর।
মেঝেতে বিস্তৃত পুরু গালিচার একপাশে রক্ষিত নিজের তানপুরাটা টেনে নিয়ে কোলের কাছে মেঝেতে গালিচার ওপরই বসে মুন্না বাঈজী।
তানপুরার তারে মৃদুমন্দ অঙ্গুলি চালনা করতে করতে সে গুনগুনিয়ে ওঠে–
ধন ধন সুরত কৃষ্ণ মুরারে
সুলছানা গিরিধারী
সব সুন্দর লাগে
অত পিয়ারী।
নিঃশব্দ পদসঞ্চারে কখন ইতিমধ্যে একসময় যে রুচিরা বাঈজীর ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করেছিল তা সে টেরও পায়নি।
রুচিরা এ বাড়িতে বেশী একটা থাকে না।
সে কলকাতায় কলেজে পড়ে। মধ্যে মধ্যে ছুটিছাটায় কেবল কখনও বেড়াতে আসে, আবার ছুটি ফুরোলেই কলকাতায় ফিরে যায়।
এ বাড়ি সম্পর্কে তার এই কারণেই বোধ হয় এতটুকুও কৌতূহল কোনদিন ছিল না।
এ বাড়ির আবহাওয়া হতে শুরু করে এই বাড়ির লোকগুলিও যেন কেমন তার নিকট অদ্ভুত বিচিত্র বলে মনে হয়।
কেমন যেন একটা চাপা গুমোট ভাব, একটা বিকৃত শাসনের নাগপাশ যেন এই বাড়ির প্রাণকে চেপে রেখেছে অষ্টপ্রহর।
এখানে প্রত্যেকেই প্রত্যেক হতে স্বতন্ত্র, কেউই যেন কারও আপনার নয়।
কারও সঙ্গে কারও যেন বিন্দুমাত্রও মনের যোগাযোগ নেই। কারও জন্য কারও যেন এতটুকু সমবেদনা স্নেহ বা ভালবাসা নেই।
মনে হয় কেমন প্রত্যেকেই যেন একটা কুৎসিত স্বার্থের ঘূণাবর্তের মধ্যে পাক খেয়ে খেয়ে এ বাড়ির আবহাওয়াকে বিষাক্ত ও ঘোলাটে করে রেখেছে।
কেউ কাউকে বিশ্বাস পর্যন্ত যেন করে না।
এবং যতবারই সেই কারণে রুচিরা এখানে এসেছে এবং যে কদিন থেকেছে, নিজেকে যেন এ বাড়ির সকল কিছু থেকে কতকটা ইচ্ছে করেই পৃথক করে রেখেছে, নিজের স্বাতন্ত্র নিয়ে দিনগুলো কাটিয়েছে।
আর একটা কথা। এ বাড়িতে এসে থাকাকালীন সময়ে তবুও কদাচিৎ কখনও অন্য সকলের ঘরে গেলেও এবং একটা-আধটা কথা কারও সঙ্গে বললেও, কেন যেন আজ পর্যন্ত ছুটিছাটা উপলক্ষে ইতিপূর্বে সে এ বাড়িতে যতবার এসেছে কোনবারই দাদু অবিনাশ চৌধুরীর মহলে সে প্রবেশ করেনি এবং সেই কারণেই বোধ হয় বাঈজীকে দেখেনি বা দেখতে পায়নি। অবিশ্যি বাঈজীর এ বাড়িতে এই প্রথম পদার্পণ নয়।
গতকাল প্রত্যুষে তাই সে যখন অন্দরের বাগানে বেড়াচ্ছিল, এক মুহূর্তের জন্য দূর থেকে ভ্রমণরতা বাঈজীকে দেখেই সে যেন চমকে উঠেছিল।
চমকাবার অবিশ্যি কারণও ছিল। মুখটা যেন কেমন দূর থেকেই চেনা-চেনা লেগেছিল। কোথায় কবে যেন সে এ মুখটির সঙ্গে বিশেষ ভাবেই পরিচিত ছিলও। কিন্তু ভেবে কিছুই ঠিক করতে পারছিল না।
অবশেষে আর কৌতূহলকে দমন করতে না পেরে আজ খোঁজ করতে করতে বাঈজীর ঘরে এসে নিজেই প্রবেশ করেছে।
বাঈজী তানপুরায় ভৈরো রাগ আলাপ করছিল। আপন মনেই বাঈজী আলাপ করছিল, রুচিরা যে তার ঘরে এসে ঢুকেছে সে টেরও পায়নি। চেয়েছিল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রুচিরা বাঈজীর দিকে। কণ্ঠস্বর ও বসবার ভঙ্গীটি পর্যন্ত তার যেন কতই না পরিচিত।
কে—কে ঐ বাঈজী?
দাদুর গান-বাজনার প্রচণ্ড নেশা আছে ও জানত এবং মধ্যে মধ্যে নাকি বাঈজীরা দাদুর কাছে গানের মুজরা নিয়ে আসে এ গৃহে দু-চার-দশ দিনের জন্য।
সে কারণে বাঈজীর প্রতি আকৃষ্ট হয়নি সে, হয়েছিল গতকাল সন্ধ্যায় দূর থেকে উদ্যানে ভ্রমণরতা বাঈজীকে দেখে।
আলাপ শেষ হতেই তানপুরাটা কোলের কাছে নামিয়ে রেখে গুনগুন করে তখনও সুর ভাঁজতে ভাঁজতে সামনের দিকে তাকাতেই বাঈজীর সামনে দর্পণে প্রতিফলিত ঠিক পিছনেই নিঃশব্দে দণ্ডায়মানা রুচিরার প্রতিকৃতির প্রতি দৃষ্টি পড়তেই চমকে বাঈজী ফিরে তাকায়।
পরস্পরের সঙ্গে চোখাচোখি হল। কিছুক্ষণ পরস্পর পরস্পরের দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। কথা বলে প্রথমে এবারে রুচিরাই, সাবিত্রী না? এতক্ষণে রুচিরা চিনতে পেরেছে বাঈজীকে।
বাঈজী আর কেউ নয়, সাবিত্রী। বেথুনে ম্যাট্রিক পড়বার সময় তার সহপাঠিনী তো ছিলই, রুচিরার সঙ্গে হোস্টেলের একই ঘরে বাসও করেছিল সে কয়েক মাস।
অত্যন্ত অন্তরঙ্গতা একদিন ছিল ওদের পরস্পরের মধ্যে।
রুচি!
এতক্ষণে বাঈজীরও কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
হ্যাঁ। আশ্চর্য! কিন্তু তুই এখানে? রুচিরা প্রশ্ন করে।
মৃদু হাসির একটা আভাস যেন খেলে যায় বাঈজীর ওষ্ঠের ওপরে, হ্যাঁ। আজ আমার পরিচয় আর সাবিত্রী নয়, আজ আমি মুন্না বাঈজী।
মুন্না বাঈজী!
হ্যাঁ। কিন্তু তুই এখানে? কিছুই তো বুঝতে পারছি না রুচি! সাবিত্রী দ্বিতীয়বার আবার প্রশ্ন করে।
এটা তো আমার মামার বাড়ি। তুই তো জানিস মামাদের পয়সা ও দয়াতেই আমি মানুষ।
হ্যাঁ হ্যাঁ, ভুলে গিয়েছিলাম—কত দিনকার কথা। প্রায় তিন-চার বছর হবে, তাই না?
তা হবে বৈকি।
রায়বাহাদুর—যিনি গতকাল—
হ্যাঁ, তিনিই আমার মামা। আর অবিনাশ চৌধুরী—ওঁর কাকা হলেন আমার দাদু।
ও।
সাবিত্রী যেন হঠাৎ চুপ করে গেল।
খোলা বাতায়ন-পথে দৃষ্টি প্রসারিত করে অতঃপর নিঃশব্দে বসে রইল কিছুক্ষণ সাবিত্রী।
রুচিরা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে তখন সাবিত্রী— মুন্না বাঈজীর দিকে।
সাবিত্রী!
তার সহপাঠিনী সাবিত্রী—যার রূপের ও কণ্ঠের খ্যাতি একদিন সমস্ত কলেজ ছাত্রীদের মধ্যে হিংসার বস্তু ছিল!
লেখাপড়ায় সাবিত্রী কোন দিনই ভাল ছিল না তেমন, অত্যন্ত সাধারণ শ্রেণীর ছাত্রী ছিল।
কিন্তু তবু সারা কলেজে তাকে চিনত না এমন কেউ ছিল না, তার মধুক্ষরা কণ্ঠের জন্য।
নিঃশব্দে সাবিত্রী বসে আছে।
খুব প্রত্যুষেই বোধহয় স্নান করেছে। পরিধানে সাদা মিলের নরুণপাড় একটা ধুতি। দু কাঁধের ওপর দিয়ে সিক্ত চুলের গোছা বুকের দুপাশে বিলম্বিত।
কপালে দুই জ্বর মধ্যস্থলে একটি বোধ হয় শ্বেতচন্দনের টিপ।
সিঁথিতে বা কপালে এয়োতির চিহ্নমাত্রও নেই। অথচ সাবিত্রী তো বিবাহিতাই ছিল যতদূর ওর মনে পড়ে। ওর সমগ্র চোখেমুখে যেন একটা বিষণ্ণ করুণ দুঃখের ও ক্লিষ্ট যাতনার ছায়া।
রুচিরা আবার মৃদু কণ্ঠে ডাকে, সাবিত্রী!
সাবিত্রী রুচিরার ডাকে যেন হঠাৎ চমকে ওঠে।
এবং অত্যন্ত মৃদুকণ্ঠে বলে এবারে, সাবিত্রীকে হঠাৎ আজ এই বেশে সামান্য এক বাঈজীর পরিচয়ে এতদিন পরে দেখে খুব চমকে গিয়েছিস, না? আয়, বোস। রুচিরার দিকে তাকিয়ে সাবিত্রী রুচিরাকে আহ্বান জানায়।
না। কিন্তু—
ও, তুই তো শুনেছিলি যে স্বামীর ঘরে যাবার পর সাবিত্রী আফিং খেয়ে আত্মহত্যা করেছিল—
না।
শুনিসনি? আশ্চর্য!
না, শুনিনি। আবার কিছুক্ষণ কতকটা যেন আত্মচিন্তায় বিভোর হয়েই সাবিত্রী নিঃশব্দে যেমন বসে ছিল তেমনি বসে থাকে।
হঠাৎ আবার সাবিত্রী কথা বলে, সত্যি ভাই, আমার নিজেরই কি এক এক সময় কম আশ্চর্য লাগে! বাপ মা নাম রেখেছিল সাবিত্রী। দিদিমার মুখে খুব ছোটবেলায় গল্প শুনেছিলাম,যমের গ্রাস থেকে স্বামীকে ফিরিয়ে নিয়ে এসে সাবিত্রী হয়েছিল সতী-সীমন্তিনী, নারীকুলে ধন্যা গরবিনী। আর আমিও সাবিত্রী—স্বামীকে নিজ হাতে হত্যা করে হয়েছি মুন্না বাঈজী! আমিও নারীকুলে অনন্যা, কি বলিস!
একটানা কথাগুলো বলে হাসতে লাগল সাবিত্রী। চোখেমুখে একটা নারকীয় জঘন্য উল্লাস যেন উপচে পড়তে থাকে।
সাবিত্রীর কথায় রুচিরা যেন সত্যিই একেবারে বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে গিয়েছিল।
কি বলছিস তুই সাবিত্রী! স্বামীকে হত্যা করেছিস?
হ্যাঁ। কেন, বিশ্বাস হচ্ছে না? এই হাত, এখনও এতে—ভাল করে চেয়ে দেখ, হয়তো হত্যার রক্ত লেগে আছে।
কেমন একটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে যেন সাবিত্রী তাকিয়ে আছে রুচিরার দিকে।
ঘৃণা, বিদ্বেষ, আক্রোশ সব কিছুই যেন সাবিত্রীর দুই চোখের দৃষ্টির মধ্যে ঐ মুহূর্তে একসঙ্গে ফুটে উঠেছে।
দাঁড়া, দরজাটা ভাল করে বন্ধ করে দিয়ে আসিবলতে বলতে হঠাৎই যেন সাবিত্রী উঠে গিয়ে ঘরের দরজার কপাট দুটো বন্ধ করে দিয়ে ফিরে এল। এবং যেখানে বসেছিল সেইখানেই এসে বসল।
সাবিত্রী আবার বলে, ভাগ্যি সাবিত্রীর রূপ ছিল— বোকা পুরুষগুলোর চোখ-ঝলসানো রূপ ছিল, নচেৎ এত বড় কোনদিন কি হতে পারতাম! গরীবের ঘরে জন্মেছিলাম, কিন্তু সেই রূপের দৌলতেই তো ধনীর ঘরে বিকিয়ে গেলাম, সে-সব কথা তো তুই জানিসই।
হ্যাঁ, কিন্তু মৃদুকণ্ঠে কি বলতে গিয়েও যেন থেমে গেল রুচিরা।
রূপের দৌলতে ধনীর ঘরের বধূ হবার সৌভাগ্যটুকুই কেবল সেদিন আমি তোকে বলেছিলাম রুচি, কিন্তু সে ধনীর ঘরের বধূর দৈনন্দিনের পরবর্তী যে দুঃখ ও লাঞ্ছনার কাহিনী সেটা সেদিন তোকে আমি শোনাইনি।
সাবিত্রী!
তাই। ধনীর পুত্রবধূ সাবিত্রীর কাহিনীই সেদিন তুই শুনেছিলি ভাই কিন্তু শোনানো হয়নি তোকে কেমন করে সেই বধূকে একদিন অনন্যোপায় হয়ে আজকের এই বাঈজীতে রূপান্তরিত হতে হল।
রুচিরা চেয়ে থাকে সাবিত্রীর মুখের দিকে।
একটা দীর্ঘশ্বাস রোধ করে সাবিত্রী আবার বলতে শুরু করে :
উঃ! যখন ভাবি না সেদিনকার কথাগুলো, ঘৃণায় লজ্জায় আর ধিক্কারে যেন মাটির সঙ্গে মিশে যেতে ইচ্ছা করে। তখন কি জানি কেন কলেজে পাঠিয়েছিল আমায়! খেয়াল—লম্পট, ধনী স্বামীর খেয়াল! আমায় কলকাতায় পড়তে পাঠালে। ছোট শহরের এক স্কুলে পড়ছিলাম, সেখান থেকে ছাড়িয়ে এনে কলকাতায় ভর্তি করে দিল বেথুনে। ধনীর খেয়াল কিনা তাই হঠাৎ একদিন ডাক এল আবার স্বামীর ঘরে ফিরে যাবার, পড়াশুনায় ইস্তফা দিয়ে মধ্যপথেই।
হ্যাঁ, মনে আছে পরীক্ষার মাত্র দিনকয়েক আগে তুই পরীক্ষা না দিয়েই স্বামীর ঘর করতে চলে গেলি।
স্বামীর ঘরই বটে। তবে ভেতরের ঘর নয়, বাইরের ঘর। স্বামীর বিলাসভবন বাগানবাড়িতে, নাচঘরে।
বলিস কি!
এক বর্ণও মিথ্যে নয়। এবং সেই বাগানবাড়িতে গিয়েই শুনলাম বিবাহিতা হলেও স্বামীর গৃহের অন্দরমহলে প্রবেশের নাকি আমার কোন অধিকার নেই—আমি সেখানে অহেতুক অনাবশ্যক বোঝা মাত্র।
কেন? প্রশ্নটা না করে চুপ করে থাকতে পারে না রুচিরা, তোকেও তো তিনি বিয়েই করেছিলেন।
তা করেছিলেন বটে, তবে ঘরে তাঁর প্রথম বিবাহিতা গৃহলক্ষ্মী ছিলেন। আমার স্বামীর প্রথমা পত্নী। তাঁর সন্তানের জননী। তাঁর ছাড়পত্রে আগেই শীলমোহর পড়ে গিয়েছিল কিনা।
সে কি! তুই শুনিসনি কিছু বিয়ের সময় যে তাঁর আগের স্ত্রী বর্তমান ছিল!
গরীব কন্যাদায়গ্রস্ত মা-বাপ আমার, তার ওপরে বিনা পণে এত বড় ঘরে এমন পাত্রে বিয়ে, তাঁরা হয়ত তাই আর কিছু শোনাটা প্রয়োজন মনে করেননি, কারণ জানবার কথা তো তাঁদেরই, আমার তো নয়। আমি তো তখন বাংলা দেশের বিয়ের কনে মাত্র। দেওয়া না-দেওয়ার ক্ষমতাটা তো ছিল তাঁদেরই হাতে। আইনগত জন্মস্বত্ব সেদিন তো তাঁদের হাতেই ছিল।
হুঁ, তারপর?
তারপর আর কি! ঘর যেখানে জলসাঘর, সেখানে গৃহস্থ বধূর পরিণতি কি হতে পারে এ তত সহজেই বুঝতে পারিস।
স্বামী হয়ে তোকে—
মুহূর্তে যেন সাবিত্রীর দুই চক্ষুর তারা রুদ্র তেজে জ্বলে ওঠে।
তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে, স্বামী! কাকে তুই স্বামী বলিস! যে তার নিজের বিবাহিতা স্ত্রীকে অনায়াসে লম্পটের ক্ষুদার অনলে সমর্পণ করতে পারে সে কি স্বামী? নাই বা হল এটা আইনগত সিদ্ধ বিয়ে, তবু তো অগ্নি-নারায়ণশিলা সাক্ষী রেখেই আমাদের বিয়েটা হয়েছিল। মন্ত্র ও সেই অনুষ্ঠানকে না হয় সে অস্বীকার করলে, কিন্তু দায়িত্ব নীতি বা রুচি বলে কি কিছুই নেই? ক্রুদ্ধ বাঘিনীর মতই যেন একটা চাপা আক্রোশে ফুলতে থাকে সাবিত্রী।
বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে গিয়েছে যেন রুচিরা।
সাবিত্রী বলতে থাকে, কিন্তু আমিও তাকে ক্ষমা করিনি। অপমানের প্রতিশোধ নিয়েছি। কিন্তু বাকি একজনকে এখনও খুঁজে সামনে পাইনি। সঙ্গীতপিপাসু সে, তাই গানের মুজরা নিয়ে বাগানবাড়িতে বাগানবাড়িতে গানের আসরে আসরে হানা আজও দিয়ে বেড়াচ্ছি, কারণ জানি একদিন-না একদিন তার সন্ধান পাবই। সেই দিন—বলতে বলতে সহসা মুন্না বাঈজী কোমর থেকে একটা তীক্ষ্ণ ধারাল ছুরি বের করে। ছুরির চকচকে অগ্রভাগটা যেন জিঘাংসায় হিলহিল করে ওঠে।
রুচিরা চমকে উঠে দু পা পিছিয়ে যায়।
সাবিত্রী খিলখিল করে হেসে ওঠে এবং হাসতে হাসতেই আবার ছুরিটা কোমরে গুঁজে রাখতে রাখতে বলে, ভয় পেলি রুচি? সম্মানের সঙ্গে গৃহের আব্রু নিয়ে নারীর মর্যাদায় তোরা
প্রতিষ্ঠিত; অপমানিত লাঞ্ছিত নারীত্বের মর্মন্তুদ জ্বালা যে কী—কেমন করে তারা বুঝবি ভাই! কি যন্ত্রণায় তারা নিশিদিন ছটফট করে মাথা খুঁড়ে মরে কেমন করে তোরা বুঝবি!
সাবিত্রীর দু চোখের কোণ বেয়ে অশ্রুর ধারা নেমে আসে।
আর নির্বাক বিস্ময়ে সেই দিকে তাকিয়ে বসে থাকে রুচিরা যেন পাথরের মত।
০৯. ডাঃ সানিয়ালের ঘরে
কিরীটী ডাঃ সানিয়ালের ঘরে আবার ফিরে এল।
ডাঃ সমর সেনই প্রথমে কথা বলেন, এই যে মিঃ রায়, এতক্ষণ কোথায় ছিলেন? দালাল সাহেব চলে গেলেন যে আপনার জন্যে অপেক্ষা করে করে!
কখন আসবেন কিছু বলে গেছেন? কিরীটী প্রশ্ন করে!
হ্যাঁ, বিকেলের দিকে আবার আসবেন বলে গেলেন। কিন্তু আমি তো আর দেরি করতে পারছি না মিঃ রায়। আজ আবার আমার একটা অপারেশন আছে। জবাব দিলেন ডাঃ সেন।
কিরীটী যেন আপন মনে কি ভাবছিল। ডাঃ সমর সেনের প্রশ্নে ওঁর মুখের দিকে চেয়ে বলে, কি বললেন ডাঃ সেন?
আমার একটা অপারেশন ছিল! ডাঃ সেন আবার কথাটা পুনরাবৃত্তি করলেন।
নিশ্চয়ই। আপনি যাবেন বৈকি। আপাততঃ আপনাকে আর আমাদের প্রয়োজন নেই।
ডাঃ সেন বলেন, কিন্তু দালাল সাহেব যে বলে গেলেন তিনি না ফিরে আসা পর্যন্ত আমাকে অপেক্ষা করতে!
না, তার আপাততঃ কোন প্রয়োজন নেই। তবে যাবার আগে আমার যে কয়েকটা কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করবার ছিল ডাঃ সেন।
কিরীটীর শেষের কথায় যেন একটু বিস্ময়ের সঙ্গেই ডাঃ সমর সেন তার মুখের দিকে তাকান।
কিরীটী মৃদু হেসে বলে, কথাটা অবিশ্যি একটু ব্যক্তিগত।
কি রকম?
আপনি এই বাড়িতে কি কাল রাত্রেই সর্বপ্রথম এলেন–না আগেও এ বাড়িতে দু-একবার এসেছেন?
না, কাল রাত্রেই সর্বপ্রথম এ বাড়িতে আমি পা দিয়েছি।
ও। তাহলে এ বাড়ির কাউকেই আপনি পূর্বে চিনতেন না?
ডাঃ সেন যেন এবারে একটু চমকেই কিরীটীর মুখের দিকে তাকান। বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই আমার কথাটা?
আমি—মানে—
বলুন, লজ্জা বা দ্বিধার এতে কিছু নেই।
না, তা ঠিক নয়। রুচিরার সঙ্গে আমার আলাপ ছিল। তবে—
জানতেন না বোধ হয় কালকের রাতে এখানে এসে তাকে দেখার আগে পর্যন্ত যে সে এ বাড়িরই একজন। তাই কি?
হ্যাঁ। বছর দুয়েক আগে কলকাতায় থাকবার সময়ই আলোছায়া সঙ্ঘের একটা চ্যারিটি থিয়েটার পারফরমেন্সের সময় রুচিরার সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হয়।
তারপর?
তারপর অবিশ্যি একটু ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল।
হুঁ। এখন বুঝতে পারছি—
কি, মিঃ রায়?
কিরীটী মৃদু হেসে বলে, না, বিশেষ কিছু নয়। তারপর একটু থেমে কিরীটী আবার প্রশ্ন করে, আপনি কি কখনও শোনেননি রুচিরা দেবীর মুখে, সমীরবাবুর সঙ্গে তাঁর বিয়ের কথাবার্তা, চলেছে?
না।
আশ্চর্য!
কি বললেন মিঃ রায়?
কিছু না। রুচিরা দেবীর সঙ্গে কতদিন আগে আপনার শেষ সাক্ষাৎ হয়েছিল?
দিন পনের আগেও কলকাতায় দেখা হয়েছে। মধ্যে মধ্যে আমি কলকাতায় যাই তো, তখন দেখা হয়।
ক্ষমা করবেন, আর একটা কথা।
বলুন!
আপনি তো অবিবাহিত, তাই না?
হ্যাঁ।
বিয়ে সম্পর্কে কিছু ভেবেছেন?
না।
কেন?
সত্যি বলব? মৃদু জবাব দেন ডাঃ সেন।
বলুন না।
এখনও জবাব পাইনি।
সে কি! এখনও জবাব পাননি?
না।
তাহলে আমি বলব মা ভৈষী। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন ডাঃ সেন।
কি বলছেন আপনি মিঃ রায়!
পরে বুঝতে পারবেন। আচ্ছা এবারে তাহলে আপনি যেতে পারেন।
কিন্তু ডাঃ সেন একটু ইতস্ততঃ করতে থাকেন তবু।
তখন কিরীটী বলে, যা বলবার তাঁকে আমিই বলবখন। আপনি যান।
ডাঃ সমর সেন উঠে দাঁড়ালেন বোধ হয় ঘর ত্যাগ করবার জন্যই। ডাঃ সানিয়াল ইতিমধ্যে আবার কিরীটীর জন্য এক কাপ চা তৈরী করে চামচের সাহায্যে চিনিটা গুলছিলেন। এবার তাঁর দিকে চেয়ে কিরীটী বলে, আচ্ছা ডাঃ সানিয়াল, রায়বাহাদুরের যে attending nurse সুলতা কর, তার সম্পর্কে আপনার ঠিক কি ধারণা বলুন তো?
ডাঃ সমর সেন ঘর হতে বের হয়ে গেলেন।
চায়ের কাপটা কিরীটীর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে ডাঃ সানিয়াল বলেন, আপনার কথা আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না মিঃ রায়।
ডাক্তারের হাত হতে চায়ের কাপটা নিয়ে, চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে একটা আরামসূচক শব্দ করে স্থিরভাবে কিরীটী বলে, বুঝতে পারলেন না?
না।
মানে এই বলছিলাম আর কি, নিজের ডিউটি সম্পর্কে তার সততাকে বিশ্বাস করা যায় কিনা। আপনি তো অনেকদিন থেকেই সুলতা করকে দেখছেন এ বাড়িতে।
তা তাকে বিশ্বাস করা যায় বৈকি। ডিউটির ব্যাপারে কখনও তার কোন গাফিলতি বড় একটা দেখিনি।
বলেন কি! আমার তো মনে হল বরং ঠিক তার উল্টো। নার্স হবার আদৌ উপযুক্ত নন তিনি। She has rather chosen the wrong profession!
কেন? এ-কথা বলছেন কেন? বিস্মিত সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন ডাঃ সানিয়াল কিরীটীর মুখের দিকে।
তাছাড়া আর কি বলি বলুন! ডিউটি দিতে এসে নাহলে কেউ অমন করে অঘোরে ঘুমোতে পারে কফির সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খেয়ে!
ডাঃ সানিয়াল নির্বাক বিস্ময়ে কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে থাকেন।
নিঃশেষিত চায়ের কাপটা একপাশে নামিয়ে রেখে পকেট হতে পাইপটা বের করল কিরীটী এবং অন্য হাতে কিমনোর পকেট হতে টোবাকো পাউচটা বের করে খানিকটা টোবাকো পাউচ থেকে দুই আঙুলের সাহায্যে তুলে পাইপের গহুরে ঠাসতে থাকে ধীরে ধীরে। এবং পাইপটা ঠিক করতে করতে কতকটা যেন অন্যমনস্ক ভাবেই বলে, আমার কি মনে হয় জানেন ডাক্তার?
কি?
নার্স সুলতা কর শুধু যে তার ডিউটিতে গত রাত্রে মারাত্মক গাফিলতি করেছে তাই নয়, সে আমাদের সব কথা খুলে বলেনি।
সত্যি আপনার তাই মনে হয় নাকি মিঃ রায়?
হ্যাঁ। আরও অনেক কিছু সে জানে, যা ঘুমের দোহাই দিয়ে আমাদের কাছ থেকে চেপে গিয়েছে।
তাহলে আর একবার না হয় সুলতাকে ডাকি!
