মালঞ্চ সুরজিৎ সম্পর্কে একটু ভুল করেছিল। সে ভেবেছিল তার আর দীপ্তেনের গোপন মিলনের ব্যাপারটা সুরজিৎ ঘুণাক্ষরেও জানতে পারবে না। জানবার একমাত্র উপায় মানদা আর রতন, কিন্তু টাকার লোভে তারা সুরজিতের কানে কথাটা তুলবে না।
কিন্তু তার ঐখানেই হিসেবে ভুল হয়েছিল। রতন বলেনি কিন্তু মানদা সুরজিতের কানে কথাটা আকারে ইঙ্গিতে তুলে দিয়েছিল, সুরজিতের ইদানীং ভাবান্তরের কারণও তাই। সেটা মালঞ্চ অনুমানও করতে পারেনি।
কিন্তু সুরজিৎ মুখে কিছু প্রকাশ করেনি, তক্কে তক্কে ছিল সুযোগের অপেক্ষায়। তবু দীপ্তেনকে ধরতে পারেনি সুরজিৎ, কারণ দীপ্তেন এমনই সময় আসত যখন সুরজিতের আসার সম্ভাবনা নেই। দু-একবার তথ্যপি সে surprise visit দিয়েছে, তবু দীপ্তেনকে ধরতে পারেনি মালঞ্চরই সাবধানতার জন্য।
আজ ঘরে ঢুকেই সুরজিৎ থমকে দাঁড়াল। মালঞ্চ সুরজিতের মুখের দিকে তাকিয়ে মদির কটাক্ষে মুখে মৃদু হাসি টেনে বলল, কি সৌভাগ্য, আজ একেবারে নির্ধারিত সময়ের আগেই?
–আগে এসে পড়ে তোমার অসুবিধা ঘটালাম মালঞ্চ?
–কি যা-তা বলছ সুরজিৎ? জানো, আজ মার্কেট থেকে মটন এনে আমি নিজে স্টু বেঁধেছি তোমার জন্যে, সঙ্গে কি খাবে বল—পরটা না লুচি? কি হল, অমন ভূতের মত দাঁড়িয়ে রইলে কেন—পোশাক ছাড়বে না?
–বাঃ, তোমার হারটা তো চমৎকার-সুরজিৎ ঘোষাল বলে ওঠে।
–আমার গলায়! সঙ্গে সঙ্গে হারটার কথা মনে পড়ে যায় মালঞ্চর, মুখের হাসি তার। উবে যায়।
—তা কিনলে বুঝি হারটা—না কোন প্রেমিকের প্রেমোপহার?
—ছিঃ সুরজিৎ, তোমার মন এত ছোট! হারটা আমি আজই কিনে এনেছি।
—কোন্ দোকান থেকে কিনলে? সাচ্চা মুক্তো বলেই যেন মনে হচ্ছে—বলতে বলতে হঠাৎ সুরজিতের নজর পড়ে সামনের ত্রিপয়ে অ্যাশট্রেটার ওপর।
এগিয়ে গেল সুরজিৎ–অর্ধদগ্ধ, দুমড়ানো সিগ্রেটটা অ্যাশট্রে থেকে তুলে নিল। তারপর শান্ত গলায় সুরজিৎ বলল, দীপ্তেন ভৌমিক কখন এসেছিল মালঞ্চ?
–দীপ্তেন ভৌমিক!
—আকাশ থেকে পড়ার ভাব কোরো না মালঞ্চ, ব্যাপারটা আমার কাছে আর গোপন নেই।
–কি গোপন নেই।
—তুমি যে বেশ কিছুকাল ধরেই দীপ্তেন ভৌমিকের সঙ্গে মাতামাতি করছ—আমি সেটা জানি।
হঠাৎ সোজা ঋজু হয়ে দাঁড়াল মালঞ্চ। বলল, হ্যাঁ, এসেছিল।
-কেন, কেন সে এখানে আসে?
–কৈফিয়ৎ চাইছ?
—চাওয়াটা নিশ্চয়ই অন্যায় নয়।
—কিন্তু ভুলো না সুরজিৎ, আমি তোমার বিয়ে করা স্ত্রী নই।
–জানি, তুমি আমার রক্ষিতা।
–ভদ্রভাবে কথা বল সুরজিৎ।
–ভদ্রভাবে কথা বলব কার সঙ্গে, তোমার সঙ্গে—একটা হার্লটের সঙ্গে?
—Shut up!
—হারামজাদী, তুই আমারই খাবি, আমারই ঘরে থাকবি, আর–
—বের হয়ে যাও—মালঞ্চ চিৎকার করে ওঠে, এই মুহূর্তে এ বাড়ি থেকে বের হয়ে যাও সুরজিৎ-এটা আমার বাড়ি।
সুরজিতের বোধহয় মনে পড়ে যায় যে বৎসর খানেক পূর্বে পাকাপোক্তভাবে বাড়িটার দলিল রেজিস্ট্রি করা হয়ে গিয়েছে মালঞ্চর নামে।
তাই বলে, ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি। কিন্তু তোকেও আমি ছেড়ে দেব না হারামজাদী, গলা টিপে তোকে আমি শেষ করে দেব—মুহূর্তে সুরজিৎ ঘর থেকে হনহন করে বের হয়ে গেল।
রাগে মালঞ্চ তখন ফুসছে।
একটু পরেই মানদা এসে ঘরে ঢুকল।—কি হয়েছে মা, বাবু চলে গেলেন?
—নীচের দরজায় তালা দিয়ে চাবিটা আমায় এনে দে মানদা!
—কিন্তু নীচের বাবু যদি ফিরে আসেন?
-–ঠিক আছে, হ্যাঁ। আর হ্যাঁ, শোন, ঐ নীচের বাবু এলে আমাকে জানাবি।
০৪. ব্যাপারটা পরে জানা যায়
ব্যাপারটা পরে জানা যায়-আগের দিন অর্থাৎ শুক্রবারের সন্ধ্যার ঘটনা।
পরের দিন শনিবার, মানদা সকাল পৌনে সাতটা নাগাদ চা নিয়ে এসে দরজা ঠেলে দেখে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ।
প্রথমে ডাকাডাকি করে মানদা, পরে দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে, কিন্তু ঘরের ভিতর থেকে মালঞ্চর কোন সাড়া পাওয়া যায় না। মানদা ভয় পেয়ে রতনকে ডেকে আনে। দুজনে তখন আরো জোরে জোরে দরজায় ধাক্কা দেয় আর চেঁচিয়ে ডাকাডাকি করে, তবু কোন সাড়া নেই
মানদা ভয় পেয়ে গিয়েছে তখন রীতিমত। কাঁপা কাঁপা গলায় রতনকে বলল, ব্যাপার কি বল তো রতন?।
ঠিক ঐ সময় সিঁড়িতে স্যান্ডেলের শব্দ পাওয়া গেল।
মানদা বলল, এ সময় কে এলো আবার?
মালঞ্চর স্বামী সুশান্ত সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে এলো। মাথার চুল রুক্ষ, একমুখ খোঁচা খোঁচা দাড়ি, পরনের প্যান্ট আর শার্টটা আরো ময়লা হয়ে গিয়েছে।
মানদা সুশান্তকে দেখে বলে, বাবু, মা ঘরের দরজা খুলছে না।
—খুলবেও না আর কোন দিন—
—সে কি বাবু! কি বলছেন আপনি।
—আমি জানি, শেষ হয়ে গেছে—আমি চললাম-থানায় খবর দাও—তারাই এসে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকবে—বলে যেমন একটু আগে এসেছিল সুশান্ত, তেমনি ভাবেই সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল।
সুশান্ত কিন্তু বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল না, সিঁড়ি দিয়ে নেমে নীচের তলায় নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকল।
ঘণ্টা দুই পরে থানার অফিসার নীচের ঘরে ঢুকে দেখতে পেয়েছিলেন তজোপোষের ওপর সুশান্ত গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন।
সুশান্ত কথাগুলো বলে যাবার পর রতন কিছুক্ষণ ঘরের সামনে বারান্দাতে দাঁড়িয়েই থাকে, তারপর মানদার দিকে কেমন যেন বিহুল বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মানদাও চুপচাপ দাঁড়িয়ে, তারও মুখে কোন কথা নেই।
কিছুক্ষণ পর রতনের যেন বিহুলতাটা কাটে। সে বলে, তুই কোথাও যাস নে মানদা, আমি থানাতে চললাম
—থানায়, কেন রে?
–কি বোকা রে তুই। সত্যিই যদি মা মারা পড়ে থাকেন তাহলে ঘরের দরজা ভেঙে কি আমরা খুনের দায়ে পড়ব?