লেক রোডে দীপ্তেনের ফ্ল্যাটে তার শোবার ঘরে মুখোমুখি বসে ছিল দীপ্তেন আর ডলি দত্ত।
তারা জানত না যে তারা যে সব কথা বলছে, সব কিছু একটা অদৃশ্য শক্তিশালী মাইক্রোফোনের সাহায্যে টেপ হয়ে যাচ্ছে।
কিরীটীর পরামর্শেই ব্যবস্থাটা ডি.সি. ডি.ডি. চট্টরাজ করেছিলেন দীপ্তেনের গৃহভৃত্য বামাপদকে হাত করে। দীপ্তেনের গৃহভৃত্য বামাপদকে পুলিসের হাত করতে কষ্ট হয়নি।
বামাপদ বৎসরখানেক হল দীপ্তেনের কাছে কাজ করছে।
বয়স অল্প, বছর বত্রিশ-তেত্রিশ হবে। কালো মতন রোগা চেহারা, কিন্তু বোঝা যায় বেশ চালাকচতুর? সুশীল চক্রবর্তীর কথায় সেটা বুঝতে পেরেই কিরীটী বামাপদকে পুলিসের দলে টানতে পেরেছিল।
ব্যাচিলার মানুষ দীপ্তেন, বামাপদ ছিল তার একাধারে কুক এবং সার্ভেন্ট, আবার কেয়ারটেকারও বটে। বামাপদকে পেয়ে দীপ্তেন নিশ্চিত ছিল।
বামাপদকে আলাদা ভাবে জেরা করে সুশীল চক্রবর্তী থানায় নিয়ে এসে অনেক কথাই দীপ্তেন সম্পর্কে জানতে পেরেছিলেন।
ডলি দত্ত যে ইদানীং প্রায় প্রতি রাত্রেই দীপ্তেনের ফ্ল্যাটে আসে, তারপর মধ্যরাত্রি পর্যন্ত সেখানে কাটিয়ে যায়, সে কথা বামাপদর কাছ থেকেই সুশীল চক্রবর্তী প্রথম জানতে পেরেছিলেন। এবং বামাপদর কাছ থেকেই আরো শুনেছিলেন মালঞ্চ দেবী আগে প্রায়ই আসত দীপ্তেনের ফ্ল্যাটে, তবে ইদানীং কেন যেন সে বড় একটা আসত না।
তারপর একদিন সুশীল চক্রবর্তী দীপ্তেন ভৌমিকের অনুপস্থিতিতে তার ফ্ল্যাটে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন।
সুশীল বলেছিলেন, শোন বামাপদ, পুলিসকে যদি তুমি সাহায্য না কর পুলিস তোমাকে গ্রেপ্তার করে চালান দেবে। পুলিস সংবাদ পেয়েছে তোমার বাবুর সঙ্গে তুমি চোরাকারবার কর।
—দোহাই হুজুর, বিশ্বাস করুন, আমি কিছুই জানি না—
–জানি না বললেই তো আর তোমাকে পুলিস ছেড়ে কথা বলবে না বামাপদ।
বামাপদ হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিল। বলেছিল, বিশ্বাস করুন হুজুর, আমি কিছুই জানি না।
–ঠিক আছে, তুমি পুলিসকে যদি সাহায্য কর—তবে আমি তোমাকে বাঁচাব–
–বলুন হুজুর কি করতে হবে—আমি সব কিছু করব আপনার হুকুমমত।
—বেশ, তাহলে আগে কয়েকটা কথার জবাব দাও আমার।
—বলুন হুজুর।
—তোমার বাবুর ঘরে একটি মেয়ে আসত?
—কার কথা বলছেন হুজুর, সেই যে সিনেমায় নামে?
–না, সে নয়, আর একজন, মালঞ্চ তার নাম—
–মালা দিদিমণি? কিন্তু তিনি তো অনেকদিন আর এখানে আসেন না।
—আসবেন কি করে, তিনি কি আর বেঁচে আছেন, তাকে খুন করা হয়েছে।
–খুন! কি বলছেন হুজুর?