না। এখন তাকে আবার ডেকে এনে কোন ফল হবে না।
কিন্তু একটা কথা বুঝতে পারছি না মিঃ রায়, এ ব্যাপারে ইচ্ছে করে কোন কথা তার পক্ষে গোপন রাখবার কি কারণই বা থাকতে পারে?
কিরীটীর ওষ্ঠপ্রান্তে রহস্যময় হাসি দেখা যায়। মৃদু হেসে সে বলে, কোথায় কার স্বার্থ—এত সহজেই ঠিক ধরা যায় না। অত সহজে যাচাই করতে গেলে কিন্তু আপনি ঠকবেন ডাক্তার। স্বার্থ ব্যাপারটা এমন সূক্ষ্ম ও ঘোরালো যে, অনেক সময় তার হদিস পাওয়াই মুশকিল হয়ে পড়ে। তারপর যেন কতকটা বেখাপ্পা ভাবেই কিরীটী ডাঃ সানিয়ালের মুখের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করে, আচ্ছা বলতে পারেন ডাক্তার, আপনার ঐ নার্স সুলতা কর ও শকুনি ঘোষের মধ্যে পরস্পরের আলাপ-পরিচয়টা ঠিক কি ধরণের এবং কত দিনের?
প্রশ্নোত্তরে এবারে একটুখানি মৃদু হেসে ডাঃ সানিয়াল বলেন, কেন বলুন তো?
এমনি জিজ্ঞাসা করছি।
সুলতা কর এখানেই থাকে এবং শুনেছি শকুনিবাবুর সঙ্গে সুলতার এ বাড়িতে ডিউটি দিতে আসবার আগে থেকেই নাকি আলাপ-পরিচয় কিছুটা ছিল।
কথাটা শুনে কিরীটীর চোখের তারা দুটো যেন হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
কিন্তু হঠাৎ এ-কথা আপনার মনে হল কেন মিঃ রায়? প্রশ্ন করেন ডাঃ সানিয়াল।
কারণ অবশ্য একটা আছে, কিন্তু তারও আগে আমাদের জানতে হবে কাল রাতে সুলতা কর তার জবানবন্দিতে কতকটা ইচ্ছে করেই বিশেষ একটা মিথ্যে কথা কেন বলেছিল?
বিশেষ মিথ্যে কথা! ডাঃ সানিয়াল বিস্মিত ও সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে আবার কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন।
হ্যাঁ, বিশেষ একটা মিথ্যে কথা। সে তার জবানবন্দিতে বলেছে, আপনার ঘরের তৈরি কফি খেয়েই নাকি সে ঘুমিয়ে পড়েছিল—কিন্তু কেন ঐ মিথ্যে কথাটা বললে!
কিরীটীর কথায় ডাঃ সানিয়াল চমকে উঠে বললেন, সে কি? কাল আমার তাকে আমি কখন কফি দিলাম?
জানি আপনি দেননি।
কিন্তু অমন একটা মিথ্যে কথা বলবার কি এমন কারণ?
এটা আর বুঝলেন না ডাক্তার! অর্থাৎ সে প্রমাণ করতে চেয়েছিল, হয়ত আপনার দেওয়া কফির মধ্যেই কোন তীব্র ঘুমের ওষুধ মিশ্রিত ছিল। যার ফলে সে ঠিক হত্যার সময়টিতে ঘুমিয়ে পড়েছে।
কিরীটী একটু থেমে আবার বলে, কিন্তু আমি ভাবছি কি জানেন ডাঃ সানিয়াল, সে তাহলে কার দেওয়া কফি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল? কে দিল ঘুমের ওষুধ-মিশ্রিত কফি তাকে কাল রাত্রে?
আপনার তাহলে ধারণা, কাল রাত্রে কেউ-না-কেউ তাকে কফি দিয়েছিল?
হ্যাঁ।
আচ্ছা মিঃ রায়, এমনও তো হতে পারে কাল রাত্রে মিস কর আদপেই কফি পান করেনি! স্রেফ মিথ্যে কথা বলেছে।
না। মিস কর কাল রাত্রে কফি পান করেছিল এবং কফির সঙ্গে কোন তীব্র ঘুমের ওষুধও যে মিশ্রিত ছিল সে সম্পর্কে আমি নিঃসন্দেহ।
কে তাহলে দিল তাকে কফি! ডাঃ সানিয়াল আপন মনেই যেন কথাটা উচ্চারণ করেন।
তাই তো আমিও ভাবছি। কিরীটী চিন্তান্বিত ভাবেই পুনরায় বলে, কে সেই তৃতীয় ব্যক্তিটি, মানে কে সুলতা করকে কাল রাত্রে ঘুম পাড়াবার জন্য ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে কফি তৈরী করে দিয়েছিল এবং কে গিয়ে তাকে আপনার নাম করে কফিটা দিয়ে এসেছিল, সেটাই সর্বাগ্রে আমাদের এখন জানা দরকার।
কিন্তু আপনি যা ভাবছেন তাই যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে আমার মনে হয় মিঃ রায়, ডাঃ বলেন, মিস করকে এ ঘরে আর একবার ডেকে এনে সে কথাটা জিজ্ঞাসা করলেই তো লেটা চুকে যায়। কে তাকে কফি করে গত রাত্রে দিয়ে এসেছিল!
ডাঃ সানিয়ালের কথায় কিরীটী হেসে ওঠে এবং হাসতে হাসতে বলে, কেন, আপনি দিয়ে এসেছিলেন সে তাই বলবে!
আমি যে তাকে কফি দিইনি আপনি তো তা জানেন, তাছাড়া আপনি তো আমার ঘরেই ছিলেন সে সময়। আমরা তো সব এক জায়গাতেই ছিলাম।
ডাক্তার, এসব ব্যাপারে আপনি দেখছি একেবারে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ। আপনি এটা বুঝছেন না কেন, আপনি একজন মধ্যবয়সী পুরুষ—যে বয়সটা পুরুষের পক্ষে এবং বিপত্নীক পুরুষের পক্ষে বিশেষ করে একটু আশঙ্কাজনকই। তাই ঐ চাতুরীর সাহায্য সে নিয়েছে। চালাক মেয়ে!
কিন্তু এ কথাটা কি তার বোঝবার বয়স হয়নি যে জেরার মুখে সত্যটা প্রকাশ হবেই?
এখন সে ভুল শোনবার দোহাই দিয়ে অস্বীকৃতি জানিয়ে হয়ত বাঁচবার চেষ্টা করবে।
কিন্তু তাতেই বা লাভটা কি?
লাভ! লাভ time-factor! কিরীটী হাসতে হাসতে প্রত্যুত্তর দিল।
১০. কিছুক্ষণ অতঃপর উভয়েই স্তব্ধ
কিছুক্ষণ অতঃপর উভয়েই স্তব্ধ হয়ে আত্মগত চিন্তায় বিভোর হয়ে থাকে এবং আবার এক সময় ডাঃ সানিয়ালই প্রশ্ন করেন, তাহলে আপনার ধারণা মিঃ রায় যে গত রাত্রে মিস সুলতা করকে নিশ্চয়ই কেউ-না-কেউ কফির সঙ্গে ইচ্ছে করে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে তাকে ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করেছিল!
বলাই বাহুল্য। অন্যথায় তার উপস্থিতিতে মিঃ চৌধুরীকে ওভাবে হত্যা করা তত সম্ভবপর হত না।
I see! আচ্ছা মিঃ রায়, আপনার কি তাহলে মনে হয় মিস সুলতা কর এই হত্যার ষড়যন্ত্রের মধ্যে আছে?
ষড়যন্ত্রের মধ্যে আছে কিনা জানি না তবে হত্যার সময়টিতে সে অকুস্থানে উপস্থিত ছিল সেটাই যে সব চাইতে বড় কথা এখন।
কিন্তু–
এর মধ্যে আর কোন কিন্তু নেই ডাক্তার—তবে হ্যাঁ, She was in deep sleep হত্যার সময়টিতে এটা ঠিকই।
অতঃপর ডাঃ সানিয়াল যেন বলবার মত কোন কথাই আর খুঁজে পান না। এবং কিরীটীও নিঃশব্দে বসেই ধূমপান করতে করতে পীতাভ ধোঁয়া উদগীরণ করতে থাকে।
সহসা একসময় যেন চিন্তাগ্রস্ত মনটাকে একটা নাড়া দিয়ে চুরুটের অগ্রভাগ হতে ভস্মাবশেষ ছাইটা আঙুলের টোকা দিয়ে ঝাড়তে ঝাড়তে মৃদুকণ্ঠে কিরীটী বলে, ডাক্তার, আপনার পরামর্শটা ভেবে দেখলাম মন্দ নয়—আর একবার বাজিয়ে দেখতে ক্ষতি কি? আপনি গিয়ে একটিবার মিস করকে এ ঘরে পাঠিয়ে দিতে পারেন, তাকে আবার cross করে না হয় দেখা যাক।
নিশ্চয়ই, এখুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি।
ডাঃ সানিয়াল ঘর হতে বের হয়ে গেলেন।
.
দশ-পনের মিনিট পরেই বাইরে মৃদু পদশব্দ শোনা গেল এবং বোঝা গেল পদশব্দ এগিয়ে আসছে এবং পদশব্দ ঘরের বাইরে বদ্ধ দরজার সামনে এসে থামল।
মৃদু কণ্ঠে কিরীটী আহ্বান জানায়, আসুন সুলতা দেবী। দরজা খোলাই আছে।
সত্যি সুলতাই। সুলতা দরজা ঠেলে ঘরে এসে প্রবেশ করল।
কিরীটী চেয়ারটার উপরে সোজা হয়ে বসে একটু নড়েচড়ে।
সুলতা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে মুহূর্তের জন্য একবার কিরীটীর মুখের দিকে চোখ তুলে তাকাল এবং কিরীটীর স্থির নিষ্কম্প দুই চোখের শান্ত দৃষ্টির সঙ্গে বারেকের জন্য দৃষ্টি বিনিময় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় সে মুখখানি অবনত করে ভূমিতলে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে।
কারও মুখেই কোন কথা নেই।
কয়েক মুহূর্ত ঘরের মধ্যে যেন একটা বিশ্রী স্তব্ধতা থমথম করতে থাকে।
কিরীটীই পুনরায় আড়চোখে সুলতার সর্বাঙ্গে বারেকের জন্য তার দুই চক্ষুর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলিয়ে নেয়।
মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সুলতার সমগ্র মুখখানিতে দুশ্চিন্তার একটা কালো ছায়া যেন সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
বসুন সুলতা দেবী, ঐ চেয়ারটায় বসুন। স্নিগ্ধ কণ্ঠে কিরীটী সুলতাকে বলে কথাগুলো। সুলতা কিরীটীর নির্দেশে সামনের শূন্য চেয়ারটা একটু ঠেলে নিয়ে বসল।
কিরীটী লক্ষ্য করে, সামনাসামনি চেয়ারে বসলেও সুলতা যেন তার দিকে চোখ তুলে চাইছে না।
কিরীটী সুলতার দিকেই চেয়ে ছিল।
দু হাত তার চেয়ারের দুদিককার হাতলের ওপরে ন্যস্ত। দু হাতের দশ আঙুলের সাহায্যে সে চেয়ারের হাতল দুটো যেন চেপে ধরেছে।
কিরীটী নিঃশব্দে পূর্ববৎ ধূমপান করতে থাকে।
অদূরে টেবিলের উপর রক্ষিত টাইমপিসটা কেবল ঘরের নিস্তব্ধতা একঘেয়ে টিক টিক শব্দ তুলে ভঙ্গ করে চলেছে।
দুজনের একজনও কোন কথা না বলায় মনে হচ্ছিল যেন একটা সুকঠিন স্তব্ধতা ঘরের নিস্তরঙ্গ বায়ুস্তরে কুৎসিত একটা জিজ্ঞাসার চিহ্নের মত পাক খেয়ে খেয়ে চলেছে।
পরস্পর যেন পরস্পরের মুখের দিকে চেয়ে অপেক্ষা করছে, কে কাকে এবং কে আগে প্রশ্ন করবে।
কিছুক্ষণ পরে কিরীটীই সেই স্তব্ধতা ভঙ্গ করে এক সময় দগ্ধ চুরুটের অগ্রভাগের ছাইটা সম্মুখের ত্রিপয়ের ওপরে রক্ষিত অ্যাসট্রেটার ওপরে ঠুকে ঝাড়তে ঝাড়তে বলে, সুলতা দেবী, কয়েকটা কথা আপনার কাছ থেকে জানবার জন্য কষ্ট দিলাম আপনাকে।
সুলতা কিরীটীর মুখের দিকে চোখ তুলে তাকাল, কিন্তু কিরীটীর কথার কোন প্রত্যুত্তর দিল না।
দুভাগ্যবশতঃ গতরাত্রে ঘটনা-বিপর্যয়ে ঠিক দুর্ঘটনাটার সময়ই মিঃ চৌধুরীর শিয়রের সামনে আপনার উপস্থিতিটা বলতে বলতে কথার মধ্যে একটুখানি ইতস্ততঃ করেই যেন কিরীটী আবার তার অর্ধসমাপ্ত বক্তব্যের জের টেনে বলে, বুঝতেই পারছেন মিস কর, পুলিসের কাছে আপনার জবানবন্দিরই সব চাইতে বেশী মূল্য এখন।
কিন্তু–সুলতা কিরীটীর দিকে মুখ তুলে কি যেন বলতে চেষ্টা করতেই, কিরীটী মৃদু স্মিতকণ্ঠে। বলে, অবশ্য ঠিক দুর্ঘটনাটা যে সময় ঘটে আপনিই অকুস্থানের সর্বাপেক্ষা কাছাকাছি ছিলেন এবং এ-কথাও মিথ্যে নয় যে আপনার এ হত্যার ব্যাপারে কোনপ্রকার স্বার্থেরই যোগাযোগ থাকতে পারে না, তাহলেও বুঝতেই পারছেন এক্ষেত্রে আপনি যে একেবারে খুব সহজেই সমস্ত প্রকার সন্দেহ থেকে রেহাই পাবেন তাও নয়।
কিরীটীর কথায় সুলতার চোখেমুখে যেন একটা চাপা আতঙ্কের অস্পষ্ট আভাস জেগে ওঠে সহসা।
আপনি কি আমাকে সন্দেহ করেন মিঃ রায়?
অত্যন্ত নিম্নকণ্ঠে ঢোঁক গিলে সুলতা প্রশ্ন করে।
কিরীটী মৃদু হেসে বলে, আপনি বোধ হয় জানেন না সুলতা দেবী, অনুসন্ধানের ব্যাপারে আমরা গোড়াতেই ঐ সন্দেহ নিয়েই কাজ শুরু করি, কিন্তু সে কথা যাক, ভয় পাবেন না যেন তাই বলে। বলছিলাম সমস্ত কিছুকেই একটা সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করে ক্রমে ক্রমে আমরা নিঃসন্দেহে গিয়ে পৌঁছই। সন্দেহই আমাদের নিঃসন্দেহের সত্যে পৌঁছে দেয়।
কিরীটী কথা বলতে বলতে এক সময় চেয়ার হতে উঠে ঘরের মধ্যে ধীরে ধীরে পায়চারি শুরু করে দেয় এবং পায়চারি করতে করতেই পুনরায় তার বক্তব্যের মধ্যে ফিরে যায়, এবার আমাদের আসল ও কাজের কথায় আসা যাক—যে জন্য আপনাকে ডেকে এনেছি এ ঘরে। আমি যে প্রশ্নগুলো আপনাকে করব, আশা করি ভেবেচিন্তে তার যথাযথ উত্তর দেবেন।
বলুন?
প্রথমতঃ আপনার কি মনে আছে ঠিক কত রাত পর্যন্ত আপনি জেগে ছিলেন?
ঠিক কারেক্ট টাইম বলতে পারব না হয়ত, তবে মনে হয় সোয়া তিনটে পর্যন্ত বোধ হয় জেগে ছিলাম।
বেশ। আপনি আপনার গত রাত্রির জবানবন্দিতে বলেছেন, কফি পানের পরই কিছুক্ষণের মধ্যে নাকি আপনি ঘুমিয়ে পড়েন। মনে পড়ে আপনার?
হ্যাঁ, এমন ঘুম পেয়েছিল যে কিছুতেই জেগে থাকতে পারলাম না। তাছাড়া রায়বাহাদুরও ঘুমিয়ে পড়ায়–
কিরীটী আবার বলে, আচ্ছা ডাক্তারের কাছেই শুনেছিলাম, ইদানীং প্রায় কোন ঘুমের ওষুধেই নাকি রায়বাহাদুরের তেমন ভাল ঘুম আসত না এবং সেই কারণেই সমস্ত রাত ধরেই। ডাক্তারকে ও আপনাকে বলতে গেলে প্রায় তটস্থ হয়ে——মানে কখন ডাকবেন সেই জন্য। সর্বক্ষণই প্রায় সজাগ হয়ে থাকতে হত, কথাটা কি সত্যি?
হ্যাঁ। মৃদুকণ্ঠে সুলতা জবাব দেয়।
তাই যদি হবে তো অমন চট্ করে মাত্র একটা ঘুমের বড়ি খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লেন কি করে?
সুলতা চুপ করে আছে। কিরীটীর প্রশ্নের কোন জবাব দিচ্ছে না।
মুহূর্তকাল চুপ করে থেকে কিরীটী পুনরায় প্রশ্ন করে, আপনার সঙ্গে শকুনিবাবুর কতদিনকার আলাপ মিস কর?
কিরীটীর প্রশ্নে হঠাৎ যেন একটু চমকেই সুলতা তার মুখের দিকে তাকায়।
কিরীটী সেই চমকানোটুকু লক্ষ্য করেই এবারে বলে, কই, কথাটার আমার জবাব দিলেন না!
সুলতা মৃদুকণ্ঠে বলে, বছর দুই হবে।
দু বছর?
হ্যাঁ, আমার জন্ম এখানে, আমি এখানেই মানুষ। বাবা এখানকার একটা কোলিয়ারীর অ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজার ছিলেন।
Excuse me, শকুনিবাবুর সঙ্গে আপনার প্রথম পরিচয় কি করে হল?
রায়বাহাদুরের কোলিয়ারীর হাসপাতালে কলকাতা থেকে নার্সিং শিখে এসে প্রথম যখন বছর দুই আগে চাকরি নিই—হাসপাতালের ডাক্তারবাবু মিঃ ঘোষের বন্ধু ছিলেন, সেই সূত্রে হাসপাতালে ঐ সময় ওঁর যাতায়াত ছিল এবং সেই সময়েই আমাদের পরস্পরের আলাপ-পরিচয় হয়।
একটা কথা সুলতা দেবী, রায়বাহাদুরের এখানে আপনাকে কাজে নিযুক্ত করবার ব্যাপারে মিঃ ঘোষের কোন হাত ছিল কি?
কিরীটীর প্রশ্নটা এত পরিষ্কার যে প্রথমটায় সুলতা কিছুই জবাব দিতে পারে না। নিঃশব্দে বসে কেবল নিজের পরিধেয় শাড়ির আঁচলের পাড়টা টেনে টেনে সোজা করতে থাকে। কিরীটীও সুলতাকে দ্বিতীয় আর কোন প্রশ্ন না করে তীক্ষ্ণ সজাগ দৃষ্টিতে তার প্রতি চেয়ে থাকে।
অতঃপর কিছুক্ষণ ঐভাবেই নিস্তব্ধতার মধ্যেই কেটে যায়।
ধীরে ধীরে এক সময় সুলতা আবার মুখ তুলে বারেকের জন্য কিরীটীর প্রতি দৃষ্টিপাত করল এবং শান্ত ধীর কণ্ঠে বললে, না, আমার এখানে কাজে নিয়োগ সম্পর্কে মিঃ ঘোষের কোন তদারকের প্রয়োজন হয়নি, কারণ আমি রায়বাহাদুরের হাসপাতালেই চাকরি করছিলাম। কাজেই হাসপাতালের ডাক্তারবাবুই নার্সের প্রয়োজন হওয়ায় আমার কথা ডাঃ সানিয়ালকে বলায় এখানে আমার চাকরি হয়। বলতে গেলে হাসপাতালের ডাক্তারবাবুই আমার এখানে চাকরি করে দেন।
কিরীটী আবার কিছুক্ষণ চুপ করে বসে নিঃশব্দে ধূমপান করতে থাকে।
আচ্ছা এমনও তো হতে পারে, মিঃ ঘোষই হাসপাতালের ডাক্তারবাবুকে বলে এখানে– আপনার নিয়োগ যাতে হয় সে বিষয়ে সাহায্য করেছিলেন?
কিরীটীর প্রশ্নে সুলতা কর মুহূর্তের জন্য চোখ তুলে কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়, তারপর শান্ত ধীর কণ্ঠে বললে, না, আপনার সে সন্দেহ সত্যি নয়, তাছাড়া সে রকম কোন কিছু হয়ে থাকলে আমি নিশ্চয়ই জানতে পারতাম।
মুহূর্তের জন্যই কিরীটীর চোখের তারা দুটি চকচক করে ওঠে এবং যে উদ্দেশ্যে সে একই প্রশ্ন বারংবার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সুলতাকে করছিল সেটা যে কতকটা সিদ্ধ হয়েছে তাতেই তার কিছুটা আনন্দ হয়। অতঃপর কিরীটী তার দ্বিতীয় প্রশ্ন করে।
মিস কর, এবারে আপনাকে আমি আবার গত রাত্রি সম্পর্কে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই।
বলুন? শান্ত স্বর সুলতার।
গতরাত্রের জবানবন্দিতে এবং আজও এই কিছুক্ষণ আগে আপনি বলেছেন, কফি পানের পরই আপনার দু চোখের পাতায় অসহ্য ঘুম নেমে আসে, আপনি কোনমতেই আর চোখ খুলে রাখতে পারেন না, আপনি ঘুমোতে বাধ্য হন।
১১. কিরীটীর প্রশ্নে কিছুক্ষণের জন্য সুলতা
কিরীটীর প্রশ্নে কিছুক্ষণের জন্য সুলতা ওর মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে। কয়েকটা মুহূর্ত নিঃশব্দেই অতিবাহিত হয়।
সুলতাকে নিঃশব্দে বসে থাকতে দেখে কিরীটী আবার বলে, আপনি বোধ হয় জানেন না যে গত রাত্রে আপনাদের প্রত্যেকের জবানবন্দিই থানায় recorded হয়ে গিয়েছে! এবং, বর্তমানের এই রায়বাহাদুরের হত্যা-মামলায় আপনাদের আলাদা আলাদা ভাবে প্রত্যেকের দেওয়া জবানবন্দিই প্রত্যেকের স্বপক্ষে বা বিপক্ষে evidence হিসাবেই আদালতে জেরা করা হবে!
একটু থেমে কিরীটী আবার তার অর্ধসমাপ্ত বক্তব্যের জের টেনে বলতে শুরু করে, এবং এও হয়ত বুঝতে পারছেন, ঘটনাচক্রে একমাত্র আপনিই সশরীরে অকুস্থানের সর্বাপেক্ষা কাছাকাছি ছিলেন ঠিক হত্যার সময়টিতে!
কিন্তু আমি—আমি তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। যথাসাধ্য নিজেকে সংযতভাবে প্রকাশ করবার প্রয়াসে সুলতার কণ্ঠস্বরে যে উদ্বেগ ফুটে ওঠে সেটা কিরীটীর কান এড়াতে পারে না।
হ্যাঁ, হয়ত ঘুমিয়েছিলেন, কিন্তু সেটাও তো আদালতের বিচারের সময় বিবেচনাসাপেক্ষ। সে ঘুম কেন এল? কারণ আপনার তো ঘুমোবার কথা নয়!
সুলতা এরপর আর নিজের মনের উদ্বেগকে সংযত রাখতে পারে না। স্পষ্ট ব্যাকুল কঠেই বলে ওঠে, কি আপনি বলতে চাইছেন মিঃ রায়! আপনি কি বিশ্বাস করেন না সত্যিসত্যিই আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম!
আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসে কি এমন এসে যায় বলুন মিস কর? আমি তো আর কিছু আদালতের নিয়োজিত প্রতিভূ নই এবং স্বয়ং বিচারকও নই, আপনাদের মতই একজন সাধারণ তৃতীয় ব্যক্তি যে হত্যার সময় এই বাড়িতে উপস্থিত ছিল এইমাত্র!
কিন্তু সত্যিই বিশ্বাস করুন মিঃ রায়, আমি ঘুমিয়েই পড়েছিলাম, নচেৎ আপনি কি ভাবেন আমার জেগে থাকা সত্ত্বেও আমি আমার চোখের ওপর একজনকে হত্যা করতে বাধা দেব না? কারও পক্ষেই কি সেটা সম্ভব?
কারও পক্ষে সম্ভব কিনা সেটা এক্ষেত্রে নিষ্প্রোয়োজন। তবে আপনি যে আপনার duty ঠিকভাবে পালন করেননি, এ কথাটা তো নিশ্চয়ই অস্বীকার করতে পারেন না।
আমি আমার duty অবহেলা করেছি!
করেননি? নিশ্চয়ই করেছেন সুলতা দেবী। নিজেই ব্যাপারটা একবার ভাল করে ভেবে দেখুন না, রাত্রে একজন মুমূর্ষ রোগীর সেবা ও দেখাশুনা করবার জন্যই তো টাকা দিয়ে আপনাকে নিয়োজিত করা হয়েছিল এখানে। আপনি জেগে থেকে রোগীর ভালমন্দ দেখাশোনা করবেন এবং প্রয়োজন হলে অবিলম্বে ডাক্তারকে পাশের ঘর থেকে ডেকে আনবেন, এই তো ছিল আপনার duty? সেদিক থেকে ঘুমিয়ে আপনি কি কর্তব্যে অবহেলা করেননি? বলুন, জবাব দিন আমার প্রশ্নের?
শেষের দিকে কিরীটীর কণ্ঠস্বরে যেন কতকটা আদেশের সুরই ফুটে ওঠে। সুলতা চুপ করে বসে থাকে। কোন জবাবই দিতে পারে না কিরীটীর অতর্কিত প্রশ্নের।
আপনি বলেছেন আপনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন কফি পানের পরই; ধরে নেওয়া গেল নাহয় কথাটা আপনার সত্যি, এর পরই আদালত আপনার সম্পর্কে প্রশ্ন তুলবে, তাহলে নিশ্চয়ই সেই কফির মধ্যে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল!
ঘুমের ওষুধ?
হ্যাঁ। নচেৎ কি এক কাপ কফি খেয়ে কেউ অমন গভীরভাবে ঘুমিয়ে পড়তে পারে? বরং উল্টোটাই স্বাভাবিক। কফিতে ঘুম তাড়ায়।
সুলতা কিরীটীর মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে।
কিরীটী আবার বলে, ধরুন তাই যদি হয়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে আবার প্রশ্ন উঠবে, কে আপনাকে কফির সঙ্গে ঘুমের ওষুধ দিল? আর প্রশ্নটা ঐখানেই শেষ হবে না। কারণ আরও একটা প্রশ্ন করা যেতে পারে ঐ সঙ্গে, কে আপনাকে কফি পাঠিয়ে দিয়েছিল?
কেন, কফি তো ডাক্তার সানিয়ালই দিয়ে গিয়েছিলেন আমাকে, যেমন এর আগেও প্রায়ই প্রতি রাত্রে ঐ সময় এক কাপ করে কফি তিনি আমাকে দিয়ে যেতেন!
