বেশীর ভাগ রাত্রেই খেত না সুশান্ত, কেন যেন গলা দিয়ে ভাত, ডাল, মাছ, দুধ, মিষ্টি নামতে চাইত না।
প্রথম প্রথম রতনের কেমন যেন কৌতূহল হত সুশান্ত সম্পর্কে—কে লোকটা? কিন্তু পারত গিন্নীমাকে শুধোতে, না পারত বাড়ির অন্য কাউকে শুধাতে।
বাবু আসেন রোজ বিকেলে, রাত এগারোটা সাড়ে এগারোটা নাগাদ আবার তার গাড়িতে চেপে চলে যান। ঝকঝকে গাড়িটা ঠিক সন্ধ্যার কিছু পূর্বে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। উর্দি পরা ড্রাইভার নেমে গাড়ির দরজা খুলে দেয়। সুরজিৎ ঘোষাল গাড়ি থেকে নেমে কোন দিকে না তাকিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে যান। জুতোর শব্দটা সিঁড়ির মাথায় মিলিয়ে যায়।
আবার রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ জুতোর শব্দ শোনা যায়। রতন বুঝতে পারে সুরজিৎ ঘোষাল বের হয়ে যাচ্ছেন। ড্রাইভার গাড়ির দরজা খুলে দেয়। সুরজিৎ ঘোষাল গাড়িতে উঠে বসলে গাড়িটা হুস করে বের হয়ে যায়।
তার প্রশ্নের জবাব একদিন গিন্নীমার ঝি মানদাই দিয়েছিল। রতন প্রশ্ন করেছিল, হ্যাঁ গা মানদা, রোজ রাত্রে বাবু চলে যান কেন বলতে পারো?
ফিক করে হেসে ফেলেছিল মানদা। বলেছিল ওসব লোকেরা তাদের মেয়েমানুষের ঘরে রাত কাটায় নাকি! আসে চলে যায়।
—কি বলছ! মেয়েমানুয! উনি তো বাবুর স্ত্রী, গিন্নীমা—
মৃদু হেসে মানদা বলেছিল, এ পাড়ার সকলে তাই জানে বটে, তবে উনি তো কর্তার বিয়ে করা ইস্ত্রী নন—
রতন কল্পনাও করতে পারেনি, যে, গিন্নীমা সুরজিৎ ঘোষালের বিয়ে করা স্ত্রী নয়। তাই সত্যিই অবাক হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে ছিল মানদার মুখের দিকে।
–সত্যি?
-তবে কি মিথ্যে!
—কি করে জানলে? কে বললেন?
-কে আবার বলবে, আমি জানি। উনি বাবুর রক্ষিতা, রক্ষিতাকেই বাবু এ বাড়ি করে দিয়েছেন।
—বল কি! ভদ্রপাড়ায় বাবু তার রক্ষিতাকে রেখেছেন! পাড়ার লোকেরা কেউ কিছু বলে না?
-এই কলকাতা শহরে পাশের বাড়ির লোকও পাশের বাড়ির খোঁজ রাখে না। আর রাখলেই বা কি, জানলেও কেউ উচ্চবাচ্য করে না। এনারা সব সভ্য ভদ্রলোক যে গো। তাছাড়া কে কার রক্ষিতা জানাটা এত সহজ নাকি! এ কি সেই সব পাড়ার মেয়েছেলে, একেবারে চিহ্নিত করা
সত্যি! রতনের যেন কথাটা শুনে বিস্ময়ের অবধি ছিল না প্রথম দিন। মানদা তখনো বলে চলেছে, এ শহরে কত ভদ্রলোকের মেয়েদেরকেই তো দেখলাম, কত যে অমন দেহ-ব্যবসা চালাচ্ছে তা জানবারও উপায় নেই
মানদার কথাগুলো শুনলেও কিন্তু সেদিন পুরোপুরি বিশ্বাস করে উঠতে পারেনি রতন। তবে তা নিয়ে আর বেশী মাথা ঘামায়নি। ঘামাতেই বা যাবে কেন, চাকরি করতে এসেছে সে, চাকরিই করবে। কত্তা-গিন্নীর হাঁড়ির খবর দিয়ে তার প্রয়োজন কি।
কিন্তু যেদিন রতন জানতে পেরেছিল নীচের তলার ঐ বাবুটিই গিন্নিমার স্বামী, রতন যেন একটা প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছিল সেদিন। ঐ সংবাদটিও মানদাই পেশ করেছিল তার
কাছে।
—আচ্ছা মানদা, নীচের তলায় যে বাবুটি থাকেন, উনি কে? মধ্যে মধ্যে দেখি গিন্নীমার ঘরে যান
মুচকি হেসে মানদা বলেছিল, উনিই তো আমাদের গিন্নীমার স্বামী–
—উনিই গিন্নীমার স্বামী!