–হ্যাঁ, তাকে খুন করা হয়েছে।
—হুজুর, আপনারা কি আমার বাবুকে সন্দেহ করছেন? আমি হলফ করে বলতে পারি হুজুর, আমার বাবু ঐ দিদিমণিকে খুন করেননি।
–কি করে বুঝলে যে তোমার বাবু
—কি বলছেন হুজুর, ঐ দিদিমণিকে আমার বাবু খুব ভালবাসতেন। আর দিদিমণিও বাবুকে–
—জানি বামাপদ, সেইজন্যই তো আসল লোককে আমরা খুঁজে বেড়াচ্ছি। আর আমাদের ধারণা সেই লোকটা তোমার বাবুর কাছে আসা-যাওয়া করে। হ্যাঁ, তাকে আমরা ধরতে চাই, আর তাতে তোমার সাহায্য চাই আমরা।
—নিশ্চয় হুজুর আমি আপনাদের সাহায্য করব, আমাকে কি করতে হবে বলুন।
-বেশী কিছু না, তোমার বাবুর বসবার আর শোবার ঘর আমরা একটু দেখব, যদি সে লোকটার কোন হদিস পাই!
—বেশ তত বাবু, দেখুন।
–হ্যাঁ দেখছি, কিন্তু আমি একা একা দেখব, তুমি আমার সঙ্গে থাকবে না।
—ঠিক আছে, আমি দাঁড়াচ্ছি।
সুশীল চক্রবর্তী ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে একটা ভারী সোফার নীচে মাইক্রোফোন আর ছোট টেপ রেকর্ডারটা ফিট করে মিনিট কুড়ি বাদে ঘরের দরজা খুলে বের হয়ে এলেন।
—দেখলেন হুজুর?
–হ্যাঁ, পাঁচ-সাতদিন বাদে আবার আসব, তুমি কিন্তু তোমার বাবুকে একেবারেই বলবে না যে আমি এখানে এসেছিলাম। তোমার বাবু জানতে পারলে যদি বেফাঁস কথাটা বলে ফেলেন তাহলে সে সাবধান হয়ে যাবে, বুঝেছ?
—আজ্ঞে হ্যাঁ।
সুশীল ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে এসেছিলেন।
১৪. দীপ্তেন ভৌমিক বলছিল
দীপ্তেন ভৌমিক বলছিল, আমি কিছুদিনের জন্যে বাইরে যাচ্ছি ডলি। ইউরোপ–
–আমাকে সঙ্গে নেবে দীপু?
—তোমাকে! না বাবা, ওসবের মধ্যে আমি আর নেই, শেষটায় জীবন দত্ত আমার নামে কে ঠুকে দিক আর কি। একে সুরজিৎ ঘোষালের ঝামেলায় নাস্তানাবুদ হচ্ছি
—কেন, পুলিস তোমাকে মালঞ্চ-হত্যার ব্যাপারে খুব নাস্তানাবুদ করছে বুঝি?
—আর বল কেন—
-তুমি তো আমার কথা শোননি। কতবার বলেছি ওর সঙ্গে মিশো না অত, তা তুমি রোজই ওখানে যেতে–
—শুধু আমি কেন, তুমি যেতে না? ডাঃ সমীর রায় যেতেন না?
—তা তো সকলেই যেতাম। কিন্তু তোমার সঙ্গে মালঞ্চর ঘনিষ্ঠতা ছিল–।
–বাজে বকো না। একটা ক্যারেক্টারলেস উওম্যান–
তার জন্যেই তো তুমি হেদিয়ে মরতে দীপ্তেন।
–She was a fool! সে ভাবত আমি বুঝি তার প্রেমে পড়ে গিয়েছি, কিন্তু মোটেই তা নয়, আমি তাকে ঘৃণা করতাম।
–বাজে কথা বলো না। আমি জানি দীপ্তেন।
–কি জানো?
সেরাত্রে দু-দুবার গিয়েছিলে তুমি মালঞ্চর ঘরে—
–তুমি জানো?
-আমি জানি। মনে আছে, সেরাত্রে আমাকে নিয়ে তোমার দি রিট্রিটে ডিনার খাবার কথা ছিল, অথচ রাত সোয়া এগারোটা পর্যন্ত যখন তুমি এলে না–
-তুমি বিশ্বাস কর—আমি একটা বিশেষ কাজে আটকা পড়েছিলাম।
—তাও জানি বৈকি, আর সেই বিশেষ কাজে মালঞ্চর বাড়িতেই যে আটকা পড়েছ তাই ভেবেই তো আমি মালঞ্চর বাড়ি যাই–