—খুন! অস্ফুট কণ্ঠে চিৎকার করে ওঠে মানদা।
–কে জানে! হতেও তো পারে! কাল এগোরাটা পর্যন্ত যে মানুষটা বেঁচে ছিল হঠাৎ সে যদি রাত্রে ঘরের মধ্যে মরে পড়ে থাকে। উঁহু বাবা, আমার ভাল ঠেকছে না। নিশ্চয়ই কোন গোলমাল আছে—আমি চললাম থানায় খবর দিতে—বলতে বলতে রতন সিঁড়ির দিকে এগুলো।
—এই রতন, আমাকেও তাহলে তোর সঙ্গে নিয়ে চ-মানদা চেঁচিয়ে ওঠে।
–আমাকে সঙ্গে নে! মানদাকে খিচিয়ে উঠল রতন, তুই কচি খুকীটি নাকি!
—মাইরি বলছি কতন, আমি এর কিছু জানি না।
–জানিস না তো থানার লোক এসে যখন জিজ্ঞাসা করবে তখন তাই বলবি।
—আমি কাল রাত এগারোটার সময় যখন নীচে চলে যাই মা তখন চেয়ারে বসে একটা বই পড়ছিল। জলজ্যান্ত মানুষটা
–তাহলে তাই বলবি, আমি আসছি—বলে রতন সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে গেল।
স্থানীয় থানার দারোগা সুশীল চক্রবর্তীর বয়স খুব বেশী নয়, বছর চল্লিশেক হবে। রতনের মুখে সংবাদটা পেয়েই জনা-দুই সেপাই সঙ্গে নিয়ে তিনি হিন্দুস্থান রোডের বাড়িতে চলে এলেন।
মানদা তখনও বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখমুখ ফ্যাকাশে। একটা অজ্ঞাত ভয় যেন মানদাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে।
সুশীল চক্রবর্তী মানদাকে দেখিয়ে রতনকে জিজ্ঞাসা করলেন, এ কে?
—আজ্ঞে বাবু, ও এই বাড়িব ঝি, মানা।
—হুঁ। কোন্ দরজা?
–ঐ যে দেখুন না–
—সুশীল চক্রবর্তী দরজাটা একবার ঠেললেন—দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। জোরে জোরে দরজার গায়ে কয়েকবার ধাক্কা দিলেন—ভিতর থেকে কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।
—বিক্রম সিং!
—জি হুজুর!
–দরজা ভেঙে ফেল।
কিন্তু ঘরের দরজা ভাঙা অত সহজ হল না। মজবুজ কাঠের দরজা, দরজার গায়ে ইয়েল লক সিস্টেম। অনেক কষ্টে প্রায় আধ-ঘণ্টা ধরে চেষ্টার পর বিক্রম সিং আর হরদয়াল উপাধ্যায় দরজাটা ভেঙে ফেলল।
ঘরের মধ্যে ঢুকেই সুশীল চক্রবর্তী থমকে দাঁড়ালেন।
ঘরের মধ্যে আলো জ্বলছে তখনো, সব জানলা বন্ধ। মালঞ্চ চেয়ারের ওপর বসে—মাথাটা ঈষৎ বুকের ওপর ঝুঁকে আছে, আর হাত-পাঁচেক দূর থেকেই সুশীল চক্রবর্তী স্পষ্ট দেখতে পেলেন, একটা পাকানো রুমাল মহিলাটির গলায় চেপে বসে আছে।
কিছুক্ষণ নিঃশব্দে উপবিষ্ট ঐ দেহটার দিকে তাকিয়ে থেকে পায়ে পায়ে এগিয়ে এলেন সুশীলবাবু।
চোখ দুটো বিস্ফারিত, মুখটা ঈষৎ হাঁ হয়ে আছে, এবং মুখের ভিতর থেকে জিহ্বাটা সামান্য বের হয়ে আছে। গায়ে হাত দিলেন—শরীর ঠাণ্ডা এবং শক্ত কাঠ। সুশীল চক্রবর্তীর বুঝতে কষ্ট হল না, মহিলাটি অনেকক্ষণ আগেই মারা গেছেন।
মাথার কেশ বিপর্যস্ত কিছুটা। হাত দুটো দুপাশে ছড়ানো। গলায় একটা সোনার হার, হাতে পাঁচগাছি করে বর্ফি প্যাটার্নের সোনার চুড়ি ঝকঝক করছে, কানে নীল পাথরের দুটো টাব। পরনে একটা জামদানী ঢাকাই শাড়ি, বুক পর্যন্ত ব্লাউজের বোতামগুলো ছেড়া, খালি পা—