সুলতার জবাবে কিরীটী যেন চমকে ওঠে, কিন্তু কণ্ঠস্বরে তার কিছুই প্রকাশ পায় না।
কিরীটী কেবল প্রশ্ন করে, প্রায় রাত্রেই তাহলে ডাঃ সানিয়াল ঐ সময় আপনাকে এক কাপ করে কফি পাঠিয়ে দিতেন নাকি?
হ্যাঁ। রাত্রে ঐ সময় তিনি প্রত্যহই কফি পান করতেন এবং জেগে থাকবার সুবিধে হবে বলে আমাকে তিনিই একদিন suggest করেন, ঐ সময় এক কাপ গরম কফি পান করলে আমার জেগে থাকতে নাকি তত কষ্ট হবে না। সেই জন্য এক কাপ করে কফি আমাকেও পাঠিয়ে দিতেন এবং আমিও কফিটা খেতাম, কারণ ঐ সময়টায় প্রতি রাত্রেই প্রায় আমার একটা ঘুমের ঝোঁক আসত।
আপনি সে কথা ডাক্তার সানিয়ালকে বলেছিলেন বুঝি?
হ্যাঁ, কথায় কথায় একদিন বলেছিলাম।
ও। তাহলে দেখছি প্রায় রাত্রেই ঐ সময়টা আপনার ঘুমের একটা ঝোঁক আসত বলেই ডাঃ সানিয়াল আপনাকে কফি পাঠিয়ে দিতেন নিজে।
অ্যাঁ, কি বললেন?
বলছিলাম জেগে থাকবার জন্যই আপনি কফি খেতেন! তাহলে কাল রাত্রে যদি আপনাকে কফির সঙ্গে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়ানো হয়েই থাকে, তাহলে it was intentional!
সুলতা কিরীটীর কথা যেন কিছুই বুঝতে পারেনি, এইভাবে ওর মুখের দিকে চেয়ে থাকে।
যাক সে কথা, আচ্ছা মিস কর, এ বাড়িতে আপনি তো অনেকদিন ধরে রায়বাহাদুরের রোগশয্যায় duty দিচ্ছেন? কতদিন ধরে রাত্রে ঐ সময় আপনি ডাক্তারের কাছ থেকে কফি খাচ্ছেন মিস কর?
কতদিন ধরে খাচ্ছি?
হ্যাঁ, একটু আগে আপনি বললেন না, উনিই মানে ডাঃ সানিয়ালই একদিন কফি খাবার কথা আপনাকে বলেছিলেন?
খুব বেশী দিন নয়, বোধ হয় দিন দশেক হবে।
দিন দশেক!
হ্যাঁ, বোধ হয় দিন দশ থেকেই রাত্রে তিনি যখন কফি খান, সেই সময় কফি তৈরী হলে এক কাপ করে আমার জন্য দিয়ে যেতেন।
সাধারণতঃ কি তিনিই—অর্থাৎ ডাঃ সানিয়ালই কি আপনাকে কফি এনে দিতেন ঐ রাত্রে?
হ্যাঁ, ডাক্তার সানিয়ালই দিতেন নিজে।
ডাঃ সানিয়ালই দিয়ে যেতেন! আবার প্রশ্ন করল কিরীটী।
হ্যাঁ।
গত রাত্রেও তাহলে তিনিই দিয়ে গিয়েছিলেন কফি?
হ্যাঁ, ডাঃ সানিয়ালই।
সুলতার জবাবে কয়েকটা মুহূর্তের জন্য কিরীটী যেন বিস্ময়ে বোবা হয়ে থাকে। তারপর আবার এক সময় নিজেকে সামলে নিয়ে শান্ত ধীর কণ্ঠে বলে, কিন্তু সুলতা দেবী, অন্যান্য রাতের কথা আমি বলতে পারব না বটে তবে গতকাল রাত্রে যে তিনি আপনাকে কফি দিতে আসেননি সে সম্পর্কে কিন্তু আমি স্থিরনিশ্চিত।
ঘরের মধ্যে হঠাৎ যেন বজ্রপাত হল।
কি বলছেন আপনি মি রায়, আমি তখন জেগে একটা বই পড়ছিলাম—ডাঃ সানিয়ালই কাল রাত্রেও আমাকে নিজে এসে কফি দিয়ে গেলেন!
না, বললাম তো, কাল রাত্রে তিনি যে অন্ততঃ আপনাকে কফি দিতে আসেননি সে বিষয়ে আমি স্থিরনিশ্চিত। কারণ সে সময়ে তাঁর ঘরেই তিনি উপস্থিত ছিলেন।
না, তা হতে পারে না।
হওয়া-হওয়ির কথা এ নয় মিস কর, কারণ it is a fact। তাছাড়া আমি নিজে ও ডাঃ সেন ঐ সময় ডাক্তারের ঘরে বসে সকলে মিলে তাঁরই হাতে তৈরী কফি পান করছিলাম। কাজেই বুঝতে পারছেন, তিনি কিছু আর ম্যাজিকের দ্বারা নিজেকে অদৃশ্য করে কিংবা আমাদের hypnotise করে আমাদের চোখের সামনেই সে ঘর থেকে বের হয়ে এসে আপনাকে কফি দিয়ে যেতে পারেন না!
সুলতারও বিস্ময়ের যেন অবধি থাকে না। বিস্মিত ব্যাকুল কণ্ঠে সে বলে ওঠে, কিন্তু বিশ্বাস করুন মিঃ রায়, আমি বলছি সত্যিই তিনি গত রাত্রে কফি দিয়ে গিয়েছিলেন আমাকে নিজে এসে অন্যান্য দিনের মত।
বা দেননি, তবু আপনি যখন বলছেন—আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, সেটা আপনার দেখবার ভুল সুলতা দেবী।
দেখবার ভুল!
হ্যাঁ। বা এমনও হতে পারে, আপনি আদৌ ভাল করে দেখেননি চেয়ে কে গত রাত্রে আপনাকে কফি দিয়ে গেল—মানে হয়ত অন্যমনস্ক ছিলেন কোন রকম!
তবে—একটা ভয়ার্ত শঙ্কিত দৃষ্টি সুলতার দু চোখের তারায় ফুটে উঠল।
হ্যাঁ, এ-কথা অবিশ্যি সত্যি একজন কেউ এসে গত রাত্রে কফি দিয়ে গিয়েছেন, তিনি অবিকল ডাঃ সানিয়ালের মত দেখতে হলেও আসল ডাঃ সানিয়াল নন। অন্য কেউ। কিন্তু কে সে? সেই-ই হচ্ছে প্রশ্ন—শেষের কথাটা কিরীটী যেন আত্মগত ভাবেই উচ্চারণ করে কতকটা।
আপনার কথা যে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না মিঃ রায়। তিনি ডাক্তারের মত দেখতে, অথচ তিনি নন!
বললাম তো একটু আগে আপনাকে, এ বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কথা নয়, নিষ্ঠুর সত্য যা ঘটেছিল কাল রাত্রে তাই বলেছি আপনাকে আমি। আচ্ছা এবারে আপনি বাড়ি যেতে পারেন মিস কর।
বাড়ি যাব?
হ্যাঁ। প্রয়োজন হলে আমরাই দেখা করব। কেবল এই জায়গা ছেড়ে পুলিসের বিনা অনুমতিতে কোথাও আপাততঃ যাবেন না।
সুলতা নিঃশব্দে শ্লথ গতিতে কক্ষ থেকে বের হয়ে গেল।
.
ধীরে ধীরে সুলতা করের পায়ের শব্দটা বারান্দায় একসময় মিলিয়েও গেল।
সুলতার সঙ্গে কথা বলতে বলতে কখন যে এক সময় হাতের সিগারটা নিভে গিয়েছে কিরীটীর খেয়ালও হয়নি। আবার নিবাপিত সিগারটায় অগ্নিসংযোগ করে হাতের দেশলাইয়ের কাঠিটা ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে ঘরের কোণে ছুঁড়ে ফেলে দিল।
নেহাৎ একটা অনুমানের ওপর একান্তভাবে নির্ভর করে কিরীটী সুলতাকে প্রশ্ন করেছিল ঐভাবে এবং অকস্মাৎ তার হাতের মধ্যে একটি মূল্যবান সূত্র (clue) এসে গেল।
সুলতাকে প্রশ্ন করতে করতে এবং তার জবাবের পর কিরীটীর এখন আর বুঝতে আদৌ কষ্ট হয় না যে গত দশদিন ধরে ডাঃ সানিয়লের পরামর্শ ও উপদেশ মতই সুলতা রাত্রে নিদ্রাকে এড়াবার জন্য কফি পান করছিল এবং হত্যাকারী যে উপায়েই হোক সেই কথাটি জানতে পেরে পূর্বাহ্নে সেই সুযোগটি চমৎকার কৌশলের সঙ্গে কাজে লাগিয়েছে। অপূর্ব চাতুর্যের সঙ্গেই সে নির্দিষ্ট একটি সময়ের পরিপূর্ণ ভাবেই সুযোগ নিয়েছে। ভাবতেও বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যেতে হয় কি অসাধারণ বুদ্ধিচাতুর্য দুঃসাহস ও ক্ষিপ্রতার পরিচয় সে দিয়েছে এক্ষেত্রে।
আর রায়বাহাদুর যদি সত্যিই তা সে যে ভাবেই হোক, জেনে থাকেন তাঁর এই মৃত্যুর ব্যাপারটা, তারপর তাঁকে ঠিক পূর্বাহ্নে এভাবে জ্ঞাত করে কেউ যে এমনভাবে পরিকল্পনানুযায়ী হত্যা করতে পারে এ যেন কিরীটীর স্বপ্নেরও অতীত।
কিন্তু সুলতা কর, তার কথাগুলো কি সত্যিই বিশ্বাসযোগ্য?
সত্যি কি সুলতা কর গত রাত্রের কফি পরিবেশনকারীকে চিনতে পারেনি, না ইচ্ছে করেই অর্থাৎ কথাটা জেনেও গোপন করে গেল?
.
মনে মনে কিরীটী গত রাত্রের ব্যাপারটা আর একবার পর্যালোচনা করে। রায়বাহাদুর ঘরের যে অংশে রোগশয্যায় শায়িত ছিলেন সেখানে নীল বাতিটা ডোমে ঢাকা থাকার দরুণ স্থানটি তেমনি সুস্পষ্ট ভাবে আলোকিত ছিল না। ঘরের অন্য অংশ হতে সেই স্থানটি একটা ভারি কালো পর্দা টাঙিয়ে ব্যবধানের সৃষ্টি করা হয়েছিল এবং যে সময় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়—ঘরের মধ্যে অসুস্থ, ওষুধের প্রভাবে নিদ্রিত, রায়বাহাদুর ও পার্শ্বে একটি চেয়ারে ঐ একই ভাবে ওষুধের প্রভাবে নিদ্রিত নার্স সুলতা কর ব্যতীত আর কোন তৃতীয় প্রাণীই অকুস্থানে ছিল না। এবং রাত্রি সাড়ে তিনটে হতে চারটে বাজবার মধ্যে যে আধ ঘণ্টা সময়, ঐ সময়ের মধ্যেই কোন এক মুহূর্তে কৌশলে সুলতা করকে ঘুম পাড়াবার জন্য ঘুমের কোনো তীব্র ওষুধ-মিশ্রিত কফি পান করানো হয়েছিল তার অজ্ঞাতেই। তারপর নিশ্চয়ই সুলতার কফি পানের পর নিদ্রাভিভূত হতে অন্ততঃ মিনিট দশ-বারো সময় তো লেগেছে। তাহলে বাকি থাকে কেবল হিসেবমত ঐ আধ ঘণ্টার মধ্যে মিনিট পনের, যে সময়ের মধ্যে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে।
মাত্র পনের মিনিট সময়। এবং গতরাত্রের ঐ পনের মিনিট সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময় তদন্তের ব্যাপারে। কাজেই এখন খোঁজখবর নিয়ে দেখতে হবে ঐ পনের মিনিট সময়ে অর্থাৎ রাত্রি পৌনে চারটে থেকে রাত্রি চারটে পর্যন্ত এই বাড়ির সকলে কে কোথায় কোন অবস্থায় ছিল। ঐ পনের মিনিট সময়ের মধ্যেকার প্রত্যেকের গতিবিধি চেক করা একান্ত প্রয়োজন। কারণ স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে যে, ঐ পনের মিনিট সময়ের মধ্যেকার প্রত্যেকের গতিবিধি বা অবস্থানই বর্তমানে এই হত্যা-ব্যাপারের রহস্যোদঘাটনে সর্বাপেক্ষা মূল্যবান সূত্র।
১২. কিরীটী পকেট থেকে তার নোট বুকটা
কিরীটী পকেট থেকে তার নোট বুকটা বের করল এবংনিম্নলিখিত কথাগুলো মনে মনে পর্যালোচনা করে এক, দুই, তিন ক্রমিক নম্বর দিয়ে পর পর লিখে যেতে লাগল।
১। রায়বাহাদুর যে গতরাত্রে ঠিক চারটের সময় নিহত হবেন সেটা তিনি অন্ততঃ এখন বোঝা যাচ্ছে জানতেন।
[টীকা: তাঁর এরূপ বদ্ধমূল ধারণা হওয়ার সত্যি কোন কারণ ছিল কি? না ডাক্তার যা বলছেন ব্যাপারটা সম্পূর্ণ একটা hallucination—তাই? এবং তা যদি হয় তাহলে কেন হল ঐ রকম একটা hallucination এবং তার কারণ কি?]
২। ধারণা থেকে আর যাই হোক রাত্রি পৌনে চারটে থেকে চারটের মধ্যে যে তিনি নিহত হয়েছেন এ স্বতঃসিদ্ধ।
[টীকা: কাজেই ব্যাপারটা যেখানে স্বতঃসিদ্ধ সেখানে hallucination-এর theory কতদুর প্রযোজ্য?]
৩। ঐ পনের মিনিট সময়ের মধ্যে বাড়ির প্রত্যেকেই কে কোথায় ছিল এবং কে কি অবস্থায় ছিল?
[টীকা : প্রত্যেকের জবানবন্দি কি বিশ্বাসযোগ্য? গান্ধারী দেবীর জবানবন্দির মধ্যে প্রায় সবটাই মিথ্যে। তিনি জেগেই ছিলেন এবং কেন ছিলেন? জেগে থাকবার কি তাঁর কোন কারণ ছিল?]
৪। ঐ সময় গান্ধারী দেবীর শয়নঘরের পাশের ঘরে রুচিরা কি করছিল?
[টীকা: যতদুর মনে হচ্ছে ঐ সময় কেউ না কেউ তার ঘরে এসেছিল। কে তার ঘরে এসেছিল? সমীরবাবু কি?]।
৫ রুচিরা ও সমীরবাবুর মধ্যে সত্যিকারের কোন ভালবাসা ও understanding আছে কি?
[টীকা: সম্ভবতঃ পরস্পর পরস্পরকে ভালবাসে না। গান্ধারী দেবীর কথাবাতা থেকেই সেটা কিছু প্রমাণিত হয়েছে। আরও বিশদ আলোচনার প্রয়োজন। একটা ব্যাপারে কেমন
যেন সন্দেহ হয়। ডাঃ সমর সেনকে দেখে রুচিরা অমন করে তাকিয়ে ছিল কেন?]
৬৷ ঐ পনের মিনিট সময়ের মধ্যে কে সুলতা করকে কফি দিতে এসেছিল সত্যি সত্যি? সুলতা বলছে অবিশ্যি ডাঃ সানিয়ালই তাকে কফি দিতে এসেছিলেন। কিন্তু তা অসম্ভব। কারণ ডাঃ সানিয়াল তখন তার ঘরেই ছিল। তাই যদি হয় তাহলে কে ডাঃ সানিয়ালের ছদ্মবেশে তাকে গতরাত্রে কফি দিতে গিয়েছিল? আর ছদ্মবেশধারীকে সুলতা কর চিনতেই বা পারল না কেন? না চেনবার তো কথা নয়। ডাক্তারকেও একবার কথাটা জিজ্ঞাসা করা প্রয়োজন।
[টীকা: বিশেষ উল্লেখযোগ্য এবং প্রধান সূত্র।]
৭। হত্যার ব্যাপারে এ বাড়ির কার কার interest থাকা সম্ভব।
[টীকা: বলতে গেলে রায়বাহাদুরের আত্মীয়দের মধ্যে প্রত্যেকেরই। কিন্তু তাহলেও কার ওদের মধ্যে interest সর্বাপেক্ষা বেশী ছিল বা থাকতে পারে। দ্বিতীয় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সূত্র।]
৮৷ রায়বাহাদুরের সত্যি কোন উইল আছে কি?
[টীকা: থাকাটাই সম্ভব। তবে হয়ত এখন আর পাওয়া যাবে না খুঁজে।]
৯। শকুনি ঘোষের ঘরের মধ্যে প্রাপ্ত কাপড়ের মধ্যে রক্তের দাগ ছিল। রক্ত কোথা থেকে এল তার সেই পরিত্যক্ত পরিধেয় বস্ত্রে এবং সেই বস্ত্র সিক্তই বা ছিল কেন?
[টীকা: রক্তের কেমিক্যাল অ্যানালিসিস করে দেখতে হবে।]
১০৷ গান্ধারী দেবী শকুনির নিকট কাকে এই হত্যার ব্যাপারে সন্দেহ করেন বলতে এসেছিলেন, এবং ঘরের মধ্যে তাকে দেখতে পেয়ে ব্যাপারটা চেপে গেলেন।
[টীকা: বিশেষ উল্লেখযোগ্য তৃতীয় সূত্র।]
.
বর্তমানে সর্বাগ্রে এই দশটি পয়েন্টের মীমাংসার একটা আশু প্রয়োজন। ঐ পয়েন্টগুলোর একটা সুমীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত রায়বাহাদুরের হত্যার ব্যাপারটা একটা রহস্যের অন্ধকারে অস্পষ্টই থেকে যাবে।
কিরীটী চিন্তা করতে থাকে—এখন কোন পথে অগ্রসর হওয়া যায়।
বাইরে ঐ সময় জুতোর শব্দ পাওয়া গেল। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দুঃশাসন চৌধুরী ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করলেন।
কিরীটীর দুঃশাসন চৌধুরীর মুখের দিকে চেয়ে মনে হয়, এক রাত্রের শেষের দিকের মাত্র কয়েক ঘণ্টা সময়ের মধ্যেই যেন ভদ্রলোকের মনের মধ্যে একটা ঝড় বয়ে গিয়েছে। চোখে মুখে একটা সুস্পষ্ট ক্লান্তির ও দুশ্চিন্তার আভাস যেন স্পষ্ট।
আসুন মিঃ চৌধুরী। কিরীটী আহ্বান জানায়, বসুন।
নির্দিষ্ট চেয়ারটার ওপর বসতে বসতেই ক্লান্ত অবসন্ন কণ্ঠে দুঃশাসন চৌধুরী বললেন, ব্যাপারটা কি হল বলুন তো মিঃ রায়? শেষ পর্যন্ত দাদার অনুমানই সত্য হল নাকি? সত্যি কথা বলতে কি মিঃ রায়, আমি যেন এখনও ঠিক ব্যাপারটার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।
আপনি এসেছেন মিঃ চৌধুরী ভালই হল। পুলিসের সমস্ত ব্যাপারটা পুরোপুরি হাতে নেওয়ার আগে আমি আপনাদের সকলের সঙ্গে আর একবার খোলাখুলি আলোচনা করব ভেবেছিলাম।
বলুন কি জানতে চান! আর সত্যি কথা বলতে কি মিঃ রায়, আমি যেন সত্যিই puzzled হয়ে আছি।
পাজল শুধু আপনিই নন দুঃশাসনবাবু, প্রত্যেকেই হয়েছেন।
আচ্ছা আপনার এ ব্যাপারে কি ধারণা বলুন তো মিঃ রায়?
সে কথা বলবার আগে একবার আপনাদের প্রত্যেকের সঙ্গেই আমি আলোচনা করে নিতে চাই। দালাল সাহেব বিকেলেই আসবেন বলে গেছেন। তাঁর আসবার আগেই এ ব্যাপারটা আমি শেষ করে দিতে চাই।
বলুন আমাকে কি করতে হবে?
প্রত্যেকের সঙ্গে আমি আলাদা আলাদা ভাবে আলোচনা করব। এবং আপনাকেই সেই। ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
বেশ।
অনুগ্রহ করে তাহলে পনের মিনিট বাদে ডাঃ সানিয়ালের ঘরে এলে আমি খুশি হব।
বেশ তাই হবে।
দুঃশাসন চৌধুরী অতঃপর ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন কেমন শ্লথ ক্লান্ত পায়ে।
কিরীটীর মনে হয়, হঠাৎ দুঃশাসন চৌধুরী তার ঘরে কেন এসেছিলেন? কোন কথা বলতে কি?
কি কথা?
দুঃশাসন চৌধুরী কি কিছু জানেন এবং জেনে বিশেষ কারণেই সেটা গোপন করে যাচ্ছেন? লোকটা ধূর্ত নিঃসন্দেহে এবং বময় নিজের ব্যবসা গুটিয়ে বাংলা মুলুকে চলে এসেছেন—শুধু মাত্র কি রায়বাহাদুরের অনুরোধেই, না অন্য কোন কারণে?
১৩. ডাঃ সানিয়ালের ঘরে বসেই
ডাঃ সানিয়ালের ঘরে বসেই কিরীটী অপেক্ষা করছিল এবং মিনিট পনের-কুড়ি বাদেই দুঃশাসন চৌধুরী সেই ঘরের মধ্যে এসে প্রবশ করলেন।
কিরীটী আহ্বান জানায়, আসুন, বসুন।
দুঃশাসন চৌধুরীর জবানবন্দি।
কিরীটী প্রশ্ন করছিল এবং দুঃশাসন চৌধুরী জবাব দিচ্ছিলেন।–
সর্বপ্রথম একটা কথা আপনার সম্পর্কে আমার জানা প্রয়োজন মিঃ চৌধুরী।
বলুন?
আপনি গতকাল রাত্রে বলেছেন মৌচীতে আপনার মাইকার ব্যবসা ছিল এবং আপনি সে ব্যবসা আপনার দাদা রায়বাহাদুরের ইচ্ছেয় তুলে দিয়ে এখানে চলে এসেছিলেন গত কয়েক মাস হল, তাই তো?
হ্যাঁ।
সেখানে আপনার ব্যবসা কেমন চলছিল?
ভালই।
কিছু মনে করবেন না, যখন ব্যবসা তুলে দিয়ে এখানে চলে আসেন তখন হাতে আপনার liquid cash কত ছিল?
প্রশ্নটা দাদার হত্যার ব্যাপারে একান্তই অবান্তর নয় কি মিঃ রায়? দুঃশাসনের কণ্ঠস্বরটা একটু উগ্র বলেই মনে হয় যেন কিরীটীর।
অবান্তর হলে অবশ্যই এ প্রশ্নটা আপনাকে আমি করতাম না মিঃ চৌধুরী।
কিন্তু যদি জবাব না দিই?
অবশ্য জবাব দেওয়া-না দেওয়াটা আপনার একান্ত ইচ্ছাধীন, তবে আমার প্রশ্নের জবাবটা দিলে কিছুটা সন্দেহের হাত থেকে আপনি নিষ্কৃতি পেতেন।
সন্দেহ! কি বলতে চান আপনি?
বলতে চাই যে, আমার ধারণা রায়বাহাদুরের হত্যাকাণ্ডটা সম্পূর্ণ অর্থঘটিত। অর্থই অনর্থ ঘটিয়েছে।
আপনি তাহলে বলতে চান যে, সম্পত্তির লোভেই দাদাকে কেউ হত্যা করেছে?
নিশ্চয়ই। হঠাৎ কঠোর শোনায় যেন কিরীটীর কণ্ঠস্বরটা।
কয়েকটা মুহূর্ত অতঃপর দুঃশাসন চৌধুরী চুপ করে থাকেন। তারপর বলেন, আমাকেও কি তাহলে আপনি ঐদিক দিয়েই সন্দেহ করছেন মিঃ রায়?
শুধু আপনাকেই নয় মিঃ চৌধুরী, এ বাড়ির প্রত্যেককেই—এখানে গতরাত্রে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, বিশেষ করে নিহত রায়বাহাদুরের আপনারা আত্মীয়-স্বজনের দল সে সন্দেহের দিক থেকে নিষ্কৃতি পাচ্ছেন না পুলিসের বিচারে বা বিশ্লেষণে।
কিন্তু আপনি!
আমিও ঐ কথাই বলব।
বলছেন কি? তাহলে আপনার কি ধারণা আমরাই, দাদার আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে কেউ-না-কেউ দাদাকে হত্যা করেছি অর্থের লোভে কাল রাত্রে?
অতীব দুঃখের সঙ্গে অপ্রিয় ভাষণ আমাকে করতে হচ্ছে মিঃ চৌধুরী, আপনার অনুমানই সত্য।
মুহূর্তকাল দুঃশাসন চৌধুরী চুপ করে যেন কতকটা হতভম্বের মতই বসে রইলেন। তাঁর বাকশক্তি যেন লোপ পেয়েছে। কিরীটীও চুপ করে বসে থাকে।
হঠাৎ আবার দুঃশাসন চৌধুরীই প্রশ্ন করলেন, তাহলে আমাকেও আপনি দাদার হত্যাকারী বলে সন্দেহ করছেন?
তার আগে আমি জিজ্ঞাসা করি, এ ব্যাপারে আপনি কি কাউকে সন্দেহ করেন?
কিরীটীর প্রশ্নটা যেন অতর্কিতে দুঃশাসন চৌধুরীকে একটা নাড়া দিল। কতকটা হতচকিত ও বিহ্বল কণ্ঠেই দুঃশাসন চৌধুরী জবাব দেন, আমি!
হ্যাঁ। আপনার কি কারও ওপর সন্দেহ হয়?
না। একটু ইতস্ততঃ করেই জবাবটা দিলেন দুঃশাসন চৌধুরী।
আচ্ছা আপনার দাদার কোন শত্রু ছিল বলে আপনার মনে হয়?
বলতে পারি না।
ইদানীং কিছুকালের মধ্যে বা পূর্বে আপনার দাদার সঙ্গে এ বাড়ির কারও কোন মনোমালিন্যের কোন কারণ ঘটেছিল বা ছিল বলতে পারেন?
তেমন কিছু বলতে পারি না। তবে এক মধ্যে মধ্যে শকুনির সঙ্গে দাদার খিটিমিটি হত। তাছাড়া আর কারও সঙ্গে কিছু শুনিনি। একটা কথা অবিশ্যি—ইদানীং দাদা তো সকলের প্রতিই বীতরাগ হয়ে উঠেছিলেন।
শকুনিবাবুর সঙ্গে খিটিমিটি হবার কারণ কি? জানেন কিছু?
বলবেন না ওটার কথা। একটা হতচ্ছাড়া scoundrel। ঐ যে বাড়িতে দাদার নোগশয্যার পাশে নার্স দেখেছেন—ঐ মেয়েটাকে শকুনি বিয়ে করতে চায়। এক পয়সার মুরোদ নেই, মামাদের ঘাড়ে বসে খাবে, তার ওপরে বিয়ের শখ বাবুর!
কেন, শকুনিবাবু কি কিছু করেন না?
আড্ডা দেওয়া ছাড়া কিছু করে বলে তো জানি না। যেমন হয়েছেন আমাদের কাকা সাহেবটি তেমনি ঐ হতচ্ছাড়া বোম্বেটে শকুনিটা। একজন বসে বসে বাঈজী আর মদে টাকা উড়োচ্ছন, আর একজন ক্লাব থিয়েটার আর আড্ডাবাজি করে টাকা উড়োচ্ছন।
কিন্তু আমি যতদূর রায়বাহাদুরের সঙ্গে কথাবার্তা বলে বুঝেছিলাম, আপনাদের কাকা অবিনাশবাবুর প্রতি রায়বাহাদুরের কোন বিতৃষ্ণা বা বিরাগ ছিল বলে তো মনে হয়নি।
ঐ তো হয়েছিল মুশকিল! একটা অসম্ভব faith ছিল কাকার প্রতি দাদার, এবং দাদা ওঁকে বরাবরই প্রশয়ই দিয়েছে।
হুঁ। কিরীটী অতঃপর কিছুক্ষণ আত্মচিন্তাতেই বোধ হয় বিভোর হয়ে থাকে।
আবার প্রশ্ন শুরু করে কিরীটী।
আপনি কাল রাত্রি সাড়ে তিনটে থেকে আপনার দাদার হত্যাসংবাদ পেয়ে দাদার ঘরে আসবার আগে রাত চারটে পর্যন্ত সময়টা কোথায় ছিলেন?
নিজের ঘরে জেগেই ছিলাম।
কেন, আপনি তো ঘুমের ওষুধ খেয়েছিলেন, তাতেও আপনার ঘুম হয়নি?
না।
আর একটা কথা, আপনি ডাঃ সানিয়ালের ঘরে কাল রাত্রে যখন ঘুমের ওষুধ চাইতে আসেন, তখন বলেছিলেন গত এক মাস ধরে আপনি এ বাড়িতে আসা অবধি নাকি অনিদ্রা রোগে ভুগছেন, আবার দালাল সাহেবের কাছে কিছুক্ষণ পরেই জবানবন্দিতে বললেন, মাত্র দশদিন আপনি এখানে এসেছেন। কোন্ কথাটা আপনার সত্যি?
দুটোই সত্যি। স্থির কণ্ঠে দুঃশাসন চৌধুরী বললেন।
কি রকম? বিস্মিত দৃষ্টিতে কিরীটী চৌধুরীর মুখের দিকে তাকাল।
মাসখানেক হল আমি বম থেকে এখানে এসে পৌঁছেছি এবং এই জায়গায় থাকলেও এ বাড়িতে ঠিক আমি ছিলাম না।
কি রকম?
এখান থেকে মাইল পনের দূরে আমাদের একটা কোলিয়ারিতে গোলমাল চলছিল, এখানে। এসে পৌঁছবার পরই সেখানে আমাকে দাদা অসুস্থ বলে তার নির্দেশে চলে যেতে হয়। এই সবে সেখান থেকে দিন দশেক হল এই বাড়িতে ফিরে এসেছি।
কিরীটী দুঃশাসন চৌধুরীর জবাবে কিছুক্ষণ চুপ করে কি যেন ভাবে, তারপর আবার তাঁর মুখের দিকে চেয়ে প্রশ্ন শুরু করে, দালাল সাহেবের কাছে জবানবন্দিতে আপনি রুচিরা দেবীর কথায় অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেছেন, আপনি রায়বাহাদুরের নিহত হওয়ার সংবাদটা নাকি তাঁকে আদৌ দেননি। অথচ রুচিরা দেবী জোর দিয়ে বলছেন—
সে মিথ্যে কথা বলছে। আমি কেবল বৃহন্নলাকে সংবাদটা দিয়েছিলাম।
হুঁ। আচ্ছা রায়বাহাদুরের ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে যে ভৃত্যটিকে আপনি দেখেছিলেন তার নাম কি?
কৈরালাপ্রসাদ।
কতদিন সে এখানে আছে?
দাদার খাসভৃত্য, শুনেছি বছর পাঁচেক সে এ বাড়িতে কাজ করছে, ইদানীং রোগীর ঘরের যাবতীয় ফাইফরমাশই সে খাটত।
লোকটা বিশ্বাসযোগ্য নিশ্চয়ই?
হ্যাঁ, সেই রকমই তো মনে হয়।
আচ্ছা আপনি যদি রুচিরা দেবীকে সংবাদটা না দিয়ে থাকেন, তাঁকে কে ঐ সংবাদটা দিতে পারে বলে আপনার মনে হয়?
বলতে পারি না।
আপনি কি বিয়ে করেছেন?
কিরীটীর প্রশ্নটা যেন অত্যন্ত অতর্কিত ভাবেই আসে। এবং প্রশ্নের জবাবটা সঙ্গে সঙ্গে না দিয়ে একটু যেন ইতস্ততঃ করেই দুঃশাসন চৌধুরী বললেন, না।
আর একটি কথা মিঃ চৌধুরী, রায়বাহাদুরের যে বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিল গতকাল রাত ঠিক চারটের সময়ই তাঁর মৃত্যু হবে বা কেউ তাঁকে হত্যা করবে—এ ধরণের বদ্ধমূল ধারণা হবার কোন কারণ ছিল বলে আপনি জানেন কিছু?
না। সত্যি কথা বলতে কি মিঃ রায়, ব্যাপারটাকে তো আমি শোনা অবধি হাস্যকর বলেই কোন গুরুত্ব দিইনি গোড়া থেকেই।
আচ্ছা আপনি এবার যেতে পারেন। বৃহন্নলা চৌধুরীকে একটিবার পাঠিয়ে দিন এ ঘরে।
১৪. বৃহন্নলা চৌধুরী ও কিরীটীর মধ্যে কথাবার্তা
বৃহন্নলা চৌধুরী ও কিরীটীর মধ্যে কথাবার্তা হচ্ছিল।
গতরাত্রে রায়বাহাদুরের নিহত হবার সংবাদ পেয়েই আমি যখন রায়বাহাদুরের ঘরের মধ্যে প্রবেশ করি, সেখানে আপনার কাকা ও আপনাকে আমি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম। কিন্তু একটু পরে লক্ষ্য করে দেখি আপনি ঘরে নেই। হঠাৎ ঘর থেকে চলে গিয়েছিলেন কোথায় আর কেনই বা গিয়েছিলেন!
আমার ঘরে কাকা যখন আমার শোবার ঘরে গিয়ে বাবার নিহত হবার সংবাদটা দেন আমি একেবারে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। তারপর কাকার সঙ্গে সঙ্গেই বাবার ঘরে গিয়ে ঢুকি কিন্তু পরে ঐ ভীষণ দৃশ্য দেখেই সমস্ত মাথাটা যেন কেমন আমার বোঁ বোঁ করে হঠাৎ ঘুরে উঠল। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। তাড়াতাড়ি আবার ঘর থেকে বের হয়ে যাই, তারপর আবার দালাল সাহেব ডেকে পাঠাতে ফিরে আসি।
রাত্রি সাড়ে তিনটে থেকে আপনার কাকা আপনাকে ডাকতে যাওয়া পর্যন্ত আপনি কি করছিলেন?
গতকালই তো আমি বলেছি, শরীরটা আমার বিশেষ ভাল না থাকায় সন্ধ্যে থেকেই প্রায় আমি আমার ঘরেই ছিলাম। বিছানাতেই শুয়ে ছিলাম, তবে ঠিক ভাল ভাবে ঘুমোইনি। একটা আধো ঘুম আধো জাগা অবস্থা।
একটা কথা বৃহন্নলাবাবু, আপনি কি সত্যিই আপনার বাবার কোন উইল আছে বলে জানেন?
যতদূর জানি বাবার কোন উইল নেই। আর থাকলেও আমার সেটা জানা নেই মিঃ রায়।
আপনি বলতে পারেন, আপনার কাকা দুঃশাসন চৌধুরীর প্রতি আপনার বাবার ঠিক মনোগত ভাবটা কেমন ছিল?
কিরীটীর প্রশ্নে স্পষ্টই বোঝা গেল বৃহন্নলা চৌধুরী যেন একটু ইতস্ততই করছেন। জবাবটা দিতে কেমন যেন একটু সংকোচ ও দ্বিধা বোধ করছেন।
অবশ্য আপনি যতটুকু জানেন, ততটুকুই আমি জানতে চাই আপনার কাছ থেকে বৃহন্নলাবাবু!
কাকা তো মাত্র মাসখানেক হল ফিরে এসেছেন। এই সময়ের মধ্যে তেমন বিশেষ কিছু আমার চোখে পড়েছে বলে তো কই আমার মনে পড়ছে না। তবে ইতিমধ্যে কাকা এখানে আসবার পরই একদিন রাত্রে, জানি না কি কারণে বাবা ও কাকা দুজনের মধ্যে একটা বচসা ও কথা-কাটাকাটি হয়েছিল এবং পরদিন সকালেই এখান থেকে মাইল পনের দূরে একটা কোলিয়ারীতে কাকা চলে যান।
সে বচসার বিষয়বস্তুটা কি ছিল কিছুই জানেন না?
না।
সে ঘরে আর কেউ ছিল?
না।
আপনি সে কথা জানলেন কি করে?
কি একটা স্টেটের কাজেই এ সময় বাবার ঘরের দিকে যাচ্ছিলাম। দরজার কাছাকাছি যেতেই শুনলাম কাকা খুব যেন রাগত ভাবেই চেঁচিয়ে কথা বলছেন।
শুনতে পেয়েছিলেন তাঁর কোন কথা? মনে করে বলতে পারেন কিছু?
হ্যাঁ, একটা কথা কেবল শুনতে পেয়েছিলাম, কাকা বলছিলেন, এ তোমার অত্যন্ত অন্যায়। এভাবে বঞ্চিত করবার তোমার কোন আইনগত অধিকার নেই জানবে। তার পরই কাকা দেখলাম ঘর থেকে দ্রুত চঞ্চল পদেই যেন বের হয়ে গেলেন। বাবার ঘরে ঢুকে দেখি বাবাও যেন তখন বেশ উত্তেজিত, কিন্তু তাঁর সঙ্গে ঐ সম্পর্কে আমার কোন কথাই হয়নি সে-সময়ে।
হুঁ। আপনার প্রতি আপনার কাকার মনোগত ভাবটা তত ভাল বলেই মনে হল, তাই না?
হ্যাঁ, কাকা আমাকে চিরদিনই একটু বেশী স্নেহ করেন। বিদেশে থাকাকালীন একমাত্র আমার কাছেই তিনি যা চিঠিপত্র মধ্যে মধ্যে দিতেন।
মৌচীর মাইকার বিজনেস তুলে দিয়ে বাঙলাদেশে ফিরে আসবার জন্য আপনার কাকাকে শুনলাম আপনার বাবাই নাকি পীড়াপীড়ি করেছিলেন, কথাটা সত্যি।
হ্যাঁ। বাবা কাকাকে একমাত্র ভাই বলে চিরদিনই বিশেষ একটু স্নেহ করতেন। কাকার বিদেশ যাওয়াটা শুনেছিলাম বাবার অমতেই হয়েছিল।
বিদেশ যাওয়ার আপনার কাকার কোন কারণ ছিল বলে জানেন?
বিদেশ যাওয়ার আগে কাকা বাবার ব্যবসাতেই কাজ করতেন। তারপর সঠিক আমি জানি না আসল ব্যাপারটা কি, তবে মনে হয় ব্যবসা-সংক্রান্ত ব্যাপারেই বোধহয় কি একটা গোলমাল হয়। তারপরই কাকা বাবার কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে মৌচীতে তাঁর এক বন্ধু মাইকার বিজনেস করছিলেন সেই বিজনেসে গিয়ে যোগ দেন। এবং শুনেছি ব্যবসাতে নাকি তাঁর খুব উন্নতি হয় এবং যথেষ্ট অথগমও হতে থাকে।
একটা কথা, আশা করি কিছু মনে করবেন না বৃহন্নলাবাবু, আপনার কাকার বর্তমান আর্থিক অবস্থাটা কেমন বলতে পারেন?
সঠিক আমি জানি না, তবে নগদ টাকা বেশ কিছু তাঁর হাতে আছে বলেই আমার তো ধারণা।
কেন আপনার এ ধারণা—বলতে আপনার আপত্তি আছে কি কিছু?
এখানে এসে অবধিই তিনি আমাকে প্রায়ই বলেছেন কোডামতে আবার তিনি মাইকার বিজনেস বড় করেই শুরু করবেন। ইতিমধ্যে দুএকবার কোমায় গিয়ে ঘুরেও এসেছেন।
আচ্ছা আপনি আপনার পিতার হত্যার ব্যাপারে কাউকে সন্দেহ করেন কি?
না। ধীর সংহত কণ্ঠে জবাব দিলেন বৃহন্নলা চৌধুরী।
আপনি এবারে যেতে পারেন মিঃ চৌধুরী। আপনার দাদু অবিনাশবাবুকে যদি এ ঘরে একবার দেখা করতে আসতে বলি, আসবেন কি?
যদি মনে কিছু না করেন মিঃ রায়, আমার মনে হয় যদি তাঁকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে চান তাহলে তাঁর ঘরে গেলেই বোধ হয় ভাল হয়, কারণ তাঁকে ডাকলে যে তিনি আসবেন আমার তো মনে হয় না।
ডাঃ সানিয়ালের ঘর থেকে বের হয়ে ডাঃ সমর সেন কতকটা অন্যমনস্ক ভাবেই সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হন। কিন্তু অন্যমনস্ক ভাবে—সিঁড়ি যেখানে বাঁক নিয়েছে, সেখানে এসে পৌঁছতেই যেন হঠাৎ চমকে ওঠেন।
ঠিক সামনেই তাঁর দাঁড়িয়ে রুচিরা। বোধ হয় নীচে গিয়েছিল। সেই সময় সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে আসছিল।
রুচিরা!
রুচিরা ডাঃ সেনের ডাকে মুখ তুলে তাঁর দিকে তাকায় একটু যেন চমকেই।
তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল রুচিরা।
নীচে বাইরের ঘরে এস।
চল।
রুচিরাকেই অতঃপর অনুসরণ করে ডাঃ সেন পূর্বরাত্রের সেই নীচেকার বিরাট খালি ঘরটার মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করলেন।
কাল রাত্রে দেখা গিয়েছিল ঘরের জানলা-দরজাগুলো বন্ধ, কিন্তু আজ দেখা গেল জানলাগুলো খোলা। একটা খোলা জানালার সামনে দুজন এসে দাঁড়ায়।
রুচিরাই প্রথমে কথা বলে মৃদু হেসে, তোমাকে কাল রাত্রে বাড়িতে দেখেও কেন না চেনবার ভান করেছি তাই জিজ্ঞাসা করবে তো?
হ্যাঁ, তাছাড়া—
তাছাড়া আবার কি?
তাছাড়া সমীরবাবুর সঙ্গে যে অলরেডি তোমার বিয়ের সম্বন্ধ ঠিক হয়ে গেছে সেইটাই বা এতদিন জানাওনি কেন?
রুচিরা ডাঃ সেনের কথার জবাব দেয় না। চুপ করেই থাকে।
ডাঃ সেন আবার বলেন, এইজন্যই যে এতদিন বার বার তোমার কাছে প্রোপোজ করা সত্ত্বেও আমায় কোন জবাব দাওনি তাও বুঝলাম, কিন্তু এর তো কোন প্রয়োজন ছিল না। রুচিরা!
রুচিরা তথাপি চুপ।
কি, জবাব দিচ্ছ না যে?
যে জবাবই এখন দিই না কেন, তুমি তো বিশ্বাস করবে না সমর।
বিশ্বাস করব না!
না। তারপর একটু থেমে আবার বলে, কার কাছে তুমি কি শুনেছ তা জানি না, তবে আমি ভেবেছিলাম তুমি অন্ততঃ আমাকে এতদিনে বুঝতে পেরেছ।
হ্যাঁ, বুঝেছি বৈকি। বড়লোক স্বামীর লোভ তুমি ছাড়তে পারনি বলেই গরীব আমাকে নিয়ে তুমি এতদিন ধরে খেলা খেলছ!
সমর!
হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই। কিন্তু এর কি প্রয়োজন ছিল বলতে পার রুচিরা দেবী?
তোমার আর কোন কথা যদি না থাকে তো এবারে আমি যাব!
যাবে বৈকি। খেলাটা যখন জানতে পেরে গেছি–
সমর সেনের কথাটা শেষ হল না, ঘরের মধ্যে কিরীটীর গলা শোনা গেল, সমরবাবু!
দুজনেই চমকে অদূরে উপস্থিত কিরীটীর দিকে তাকায়। কিরীটী যে ইতিমধ্যে নিজের ঘর থেকে বেরুবার মুখে সিঁড়ির সামনে ওদের দূর থেকে দেখে একেবারে কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে ওদের কথাগুলো শুনেছে সেটা দুজনের একজনও টের পায়নি।
কিরীটী অতঃপর বলল, আপনারা দুজনেই একটু ভুল বুঝেছেন দুজনকে। ডাঃ সেন, আপনার এটা অন্ততঃ বোঝা উচিত ছিল যে রুচিরা দেবীর মা এখানে বর্তমান!
আমি জানি তা মিঃ রায়, ডাক্তার সেন বললেন।
কিরীটী আবার যেন কি বলতে যাচ্ছিল, এবার রুচিরা বাধা দিল, মিঃ রায়!
না রুচিরা দেবী, মিথ্যে মনগড়া মনোমালিন্যের বোঝ টেনে লাভ নেই। শুনুন ডাঃ সেন, ওঁর মা সমীরবাবুর সঙ্গে ওঁর বিয়ের সব কথাবাতা ঠিক করলেও ওঁর মত পাননি–বলেই হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে মৃদু হেসে বলে, ঝগড়াটা তাহলে এবার মিটিয়ে ফেলুন, আমি চলি।
কিরীটী স্থানত্যাগ করে।
১৫. অবিনাশ চৌধুরীর ঘরের দরজা
অবিনাশ চৌধুরীর ঘরের দরজা ভেতর হতে ভেজানোই ছিল।
দরজার গায়ে মৃদু করাঘাত করে কিরীটী। ভেতর হতে সুমিষ্ট শান্ত গলায় প্রশ্ন আসে, কে?
আমি কিরীটী।
আসুন। ভেতর থেকে আহ্বান আসে।
দরজা ঠেলে কিরীটী ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।
খোলা দরজার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন অবিনাশ চৌধুরী।
হাত দুটি তাঁর পশ্চাতের দিকে নিবদ্ধ। পরিধানে দামী শান্তিপুরী মিহি ধুতি। গিলে করা কোঁচাটা মেঝেতে লুটোচ্ছে। গায়ে একটা সবুজ রঙের কাশ্মীরী কলকাতোলা দামী শাল।
মেঝেতে পুরু দামী গালিচা বিছানো। একপাশে কয়েকটি বাদ্যযন্ত্র এলোমেলো পড়ে আছে। দেয়ালের দিকে ঘেঁষে একটি কাঁচের আলমারি। ভেতরে সুন্দরভাবে সাজানো নানা বই।
অবিনাশ চৌধুরী একবার ফিরেও তাকালেন না। যেমন পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তেমনই নিঃশব্দে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন।
কিরীটীও নিঃশব্দে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল।
তারপর রায় মশাই, কি মনে করে আমার ঘরে? মৃদু শান্ত কণ্ঠে এক সময় অবিনাশ চৌধুরী আগের মত দাঁড়ানো অবস্থাতেই প্রশ্ন করলেন।
আপনার সঙ্গে কয়েকটা কথা ছিল কাকা সাহেব।
কথা?
আজ্ঞে।
আবার কিছুক্ষণ পীড়াদায়ক স্তব্ধতা।
কেবল ঘরের দেয়ালে বসানো একটি সুদৃশ্য দামী জামান ক্লক সময়-সমুদ্রের বুকে একটানা শব্দ জাগিয়ে চলেছে টক টক টক্ টক্ টক।
বলে ফেলুন, শুনি কি কথা! পুনরায় কিছুক্ষণ বাদে অবিনাশ চৌধুরীই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করলেন।
আপনি বোধহয় বুঝতেই পেরেছেন কাকা সাহেব, কি সম্পর্কে এবং কি কথা আমি বলতে চাই? কিরীটী বলে।
আমি তো অন্তযামী নই যে আপনার মনের কথা জানতে পারব মশাই। তবে যা জিজ্ঞাসা করতে চান একটু চটপট করলে বাধিত হব।
সামান্য কয়েকটা কথাই আমি জিজ্ঞাসা করব, বেশীক্ষণ আপনাকে আমি বিরক্ত করব না। আমি বলছিলাম রায়বাহাদুরের–
সহসা এতক্ষণে ফিরে দাঁড়ান অবিনাশ চৌধুরী এবং ক্ষণকাল তীব্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন নিঃশব্দে।
সত্যিই তো, ভুলেই গিয়েছিলাম, আপনি সেই রহস্যভেদী না? দুযযাধনের অঘটন-পটিয়সী অদ্ভুত শক্তিধর কিরীটী রায়! তা বেশ, দুযযাধনের হত্যার রহস্যভেদের জন্য লেগেছেন বুঝি? কিন্তু পারবেনধরতে পারবেন দুযোধনের হত্যাকারীকে? পারবেন ধরতে?
কিরীটীর ওষ্ঠপ্রান্তে মৃদু একটু হাসি ফুটে ওঠে। মৃদু হাস্যোদ্দীপ্ত কণ্ঠে বলে, চেষ্টা করে দেখি।
কিরীটীর কথায় কয়েক মুহূর্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিঃশব্দে তার মুখের দিকে চেয়ে থেকে অবিনাশ চৌধুরী বললেন, করুন চেষ্টা তবে। হ্যাঁ, পারেন যদি আমি নিজে আপনাকে একটা reward দেব। কিন্তু দাঁড়িয়ে রইলেন কেন, বসুন।
না, আপনাকে বেশী বিরক্ত করব না। দু-চারটে কথা জিজ্ঞাসা করেই চলে যাব।
দু-চারটে কেন, হাজারটা করুন না! হ্যাঁ, আমিও ভাবছিলাম ব্যাপারটা ঠিক কি হল! আগাগোড়া সমস্ত ব্যাপারটাই এখনও যেন একটা দুঃস্বপ্ন বলেই মনে হচ্ছে। দুর্যোধন সত্যি-সত্যিই শেষ পর্যন্ত নিহত হল! কিন্তু কেন? কেন—কেন সে এমন brutally নিহত হবে—শেষের দিককার কথাগুলো কতকটা যেন আত্মগত ভাবেই উচ্চারণ করে অবিনাশ চৌধুরী ঘরের মধ্যে আবার পরিক্রমণ শুরু করলেন।
নিঃশব্দে গালিচা-বিস্তৃত ঘরের মেঝেতে অবিনাশ চৌধুরী পরিক্রমণ করছেন। পূর্বের মতই। হাত দুটি তাঁর পশ্চাতের দিকে নিবদ্ধ।
আত্মগত ভাবেই যেন অবিনাশ চৌধুরী আবার বলতে লাগলেন, Its a curse! বুঝলে, curse—অভিশাপ! সুরমার অভিশাপ। একটা দিনের জন্যও মেয়েটাকে শান্তিতে থাকতে দেয়নি। একটা দিনের জন্যও শান্তি দেয়নি।
কার কথা বলছেন কাকা সাহেব? কিরীটী মৃদু কণ্ঠে প্রশ্ন করল।
কিরীটীর প্রশ্নে অবিনাশ চৌধুরী যেন চমকে ওঠেন, হ্যাঁ, কি বললেন! না, কারও কথাই নয়। কিন্তু আপনি—আপনি এখানে কি চান? কি প্রয়োজন আপনার? শেষের দিকে অবিনাশ চৌধুরীর কণ্ঠস্বরও যেন বদলে গেল। রুক্ষ, কর্কশ।
এবং পরক্ষণেই মহাবীর সিং! মহাবীর সিং!বলে অবিনাশ চৌধুরী চিৎকার করে ভৃত্যকে ডাকেন।
সঙ্গে সঙ্গে ঘরের ভেতর দিকের একটা দরজা খুলে গেল এবং বৃদ্ধগোছের একজন, বোধ। হয় রাজপুত, ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল, জি মহারাজ!
বাঈজী! অবিনাশ চৌধুরী বললেন।
মহাবীর সিং আবার পূর্বদ্বারপথেই অন্তর্হিত হয়ে গেল।
এবং মহাবীর সিং ঘর ছেড়ে চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আবার কিরীটীর দিকে তাকিয়ে অবিনাশ রুক্ষ স্বরে বলেন, এখনও দাঁড়িয়ে আছেন?
আপনার সঙ্গে আমার গোটাকতক কথা মিঃ চৌধুরী—
কথা! কি কথা? এখন আমার সময় নেই কোন কথা শোনবার বা বলবার।
কিন্তু–
আঃ, বলছি না সময় নেই!
বেশিক্ষণ আমি সময় নেব না।
এক মিনিট সময়ও আমার নেই।
মুন্না বাঈজী ঘরের মধ্যে এসে এমন সময় প্রবেশ করল।
অতি সাধারণ একখানি রক্তলাল চওড়াপাড় বাসন্তী রঙের খদ্দরের শাড়ি পরিধানে। অনুরূপ রক্তলাল বর্ণের সাটিনের হাফ-হাতা ব্লাউজ গায়ে। বিকীর্ণ-কুন্তলা। চোখের কোলে সূক্ষ্ম সুমার টান।
সরু সরু চাঁপার কলির মত আঙুলগুলো। নখ হতে যেন রক্ত চুঁয়ে চুঁয়ে পড়ছে।
আমায় ডাকছিলেন চৌধুরী মশাই?
এস মুন্না। এবারে সম্পূর্ণ অন্য কণ্ঠস্বর। যেন অবিনাশ চৌধুরী নয়।
আজ সকালে তুমি যে ভৈরো রাগটা ধরেছিলে, কিছুতেই মনের মধ্যে আর সে সুরটাকে খুঁজে পাচ্ছি না। সুরটাকে ফিরিয়ে আনতে পার বাঈজী?
মুন্না বাঈজী নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে মেঝের গালিচার ওপর হতে বীণাটা কোলে টেনে নিয়ে তারে মৃদু আঘাত করল।
তারের বুকে রিনিঝিনি শব্দ জাগে। এবং সেই সঙ্গে কণ্ঠও বাঈজীর গুনগুনিয়ে ওঠে। অবিনাশ গালিচার ওপরে বসে একটা তাকিয়া কোলের কাছে হাত বাড়িয়ে টেনে নিয়ে নিজেকে তাকিয়ার ওপর এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজলেন।
১৬. কিরীটী যেমন দাঁড়িয়েছিল
কিরীটী কিন্তু যেমন দাঁড়িয়েছিল তেমনই দাঁড়িয়ে থাকে।
সে নিজে অত্যন্ত সঙ্গীতপিপাসু হলেও, বর্তমানে তার সমগ্র চিন্তারাজ্যকে মন্থন করে যে চিন্তা ঘূণাবর্ত রচনা করেছিল—সঙ্গীতের সুর তার মধ্যে যেন কোনমতেই প্রবেশ করতে পারে না। এতটুকু স্পর্শও যেন করে না।
অবিনাশ চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলা একান্ত প্রয়োজন। কতকগুলো প্রশ্নের জবাব তাঁর কাছ থেকে পেতেই হবে। কিন্তু অবিনাশ চৌধুরীর ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে, অত সহজে তাঁর কাছ থেকে কোন প্রশ্নের জবাব পাওয়া বোধহয় যাবে না। এ অবস্থায় ঠিক কি ভাবে অবিনাশ চৌধুরীর কাছে প্রশ্নগুলো উত্থাপন করে তাঁর জবাব পাওয়া যায়।
বাঈজী তখনও গুনগুন গলায় তান তুলে ভৈরো রাগটা আয়ত্তের মধ্যে আনবার চেষ্টা করছে। কিরীটী কতকটা অনন্যোপায় হয়েই নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে ঘরের চারদিকে চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগল। এতক্ষণ সে তার স্বভাববিরুদ্ধ ভাবেই ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেও, অন্য কোন দিকে দৃষ্টিপাত না করেই অবিনাশ চৌধুরীকেই পর্যবেক্ষণ করছিল।
ঘরের চারিদিকে দৃষ্টিপাত করতে করতে সহসা তার দৃষ্টি দেওয়ালের গায়ে টাঙানো কতকগুলো ফটো ও চিত্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতেই কিরীটী ফটো ও চিত্রগুলো দেখতে থাকে।
চিত্রগুলো সব বিখ্যাত অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের।
নাট্যাচার্য গিরিশ ঘোষ, দানীবাবু, অর্ধেন্দু মুস্তফী, শিশির ভাদুড়ী, কৃষ্ণভামিনী, তারাসুন্দরী, বিনোদিনী, কুসুমকুমারী প্রভৃতির। আর সেই সঙ্গে কয়েকটি ফটো—বিখ্যাত সব নাটকের কয়েকটি বিখ্যাত চরিত্রের রূপসজ্জায়। সাজাহানের ঔরংজীব, প্রফুল্লর রমেশ, চন্দ্রগুপ্তের চাণক্য, প্রতাপাদিনের ভবানন্দ ইত্যাদি।
একসময় কিরীটীর অভিনয় দেখবার প্রচণ্ড নেশা ছিল ছাত্রজীবনে। এক গিরিশ ঘোষ ও সেই সময়কার দু-একজন ব্যতীত প্রায় সব নামকরা অভিনেতা-অভিনেত্রীদেরই সে প্রায় চেনে। কিন্তু বিশেষ ঐ বিভিন্ন রূপে সজ্জিত অভিনেতাটিকে তো কখনও ইতিপূর্বে কোন নাট্যালয়ে দেখেছে বলে কই স্মরণ করতে পারছে না!
হঠাৎ একটি ফটোর সামনে কৌতূহলভরেইসে এগিয়ে গেল। ঔরংজীবের রূপসজ্জায় ফটোটি।
মুখটা বিশেষ করে চোখ দুটি চেনা-চেনা বলে মনে হচ্ছে যেন। কে ঐ অভিনেতা? কে?
সহসা যেন বিদ্যুৎ-চমকের মতই মানসপটে একটা সম্ভাবনা উঁকি দিয়ে যায়।
তবে কি—
সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দাঁড়ায় কিরীটী। এবং ঘুরে দাঁড়াতেই অবিনাশ চৌধুরীর কৌতূহলী দৃষ্টির সঙ্গে তার দৃষ্টি-বিনিময় হয়।
কি দেখছেন মিঃ রায়! অবিনাশ চৌধুরী প্রশ্ন করেন।
আপনারই রূপসজ্জার ফটো বোধ হয় এগুলো? প্রশ্ন করে কিরীটী।
এতক্ষণ ধরে ঘরের মধ্যে যার উপস্থিতিকে অবিনাশ চৌধুরী ভ্রুক্ষেপমাত্রও করেননি—ফিরে তাকাননি পর্যন্ত তার দিকে, কিরীটীর ঐ শেষের প্রশ্নে সেই অবিনাশ চৌধুরী যেন সচকিতে মুখ তুলে তাকালেন ওর দিকে এবং এতক্ষণের মৌনতা ও বিরক্তি যেন সহসা মুহূর্তে এক নির্মল স্নিগ্ধ কৌতুক হাসিতে রূপান্তরিত হল।
স্নিগ্ধ প্রসন্ন কণ্ঠে চৌধুরী বললেন, হ্যাঁ। এককালে আমার ঐ থিয়েটার করা একটা প্রচণ্ড নেশা ছিল রায় মশায়—বলতে বলতে সহসা উপবিষ্ট অবিনাশ গালিচা ছেড়ে উঠে কিরীটীর। একেবারে পাশটিতে এসে দাঁড়ালেন।
আপনি কখনও পাবলিক স্টেজে অভিনয় করেছেন?
না। সাধারণ রঙ্গমঞ্চে পেশাদারী ভাবে অভিনয় আমার ধাতে ঠিক খাপ খেত না রায় মশাই। স্টেজ ও অভিনয়ের ব্যাপারে আমার যেমন আগ্রহ কৌতূহল ও নিষ্ঠার অভাব ছিল না তেমনি অর্থব্যয়ও কম করিনি। শুধু আমাদের দেশেই নয়, ওদের দেশের অভিনয়, অভিনেতা ও ওখানকার রঙ্গমঞ্চ সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করবার জন্য ওদের দেশেও গিয়েছি এবং জীবনে এক সময় অভিনয়কেই পেশা বলে গ্রহণ করব ভেবেছিলাম। কিন্তু আপনি হয়ত জানেন না রায় মশাই, এদেশের অভিনয়শিল্পের সঙ্গে যে সব পুরুষ ও নারী সংশ্লিষ্ট, বলতে গেলে তাদের মধ্যে সকলেরই প্রায় অত বড় একটা শিল্পের প্রতি যে নিষ্ঠা ও শ্রদ্ধা থাকা দরকার তার বিন্দুমাত্রও আদৌ নেই। সেই জন্যই শেষ পর্যন্ত রঙ্গমঞ্চ ও অভিনয়কে ত্যাগ করে আসতে বাধ্য হয়েছিলাম আমি।
দোষটা হয়ত এক পক্ষেরই নয় চৌধুরী মশায়। কিরীটী মৃদু হেসে বলে, জনসাধারণের কাছ থেকেই বা অভিনেতা ও অভিনেত্রীরা কতটুকু সম্মান পেয়ে থাকেন আমাদের দেশে বলুন!
শ্রদ্ধা আকর্ষণ করতে হয়, অর্জন করতে হয় মিঃ রায়। ভিক্ষুকের মত হাত পেতে তা মেলে না।
কিরীটী ও অবিনাশ চৌধুরীর কথাবার্তায় আকৃষ্ট হয়ে ইতিমধ্যে কখন এক সময় বাঈজী গুনগুন করে কণ্ঠে যে তাল তুলেছিল সেটা মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে কখন এক সময় ওদের কথাবার্তায় কান দিয়েছিল। কেবল মধ্যে মধ্যে অন্যমনস্কভাবে ক্রোড়স্থিত বীণার তারে মৃদু মৃদু অঙ্গুলি সঞ্চালন করছিল।
মধ্যে মধ্যে রিনঝিন একটা মিষ্টি তারের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল।
অবিনাশ চৌধুরী যেন কিরীটীর প্রতি সহসা অত্যন্ত প্রসন্ন হয়ে ওঠেন।
অবিনাশ ও কিরীটী অভিনয়-সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনায় এতটা তন্ময় হয়ে ওঠে যে, বাঈজী যে একপ্রকার বাধ্য হয়েই একসময় ক্রোড়স্থিত বীণাটি গালিচার ওপরে নিঃশব্দে নামিয়ে রেখে ঘর থেকে বের হয়ে গেল অবিনাশ চৌধুরীরও যেন সেটা নজরেই পড়ে না।
কিরীটী অবিনাশ চৌধুরীর সঙ্গে আলোচনায় নিবিষ্ট থাকলেও, তার মনের সক্রিয় অংশটা কিন্তু সুযোগের অপেক্ষায় ছিল—কখন কোন ফাঁকে সে তার আসল বক্তব্যের মধ্যে প্রবেশ করবে!
সুযোগ করে দিলেন অবিনাশ চৌধুরী নিজেই। সহসা তিনিই কিরীটীকে প্রশ্ন করলেন, আপনার কি যেন প্রয়োজন ছিল আমার কাছে রায় মশাই, আপনি বলছিলেন—
না না থাক, সে অন্য সময় হবেখন।
উঁহু! স্বর্ণলঙ্কাধিপতি রাবণের খেদোক্তি শোনেননি, আজ নয় কাল এই করে করে স্বর্গের সিঁড়ি শেষ পর্যন্ত তাঁর তৈরী করাই হল না। বলুন, out with it!
বিশেষ তেমন কিছু না। আপনি তো জানেন, মৃত্যুভয়ে ভীত হয়েই রায়বাহাদুর আমাকে এখানে আনিয়েছিলেন! এখন যদি তাঁর হত্যাকারীকে—
কথাটা কিরীটী শেষ না করেই থেমে গেল এবং সঙ্কোচের সঙ্গে অবিনাশ চৌধুরীর মুখের দিকে তাকায়।
অবিনাশ চৌধুরীও যেন হঠাৎ ঐ কথায় কেমন কিছুক্ষণের জন্যে গুম হয়ে থাকেন। শুধু তাই নয়, কিরীটীর মনে হয় অবিনাশ চৌধুরী কেমন যেন একটু চিন্তিত তাঁর প্রশস্ত উন্নত ললাটে কয়েকটা চিন্তার রেখা জেগে উঠেছে।
এক সময় ধীরে ধীরে অবিনাশ চৌধুরী বলতে শুরু করলেন, কি জানেন রায় মশাই, সবই দুভাগ্য। নচেৎ বয়েস হয়েছে আমার, যাবার কথা তো আমারই। কিন্তু চলে গেল দুর্যোধন। অবিশ্যি আপনারা বলবেন সে তো অসুস্থ ছিলই। তা ছিল—ঐ ভাবে না মরে যদি সে অসুখেই মারা যেত, তবে তো দুঃখটা এত হত না। এত painful হত না ব্যাপারটা। ওরা তো জানে না, এই বিরাট কোলিয়ারীর বিজনেস দুজনে মিলে আমরা গায়ের রক্ত জল করে দিনের পর দিন, রাত্রির পর রাত্রি অক্লান্ত পরিশ্রমে তিল তিল করে কি ভাবে গড়ে তুলেছিলাম! এই মাত্র বছর দুই হল কাজ থেকে অবসর নিয়ে একটু বিশ্রাম নিচ্ছি। দুযযাধন যে আমার কতখানি ছিল, ভাইপো হলেও সে আমার বন্ধু বলতে বন্ধু, সুহৃদ, পরামর্শদাতা, সঙ্গী সাথী—একাধারে সে-ই আমার সব ছিল। দুযযাধনই ছিল এ গোষ্ঠীর মধ্যে মানুষের মত মানুষ। নচেৎ এই চৌধুরী-বাড়িতে আর মানুষ বলতে একটা প্রাণীও আছে নাকি? ওর একমাত্র ছেলে ঐ বৃহন্নলা, ওটা তো মেয়েমানুষের অধম-effiminate, মেরুদণ্ডহীন। একমাত্র ঐ ভাই দুঃশাসন, ওটার কিছু বুদ্ধি ছিল; কিন্তু ওটার মাথায়ও পোকা আছে।
পোকা আছে! কিরীটী প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকায় অবিনাশ চৌধুরীর মুখের দিকে।
তা নয় তো কি? নইলে ও হতভাগাটার মধ্যেও পার্টস ছিল। এককালে চমৎকার গান-বাজনার শখ ছিল। কিন্তু সব গোল্লায় দিয়ে বসে আছে।
কেন, এখন আর গান-বাজনার শখ নেই বুঝি?
না, এখন কেবল এক নেশা হয়েছেটাকা, টাকা আর টাকা! দিবারাত্র কেবল ফন্দিফিকির আঁটছে কিসে টাকা আসবে!
আচ্ছা শুনছিলাম মৌচীতে বিজনেসে নাকি বেশ টাকা উনি রোজগার করছিলেন, তবে চলে এলেন কেন হঠাৎ?
বেশ টাকা রোজগার করছিল না ঘোড়ার ডিম! সেখানকার ব্যবসা নষ্ট করে এখন এখানে বসে সব লণ্ডভণ্ড করবে এই মতলব। মরুক গে। দুর্যোধন গেল। আমিও আর কটা দিনই বা! থাকলে ওর আর বৃহন্নলারই থাকত। বৃহন্নলাটা একটা হস্তীমূখ। এখন সুবিধেই হল, দুদিনে সব তছনছ করে দেবে।
কিন্তু গতরাত্রে আপনি তো বলছিলেন রায়বাহাদুরের উইল আছে—
উইল! হ্যাঁ, উইল একটা আছে। আর আমি জানি সে উইলে একটা কপর্দকও কারও নষ্ট করার ক্ষমতা নেই এমন ভাবেই ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু সাত-সাতটা কোলিয়ারীর দেখাশোনা করবে কে? কাঁচা পয়সা কোলিয়ারীতে। ওরা কাকা-ভাইপোই তো দেখবে সব। দিনের আলোয় পুকুরচুরি হলেই বা ঠেকাচ্ছে কে?
আচ্ছা উইলটা কি রেজেস্ট্রি করা আছে?
তা জানি না, সংবাদ রাখি না।
আচ্ছা কাকা সাহেব, রায়বাহাদুর যে নিহত হবেন গত রাত্রে রাত চারটের সময়, এই বদ্ধমূল ধারণাটা তাঁর কেন হয়েছিল বলতে পারেন কিছু? কোন কারণ ছিল কি?
কিরীটীর প্রশ্নে অবিনাশ চৌধুরী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন, কোন জবাবই দেন না।
তারপর শান্ত কণ্ঠে বললেন, না। বলতে পারি না।
আর একটা কথা। গতরাত্রে কে আপনাকে রায়বাহাদুরের নিহত হবার সংবাদটা দেয়?
প্রসাদই তো দেয়।
প্রসাদ!
হ্যাঁ।
কাল রাত সাড়ে তিনটে থেকে রায়বাহাদুরের নিহত হবার সংবাদ পাওয়া পর্যন্ত আপনি কোথায় ছিলেন?
রাত তিনটে নাগাদ বাঈজী চলে যায়। তারপর পাশের ঘরে আমি শুতে যাই। কিন্তু ঘুম আসছিল না বলে বিছানায় শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিলাম।
প্রসাদ ঠিক কটায় আপনাকে সংবাদ দিতে এসেছিল জানেন? মনে আছে আপনার?
রাত তখন প্রায় সাড়ে চারটে হবে বোধ হয়।
তখন কি আপনি ঘুমিয়ে ছিলেন?
ঠিক ঘুম নয়, বোধ হয় একটু তন্দ্রামত এসেছিল, এমন সময় প্রসাদ এসে ডাকতেই—
ও-ঘর থেকে ফিরে এসে আপনি বোধ হয় আর শুতে যাননি?
না। মনটা এমন অস্থির লাগতে লাগল দুযযাধনকে ঐভাবে নিহত হতে দেখে যে বাধ্য হয়ে মুন্নাকে এ-ঘরে তখুনি আবার ডেকে পাঠালাম? মুন্নাও অবাক হয়ে গিয়েছিল। ঘণ্টাখানেক আগে মাত্র তাকে রাত্রির মত বিদায় দিয়েছিলাম।
মুন্নাবাঈ তখনও জেগেই ছিলেন?
হ্যাঁ। ও এসে বললে, অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ও নিজেও বিছানায় শুয়ে ছটফট করছিল। আমার চাকর গিয়ে ডাকতেই উঠে এসেছিল।
হঠাৎ এমন সময় দেওয়াল ঘড়িটায় ঢং ঢং করে বেলা এগারটার সময়-সঙ্কেত শোনা গেল।
ঘড়ির সময়-সঙ্কেতে কিরীটীর খেয়াল হল অনেকক্ষণ সে ঐ ঘরে আছে। বলে, আচ্ছা অনেক বেলা হয়ে গেল, আর আপনাকে বিরক্ত করব না কাকা সাহেব।
কাকা সাহেবও যেন কিরীটীর কথায় চমকে ওঠেন। এবং অকস্মাৎ একটা প্রশ্ন করে বসেন, আচ্ছা রায় মশাই, দুযযাধনের মৃতদেহটা কি ওরা এখান থেকে নিয়ে গিয়েছে? প্রশ্নটা করে কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণের জন্য অবিনাশ চৌধুরী।
হ্যাঁ, ময়নাতদন্তের জন্য পুলিস মৃতদেহ নিয়ে গিয়েছে।
সৎকার হবে না?
ময়নাতদন্ত হয়ে গেলেই আপনারা সৎকারের ব্যবস্থা করতে পারবেন। কিরীটী মৃদুকণ্ঠে প্রত্যুত্তর দেয়।
তার আয়োজন কিছু ওরা করেছে জানেন?
আমি এখুনি গিয়ে বৃহন্নলা ও দুঃশাসন চৌধুরীর কাছে সংবাদ নিচ্ছি।
দয়া করে ওদের বলে দেবেন, আমাকে যেন ওর মধ্যে আর না টানে। আর একটা কথা বলে দেবেন, অস্থিটা যেন গঙ্গায় ফেলার ব্যবস্থা করা হয়।
বলব।
দুঃখ যেমন দিয়েছে তেমনি নিজেও দুঃখ কম পায়নি। দিক, অস্থিটা গঙ্গাতেই বিসর্জন দিক। তবু যদি মরার পর গিয়ে শান্তি পায়।
কথাগুলো বলে অবিনাশ চৌধুরী যেন হঠাৎ আবার কেমন অন্যমনস্ক হয়ে যান। এবং নিঃশব্দে ঘরের মধ্যে আবার পায়চারি শুরু করেন।
তারপর আবার একসময় পায়চারি থামিয়ে অবিনাশ চৌধুরী বলেন, মৃত্যুর পরে ঐসব প্রেতলোকটোক আপনি মানেন রায় মশাই?
হিন্দুর ছেলে যখন তখন চিরন্তন সংস্কারকে একেবারে এড়াব কেমন করে বলুন!
বিশ্বাস করেন তাহলে?
কিরীটী প্রত্যুত্তরে মৃদু হাসে।
এই যে সব লোকে বলে অতৃপ্ত বাসনা বা কামনা নিয়ে মরলে বায়বীয় সত্তা সেই বাসনা বা কামনার জন্য এই পৃথিবীতে ফিরে ফিরে আসে, বিশ্বাস করেন এসব কথা?
কিরীটী অবিনাশ চৌধুরীর মুখের দিকে অতঃপর না তাকিয়ে পারে না। বিশেষ করে অবিনাশ চৌধুরীর কণ্ঠস্বর শুনে। অবিনাশ চৌধুরীর মুখের দিকে চেয়ে হঠাৎ যেন ওর মনে হয় একটা অলিখিত ভয় ও শঙ্কা যেন সে মুখের রেখায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কিন্তু কেন?
অবিনাশ চৌধুরী অতঃপর ঘুরে দাঁড়িয়ে দেয়ালে প্রলম্বিত একখানি নিজেরই ছবির দিকে। একদৃষ্টে চেয়ে যেন কি দেখতে লাগলেন। আর একটি কথাও কিরীটীর সঙ্গে বললেন না।
কিরীটী কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু অবিনাশ চৌধুরী পূর্ববৎ পায়চারি করতে লাগলেন।
কিরীটী ঘর হতে বের হয়ে আসবার জন্য অতঃপর দুয়ারের দিকে পা বাড়ায়।
.
কিরীটী অবিনাশ চৌধুরীর ঘর থেকে বের হয়ে কি ভেবে আবার রায়বাহাদুর দুর্যোধনের ঘরের দিকে অগ্রসর হয় এবং ঢুকতেই হঠাৎ মেঝেতে রায়বাহাদুরের শূন্য খাটটার নীচে কি একটা বস্তু চিকচিক করছে তার নজরে পড়ে। কৌতূহলে এগিয়ে গিয়ে তুলে নেয় নীচু হয়ে বস্তুটি। একটা লাল সূতোয় বাঁধা সোনার লকেট। লকেটটা খুলতেই ভেতর থেকে প্রকাশ পেল অপরূপ সুন্দরী একটি তরুণীর মুখচ্ছবি। কে? কার ফটো?
১৭. অবিনাশ পায়চারি করছেন
অবিনাশ পায়চারি করছেন আর মৃদুকণ্ঠে আবৃত্তি করে চলেছেন—
নির্মম নিয়তি। অন্তিম সময়ে
একি মহা বিস্মরণ! গুরুদেব!
গুরুদেব!–ক্ষমা কর। ক্ষমা
কর প্রভু। অস্ত্র আবাহন মন্ত্র
দাও প্রভু ফিরাইয়া মোরে।
নিঃশব্দে ঘরের দরজাটা খুলে গেল এবং ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন গান্ধারী দেবী।
কাকামণি!
কে? ফিরে তাকালেন সঙ্গে সঙ্গে অবিনাশ চৌধুরী।
আমি গান্ধারী।
আয় মা। দুর্যোধন—দুর্যোধনকে কি ওরা নিয়ে গেল?
হ্যাঁ। এই আধঘণ্টাটাক আগে পুলিসের লোক এসে মৃতদেহ নিয়ে গেছে।
অভিশাপ—বুঝলি মা, এ সুরমার অভিশাপ!
সতী নারী দেছে অভিশাপ।
তীব্র নিরাশায় কেটে যাবে দিন
সহস্র বান্ধব মাঝে রহিব একাকী–
আমার মনের ব্যথা কেহ বুঝিবে না,
কণ্টক হইবে শয্যা—
কাঁদতে পারছি না মা—আমি কাঁদতে পারছি না। সুরমাই আমার সমস্ত চোখের জল মুছে নিয়ে গিয়েছে।
একটু থেমে অবিনাশ চৌধুরী আবার বলতে থাকেন, চার বছর আগে এই বাড়ি থেকে যেদিন সুরমার মৃতদেহটা পালঙ্কের ওপর থেকে নিয়ে ওরা বের হয়ে গেল, সেই দিন—সেই দিনই এ-বাড়ির সমস্ত ঐশ্বর্য বিদায় নিয়েছিল চিরদিনের মতই। একটা দিনের জন্য তাকে শান্তি দেয়নি ওই দুযযাধন। টাকা—টাকাই কেবল চিনেছিল। কিন্তু পারলি নিয়ে যেতে সঙ্গে সেই টাকা? একটা পয়সা নিয়ে যেতে পারলি? এত চিকিৎসা, এত আয়োজন সবই মিথ্যে হয়ে গেল তো?
আপন মনেই এবং আপন খেয়ালেই যেন অবিনাশ কথাগুলো বলে যান। গান্ধারী নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনতে থাকে।
মেজাজী ও অত্যন্ত খেয়ালী প্রকৃতির খুল্লতাতকে গান্ধারী দেবী বেশ ভাল করেই চেনেন। নিজের চলার পথে আজ পর্যন্ত এতটুকু বাধাও অবিনাশ কখনও সহ্য করেননি। কারও উপদেশ বা পরামর্শকে কোনদিন গ্রহণ করেননি। নিজের বিচারবুদ্ধিতে চিরদিন যা ভাল বুঝেছেন তাই করেছেন। তাঁর কথার মধ্যে কোনরূপ মন্তব্য প্রকাশ করলে বা কথা বললে মুহূর্তে যে তিনি বারুদের মত জ্বলে উঠবেন গান্ধারী দেবী তা ভাল করেই জানেন। তাই বোধ হয় নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকেন গান্ধারী দেবী।
কথাগুলো বলে অবিনাশ আবার আপন মনেই ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগলেন নিঃশব্দে। তারপর হঠাৎ একসময় যেন অদূরে নিঃশব্দে দণ্ডায়মান গান্ধারী দেবীর প্রতি দৃষ্টিপাত করে বলে ওঠেন, গান্ধারী, তুই আবার এখানে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কি চাস?
একটা কথা বলতে এসেছিলাম কাকামণি!
কি বলবি বলে ফেল! হাঁ করে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ কি?
আশ্চর্য, এ যেন সম্পূর্ণ অন্য এক মানুষ।
একটা বিশ্রী ব্যাপার ঘটে গেছে কাকামণি—
কি–কি হয়েছে?
বলছিলাম, শকুনি পালিয়েছে–
শকুনি পালিয়েছে! সে কি? হঠাৎ সে হতভাগাটা আবার পালাতেগেল কেন? কিন্তু তুই-তুই সে কথা জানলি কি করে?
এই কিছুক্ষণ আগে কৈরালা এসে প্রসাদকে বলেছে কথাটা। প্রসাদ আমাকে বলে গেল। বৃহন্নলার টু-সিটার গাড়িটা নিয়ে সে পালিয়েছে।
ইডিয়েট! গর্দভ!
কিন্তু তার পালানো ছাড়া আর উপায়ই বা ছিল কি?
মাথামুণ্ডু কি বলছিস তুই?
উত্তরে গান্ধারী দেবী কিছুক্ষণ নিঃশব্দে চুপচাপ দাঁড়িয়েই থাকেন।
অবিনাশ খিঁচিয়ে ওঠেন, জবাব দিচ্ছিস না কেন? বল না, হঠাৎ সে গর্দভটা পালাতেই বা গেল কেন?
কাল রাত্রে—গান্ধারী ইতস্ততঃ করতে থাকেন।
কি–কাল রাত্রে কি? উত্তেজিত ব্যাকুল কণ্ঠে প্রশ্ন করেন অবিনাশ।
কাল রাত্রে তখন বোধ করি রাত পৌনে চারটে হবে, ওর পাশের ঘরের লাগোয়াই তো আমার শোবার ঘর, একটা ছপছপ জলে কাপড় কাচার শব্দ শুনে সন্দেহ হওয়ায় আমার ঘরের লাগোয়া যে পেছনের বারান্দা আছে সেই বারান্দা দিয়ে ওর ঘরে বন্ধ জানলার কপাটের খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখি—
কি—কি দেখেছিস তুই?
ঘরের কুঁজো থেকে জল ঢেলে ঢেলে তাড়াতাড়ি করে শেকো একটা কাপড় ধুচ্ছে। আর মাঝে মাঝে আলোর সামনে তুলে ধরে কাপড়টা দেখছে। সে সময় আমি দেখেছি
কি–কি দেখেছিস?
দেখলাম কাপড়ের সেই অংশে ছোপ ছোপ রঙের লাল দাগ। আজও সে কাপড়টা ঘরের কোণেতেই পড়ে ছিল। সকালে কিরীটীবাবু ওর সঙ্গে কথা বলে চলে আসবার পর কাপড়টা পরীক্ষা করে দেখেছি, ধুলেও তাতে অস্পষ্ট রক্তের দাগ লেগে রয়েছে এখনও।
রক্ত! কিসের রক্ত? রক্ত আবার কোথা থেকে এল তার কাপড়ে?
আমি ভেবেছিলাম প্রথমে ছোড়দাই বোধ হয়—
গান্ধারী! চাপা কণ্ঠে একটা যেন গর্জন করে ওঠেন অবিনাশ রোষকষায়িত লোচনে গান্ধারীর দিকে চেয়ে।
হ্যাঁ কাকামণি, আমি ভেবেছিলাম ছোড়দাই হয়ত—তুমি তো জান না, দিন কুড়ি-পঁচিশ আগে একদিন বেলা তখন দুটো কি আড়াইটে হবে, দাদা সেই সময়টা দু-চার দিন সুস্থই ছিলেন—নার্স সব সময় বড় একটা কাছে থাকত না, ডাক্তার সানিয়ালও ঐদিন দুপুরে ঘণ্টা দুয়েকের ছুটি নিয়ে শহরে গিয়েছিলেন, ওদিকটা একরকম খালিই ছিল, দাদা একটু আগে আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন বলে তাঁর ঘরের দিকে যাচ্ছিলাম। দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে থমকে দাঁড়ালাম।
অবিনাশের চোখের তারা দুটো তীক্ষ্ণ অনুসন্ধিৎসায় ছুরির ধারাল ফলার ন্যায় চকচক করতে থাকে। মুখের শিরা-উপশিরাগুলি যেন সজাগ হয়ে ওঠে। চাপা উত্তেজিত কণ্ঠে প্রশ্ন করেন অবিনাশ, কেন? দাঁড়ালি কেন?