–হ্যাঁ।
–হ্যাঁ, সুরজিৎ ঘোষালই এ বাড়ির আসল মালিক হলেও গিন্নীমার স্বামী হচ্ছে ঐ নীচের তলার বাবুটি। এ পাড়ার সবাই জানে ওটা সুশান্ত মল্লিকের বাড়ি।
সুশান্ত মল্লিক ব্যবসা করেন। পাড়ার লোকেরা মধ্যে মধ্যে আসে, গল্পগুজবও করে। সুশান্ত মল্লিক হেসে হেসে তাদের সঙ্গে কথাও বলে। কিন্তু তারা কেউই অনুমান করতে পারে না ভিতরের ব্যাপারটা।
০২. সুশান্ত হাঁটতে হাঁটতে এসে লেকে ঢুকল
সুশান্ত হাঁটতে হাঁটতে এসে লেকে ঢুকল। এখন আর লেকে অত মানুষজনের ভিড় নেই, জলের ধার ঘেঁয়ে গাছতলার নীচে অন্ধকার একটা বেঞ্চে বসল সুশান্ত।
বুকের ভেতরটা আজ এত বছর পরে যেন কি এক জ্বালায় জ্বলে যাচ্ছে। নিরুপায়। আক্রোশে যেন নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলতে চায়।
এত বড় লজ্জাটা সে বহন করছে এই সাত বছর ধরে, হ্যাঁ, সাত বছরই হবে— বালিগঞ্জের হিন্দুস্থান রোডের বাড়িতে আসার আগে যখন তারা হেদুয়ার কাছে একটা গলিতে ছোট দোতলা একটা বাড়ির একতলায় থাকত, তখন থেকেই তো মালঞ্চর অফিসের ম্যানেজার সুরজিৎ ঘোষাল সেখানে যাতায়াত শুরু করেছিল।
মালঞ্চ সুরজিৎ ঘোষালের অফিসে তার পার্সোন্যাল স্টেনো টাইপিস্ট ছিল। সেখান থেকেই দুজনের আলাপ।
বালিগঞ্জের বাড়িতে উঠে আসবার মাস দুই আগেই মালঞ্চ চাকরি ছেড়ে দিয়েছিল। না, বাধা দেয়নি সুশান্ত। সুরজিৎ ঘোষাল এলেই সে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেত। আর বাধা দিয়েই বা সে কি করত, মালঞ্চ কি শুনত তার কথা।
স্বামী স্ত্রী, সুশান্ত আর মালঞ্চ দুজনেই দুটো অফিসে চাকরি করত, হঠাৎ কেন যেন চাকরিটা ছেড়ে দিল সুশান্ত। মালঞ্চ প্রথমটায় বুঝতে পারেনি যে তার স্বামী চাকরি ছেড়ে দিয়েছে।
আর বুঝবেই বা কি করে, সুশান্তর সঙ্গে তখন তার সম্পর্কই বা কতটুকু। সুরজিৎ ঘোষালের অনুগ্রহে তখন তার নিত্য নতুন দামী দামী শাড়ি আসছে, দু-একটা অলংকারও সেই সঙ্গে গায়ে শোভা পেতে শুরু করেছে।
সুশান্ত নীরেট বোকা, তাই প্রথমটায় ধরতে পারেনি, ধরতে পেরেছিল অনেক দেরিতে, যখন সুরজিৎ ঘোষাল তাদের বাড়িতে যাতায়াত শুরু করেছিল, তার আগে মধ্যে মধ্যে অফিস থেকে তার ফিরতে দেরি হলে মালঞ্চ সুশান্তকে বলেছে, অফিসে কাজের চাপ।
নীরেট বোকা সুশান্ত সরল মনেই কথাটা বিশ্বাস করেছে। চোখ থেকে পর্দাটা সরে যাওয়া পর্যন্ত তাদের অন্তরঙ্গতা বুঝতে পারেনি, কিন্তু যখন বুঝল তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে।