—আচ্ছা, আপনার সোনার সিগারেট কেস ছিল কি কখনো?
—না তো।
—আপনার পরিচিত জনেদের মধ্যে কারও ছিল বলে কি আপনার মনে পড়ে?
–ডাঃ রায়ের কাছে একটা সোনার সিগারেট কেস দেখেছি বলে মনে পড়ছে।
—তিনি কি ব্র্যান্ড সিগারেট খান?
—সেম ব্র্যান্ড—State Express 555.
–ঠিক আছে, আর আপনার সময় নষ্ট করব না। তবে আপনাকে আবার আমাদের প্রয়োজন হতে পারে। কলকাতার বাইরে গেলে পুলিসের পারমিশন ছাড়া যাবেন না।
–ঠিক আছে।
—চলি। সুশীল চক্রবর্তী অতঃপর উঠে দাঁড়ালেন।
» ১৩. মালঞ্চ হত্যারহস্য আরো ঘনীভূত হল
মালঞ্চ হত্যারহস্য আরো ঘনীভূত হল এবং তার আভাস পাওয়া গেল দিন দুই পরে, সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদে।
শহরের কোন এক নামকরা ডাক্তার ও কোন এক কোম্পানির বড় অফিসারের ব্যাঙ্কের লকার থেকে প্রচুর গিনি ও কারেন্সী নোট পাওয়া গিয়েছে। যে অর্থের কোন বিশ্বাসযোগ্য এক্সপ্লানেশান ওই দুজনের একজনও দিতে পারেননি, ওঁরা দুজনেই নিহত মালঞ্চ দেবীর বিশেষ ঘনিষ্ঠ ও পরিচিত ছিলেন।
আরো একটি সংবাদমালঞ্চ দেবী পেথিডিনে অ্যাডিক্টেড ছিলেন। হিন্দুস্থান রোডের বাড়ির একটি তালাবন্ধ ঘরে তল্লাসী চালিয়ে পুলিস-বহু টাকার নিষিদ্ধ নেশার বস্তু পেয়েছে। ঐ হত্যার ব্যাপারের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে পুলিস মালঞ্চ দেবীর পেয়ারের দাসী মানদা দাসীকে গ্রেপ্তার করেছে।
দিন দুই পরে আবার সংবাদ বেরুল কাগজে কাগজে–
শহরের এক নামকরা অ্যাড়ভভাকেট জগৎ চৌধুরী, মানদার জামিনের জন্য আদালতে আবেদন রেখেছিলেন কিন্তু পাবলিক প্রসিকিউটার সদানন্দ মিত্র তার বিরোধিতা করেন। জজ আরো তদন্ত সাপেক্ষে মানদার জামিন অনুমোদন করেননি। তাকে জেলহাজতে রাখার নির্দেশ জারী করেছেন। সুরজিৎ ঘোষালের জামিনের প্রশ্ন নিয়ে জজসাহেব বিবেচনা করবেন আগামী মঙ্গলবার।
ঐদিনই সন্ধ্যার দিকে সোমনাথ ভাদুড়ী তাঁর চেয়ারে বসে কিরীটীর সঙ্গে ঐ মামলার ব্যাপার নিয়েই আলোচনা করছিলেন।
কিরীটী বলছিল, মানদা যে অনেক কিছুই জানে ভাদুড়ী মশাই, সেটা অনুমান করেই আমি সুশীলকে পরামর্শ দিয়েছিলাম ওকে গ্রেপ্তার করতে।
—আমারও মনে হয় কাজটা ভালই হয়েছে রায়মশাই, আপনার কাছে যা শুনলাম, তাতে মনে হচ্ছে, হত্যাকারীকে নানাভাবে ঐ মানদার সাহায্য নিতে হয়েছে। কিন্তু মানদার জামিনের ব্যাপারে আমাদের জগৎ চৌধুরীকে কে ব্রিফ দিয়েছেন সেটাই বুঝতে পারছি না।
—যার বেশী interest নিঃসন্দেহে সে-ই দিয়েছে—কিরীটী মৃদু হেসে বলল।
—কিন্তু কে সে? কাকে আপনার সন্দেহ হয় বলুন তো?
–সন্দেহ যার ওপরেই হোক, একটা ব্যাপারে আমি কিন্তু নিশ্চিত হয়েছি ভাদুড়ী মশাই-কিরীটী বলল, মানদা অনেক কিছুই জানে আর তাই বোধহয় আমার অনুমান, হত্যাকারী মানদার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। কিন্তু সে জানে না ঐ রকমের চরিত্রের এক মেয়েমানুষকে বিশ্বাস করে কত বড় ভুল সে করেছে। এবং শেষ পর্যন্ত হয়তো মানদার হাত দিয়েই ফাঁসির দড়িটা তার গলায় এঁটে বসবে।
—আপনিই তো একটু আগে বলেছিলেন রায়মশাই, সুশান্ত মল্লিক নাকি ঐ মানদা সম্পর্কে বলেছিল, she is a dangerous woman!
-হ্যাঁ, বলেছিল, কিন্তু you cant count much upon him! একটা মেরুদণ্ডহীন মাতাল—নিজের স্ত্রীকে অন্যের রক্ষিতা জেনেও তারই আশ্রয়ে যে পড়ে থাকে এবং তারই টাকায় নেশা করে, আর যাই হোক তাকে বোধহয় পুরোপুরি বিশ্বাস করা যায় না।
—আচ্ছা রায়মশাই, ঐ চিত্রাভিনেত্রীটিকে আপনার কি রকম মনে হয়?
—গোলমালটা হয়তো সেখানেও থাকতে পারে ভাদুড়ি মশাই।
—হ্যাঁ, এটা তো বুঝতে পারা গিয়েছে দীপ্তেন ভৌমিককে মালঞ্চ ভালবাসত, তাই হয়তো সে ডলি দত্তর প্রতি দীপ্তেনের আকর্ষণটা ভাল চোখে দেখত না। এবং ডলি দত্তও মালঞ্চকে অনুরূপ সুনজরে দেখত না। ফলে সম্ভবত পরস্পরের প্রতি একটা jealousy হয়তো দেখা দিয়েছিল দীপ্তেন ভৌমিককে ঘিরে। আর কে বলতে পারে, সেই ঈর্ষাকে মন্থন করেই হয়তো হলাহল উঠে এসেছিল, যে হলাহল মালঞ্চর মৃত্যু ঘটিয়েছে।
—আর ঐ ডাক্তারটি?
—আমার যতদূর মনে হয় সে ভদ্রলোকও চোরাকারবারে একজন অংশীদার, এবং সেক্ষেত্রে ঐ মাকড়শার জালে তারও জড়িয়ে পড়াটা খুবই স্বাভাবিক।
-আচ্ছা রায়মশাই, আপনার কি মনে হয় মালঞ্চর স্বামী সুশান্ত মল্লিকও ঐ চোরাকারবারে—
—অংশীদার সে হয়তো ঐ চোরাকারবারে ছিল না—আর সেটা সম্ভবও নয়।
–কেন?
—আর যাই করুক না কেন মালঞ্চ, ঐ আশ্রিত ও পোষ্য স্বামীকে যে তার চোরাকারবারের মধ্যে নেবে—সেটা সম্ভব নয়। তবে একই বাড়িতে যখন ছিল লোকটা তখন তার পক্ষে ব্যাপারটা অনুমান করা এমন কিছু অসম্ভব নয়।
–আচ্ছা রায়মশাই, আপনার কি মনে হয় আমার ক্লায়েন্ট সুরজিৎ ঘোষাল ঐ চোরাকারবারের মধ্যে ছিল?
–মনে হয় না চোরাকারবারের সঙ্গে তার কোন যোগ ছিল। তবে জোর করে কিছুই এই মুহূর্তে বলা যায় না ভাদুড়ী মশাই।
—বাঁচালেন। আমারও তাই ধারণা রায়মশাই।
কিরীটী মৃদু হাসল, তারপর ধীরে ধীরে বলল, মালঞ্চর মৃত্যুর কারণ দুটোই হতে পারে—হয় ঈর্ষার হলাহল নতুবা চোরাকারবারের বিষময় পরিণাম।
ভাদুড়ী বললেন, সত্যি রায়মশাই, আজকের সমাজের মানুষগুলো কি ভাবে যে বদলে যাচ্ছে দিনকে দিন, মরাল বা নীতির কোন বালাই নেই।
-কোথা থেকে থাকবে ভাদুড়িমশাই, আজকের জীবনযাত্রা এমন একটা পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যেখানে কেবল ছুটবার নেশা এসেছে। একটা অস্থিরতা, আর সেই অস্থিরতার জন্যেই তারা তৃপ্তির অনুসন্ধান করছে মদ, মেয়েমানুষ, ঘোড়দৌড়, চোরাকারবার আর কালো টাকা জমানোর মধ্যে। ঐ মালঞ্চ মেয়েটির দিকেই তাকিয়ে দেখুন না, স্বামী। থাকতেও সে আর একজনের রক্ষিতা হয়েছিল। কিন্তু হতভাগিনী জানত না, লালসা লালসাকেই বাড়িয়ে তোলে, ওর মধ্যে তৃপ্তি নেই, আছে কেবল একটা প্রচণ্ড অস্থিরতা। সেই অস্থিরতার বিষই আজ আনছে হত্যা ধর্ষণ চোরাকারবার আর কালো টাকার নেশা। আচ্ছা, রাত অনেক হলো, এবার উঠি ভাদুড়ীমশাই কিরীটী চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।