ছোড়দার গলা শুনে।
ছোড়দা—মানে দুঃশাসন?
হ্যাঁ। তাই মনে হয়েছিল।
ঠিক মনে আছে তোর দুঃশাসনের গলাই শুনেছিলি?
হ্যাঁ, তেমনি কর্কশ ভাঙা-ভাঙা। চাপা উত্তেজিত কণ্ঠে কথা বলছিল। ছোড়দাই দাদার সঙ্গে কথা বলছিল।
কি-কি বলছিল সে? উত্তেজনায় অবিনাশের কণ্ঠের স্বর যেন বুজে আসে।
বলছিল, বিশ্বাস কর তুমি, ও চিঠি তোমাকে আমি দিইনি। দাদা জবাব দিলেন, হতভাগা, তুই ভাবিস তোর হাতের লেখা আমি চিনি না? কিন্তু আমি এতটুকুও কেয়ার করি না। কিরীটী রায়কে আনাব। যেই চিঠি লিখে থাকুক, সব জারিজুরি সে ভেঙে দেবে।
তারপর?
ছোড়দা তার জবাবে বললে, তুমি বিশ্বাস কর আর নাই কর, আমি বলছি আমি বিন্দু বিসর্গও জানি না। তবে এও তোমাকে বলছি, তুমি তোমার উইল যদি না বদলাও তোমার কপালে সত্যিসত্যিই অপঘাতে মৃত্যু আছে।
শয়তান! বলছিল শয়তানটা ও কথা?
হ্যাঁ। কিন্তু এখন আমার মনে হচ্ছে বোধ হয় সেটা ছোড়দার গলা নয়—
তবে?
বোধ হয়—এখন মনে হচ্ছে সেটা শেকোর গলা।
শকুনির গলা!
হ্যাঁ। আমি আর দাদার সঙ্গে দেখা করতে সাহস পেলাম না। কারণ পরমুহর্তেই দাদা যেন। মনে হল অত্যন্ত চটে উঠেছেন। তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে চলে এলাম। তারই আধঘণ্টাটাক পরে আবার যখন দাদার ঘরে ঢুকতে যাচ্ছি দেখি মুখ লাল করে শেকো দাদার ঘর থেকে বের হয়ে আসছে। এবং আমার পাশ দিয়েই গজর গজর করতে করতে চলে গেল।
হুঁ। কিরীটীবাবু এসব কথা জানেন, না জানেন না?
না বলিনি। কিন্তু শেকো পালিয়েই তো সর্বনাশ করলে। পুলিসের লোকেরা বিশেষ করে মিঃ রায় ওকেই এখন দাদার হত্যার ব্যাপারে সন্দেহ করবেন হয়তো
ননসেন্স! সন্দেহ করলে হল? চুপচাপ থাক, কোন কথা কাউকে বলবি না খবরদার।
সহসা এমন সময় যেন ঘরের মধ্যে বজ্রপাত হল।
ভেজানো দুয়ার ঠেলে কিরীটী ঘরের মধ্যে পা দিল, ক্ষমা করবেন চৌধুরী মশাই, ক্ষমা করবেন গান্ধারী দেবী। গান্ধারী দেবী, আপনাকে এ-ঘরে প্রবেশ করতে দেখেই দূর থেকে বাধ্য হয়েই আমাকে interrupt করতে হল আপনাদের ব্যক্তিগত কথাবার্তার মধ্যে। আমি আপনাকে অনুসরণ না করে পারিনি। দরজায় কান পেতে আপনাদের সব কথাও আমি এতক্ষ। শুনেছি।
সহসা যেন কিরীটীর কথায় বারুদ-পে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ পড়ে। চিৎকার করে উঠলেন অবিনাশ চৌধুরী, বেশ করেছেন শুনেছেন! বেরিয়ে যান এ ঘর থেকে এই মুহর্তে। হামবাগ
বৃথা আপনি উত্তেজিত হচ্ছেন চৌধুরী মশাই। অবশ্যম্ভাবীকে কেউ রোধ করতে পারে না।
গান্ধারী দেবী যেন পাষাণে পরিণত হয়েছেন। নিশ্চল স্থাণুর ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকেন নিঃশব্দে।
কিরীটী বলতে থাকে, যে কাজে আমি হাত দিয়েছি সে কাজ আজ আমি শেষ করে যাবই–
রায় মশাই! কিরীটীর কথা শেষ হল না, তীক্ষ্ণ অনুচ্চ কণ্ঠে অবিনাশ চৌধুরী যেন একটা চিৎকার করে ওঠেন।
চৌধুরী মশাই, যাচ্ছি আমি চলে; তবে একটা কথা কেবল যাবার আগে বলে যাই, আড়ি পেতে লুকিয়ে আপনাদের ঘরোয়া কথা শোনবার মধ্যে আমার দিক থেকে অসৌজন্য হয়তো কিছুটা প্রকাশ পেয়ে থাকবে, কিন্তু ন্যায়ত ও ধর্মত যে স্বৰ্গত আত্মার কাছে আমি সত্যবদ্ধ—দায়ী, সেটুকু না পালন করে এ বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার আমার উপায় নেই। তাই আশা করি সেইটুকু বিচার করে আমাকে আপনারা ক্ষমা করবেন।
অত্যন্ত ধীর ও শান্ত ভাবে কথাগুলি বলে অতঃপর কিরীটী সত্যি সত্যিই ঘর থেকে বের হয়ে গেল এবং যাবার মুখে হাত দিয়ে ঘরের দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিয়ে গেল পেছন থেকে।
.
আর ঘরের মধ্যে নিশ্চল পাষাণের মত দাঁড়িয়ে রইলেন অবিনাশ চৌধুরী ও গান্ধারী দেবী। দুজনেই নির্বাক, কারও মুখে কথা নেই।
কিরীটী সোজা নিজের ঘরে এসে ঢুকে দরজাটা ভেজিয়ে দিল। তারপর পকেট থেকে সোনার লকেটটা বের করল।
কার প্রতিকৃতি লকেটের অভ্যন্তরে সযত্নে রক্ষিত? কে ঐ নারী? এ বাড়ির কোন মুখের সঙ্গেই তো মিল নেই। আর রায়বাহাদুরের ঘরের খাটের তলায়ই বা এটা এল কি করে? লকেটটার সঙ্গে বাঁধা লাল সুতোটা পুরনো হয়ে গিয়েছিল, তাই বোধহয় ছিঁড়ে পড়ে গিয়েছে লকেটটার মালিকের অজ্ঞাতে। কিন্তু কার হাতে বাঁধা ছিল লকেটটা?
রায়বাহাদুরের কি? সম্ভব নয়, কারণ তাঁর হাতে বাঁধা থাকলে তিনি লকেটটা পড়ে গেলে নিশ্চয়ই জানতে পারতেন।
তবে কে?
দুঃশাসন-বৃহন্নলা-ডাঃ সমর সেন-সুলতা কর-ডাঃ সানিয়াল-অবিনাশ চৌধুরী, কেকার হাতে ছিল?
.
১১ নং পয়েন্ট : মৃত রায়বাহাদুরের ঘরে লাল সুতো বাঁধা সোনার লকেটে সুন্দরী তরুণীর প্রতিকৃতি।
টীকা: কোন ব্যর্থ প্রেমিকের গোপন প্রেমের নিদর্শন নয় তো ঐ লকেট!
১৮. মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য
মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য সিভিল সার্জনের কাছে সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে, অতএব সে কাজ শেষ হওয়ার পূর্বে সৎকারের কোন ব্যবস্থাই হতে পারে না। তথাপি আজ হোক বা কাল হোক সৎকার তো করতেই হবে। দুঃশাসন ও বৃহন্নলা সেক্রেটারি প্রাণতোষবাবু ও তহশীলদার কুণ্ডলেশ্বর শর্মার সঙ্গে নিচের মহালে বাইরের ঘরে তারই ব্যবস্থার জন্য নিম্নস্বরে আলাপ-আলোচনা করছিলেন পরস্পরের মধ্যে। মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সাধারণতঃ গৃহস্থঘরে যে স্বাভাবিক কান্নাকাটি ও শোকপ্রকাশ কয়েকটা দিন ধরে চলে অব্যাহত গতিতে তার কিছুই যেন নেই এক্ষেত্রে।
কে জানে, স্বাভাবিক মৃত্যু না হয়ে হত্যা বলেই হয়ত এই স্তব্ধতা। গত রাত্রে ব্যাপারটা জানাজানি হবার পর হতে কেউ হয়ত একফোঁটা চোখের জল ফেলেনি, কান্না তো দুরের কথা। অথচ স্বাভাবিক ভাবে সকলেরই হয়ত শোক করা কর্তব্য ছিল।
শোক নেই তবু যেন বাড়ির মধ্যে সর্বত্র একটা শ্বাসরোধকারী বিষণ্ণতা থমথম করে। সবাই। যেন কেমন ভীতসন্ত্রস্ত।
সকলেই যেন কান পেতে আছে একটা কিছু শোনবার জন্যে, অবশ্যম্ভাবী একটি পরিণতির আশঙ্কায় প্রত্যেকেই যেন শঙ্কিত, ব্যাকুল হয়ে প্রহর গুনছে।
নিহত হবার আগে রোগশয্যায় শুয়ে অসুস্থ রায়বাহাদুর গত কয়েকদিন ধরে বলতে গেলে দিবারাত্র যে দুঃস্বপ্ন দেখছিলেন জাগ্রত ও নিদ্রিত সকল অবস্থাতেই, সেই দুঃস্বপ্নেরই অশরীরী প্ৰেতটা যেন এখন এ বাড়ির প্রত্যেকের মনের উপর চেপে বসেছে। যেন সকলকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে।
.
শ্রীনিলয়ের পেটা ঘড়িতে ঢং ঢং করে বেলা দুটো ঘোষণা করে।
কিরীটী তার নির্দিষ্ট ঘরের মধ্যে ডাঃ সানিয়ালের সঙ্গে মুখোমুখি বসে কথা বলছিল। একটু আগে সে দালাল সাহেবের প্রেরিত অনুচরের মুখে সংবাদ পেয়েছে পলাতক শকুনি ঘোষ শেষ পর্যন্ত পুলিসের চোখ এড়িয়ে বেশীদূর পালাবার আগেই ধরা পড়েছে ও তাকে থানায় নিয়ে গিয়েছে।
ধরেছেন তাকে অবশ্য দালাল সাহেব নিজেই। কিছুদূরে একটা কোলিয়ারীতে জরুরী একটা তদন্তে নিজের গাড়িতে করে দালাল সাহেব যাচ্ছিলেন, এমন সময় পথের মধ্যে একেবারে দুখানা গাড়ি দুইদিক হতে মুখোমুখি হওয়ায় শকুনি ঘোষের অবস্থাটা সঙ্গীন হয়ে ওঠে এবং একপ্রকার বাধ্য হয়েই দালাল সাহেবের পূর্ব নির্দেশকে অমান্য করে স্থানত্যাগ করবার অপরাধে ধৃত হয়ে সরাসরি একেবারে সশস্ত্র প্রহরীর হেপাজতে হাজতে প্রেরিত হয়েছে। সংবাদটা অবশ্য একমাত্র কিরীটী ও ডাঃ সানিয়াল ব্যতীত এ বাড়ির একটি প্রাণীও জানে না বা কাউকে জানতে দেওয়া হয়নি।
কিছুক্ষণ পূর্বে কিরীটী ও ডাঃ সানিয়ালের মধ্যে শকুনি ঘোষ সম্পর্কেই কথা হচ্ছিল। তবে কি শকুনিবাবুই অপরাধী মিঃ রায়? প্রশ্ন করেন ডাঃ সানিয়াল।
মনে মনেও অন্ততঃ তিনি কিছুটা অপরাধী বৈকি। নচেৎ ওভাবে হঠাৎ তিনি পালাবার চেষ্টাই বা করবেন কেন? কিরীটী মৃদু হেসে জবাব দেয়।
আপনার কি সত্যিই মনে হয় স্পষ্ট করে বলুন মিঃ রায়। আপনার ধারণা কি তাহলে শকুনি ঘোষই কাল রাত্রে—কথাটা বলে ব্যগ্র দৃষ্টিতে তাকালেন ডাঃ সানিয়াল কিরীটীর মুখের দিকে।
প্রশ্নটা আপনার বড় direct ডাক্তার, এক্ষেত্রে অবিশ্যি সত্যিকারের সংবাদটা গোপন করে যাওয়াটাও একটা মস্তবড় অপরাধ। তাছাড়া এমনও তো হতে পারে, নিজের হাতে হত্যা
করলেও উনি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে হত্যাকারীকে সাহায্য করেছেন। বিচারের দৃষ্টিতে ও আইনে murder ও abetment of murder—দুটো charge কি একই পর্যায়ে পড়ে না?
তবে কি–
ক্ষমা করবেন, অত স্পষ্ট করে কিছুই আমি বলতে চাই না ডাক্তার, তবে শকুনি ঘোষ যে নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়েছেন একথাও আমি বলব, তাছাড়া এটা হয়ত তাঁর জানা ছিল না, বাঘে একবার কামড়ালে আঠারো জায়গায় ঘা হয়। ও বড় মারাত্মক ছোঁয়া। বলতে বলতে হঠাৎ প্রসঙ্গান্তরে উপস্থিত হয়ে কিরীটী ডাক্তারের চোখে চোখ রেখে বলে, কিন্তু আপনাকেও যে আমার কয়েকটা কথা জিজ্ঞাস্য ছিল ডাক্তার!
আমাকে?
হ্যাঁ।
কি বলুন তো?
অবশ্য কথাটা সম্পূর্ণই আমার ও আপনার মধ্যেই আবদ্ধ থাকবে, কোন তৃতীয় ব্যক্তি জানতে পারবে না।
বলুন না কি জানতে চান মিঃ রায়।
কথাটা সুলতা কর সম্পর্কে।
সুলতা!
কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই ডাঃ সানিয়ালের মুখখানা যেন রক্তিম হয়ে ওঠে। আপনা হতেই দুচোখের দৃষ্টি নত হয়ে আসে ডাক্তারের।
কিরীটী মনে মনে না হেসে পারে না। এবং কৌতুকের লোভটাও সম্বরণ করতে পারে না।
স্মিত কণ্ঠে বলে, ডাক্তার, মনের খোঁজ নিয়ে মন দিয়েছিলেন তো?
লাজরক্তিম মুখটা তুলে ডাক্তার বলেন, যাঃ, কি যে বলেন মিঃ রায়! Simply I liked that girl, বেশ মেয়েটি!
সে বিষয়ে আমিও নিঃসন্দেহ, তবু বলব মনটা দেবার আগে বোধহয় একটু যাচাই করে নিলে পারতেন।
ডাঃ সানিয়াল যেন চমকে ওঠেন কিরীটীর শেষের কথায়।
তাই-ই ডাক্তার, কারণ মহাভারতের উপাখ্যানের সঙ্গে এখানে সামান্য একটু উল্টোপাল্টা হয়ে গিয়েছে। মাতুল না হয়ে এখানে হয়েছেন ভাগিনেয়। দুর্যোধন মাতুল, ভাগিনেয় শকুনি।
বিস্মিত দৃষ্টিতে ডাক্তার কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়।
শকুনি!
হ্যাঁ। সংবাদটা কিন্তু আপনার রাখা উচিত ছিল।
শকুনি?
তাই। আশ্চর্য, এই সহজ ব্যাপারটা আপনার চোখে পড়েনি! সুলতা দেবীর প্রতি শকুনির চাউনিটাই তো ইতিপূর্বে আমার কাছে সংবাদটা ব্যক্ত করেছিল ডাক্তার!
কিন্তু সুলতা–
তা অবশ্য আমার চাইতে আপনারই বেশী জানবার কথা। কিন্তু রাত্রে কফি দিতে গিয়ে যে এদিকে আপনি একটা প্রচণ্ড জটিলতার সৃষ্টি করে ফেলেছেন!
জটিলতা!
হ্যাঁ। প্রতি রাত্রেই তাকে আপনি কফি দিয়ে আসতেন ইদানীং, তাই তো?
ডাক্তার সানিয়াল লজ্জায় আবার দৃষ্টি নত করলেন।
সুলতা দেবী বলেছেন, গতরাত্রেও নাকি আপনিই তাকে কফি দিয়ে এসেছেন অথচ তার জানা নেই যে আমরা আপনার ঘরে ঠিক গতরাত্রে ঐ সময়টায় উপস্থিত থাকায় লজ্জা। এসে আপনাকে আপনার চরণ ধরে বাধা দিয়েছিল।
কি বলছেন আপনি মিঃ রায়! আমি তো কাল–
জানি। আপনি তাকে কফি দেননি—অন্ততঃ গতকাল রাত্রে। অথচ মজা কি জানেন, আপনি দিলেও লোকে জেনেছে আপনিই দিয়ে এসেছেন। শুধু তাই নয়, যাকে দিয়েছেন তারও। সুনিশ্চিত ধারণা তাই।
সে কি!
হ্যাঁ। একেই বলে শয়তানীর চাতুরী…..
কিন্তু কিরীটীর বক্তব্য শেষ হল না, বাইরে থেকে বন্ধ দরজার কপাটের গায়ে অত্যন্ত মৃদু একটা করাঘাত শোনা গেল।
নিশ্চয়ই রুচিরা দেবী! আপনি একটু অনুগ্রহ করে বাইরে যান ডাক্তার ওপাশের ঐ দরজাটা দিয়ে, ওঁর সঙ্গে আমার কয়েকটি কথা আছে।
নিশ্চয়ই। ডাঃ সানিয়াল আর কোনরূপ মন্তব্য না করেই কিরীটীর নির্দেশমত ঘরের দ্বিতীয় দ্বারপথে বের হয়ে গেলেন।
এবং পরক্ষণেই দরজার গায়ে আবার মৃদু করাঘাত শোনা গেল।
আসুন রুচিরা দেবী! কিরীটী মৃদু কণ্ঠে আহ্বান জানায়।
রুচিরাই।
রুচিরা দ্বার ঠেলে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।
কিরীটী মৃদু শান্ত কণ্ঠে বলে রুচিরাকে, আসুন। বসুন ঐ চেয়ারটায় রুচিরা দেবী।
রুচিরা নিঃশব্দে কিরীটী-নির্দিষ্ট চেয়ারটা টেনে নিয়ে বারেকের জন্য কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে একেবারে কিরীটীর মুখোমুখি বসল।
খোলা জানালাপথে শীতের পড়ন্ত রৌদ্রালোক ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করেছে। দিনশেষের শেষ লিপি যেন।
কিরীটী রুচিরার দিকে চেয়ে থাকে নিঃশব্দে।
রুচিরার পরিধানে একটা গেরুয়া রঙের দামী মিলের শাড়ি। গায়ে একটা ফিকে আকাশ-নীল রঙের দামী কাশ্মীরী শাল জড়ানো। মাথায় তৈলহীন রুক্ষ চুল এলো খোঁপা করে বাঁধা অবস্থায় কাঁধের একপাশে পাকার হয়ে আছে। সত্যিই অপূর্ব সুন্দরী রুচিরা।
কিরীটী তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে রুচিরাকে দেখছিল। গতরাত্রে প্রথম দৃষ্টিতে যাকে ষোল-সতের বছরের যুবতী বলে মনে হয়েছিল, সুস্পষ্ট দিনের আলোয় তাকে পুনবার ভাল করে দেখতেই যেন তার সে ভুল ভেঙে যায়। মুখখানি অতীব কমনীয় ও ঢলঢলে হলেও রুচিরার বয়স তেইশ-চব্বিশের কম নয়, বরং দু-এক বছর বেশীও হতে পারে।
অতঃপর কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতার মধ্যে অতিবাহিত হবার পর কিরীটী প্রশ্ন করে সর্বপ্রথমে, আপনি তো কলকাতায় বেথুনে পড়েন রুচিরা দেবী?
হ্যাঁ, আমার ফোর্থ ইয়ার।
যদি কিছু মনে না করেন, জিজ্ঞাসা করতে পারি কি, আপনার বর্তমান বয়স কত হল?
বোধ হয় চব্বিশ। মৃদু অনাসক্ত কণ্ঠে রুচিরা জবাব দেয়।
আপনার পদবী?
মিত্র।
আবার কিছুক্ষণ স্তব্ধতা। কিরীটী মনে মনে নিজেকে বোধ করি গুছিয়ে নেবার চেষ্টা করে—কি ভাবে তার আসল বক্তব্যটা এবারে সে শুরু করবে। কিন্তু তার আগে সুযোগ রুচিরাই করে দেয়। সে-ই এবারে কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করে, আমাকে আপনি ডেকেছিলেন কেন মিঃ রায়?
ও হ্যাঁ, বিশেষ তেমন কিছুই নয় রুচিরা দেবী। গত রাত্রের সম্পর্কে কয়েকটা কথা আপনাকে আমি জিজ্ঞেস করতে চাই, কিন্তু তার আগে আপনার—
ভ্রুকুটিপূর্ণ দৃষ্টিতে রুচিরা কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়।
মৃদু হেসে কিরীটী বলে, আপনার মাকে বুঝি জানাননি যে ডাঃ সেনের সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে?
কেন বলুন তো!
কথাটা জিজ্ঞাসা করলাম এইজন্য যে, মিথ্যে তাহলে আর হয়ত আপনাকে অন্যত্র উনি বিবাহের জন্য পীড়াপীড়ি করতেন না।
আমার মাকে আপনি জানেন না মিঃ রায়, কোন একটা ব্যাপারে মা একপ্রকার সিদ্ধান্ত নিলে তাঁকে সে সিদ্ধান্ত থেকে টলানো দুঃসাধ্য।
কিন্তু তাতে করে জটিলতা কি আরও বাড়ে না? যাক সে কথা, কিন্তু সমীরবাবুকে অন্ততঃ সে কথাটা জানিয়ে দিলেও হয়ত–
সেরকম বুঝলে জানাতেই হবে।
আমি বলব?
প্রয়োজন নেই। যা করবার আমিই করব।
বেশ। এবার তাহলে আমার দ্বিতীয় প্রশ্নে আসা যাক।
কিন্তু যা আমি জানতাম সবই তো দালাল সাহেবকে কাল রাত্রেই বলেছি!
বলেছেন সত্যি, তবে আরও আমার কিছু জিজ্ঞাস্য আছে।
বিস্মিত সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল রুচিরা কিরীটীর মুখের দিকে।
দেখুন মিস মিত্র, যে প্রশ্নগুলো আপনাকে আমি করব, জানবেন তার জবাবের ওপর আপনার বড়মামা রায়বাহাদুরের হত্যার ব্যাপারটা অনেকখানি নির্ভর করছে।
কি প্রশ্ন?
প্রশ্নগুলো অবশ্য কিছুটা গত রাত্রেরই পুনরুক্তি বলতে পারেন। তবু বলছি এজন্য যে কিছু কিছু ব্যাপার আরও স্পষ্ট করে আমি জানতে চাই।
কি জানতে চান বলুন?
গত রাত্রে আপনার মামার নিহত হবার কথাটা জানবার আগে আপনি কোথায় ছিলেন ও কি অবস্থায় ছিলেন? অর্থাৎ ঠিক ঐ সময়টাতে-সোয়া তিনটে থেকে পৌনে চারটে পর্যন্ত আপনি জেগে ছিলেন, না ঘুমিয়ে ছিলেন?
মুহূর্তকাল কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে অত্যন্ত মৃদু কণ্ঠে রুচিরা জবাব দেয়, আমি আমার ঘরে তখনও জেগেই ছিলাম। ঘুম আসছিল না বলে শুয়ে শুয়ে একটা উপন্যাস পড়ছিলাম।
কিরীটীর মনে হয় রুচিরা যেন শেষের দিকে একটু ইতস্ততঃ করে কথাটা শেষ করল।
হুঁ, কাল তাহলে মিথ্যে কথা বলেছিলেন যে আপনি ঐ সময় ঘুমোচ্ছিলেন! যাক গে, কাল রাত্রের মতই এমনি রাত জেগে উপন্যাস পড়াটাই কি আপনার অভ্যাস?
না। তবে ঘুম না আসা পর্যন্ত পড়ি।
পাশের ঘরে আপনার মা ঘুমিয়ে ছিলেন?
হ্যাঁ।
কিরীটী ক্ষণকাল আবার চুপ করে থাকে। অতঃপর বলে, কেউ আপনার ঘরে ঐ সময় আর ছিল না?
রুচিরা মুহূর্তকাল যেন আবার একটু ইতস্ততঃ করে, তারপর বললে, না।
জবাবটা মৃদু। হঠাৎ কিরীটী বলে ওঠে, শুনুন রুচিরা দেবী, সকালবেলা তখন নটা-দশটার সময়ই হবে, আপনি যখন আপনার ঘরে ছিলেন না, সেই সময় আপনার ঘরের মধ্যে আপনার বিনানুমতিতেই আমাকে একবার বাধ্য হয়েই যেতে হয়েছিল—
আপনি আমার ঘরে গিয়েছিলেন! বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায় রুচিরা কিরীটীর মুখের দিকে।
হ্যাঁ, শুধু আপনার ঘরেই নয়—আপনাদের প্রত্যেককেই না জানিয়ে প্রত্যেকের ঘরেই আমাকে যেতে হয়েছিল। অবশ্য ক্ষমা চাইছি সেজন্য। এবং জানেন না আপনারা কেউ যে, প্রত্যেকের ঘরেই আমি কিছু-না-কিছু সূত্রের সন্ধান পেয়েছি।
সূত্রের সন্ধান!
হ্যাঁ।
আমার ঘরে? রুচিরা হঠাৎ যেন প্রশ্নটা করে।
হ্যাঁ, আপনার ঘরেও। বলতে বলতে কিরীটী পকেটের মধ্যে সহসা হাত ঢুকিয়ে কয়েকটি দগ্ধাবশেষ সিগারেটের অংশ বের করে প্রসারিত হাতের পাতার উপর রেখে হাতটা রুচিরা দেবীর চোখের সামনে এগিয়ে ধরল এবং মৃদুকণ্ঠে বললে, এই বিশেষ সিগারেটের দগ্ধাবশেষগুলো আপনার ঘরের মেঝেতে কুড়িয়ে পেয়েছি মিস মিত্র। Special Turkish brand সিগারেট! নিশ্চয়ই আপনার ধূমপানের অভ্যাস নেই?
স্তম্ভিত নির্বাক, অসহায় দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ রুচিরা কিরীটীর প্রসারিত হাতের উপর রক্ষিত সিগারেটের অংশগুলির দিকে চেয়ে থাকে।
সামান্য শব্দও তার কণ্ঠ থেকে নির্গত হয় না।
আরও বলছি শুনুন, খোঁজ নিয়ে জেনেছি গতরাত্রে এ বাড়িতে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁদের মধ্যে একমাত্র সমীরবাবুই এই brand-এর সিগারেটে অভ্যস্ত এবং একটু বেশী মাত্রাতেই ধূমপান করে থাকেন তিনি।
নিষ্করুণ ও কঠোর কিরীটীর অদ্ভুত শান্ত কণ্ঠস্বর।
অব্যর্থ তীক্ষ্ণ শর সে যেন নিক্ষেপ করেছে।
শরাহত পক্ষিণীর দৃষ্টি রুচিরার দুই চোখের তারায় ঘনিয়ে ওঠে। একটা বোবা যন্ত্রণা যেন তার চোখমুখে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
রুচিরা দেবী! আবার কিরীটীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল, এবারে বলবেন কি, অত রাত্রে সমীরবাবু কেন আপনার ঘরে গিয়েছিলেন? এবং কখনই বা গিয়েছিলেন, আর কতক্ষণই বা সেখানে মানে আপনার ঘরে ছিলেন?
তথাপি নির্বাক রুচিরা।
জবাব দিন রুচিরা দেবী! রায়বাহাদুরের হত্যার ব্যাপারে একবার যদি আপনি তালিকার মধ্যে এসে যান, আপনারও অবস্থা ঠিক আপনার মাসতুতো ভাই শকুনির মতই হবে—হাজত
একটা অস্ফুট আর্ত শব্দ কেবল রুচিরার কণ্ঠ হতে নির্গত হল। কিন্তু কোন কথাই সে বলতে পারল না।
কিরীটী আবার বলে, শুনুন, মিথ্যে আপনি নিজেকে গোলমালের মধ্যে জড়িয়ে ফেলছেন। হত্যার ব্যাপারে সন্দেহ—এ ঠিক মাকড়সার বিষাক্ত রস-গরল। গরল গায়ে লাগলেই ঘা দেখা দেবে। Come out with it! বলুন–
বিশ্বাস করুন মিঃ রায়, সত্যিই আমি মামার হত্যার ব্যাপারের কিছুই জানি না।
অত্যন্ত দ্রুত কথাগুলি বলে রুচিরা যেন হাঁপাতে থাকে।
সে কথা তো আপনাকে আমি জিজ্ঞাসা করিনি। আমি জিজ্ঞাসা করছি কাল রাত্রে কখন সমীরবাবু আপনার ঘরে গিয়েছিলেন এবং কতক্ষণই বা ছিলেন? কেনই বা গিয়েছিলেন এবং তিনি স্ব-ইচ্ছায়ই গিয়েছিলেন, না আপনিই তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন? বলুন জবাব দিন!
আ—আমি তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম।
আপনি?
হ্যাঁ।
কখন গিয়েছিলেন তিনি?
রাত তিনটে বাজার বোধ হয় কয়েক মিনিট পরেই। বই বন্ধ করে আমি শুতে যাব, ঠিক এমনি সময় তিনি আমার ঘরে এসে ঢোকেন।
অত রাতে তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন?
না, সন্ধ্যার সময় ডেকেছিলাম—এসেছিলেন ঐ সময়।
হুঁ, তাহলে রায়বাহাদুরের ঘর থেকে বের হয়ে সোজা তিনি আপনার ঘরেই এসে ঢুকেছিলেন! কতক্ষণ ছিলেন?
বোধ করি আধঘণ্টাটাক হবে।
আধ ঘণ্টা, না ঘণ্টাখানেক?
তা ঘণ্টাখানেকও হতে পারে।
হুঁ। ঘণ্টাখানেক যদি হয় তাহলে রাত তিনটে থেকে চারটে পর্যন্ত আপনারা দুজনে আপনার ঘরেই ছিলেন?
হ্যাঁ।
কিন্তু কেন তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন?
সমরের কথাটা বলতেই।
বলেছেন তাঁকে?
না।
কেন?
সুযোগ পাইনি।
কেন?
কেবলই তিনি অন্য কথা বলতে লাগলেন!
এবারে কিরীটীর দ্বিতীয় শর নিক্ষিপ্ত হল রুচিরার প্রতি, দ্বিতীয় প্রশ্ন।
এবারে বলুন রায়বাহাদুরের মৃত্যুসংবাদটা আপনাদের কে দিয়েছিল?
সে তো কালই বলেছি, ছোটমামা!
দুঃশাসনবাবু?
হ্যাঁ।
দুঃশাসনবাবু যখন আপনাকে খবরটা দেন, সে সময় সমীরবাবুও সেখানে উপস্থিত ছিলেন কি?
কিরীটীর প্রশ্নে রুচিরা কেমন যেন একটু ইতস্ততঃ করতে থাকে।
বলুন?
না, মামার পায়ের শব্দ শুনে ঘরে কেউ আসছে টের পেয়ে চট করে ঘরের সংলগ্ন বাথরুমের মধ্যে গিয়ে আত্মগোপন করেছিল সমীর।
হুঁ। দুঃশাসনবাবু আপনাকে কি বলেছিলেন?
বলেছিলেন, সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে—দাদাকে ছোরা দিয়ে কে যেন হত্যা করেছে, শীগগিরি আয়-বলেই তিনি ঘর থেকে চলে যান।
তারপর?
কিন্তু সংবাদটা এত আকস্মিক যে কিছুক্ষণের জন্য আমি যেন বোবা হয়ে গিয়েছিলাম।
তারপর?
তারপর মাকে গিয়ে সংবাদ দিই।
আপনার মা ঐ সময় জেগে ছিলেন, না ঘুমিয়ে ছিলেন?
ঘুমিয়েই ছিলেন বিছানায়।
আচ্ছা একটা কথা বলতে পারেন, আপনার মা কি গরম জামা গায়ে দিয়েই রাত্রে বিছানায় ঘুমোন?
না, কেন বলুন তো?
না, তাই বলছিলাম। আপনি হয়ত জানেন না বা লক্ষ্য করবারও সময় পাননি রুচিরা দেবী, গতরাত্রে আপনি যখন আপনার মাকে দুঃসংবাদটা দিতে যান তিনি তখন জেগেই ছিলেন। অর্থাৎ ঘুমের ভান করে শয্যায় শুয়েছিলেন মাত্র। তবে এখন বুঝছি আপনার কথাই সত্যি!
রুচিরা কয়েক মুহূর্ত ফ্যালফ্যাল করে কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে থাকে। গতরাত্রে সে যখন তার মাকে ডাকতে যায়, মা তাহলে জেগেই ছিলেন? বিছানায় চোখ বুজে শুয়ে থেকেও ঘুমের ভান করে ছিলেন? কিন্তু কেন? তবে কি-রুচিরার চিন্তাস্রোতে বাধা পড়ল কিরীটীর প্রশ্নে!
এখন বোধ হয় বুঝতে পারছেন, গতরাত্রে আপনার ও সমীরবাবুর মধ্যে যে আলোচনাই হয়ে থাক—সমস্ত কিছুই তিনি পাশের ঘরে জেগে থাকার দরুন শুনতে পেয়েছেন!
কিন্তু কেন—মা তা করতেই বা যাবেন কেন?
কিরীটী এবারে হেসে ফেলে, তারপর স্মিতকণ্ঠে বলে, তা কেমন করে বলি বলুন! আপনাদের সাংসারিক ব্যাপার তো আমার জানা সম্ভব নয়!
But I hate simply hate this sort of spying! এ ধরনের কারও কথা আড়ি পেতে শোনা আমি অত্যন্ত ঘৃণা করি। অত্যন্ত বিরক্তিমিশ্রিত রুক্ষকণ্ঠে প্রত্যুত্তর দিল রুচিরা।
কিরীটী তার অনুমানকে যাচাই করবার এমন সুবর্ণ সুযোগটি হেলায় যেতে দিল না। সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করে, হয়ত তাঁর ইচ্ছা আপনি সমীরবাবুকেই বিবাহ করেন, তাই!
রুচিরার গোপন ব্যথার স্থানে অতর্কিতেই আঘাত করে কিরীটী। মুহূর্তে রুচিরার সমগ্র চোখমুখ রাগে ও উত্তেজনায় রক্তিম বর্ণ ধারণ করে।
তিক্ত কঠোর কণ্ঠে রুচিরা আর অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করেই বলে ওঠে, তাঁর ইচ্ছা। নিজের ভালমন্দ বিবেচনা করবার মত যথেষ্ট বয়েস হয়েছে আমার। কারোর ইচ্ছাকে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে মেনে নেবতা সে যিনিই হোন না কেন, অন্তত রুচিরার দ্বারা তা হবে না।
শান্ত হোন রুচিরা দেবী, এসব ব্যাপারে বৃথা উত্তেজিত হয়ে তো কোন লাভ নেই। আপনি সমীরবাবুকে বিবাহ করতে চান না সে কথা সুস্পষ্টভাবে আর কাউকে না পারেন সমীরবাবুকেও তো অন্ততঃ জানিয়ে দিতে পারতেন এতদিন। আর সেই কথাই আমি একটু আগে বলছিলাম।
সেই কথাই কাল রাত্রে তাকে বলব বলে ডেকে এনেছিলাম গোপনে, কিন্তু লোভী সে —কিছুতেই আমার কথা শুনতে চাইছিল না। যাক গে, না শোনে না শুনুকতাছাড়া আজ আর বড়মামাও বেঁচে নেই, দায় থেকে আমিও মুক্ত। মার এবং বিশেষ করে তাঁরই ইচ্ছায় এ ব্যাপারটা এতদূর অগ্রসর হয়েছিল। এইখানেই এর শেষ।
আপনার বড়মামা রায়বাহাদুরই বুঝি ঐ বিবাহে ইচ্ছুক ছিলেন?
হ্যাঁ। সমীরের সঙ্গে আমার বিবাহ দিয়ে বড়মামা ঐ সমীরের গ্রাস থেকে একটা কোলিয়ারী বাঁচাতে চেয়েছিলেন। মাত্র দিন-দুই হল দাদুর মুখে আমি কথাটা জানতে পেরেছি। আগে তো জানতেই পারিনি।
কে? অবিনাশবাবু আপনাকে বলেছিলেন ও-কথা?
হ্যাঁ। আমি অবিশ্যি প্রথম থেকেই কথাটায় আমল দিইনি। কিন্তু বিশেষ করে ঐ কথাটা কয়েকদিন আগে জানবার পর কাল রাত্রে খোলাখুলি ভাবেই আমার অমত জানিয়ে দেব ভেবেছিলাম সমীরকে ডেকে এনে।
রুচিরার গতরাত্রের সত্নরচিত গোপনতার আড়ালটুকু কিরীটী সুকৌশলে আঘাতের পর আঘাত দিয়ে ভেঙে একেবারে চুরমার করে দিল। রুচিরা সব কিছু অতঃপর প্রকাশ করে দিল।
আর একটা কথার জবাব চাই আমি আপনার কাছ থেকে মিস মিত্র।
কি?
গতকাল আপনার ছোটমামা যখন আপনাকে রায়বাহাদুরের নিহত হবার সংবাদটা দেওয়ার কথা অস্বীকার করলেন তখন আপনি তাঁকে বলেছিলেন—তাঁর কীর্তির কথা নাকি কারও জানতে বাকি নেই! কেন তাঁকে সে কথা আপনি বলেছিলেন বলবেন কি?
কি আর—এই বিষয়সম্পত্তি নিয়ে ওঁর এইখানে আসা অবধিই তো বড়মামার সঙ্গে নিত্য প্রায় খিটিমিটি চেঁচামেচি হত, বড়মামা যে অসুস্থ এই সামান্য কথাটাও যেন উনি ভুলে যেতেন—
তাই কি?
শুধু কি তাই! বলতে লজ্জা হয় মিঃ রায়, মার মুখে শুনেছি—একদিন নাকি উইলের ব্যাপারে ছোটমামা threaten পর্যন্ত করেছেন!
১৯. কিরীটী রুচিরাকে বিদায় দিয়ে
কিরীটী রুচিরাকে বিদায় দিয়ে ডেকে পাঠিয়েছে মুন্না বাঈজীকে।
মুন্না বাঈজী ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।
বসুন, নমস্কার। কিরীটী চোখের ইঙ্গিতে তার সম্মুখস্থিত শূন্য চেয়ারটি দেখিয়ে দিল।
মুন্না নিঃশব্দে উপবেশন করে।
আমাকে আপনি ডেকেছিলেন মিঃ রায়? প্রতিনমস্কার করে মুন্না প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ। গতরাত্রে এ বাড়িতে যে দুর্ঘটনাটা ঘটে গেছে, সব শুনেছেন বোধ হয়?
হ্যাঁ।
কার কাছে শুনলেন?
বাবুর মুখেই শুনেছি। গত রাত্রেই সব আমাকে তিনি বলেছেন।
সেই সম্পর্কেই আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন আমি করতে চাই।
বলুন?
কাল কত রাত পর্যন্ত আপনি গানবাজনা করেন?
রাত বোধহয় তিনটে বাজবার কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত।
তারপর বুঝি আপনি শুতে যান?
হ্যাঁ।
আবার কখন কাকাসাহেব আপনাকে ডেকে পাঠান তাঁর ঘরে?
বোধ হয় রাত সাড়ে চারটে কি পৌনে পাঁচটা হবে তখন, আকাশ ফিকে হয়ে আসছে—
অবিনাশবাবুর ঘরে ঢুকে কি দেখলেন?
দেখলাম ঘরের মধ্যে তিনি অস্থির ভাবে পায়চারি করছেন। আমার পদশব্দেও তাঁর খেয়াল হয়নি। আমিই তখন গলাখাঁকরি দিয়ে তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করবার চেষ্টা করলাম। এবারে তিনি আমার দিকে ফিরে তাকালেন এবং বললেন, কে, ও মুন্না—এস। আমাদের সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে মুন্না। দুযযাধন—দুর্যোধনকে কে যেন হত্যা করেছে। রায়বাহাদুর অসুস্থ, আমি তিন মাস আগে এখানে যখন আগেরবার মুজরা নিয়ে আসি তখুনি শুনে গিয়েছিলাম। এবারেও এসে শুনেছিলাম তাঁর অবস্থা নাকি একই রকম।
এবার কতদিন হল এসেছেন এখানে?
দিনপাঁচেক হল এসেছি।
সহসা এমন সময় দ্বারে করাঘাত শোনা গেল বাইরে থেকে।
কিরীটী প্রশ্ন করল, কে?
আমি দুঃশাসন। দালাল সাহেব এসেছেন, আপনাকে ডাকছেন।
কিরীটী বলে, আসুন মিঃ চৌধুরী—ভিতরে আসুন।
দুঃশাসন চৌধুরী দরজা ঠেলে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতেই, মুন্না নিজের অজ্ঞাতেই চোখ তুলে সামনের দিকে তাকিয়েছিল।
দুঃশাসনও মুন্না বাঈজীর প্রতি দৃষ্টি পড়তেই যেন সহসা থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে চেয়ে থাকে।
ব্যাপারটা কিরীটীর তীক্ষ্ণ সজাগ দৃষ্টি এড়ায় না, সেও ওদের দিকে তাকিয়ে থাকে।
দুঃশাসন চৌধুরীই সর্বপ্রথম যেন কতকটা আত্মগত ভাবেই অস্ফুট কণ্ঠে বললেন, কে?
কিন্তু সেই সঙ্গে তাঁর মুখের চেহারাটাই সম্পূর্ণ বদলে গেছে।
সুস্পষ্ট একটা আতঙ্ক যেন ফুটে ওঠে সমস্ত মুখখানিতে। সহসা বিচিত্র একটা হাসি যেন বাঈজীর অমন সুন্দর মুখখানিকেও বীভৎস করে তুলল। চাপা কণ্ঠে বাঈজী বলে, হ্যাঁ। খুব আশ্চর্য হয়ে গেছেন মিঃ চৌধুরী এখানে আমায় দেখে, না? মরিনি, চেয়ে দেখুন আজও বেঁচেই আছি।
বাঈজীর দিকে চেয়ে কিরীটীই এবার প্রশ্ন করল, আপনি তাহলে জানতেন না দুঃশাসনবাবু এই বাড়িতেই থাকেন?
না।
বলেন কি? আপনাদের পূর্বপরিচয় থাকা সত্ত্বেও জানতেন না? কিরীটী দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করে।
না।
আশ্চর্য! সাবিত্রী তুমি এখানে? এতক্ষণে কোনমতে কথাটা উচ্চারণ করলেন যেন শান্তকণ্ঠে দুঃশাসন চৌধুরী।
সাবিত্রী হঠাৎ হেসে ওঠে, কিন্তু পরক্ষণেই হাসিটা থামিয়ে বলে, সাবিত্রী সাবিত্রী তো অনেকদিন আগেই মারা গেছে চৌধুরী মশায়। এ যা দেখছেন বলতে পারেন তার প্রেতাত্মা। অধীনের নাম মুন্না বাঈজী।
বিষাক্ত একটা কদর্য শ্লেষ যেন বাঈজীর কণ্ঠস্বরে প্রকাশ পায়।
মুন্নার জবাব শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেন অকস্মাৎ দুঃশাসন চৌধুরী মুন্নার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে কিরীটীর দিকে চেয়ে মৃদুকণ্ঠে বললেন, মিঃ রায়, দালাল সাহেব বোধ হয় আপনাকে ডাকছেন।
বোঝা গেল দুঃশাসন চৌধুরী যে কারণেই হোক ঘর ত্যাগ করবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
কিরীটী মৃদু হেসে বলে, যান দুঃশাসনবাবু, দালাল সাহেবকে এ-ঘরেই ডেকে নিয়ে আসুন।
সঙ্গে সঙ্গে দুঃশাসন চৌধুরী ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। মনে হল তিনি যেন বাঁচলেন।
মুন্না বাঈজী নির্বাক নিশ্চল তখনও বসে আছে। হঠাৎ কিরীটী বাঈজীকে প্রশ্ন করে, কত দিনের আলাপ আপনাদের পরস্পরের, মুন্না দেবী?
অ্যাঁ!…..যেন চমকে ওঠে বাঈজী।
শুনেছি মিঃ দুঃশাসন চৌধুরী গত পাঁচ বছর ধরে ভারতবর্ষে ছিলেন না, আপনাদের আলাপ বুঝি তারও আগে?
হ্যাঁ। তা পাঁচ বছর হবে বৈকি। হ্যাঁ, পাঁচ বছর। অস্পষ্ট ভাবেই বাঈজী কথা কটি উচ্চারণ করে।
কিরীটী লক্ষ্য করে বাঈজী অন্যমনস্ক ও চিন্তিত। সে আবার প্রশ্ন করল, ইতিমধ্যে আর আপনাদের পরস্পরের দেখাসাক্ষাৎ হয়নি বুঝি?
না। মৃদু কণ্ঠে প্রত্যুত্তর দিল বাঈজী।
এমন সময় বাইরে দালাল সাহেবের ভারী জুতোর মম্ মম্ আওয়াজটা পাওয়া গেল। এদিকেই আসছেন তিনি বোঝা গেল।
আপনি আপাততঃ যেতে পারেন, তবে আপনি আপনার ঘরে থাকবেন মুন্না দেবী। আমি ঘণ্টাখানেক বাদেই আপনার ঘরেই আসছি আবার। আপনার সঙ্গে আমার আরও কথা আছে। দালাল সাহেবের সঙ্গে কথা বলেই আমি আসছি।
দরজা ঠেলে দালাল সাহেব ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করলেন এবং বাঈজী শ্লথ চরণে বের হয়ে গেল।
আসুন দালাল সাহেব, বসুন। কিরীটী দালাল সাহেবকে আহ্বান জানাল।
দালাল সাহেব চেয়ারটার উপরে বসতে বসতে বললেন, ইয়ে বহুত তাজ্জব কি বা হ্যায় মিঃ রায়, শকুনিবাবু তো কই বাত নেহি মানতা!
কি ব্যাপার, কি মানছে না সে?
ও মু নেহি খুলতাইয়ে আপকো হাম জরুর কঁহতে হে, ওহি রায়বাহাদুরকো জান লিয়া—
বলেন কি?
হাঁ হাঁ।
অতঃপর দুজনের মধ্যে নিম্নলিখিত আলোচনা শুরু হয়।
শকুনিবাবুকে ধরে এনে হাজতের মধ্যে বন্দী করা অবধি সেই যে লোকটা মুখ বন্ধ করেছে এখন পর্যন্ত একটি কথাও ওর কাছ থেকে আদায় করতে পারেনি করিৎকমা দালাল সাহেব।
কিন্তু এও আপনাকে বলে দিচ্ছি মিঃ রায়, দালাল সাহেব বলতে লাগলেন, রায়বাহাদুরকে হত্যা করেছে ওই শকুনিই। লোকটার চেহারা আর চোখের চাউনি দেখেছেন, একেবারে পাক্কা ক্রিমিন্যালের মত।
দালাল সাহেব কিরীটীকে বোঝাবার চেষ্টা করেন।
কিরীটী দালাল সাহেবের প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে কেবল প্রশ্ন করে, ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পাওয়া গেছে মিঃ দালাল?
হ্যাঁ। ছুরিকাঘাতে মৃত্যু হয়েছে। একেবারে হার্ট পর্যন্ত ছুরি গিয়ে ঢুকেছে।
Stomach content chemical analysis-এর জন্য পাঠানো হয়েছে?
হ্যাঁ। কিন্তু হত্যাকারীকেই যখন আমরা মুঠোর মধ্যে পেয়েছি, তখন—
মুঠোর মধ্যে পেয়েছেন—কিন্তু প্রমাণ? প্রমাণ করতে পারবেন কি উনিই রায়বাহাদুরের হত্যাকারী?
প্রমাণ? আমাদের ওর পেটের কথা টেনে বের করতে হবে। সে tactics আমার জানা আছে মিঃ রায়। তাছাড়া কিছু কিছু প্রমাণও already আমাদের হাতের মুঠোর মধ্যেই তো এসেই গেছে।
কি রকম? কি কি প্রমাণ পেয়েছেন বলুন তো, যাতে করে আপনি স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে উনিই অপরাধী, রায়বাহাদুরের হত্যাকারী?
প্রথমতঃ ধরুন, উনি অপরাধী না হলে অমন করে না বলে কয়ে হঠাৎ ওভাবে পালাতেই বা যাবেন কেন? দ্বিতীয়তঃ, অপরাধীই যদি উনি না হন এমনি করে মুখ বুজেই বা থাকবেন কেন? সা সা সব কথা যা জানেন খুলে বললেই তো পারেন।
আমি আপনাকে বলতে পারি মিঃ দালাল, ঠিক অপরাধী বলে নয়, স্রেফ ভয় পেয়েই হয়ত উনি পালাবার চেষ্টা করেছিলেন।
ভয় পেয়ে! কিসের জন্য ভয় পেয়ে?
কাপড়ে তাঁর রক্তের দাগ ছিল বলে।
রক্তের দাগ! কোন কাপড়ে?
তাঁর ঘরেই যে ধুতিটা এক কোণে পড়েছিল তাতেই রক্তের দাগ ছিল। কিন্তু একটা কথা হয়ত এখনও আপনি শোনেননি মিঃ দালাল, মৃত রায়বাহাদুর নিহত হবার কয়েকদিন আগে টাকাকড়ি ও উইলের ব্যাপার নিয়ে রায়বাহাদুর ও দুঃশাসন চৌধুরীর মধ্যে বিশ্রী একটা বচসা হয়ে যায়, এমন কি দুঃশাসন চৌধুরী রায়বাহাদুরকে নাকি threaten পর্যন্ত করেছিলেন!
বলেন কি? এখুনি তো তাহলে একবার দুঃশাসন চৌধুরীকে ডেকে ব্যাপারটা ভাল করে জেনে নেওয়া উচিত?
তাতে করে বিশেষ কিছু সুবিধা হবে বলে মনে হয় না। Most probably he will deny the whole story.
কিন্তু তাই বলে তাকে আমরা সহজে নিষ্কৃতি দেব না। কিন্তু কার মুখে কথাটা শুনলেন?
স্রেফ ঘটনাচক্রেই ব্যাপারটা জানা সম্ভব হয়েছে। আড়ি পেতে শুনেছি গান্ধারী দেবী কাকাসাহেবকে যখন কথাটা বলছিলেন।
কাকাসাহেব মানে ঐ বুড়োটা?
হ্যাঁ। রায়বাহাদুরের কাকা অবিনাশ চৌধুরী।
আমি তার সঙ্গে কথা বলতে চাই।
যান না। তিনি বোধহয় এখন তাঁর ঘরেই আছেন।
দালাল সাহেব অতঃপর হন্তদন্ত হয়েই অবিনাশ চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করবার জন্য ঘর হতে বের হয়ে গেলেন।
কিরীটী মুন্না বাঈজীর ঘরের দিকে অগ্রসর হয়।
২০-২১. কথাটা আর চাপা রাখা গেল না
কথাটা আর চাপা রাখা গেল না।
দালাল সাহেবই সকলকে ঢাক ঢোল পিটিয়ে জানিয়ে দিলেন যে, রায়বাহাদুরের হত্যাপরাধেই শকুনি ঘোষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামার হত্যাপরাধে শকুনি ধৃত হয়েছে এবং বর্তমানে সে হাজতে বাস করছে।
শীতের বেলায় শেষ আলোর ম্লান রশ্মিটুকু একটু একটু করে ক্রমশঃ ধরিত্রীর বুক থেকে যেন মিলিয়ে গেল। সন্ধ্যার ধূসর ছায়া বাদুড়ের মত ডানা মেলে যেন চারিদিকে ঘনিয়ে আসছে একটা কালো পর্দার মত শ্রীনিলয়ের উপরে। কোথাও এতটুকু সাড়াশব্দ পর্যন্ত নেই।
অন্ধকারের সঙ্গে সঙ্গে একটা আশঙ্কা দুঃস্বপ্নের মত সকলেরই মনকে যেন আচ্ছন্ন করে ফেলছে।
সন্ধ্যা নাগাদ ডাঃ সেনও এসে শ্রীনিলয়ে উপস্থিত হলেন।
কিরীটীর ঘরের মধ্যে সকলে উপস্থিত হয়। একমাত্র দালাল সাহেব বাদে, কাকাসাহেব অবিনাশ চৌধুরী, দুঃশাসন চৌধুরী, বৃহন্নলা চৌধুরী, তার স্ত্রী পদ্মা দেবী, গান্ধারী দেবী, তাঁর মেয়ে রুচিরা দেবী, সমীর বোস, নার্স সুলতা কর, ডাঃ সানিয়াল, ডাঃ সমর সেন এবং কিরীটী নিজে।
একমাত্র কিরীটী ছাড়া ঘরের মধ্যে উপস্থিত অন্যান্য সকলের চোখেমুখেই কেমন একটা যেন আতঙ্কের ভাব। কিরীটী তার পাইপটা হাতে নিয়ে সকলের দিকে একবার তাকিয়ে বলে, আপনারা নিশ্চয় ভাবছেন আপনাদের সকলকে কেন এ-সময় এ-ঘরে আমি ডেকে এনেছি—একটু থেমে বলে, আপনারা সকলেই দালাল সাহেবের মুখে শুনেছেন রায়বাহাদুরের হত্যা-অপরাধে বোধহয় শকুনিবাবুকে পুলিস গ্রেপ্তার করেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত পুলিস অনেক চেষ্টা করা সত্ত্বেও তার মুখ থেকে কোন কথাই বের করতে পারেনি। অথচ আপনারা জানেন না কিন্তু আমি জানি, শকুনিবাবু যদি মুখ খোলেন হত্যারহস্যটা জলের মত হয়ে যাবে এখনি। কারণ তিনি এই হত্যার ব্যাপারে এমন কতকগুলো মারাত্মক কথা জানেন যা একবার পুলিসের গোচরীভূত হলে হত্যাকারী আর তখন আত্মগোপন করে থাকতে পারবে না।
কিরীটীর কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই গান্ধারী দেবী প্রশ্ন করে, তবে কি শেকো দাদাকে হত্যা করেনি?