হঠাৎ নজর পড়ল সুশীলবাবুর—ঘরময় কতকগুলো বড় বড় মুক্তো ছড়ানো, নীচু হয়ে মেঝে থেকে একটা মুক্তো তুলে নিয়ে হাতের পাতায় মুক্তোটা পরীক্ষা করলেন, একটা বড় মটরের দানার মত মুক্তোটা—ভিতর থেকে একটা নীলাভ দ্যুতি যেন ঠিকরে বেরুচ্ছে। দামী সিংহলী মুক্তো মনে হয়।
স্পষ্ট বোঝা যায়, কেউ গলায় রুমাল পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে ভদ্রমহিলাকে হত্যা করেছে। মানদা আর রতন ঢোকেনি, তারা বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল। সুশীল চক্রবর্তী ডাকলেন, ওহে রতন না কি তোমার নাম, ভিতরে এসো।
রতন প্রায় কাঁপতে কাঁপতে এসে ঘরে ঢুকল আর ঢুকেই গৃহকত্রীকে ঐ ভাবে চেয়ারে বসে থাকতে দেখে অস্ফুট একটা ভয়ার্ত চিৎকার করে উঠল।
—এ কে?
—আজ্ঞে উনিই আমাদের মা, এই বাড়ির কর্ত্রী।
—তা তোমাদের বাবু—মানে কর্তাবাবু কই, তাকে ডাক তো একবার।
—বাবু তো এখানে থাকেন না আজ্ঞে।
–থাকেন না মানে?
—আজ্ঞে রেতের বেলায় থাকেন না। সন্ধ্যার পর আসেন আর রাত এগারোটা সোয়া এগারোটা নাগাদ চলে যান।
–দেখ বাপু, তোমার কথার তো আমি মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। বাবু এখানে থাকেন না—মানে তোমাদের গিন্নীমা একা একা এ বাড়িতে থাকেন?
—আজ্ঞে একা না, মানদা আর আমি থাকি, আর নীচের ঘরে একজন বাবু থাকেন।
—বাবু! কে বাবু?
—তা তো জানি না আজ্ঞে, উনি তিনদিন ছিলেন না, আজ সকালেই আবার ফিরে এসেছেন। তিনিই তো বললেন আজ্ঞে, আমাদের মা বেঁচে নেই, তিনি মরে গেছেন।
সুশীল চক্রবর্তীর কেমন যেন সব গোলমাল ঠেকে। এবং বুঝতে পারেন ব্যাপারটার মধ্যে সত্যিই গোলমাল আছে।
–যাকে ওরা এ বাড়ির মালিক বা বাবু বলছে—তিনি প্রত্যহ সন্ধ্যায় আসেন, আবার রাত্রি এগারোটা সোয়া এগারোটায় চলে যান, অথচ নীচে আর এক বাবু থাকে—মানে কি?
সুশীলবাবু প্রশ্ন করলেন, এ বাড়ির আসল মালিক কে?
আজ্ঞে বললাম তো, তিনি এখানে থাকেন না!
–তার নামটা জানো? কি নাম তার?
–আজ্ঞে শুনেছি সুরজিৎ ঘোষাল।
—আর নীচে যে বাবু থাকেন, তার নাম?
–তা তো জানি না।
—সে বাবুটি কে?
—তা জানি না।
—তবে তুমি জানলে কি করে যে এ বাড়ির আসল মালিক সুরজিৎ ঘোষাল।
—আজ্ঞে মানদার মুখে শুনেছি।
–ডাক তোমার মানদাকে। সুশীলবাবু বললেন।
–এই মানদা, ঘরে আয়, দারোগাবাবু কি শুধাচ্ছেন। রতন মানদাকে ডেকে আনল।
মানদা এসে ঘরে ঢুকল। একটু মোটার দিকে চেহারাটা, বয়সে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হবে। মনে হয় মাথার চুল পরিপাটী করে আঁচড়ানোই ছিল, এখন একটু বিপর্যস্ত। পরনে একটা ভেলভেটপাড় মিলের মিহি শাড়ি, গলায় একগাছা সরু হার, হাতে সোনার রুলি। চোখমুখের চেহারাটা বেশ সুশ্রী।