না। বজ্রকঠিন কিরীটীর কণ্ঠস্বর, কিন্তু আমি জানি হত্যাকারী কে! হত্যাকারী যতই চতুর হোক এবং যত বুদ্ধিরই পরিচয় দিয়ে থাক না কেন, এমন একটি মারাত্মক চিহ্ন সে রায়বাহাদুরের শয্যার পাশে রেখে গিয়েছে গতরাত্রে হত্যা করতে এসে, যেটি আজ দুপরে সেই ঘরটা পুনরায় গিয়ে ভাল করে পরীক্ষা করে দেখবার সময়ই আমার নজরে পড়েছে। সেটি কি জানেন?
সকলেই চেয়ে আছে কিরীটীর মুখের দিকে স্থির অপলক দৃষ্টিতে।
কিরীটী বলে, যে ছোরাটা গতরাত্রে রায়বাহাদুরকে হত্যা করবার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল তারই শূন্য খাপটা। তাড়াতাড়িতে হত্যাকারী খাপটা ঘরের মধ্যে ভুলে ফেলে এসেছিল। সেই শূন্য চামড়ার খাপটার গায়েই হত্যাকারীর আঙুলের ছাপ পাওয়া যাবে যা থেকে সহজেই প্রমাণ। করা যাবে হত্যাকারী কে?
ঘরের মধ্যে উপস্থিত সব কটি নরনারীই একেবারে যেন বোবা। সূচ পতনের শব্দও বোধ হয় শোনা যাবে। কারও মুখে একটি শব্দ পর্যন্ত নেই।
কিরীটী আবার বলতে থাকে, আপনাদের সকলের কাছেই আমার শেষ অনুরোধ এবং সেইটুকু জানবার জন্যই আপনাদের সকলকে আমি এখানে ডেকে পাঠিয়েছি, এখনও যদি আপনাদের কারও কিছু জানা থাকে যা এখনও আপনারা গোপন করে রেখেছেন আমাকে বলুন। অন্যথায় পুলিস আপনাদের প্রত্যেককেই নাজেহালের একেবারে চূড়ান্ত করবে। অপমান ও লাঞ্ছনারও অবধি হয়ত রাখবে না। দালাল সাহেব সহজে আপনাদের কাউকে নিষ্কৃতি দেবে
জানবেন। কিন্তু তথাপি সব নিশ্চুপ। কারও বাক্যস্ফূর্তিনেই। বোবা ভীত দৃষ্টিতে কেবল পরস্পর পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে।
একজন পুলিশ অফিসার ঘরের বাইরে দ্বারের নিকট প্রহরায় দাঁড়িয়েছিল, সে এমন সময় ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে কিরীটীর কানের কাছে মুখ নিয়ে নিম্নস্বরে যেন কি বলল। কিরীটী সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে সকলকে সম্বোধন করে বলে, বেশ, আপনাদের আমি আধ ঘণ্টা সময় দিচ্ছি, পরস্পর আপনারা আলোচনা করে দেখুন। নীচের থেকে আমি আধ ঘণ্টার মধ্যেই কাজ সেরে আসছি।
চলুন। কিরীটী পুলিস অফিসারটিকে সঙ্গে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
.
নীচের একটি ঘরে নিঃশব্দে পুলিসের প্রহরায় মাথা নীচু করে একটা চেয়ারে শকুনি ঘোষ বসেছিল। কিরীটীর পদশব্দে মুখ তুলে তাকাল। চোখের ইঙ্গিতে কিরীটী পুলিসের লোকটিকে ঘর ত্যাগ করার নির্দেশ দিতেই সে ঘর থেকে নিঃশব্দে বের হয়ে গেল।
ঘরের মধ্যে আর তৃতীয় প্রাণী নেই, কিরীটী আর শকুনি ছাড়া।
কিরীটীকে একা ঘরের মধ্যে পেয়ে এতক্ষণে সহসা শকুনি কান্নায় যেন ভেঙ্গে পড়ে। অরুদ্ধ কণ্ঠে বলে, আমাকে বিশ্বাস করুন মিঃ রায়, আমি—আমি মামাকে খুন করিনি।
কিন্তু পুলিস যে সে কথা বিশ্বাস করতে চাইছে না!
কেন—কেন? আমি নিদোষ, আমি জানি না, কিছুই জানি না।
কিন্তু আপনার ঘরের কোণে একটা ধুতি পাওয়া গিয়েছে, তাতে রক্তের দাগ এল কি করে?
শকুনি নিশ্চুপ।
তাছাড়া গতকাল রাত্রে সাড়ে তিনটে থেকে রাত সাড়ে চারটে পর্যন্ত আপনি কোথায় ছিলেন? ঘরে ছিলেন না তো?
আমি—
অস্বীকার করবার চেষ্টা করবেন না। আমি বলছি আপনি ঘরে ছিলেন না—কোথায় ছিলেন? এখনও বলুন? কথার জবাব দিন?
কুণ্ডলেশ্ববাবুর ঘরে গিয়েছিলাম। দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে শকুনি জবাব দিল।
কেন গিয়েছিলেন সেখানে?
আমি—মানে—
মদ খেতে, তাই না?
শকুনি চুপ।
কতদিন ধরে মদ্যপান করছেন?
মদ্যপান!
হ্যাঁ। শমাই বোধ হয় ঐ ব্যাপারে আপনাকে রপ্ত করিয়েছেন। আজ সকালেও আপনার কথা বলবার সময় মুখে অ্যালকোহলের গন্ধ পেয়েছি।
বছরখানেক হবে।
হুঁ। তারপর কখন ফিরে আসেন সেখান থেকে কাল রাত্রে?
রাত সাড়ে চারটে হবে বোধ করি তখন।
সাধারণতঃ কি আপনি ঐ সময়েই শমার ঘরে যেতেন মদ খেতে?
হ্যাঁ। পাছে জানাজানি হয়ে যায় তাই ঐ সময়েই যেতাম তার ঘরে।
পয়সা কে যোগাত, আপনি নিশ্চয়ই?
হ্যাঁ।
ঘরে ফিরে এসে কি দেখেন?
রক্তাক্ত আমারই পরনের একটা ধুতি ঘরের কোণে মেঝেতে পড়ে আছে। প্রথমটা আমারই পরিধানের একটা ধুতিতে রক্ত দেখে এমন হকচকিয়ে গিয়েছিলাম যে কি করি বুঝে উঠতে পারিনি। তারপর রক্তের দাগগুলো কুঁজোর জল দিয়ে ধুয়ে ফেলি কাপড় থেকে।
হুঁ। আচ্ছা রায়বাহাদুরের নিহত হবার সংবাদ আপনি গতরাত্রেই পেয়েছিলেন, তাই না?
না। গতরাত্রে পাননি সংবাদটা?
না।
তবে?
আজ সকালে ঘুম ভাঙার পর জানতে পারি।
.
সেই রাতেই। রাত বোধ করি পৌনে চারটে হবে।
নিঃশব্দ নিঝুম শীতের রাত। কেবল একটুক্ষণ আগে নাইট কিপার হুম সিংয়ের খবরদারীর চিৎকারটা শোনা গিয়েছে।
সেই ঘর। গতকাল রাত্রে এই ঘরের মধ্যেই রায়বাহাদুর ছুরিকাঘাতে আততায়ীর হাতে নিষ্ঠুরভাবে নিহত হয়েছে।
আজ শূন্য সেই শয্যা। কেবল গত রাতের নীল ঘেরাটোপে ঢাকা বাতিটা আজ নেভানোনা।
ঘরের একধারে ক্যাম্পখাটের উপর নিদ্রাভিভূত কিরীটী। আর কেউ ঘরের মধ্যে এই মুহূর্তে নেই। ঘরের দেয়ালে টাঙানো দেয়াল-ঘড়িটার একঘেয়ে টকটক শব্দ কেবল শূন্য ঘরের মধ্যে যেন সজাগ সতর্কবাণী উচ্চারণ করে চলেছে অন্ধকারের মধ্যে। কিরীটী নিশ্চিন্ত মনে ঘুমুচ্ছে। সহসা নিঃশব্দে ঘরের সংলগ্ন বাথরুমের দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে গেল। তারপরই ঘরের মধ্যে অতি-সতর্ক পদসঞ্চারে প্রবেশ করল এক ছায়ামূর্তি। ছায়ামূর্তি পায়ে পায়ে নিঃশব্দে এগিয়ে যায় নিদ্রিত কিরীটীর শয্যার দিকে।
অল্প পরে আর একটি ছায়ামূর্তি প্রবেশ করে সেই একই পথে। প্রথম ছায়ামূর্তি টেরও পেল না দ্বিতীয় ছায়ামূর্তি যে তাকে অনুসরণ করে ঘরে ঐ মুহূর্তে তার পেছনেই প্রবেশ করল অন্ধকারে।
শায়িত কিরীটীর শয্যার একেবারে কাছে এসে দাঁড়াল প্রথম ছায়ামূর্তি, আর ঠিক সেই মুহর্তে যেন চোখের পলকে ভোজবাজির মত কিরীটী একটা গড়ান দিয়ে একেবারে শয্যা থেকে নীচে পড়ে গেল এবং পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেন একটা আর্ত করুণ চিৎকার অন্ধকারকে চিরে দিয়ে গেল।
মাটিতে গড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই কিরীটী এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে ছুটে গিয়ে সুইচটা টিপে দিল এবং সঙ্গে সঙ্গে আগে থেকেই ফিট করা হাজার শক্তির বৈদ্যুতিক বাতিটা জ্বলে ওঠে। মুহূর্তে ঘরের অন্ধকার দূর হয়ে উজ্জ্বল আলোয় চারদিক ঝলমল করে ওঠে।
দালাল সাহেব কিরীটীর পূর্ব-নির্দেশমত এতক্ষণ তার খাটের তলাতেই ওৎ পেতে ছিলেন। তিনিও ততক্ষণে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন কিরীটীর পাশে।
রক্তাক্ত কলেবরে সামনের মেঝেতেই বসে হাঁপাচ্ছেন দুঃশাসন চৌধুরী। পেছনে রক্তমাখা হাতে তখনও দাঁড়িয়ে বাঈজী মুন্না, তার দুচোখে হিংসার আগুন যেন জ্বলছে। সহসা মুন্না বাঈজী পাগলের ন্যায় খিলখিল করে হেসে ওঠে, হি, হি! পাঁচ বছর ধরে তোকে খুঁজে বেড়িয়েছি। প্রতিশোধ—এতদিনে প্রতিশোধ নিয়েছি। কেমন কেমন হয়েছে!
Whats all this Mr. Roy? এতক্ষণে বিহ্বল হতচকিত দালাল সাহেবের কন্ঠে স্বর ফোটে।
কিরীটী দালাল সাহেবের প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে ততক্ষণে এগিয়ে গিয়ে ভূপতিত দুঃশাসনের ক্ষতস্থান থেকে বিদ্ধ ছোরাটা টেনে বের করতে করতে বলে, চট করে ডাক্তারকে পাশের ঘর থেকে এখুনি একবার ডেকে আনুন, মিঃ দালাল!
দালাল সাহেব ডাক্তারকে ডাকতে ছুটলেন।
প্রচুর রক্তপাতে দুঃশাসন চৌধুরীর অবস্থা তখন ক্রমশই সঙ্গীন হয়ে আসছে।
মুন্না বাঈজী তখন যেন কেমন হঠাৎ নিঝুম হয়ে গিয়েছে—বিড়বিড় করে বলে চলেছে, কেমন জব্দ! কেমন প্রতিশোধ! পাঁচ-পাঁচ বছর ধরে খুঁজে বেড়িয়েছি!
ডাঃ সানিয়াল ছুটে এলেন হন্তদন্ত হয়ে, কি ব্যাপার মিঃ রায়?
দেখুন তো! He has been stabbed!
কিন্তু দেখবার আর তখন কিছুই ছিল না। নিদারুণ ভাবে আহত ও প্রচুর রক্তপাতে চৌধুরীর অবস্থা তখন প্রায় সকল চিকিৎসার বাইরে চলে গিয়েছে। ক্রমেই নিস্তেজ হয়ে আসছে ও নাড়ী তার ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হয়ে আসছে; তথাপি পরীক্ষা করে বিষণ্ণভাবে মাথা নেড়ে ডাক্তার মৃদুকণ্ঠে বলে, আশা নেই, কিন্তু কেন এমন করে স্ট্যাব করল দুঃশাসনবাবুকে মিঃ রায়?
জবাব দিল মুন্না বাঈজী, আমি—আমি প্রতিশোধ নিয়েছি নারীহত্যার—vendetta.
কয়েকটা হেঁচকি তুলে চৌধুরীর দেহটা স্থির হয়ে গেল।
মরেছে। এবার আপনারা আমায় ধরতে পারেন। শুনুন পুলিস সাহেব, আমার আসল নাম সাবিত্রী। একদিন ঐ নরপিশাচ দুঃশাসন আমার নারীত্বকে এমনি করেই হত্যা করেছিল, তারই প্রতিশোধ নিতে আমি তাকে হত্যা করেছি। আমি ধরা দিচ্ছি, আমার প্রতিজ্ঞা পূর্ণ হয়েছে। এবারে, আমি ফাঁসি যেতেও প্রস্তুত।
ভুল করেছেন সাবিত্রী দেবী। গম্ভীর কঠিন কণ্ঠে কিরীটী হঠাৎ বলে।
চকিতে মুন্না বাঈজী কিরীটীর কথায় ফিরে কিরীটীর মুখের প্রতি তাকাল, ভুল করেছি!
হ্যাঁ, ভুল করেছেন। উনি তো দুঃশাসন চৌধুরী নন!
কিরীটীর কথায় ঘরের মধ্যে যেন বজ্রপাত হল এবং ঘরের মধ্যে উপস্থিত যুগপৎ সকলেই একই সময়ে বিস্ময়বিস্ফারিত নেত্রে কিরীটীর দিকে তাকায়।
হতভম্ব দালাল সাহেবই সর্বপ্রথম কথা বললেন, কি বলছেন আপনি মিঃ রায়! উনি—উনি দুঃশাসন চৌধুরী নন?
না।
তবে কে? কে উনি?
২১.
রায়বাহাদুরের হত্যাকারী! খোঁজ নিয়ে দেখুন এতক্ষণে হয়ত তীব্র কোন ঘুমের ওষুধের প্রভাবে আসল ও সত্যিকারের দুঃশাসন চৌধুরী তাঁর ঘরে গভীর নিদ্রায় অভিভূত হয়ে আছেন। দুঃশাসন চৌধুরীর ছদ্মবেশ উনি নিয়েছেন মাত্র।
এ কি বিস্ময়! সকলেই বাক্যহারা, নিস্পন্দ।
তবে উনি কে? দুঃশাসন চৌধুরী উনি নন? তবে কাকে—কাকে আমি হত্যা করলাম? বলতে বলতে পাগলের মতই মুন্না বাঈজী মৃতদেহটার উপরে লাফিয়ে পড়তে উদ্যত হতেই, চকিতে ক্ষিপ্রহস্তে কিরীটী বাঈজীকে ধরে ফেলে। তারপর শান্ত কণ্ঠে বলে, শুধু আপনারই নয় সাবিত্রী দেবী, ভুল আমারও হয়েছে। ব্যাপারটা যে শেষ পর্যন্ত এমনি দাঁড়ানে আমিও তা ভাবতে পারিনি–নইলে এই হত্যাকাণ্ডটা হয়ত ঘটত না। উঃ What a mistake—what a mistake!
.
কিরীটী বলছিল : হত্যাকারী যে কেবল অসাধারণ ক্ষিপ্র ও চতুর তাই নয়, সুদক্ষ একজন। অভিনেতাও! আগাগোড়াই সে দুঃশাসন চৌধুরীকে ধ্বংস করবার জন্য এমন চমৎকার ভাবে প্ল্যান করে হত্যার কাজে অবতীর্ণ হয়েছিল, যাতে করে রায়বাহাদুরের হত্যাপরাধের সমস্ত সন্দেহ নিঃসন্দেহে হতভাগ্য দুঃশাসন চৌধুরীর উপরে গিয়ে পড়ে। আর হয়েছিলও তাই। ব্যাপারটা অবশ্য আমি গতকালই বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু সবটাই আমার অনুমানের উপরে ভিত্তি বলে গতকাল রাত্রের ঐ ফাঁদটা পেতেছিলাম—ছোরার খাপের চার ফেলে। এবং রায়বাহাদুরেরই ঘরে নিজের শয়নের ব্যবস্থা করেছিলাম শুধু জানবার জন্য, কোন্ পথে হত্যাকারী আগের রাত্রে ঐ ঘরে প্রবেশ করে হত্যা করে গিয়েছিল। অবশ্য এটা স্থির জানতাম আমি, হত্যাকারী যত চতুরই হোক না কেন, রাত্রে সেই মারাত্মক একমাত্র হত্যার নিদর্শন ছোরার খাপটি সংগ্রহ করতে তাকে আসতে হবেই। কেননা হত্যাকারীর নিশ্চয়ই স্থিরবিশ্বাস হবে অত বড় মূল্যবান হত্যার প্রমাণটা আমি অন্য কোথাও না রেখে সবদা নিজের কাছে কাছেই রাখব। এখন আপনারা সকলেই বুঝতে পেরেছেন বোধ হয় যে আমার গণনায় ভুল হয়নি। সে আমার পাতা ফাঁদে পা দিয়েছে—এসেছে সে, কিন্তু এটা ভাবিনি ঐ সঙ্গে যে সাবিত্রী অর্থাৎ মুন্না বাঈজী, যার নারীত্বের মর্যাদা একদা দুঃশাসন চৌধুরী লুণ্ঠন করেছিল, প্রতিশোধ স্পৃহায় সে গানের মুজরা নিয়ে এ দুঃশাসনেরই খোঁজে দেশদেশান্তরে গত পাঁচ বছর ধরে তীক্ষ্ণ ছোরা কোমরে খুঁজে প্রতীক্ষ্ণয় ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এবং এও বুঝিনি যে দুঃশাসনকে খুঁজে পাওয়া মাত্রই তাকে হত্যার প্রথম সুযোগেই সাবিত্রী ক্ষুদার্ত বাঘিনীর মত উপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে। একেই বলে নিয়তি। কেউ তা রোধ করতে পারে না। ভবিতব্য অলঙঘনীয়। অনিবার্য। কিন্তু তবুও বলব হত্যাকারীর প্ল্যানটা নিঃসন্দেহে অপূর্ব। অদ্ভুত কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছে খুনী হত্যার ব্যাপারে। আগে থেকেই সমস্ত আটঘাট বেঁধে মাত্র পনের থেকে বিশ মিনিট সময়ের মধ্যে অন্য একজনের ছদ্মবেশে হত্যাকাণ্ড সমাপ্ত করে আবার সে তার নিজের জায়গায় ফিরে এসে ছদ্মবেশ ছেড়ে সব হত্যার চিহ্ন নিজের গা থেকে যেন মুছে ফেলেছে। তাহলে গোড়া থেকেই বলি। রায়বাহাদুরের কেন ধারণা কোন এক নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে মারা যাবেন! হত্যাকারী তাঁকে চিঠি দিয়ে সেকথা জানিয়েছিল।
রায়বাহাদুরের মুখেও আমি শুনি কথাটা এবং পরে একদিন সৌভাগ্যক্রমে লুকিয়ে আড়ি পেতে গান্ধারী দেবী ও কাকা সাহেবের আলোচনাথেকে জানতে পেরেছিলাম আমি, রায়বাহাদুরকে হত্যাকারী একটা চিঠি দিয়েই কোন একটা নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে হত্যা করবার ভয় দেখিয়েছিল যদি না তিনি তাঁর উইল পরিবর্তন করেন। কিন্তু কেন? ঐভাবে একটা নির্দিষ্ট সময়ে সে হত্যার ভয় দেখিয়েছিল কেন? খুব সম্ভব যাতে করে রায়বাহাদুর কথাটা সকলকে বলেন, ও হত্যার প্রতিশোধের জন্য ব্যবস্থা করেন। অন্তত আমার ধারণা তাই। তাহলেও এ থেকে দুটো জিনিস ভাববার আছে। প্রথমতঃ অসুস্থ রায়বাহাদুর ঐ ধরনের কথা বললে চট করে সহজে কেউই বিশ্বাস তো করবেই না ব্যাপারটা—অর্থাৎ তাঁর কথার কোন গুরুত্বই দেবে না কেউ। হয়েছিলও তাই।
এ বাড়ির কেউ সেকথা বিশ্বাসই করেননি, এমন কি আমিও করতে পারিনি প্রথমটায়। ডাক্তাররাও বলেছে ওটা hallucination-এর ব্যাপার।
দ্বিতীয়ত:, খুনীর নির্বিঘ্নে হত্যা করবার একটা চমৎকার সুযোগ হাতে আসবে, ঐ ধরনের একটা কথা চাউর করে দিতে পারলে। কিন্তু যা বলছিলাম, ওদিকে তারপর খুনী হত্যার সমস্ত সন্দেহ দুঃশাসন চৌধুরীর উপরে চাপিয়ে দেবার জন্য দুঃশাসনের ছদ্মবেশে একবার গিয়ে রায়বাহাদুরকে threaten পর্যন্ত করে এসেছিল এবং সন্দেহটাকে ঘনীভূত করে তোলবার জন্য ঠিক ঐ সময়টিতেই গান্ধারী দেবীকেও রায়বাহাদুরের ঘরে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। জানলা দরজা বন্ধ থাকায় ঘরটা ছিল অন্ধকার তাই হয়ত রায়বাহাদুর ছদ্মবেশে খুনীকে চিনতে পারেননি এবং গান্ধারী দেবীও শেষ পর্যন্ত ঘরে প্রবেশ না করবার দরুন ব্যাপারটা রহস্যাবৃতই থেকে গিয়েছিল। হত্যার রাত্রে খুনী প্রথমতঃ ডাঃ সানিয়ালের ছদ্মবেশে নার্স সুলতা করকে কফির সঙ্গে তীব্র কোন ঘুমের ওষুধ পান করিয়ে তাকে গভীর নিদ্রাভিভূত করে ফেলে। তারপর দুঃশাসনের ছদ্মবেশে রায়বাহাদুরের ঘরের সংলগ্ন বাথরুমের ভিতর দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে রায়বাহাদুরকে হত্যা করে। হত্যার সময় তার পরিধেয় বস্ত্র রক্ত এসে লাগে। সেই রক্তমাখা বস্ত্রটা তড়িৎপদে এসে শকুনির অবর্তমানে তার ঘরের মধ্যে ছেড়ে রেখে নিজেদের জায়গায় আবার ফিরে যায়। আমি পরীক্ষা করে দেখেছি শকুনির ঘরের বাথরুমের জানলাপথে নেমে কার্নিশ দিয়ে রায়বাহাদুরের কক্ষসংলগ্ন বাথরুমে গিয়ে প্রবেশ করা যায় খুব সহজেই। শুধু তাই নয়, হত্যা করবার পর দুঃশাসনেরই ছদ্মবেশে রুচিরা দেবীর ঘরে গিয়েও তাকে হত্যার সংবাদটা দিয়ে আসে হত্যাকারী।
স্তম্ভিত নির্বাক সকলে। কারও মুখে একটি কথা নেই।
দালাল সাহেবই আবার প্রশ্ন করেন, তবে হত্যাকারী কে?
কিরীটী এবারে মৃদুকণ্ঠে জবাব দিল, এখনও আপনারা বুঝতে পারছেন না! মহামান্য কাকা সাহেব শ্রী অবিনাশ চৌধুরী।
ঘরের মধ্যে যেন বজ্রপাত হল।
কিরীটী বলে, গতকাল সকালে কাকাসাহেবের ঘরে প্রবশ করে ঘরের দেওয়ালে টাঙানো কয়েকখানা ফটো দেখেই প্রথমে তাঁর ওপর আমার সন্দেহ হয়। এককালে অবিনাশ একজন সুদক্ষ অভিনেতা ও রূপসজ্জাকর ছিলেন। ঐটিই প্রথম কারণ ও দ্বিতীয় কারণ তাঁকে সন্দেহ করবার হচ্ছে, তিনটে থেকে রাত চারটে পর্যন্ত ঐ এক ঘণ্টা সময়ে তাঁর movements-এর কোন satisfactory explanation-ই তিনি দিতে পারেননি। তৃতীয়তঃ, তাঁর ঘরের বাথরুমের সংলগ্নই হচ্ছে শকুনিবাবুর ঘরের বাথরুম। বাইরের চওড়া কানিশ দিয়ে ঐ বাথরুমে যাওয়া খুবই সহজ। চতুর্থতঃ, হয়ত উইল। উইলের ব্যাপারটা এখনও আমি জানি না তবে নিশ্চয়ই অবিনাশ চৌধুরীর ভাগে খুব সামান্যই পড়েছে। তাতেই হয়ত তিনি উইলটার অদলবদল চেয়েছিলেন। কারণ, তাঁর ভয় ছিল দুযযাধন চৌধুরীর মৃত্যুর পর হয়ত অন্যান্য সকলে তাঁর সঙ্গীতপিপাসা ও খেয়ালের খাঁই মেটাতে রাজী থাকবে না তাঁর মত।
দুঃশাসন চৌধুরী এবারে এখানে ফিরে আসা অবধিই ঐ ব্যাপারটা নিয়ে মধ্যে মধ্যে রায়বাহাদুরের সঙ্গে বচসা করতেন। তাঁর আদৌ ইচ্ছা ছিল না ঐভাবে অনর্থক প্রতি মাসে কতকগুলো টাকা নষ্ট হয়। কিন্তু নির্মম নিয়তিই এক্ষেত্রেও প্রবল হয়ে দেখা দিল। কাকা সাহেবকে তাঁর পাপের প্রায়শ্চিত্ত চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই করতে হল প্রাণ দিয়েই। একেই বলে বিধাতার বিচার বোধ হয়। কিন্তু I pity—ঐ সাবিত্রী দেবীকে! কিরীটী চুপ করে।
সাবিত্রী এক রাতের মধ্যে সম্পূর্ণ উন্মাদিনী! কখনও হাসছে, কখনও কাঁদছে।
.
শেষ পর্যন্ত কিরীটীর মধ্যস্থতায় ডাঃ সমর সেনের সঙ্গে রুচিরার বিয়ে হয়ে গেল।
কিন্তু আজও ডাক্তার সেন মধ্যে মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠে। তাকিয়ে আছে পলকহীন স্থির নিষ্কম্প, বিভীষিকাময় কার দুটি চক্ষু তার দিকে যেন।
হাড়-জাগানো বলিরেখাঙ্কিত মুখ, ফ্যাকাশে রক্তহীন হলদেটে চামড়া বিস্ত, কাঁচাপাকা চুলগুলি কপালের উপরে নেমে এসেছে।
বুকে বিঁধে আছে একখানি কালো বাঁটওয়ালা ছোরা সমূলে। তারপরই যেন কানে আসে কে ডাকছে তাকে।
হুজুর, হুজুর!
ডাক্তার জেগে ওঠে, কে-কে?