—হিসেব যে মিলছে না ভায়া। কিরীটী যেন একটু চিন্তিত।
—কি ভাবছেন দাদা! সুশীল চক্রবর্তী জিজ্ঞাসা করেন, কিসের কি হিসেব আবার মিলছে না?
–ভাবছি তাহলে পেথিডিন অ্যাম্পুল বা একটা হাইপোডার্মিক সিরিঞ্জ পাওয়া গেল কেন? যে পেথিডিন অ্যাডিক্টেড তার ঘরে ঐ দুটি বস্তু থাকবে না তা তো হতে পারে। তবে কি হত্যাকারী কাজ শেষ হয়ে যাবার পর ঐ দুটি বস্তু ঘর থেকে নিয়ে গিয়েছে? তাই যদি হয় তো, আমরা দুটো definite conculsion-য়ে পৌঁছাতে পারি সুশীল।
–কি কনক্লশন?
প্রথমত, হত্যাকারী unknown third person নয়, সে মালঞ্চর বিশেষ পরিচিতের মধ্যেই একজন, এবং দ্বিতীয়ত, মালঞ্চ যে পেথিডিন অ্যাডিক্টেড, সেটা সে ভাল করেই জানত, এবং সেটা তার পক্ষে সুবিধাই হয়েছিল।
সুশীল চক্রবর্তী কিরীটীর ইঙ্গিতটা সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারেন বলেন, তাহলে তো ঐ পরিচিত পাঁচজনের মধ্যেই একজন—
–হ্যাঁ, মালঞ্চর স্বামী সুশান্ত মল্লিক, তার বাবু সুরজিৎ ঘোষাল, দীপ্তেন ভৌমিক এবং ডাঃ সমীর রায়, তার পেয়ারের চোরাই কারবারের পার্টনার ও শ্রীমতী ডলি দত্তকিরীটী বললে।
কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে থাকেন সুশীল চক্রবর্তী।
–এখন কথা হচ্ছে সুশীল, ওরা সকলেই মালঞ্চর বিশেষ পরিচিত জন হলেও ওরা সকলেই কি জানত যে মালঞ্চ পেথিডিন অ্যাডিক্টেড—এক ডাক্তার ছাড়া?
–একসঙ্গে মেলামেশা, একই সূত্রে বাঁধা, একই ইন্টারেস্ট-ওদের সকলের জানাটাই ততা স্বাভাবিক দাদা
—কি জানি, হতেও পারে। তবে আমার কেন যেন মনে হচ্ছে সুরজিৎ ঘোষালকে অনায়াসেই ঐ লিস্ট থেকে eleminate করা যেতে পারে আপাতত।
–কেন?
–হাজার হলেও মালঞ্চ সুরজিৎ ঘোষালের কিপিংয়ে ছিল, সেক্ষেত্রে সে নিশ্চয়ই সুরজিৎ ঘোষালকে ব্যাপারটা জানতে দেবে না, বিশেষ করে সুরজিৎ ঘোষাল সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে যা জানা গিয়েছে, মদ তো দূরের কথা, ভদ্রলোক স্মোক পর্যন্ত করেন না! মালঞ্চ সম্পর্কে তার চরিত্রের ঐ বিশেষ দুর্বলতাটুকু ছাড়া সত্যিই তিনি একজন যাকে বলে ভদ্রলোক। আজকের সো-কল্ড সোসাইটির কোন ভাইস-ই তার ছিল না। সেদিক দিয়ে বাকী চারজন তোমার সন্দেহের তালিকাভুক্ত সুশীল।…
—ঐ চারজনের মধ্যে কাকে আপনি
—সুশীল, মাকড়সার জালে চার-পাঁচটা বিষাক্ত মাকড়সা বিচরণ করছে, এবং ঐ প্রত্যেকটি মাকড়সার ক্ষেত্রেই মালঞ্চকে হত্যা করার যথেষ্ট মোটিভ থাকতে পারে। কাজেই এই মুহূর্তে ওদের চারজনের মধ্যে বিশেষভাবে একজনকে চিহ্নিত করা যুক্তিযুক্ত হবে না। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রমাণ, সার্কামস্টাসিয়াল এভিডেন্স যাকে বলে, তার দ্বারাই একমাত্র ওদের একজনকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা চলতে পারে, অন্য কাউকে নয়। অবিশ্যি বোঝা যাচ্ছে ওরা সকলেই একটা চোরাকারবার চালাত এবং প্রত্যেকেরই ঐ হিন্দুস্থান রোডের বাড়িতে যেমন যাতায়াত ছিল তেমনি ছিল আরো একটা মিটিং প্লেস, ঐ নাইট ক্লাবটি, সেক্ষেত্রে ওদেরই কেউ একজন হত্যাকারী হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু হত্যাকারী বললেই তো হবে না, আপাতদৃষ্টিতে ওদের প্রত্যেকের মোটিভ থাকলেও ঐ সঙ্গে তোমাকে ভাবতে হবে ওদের মধ্যে সে রাত্রে কার পক্ষে মালঞ্চকে হত্যা করা সবচাইতে বেশী সম্ভব ছিল, অর্থাৎ probability-র দিক থেকে কার উপরে বেশী সন্দেহ পড়ে। তার ওপর base করে তুমি যদি এগুতে পারো তাহলেই দেখবে ঐ হত্যারহস্যের কাছাকাছি তুমি পৌঁছে গেছ। হাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ আরো প্রমাণ চাই, অতএব তোমায় কিছুটা সুতো ছাড়তে হবে—আরো সুতো, তবেই বিরাট কাতলাকে তুমি বঁড়শীতে গাঁথতে পারবে।
পরের দিনই সুশীল চক্রবর্তী সকাল আটটা নাগাদ লেক রোডে দীপ্তেন ভৌমিকের ফ্ল্যাটে গিয়ে হাজির হলেন।
দিনটা ছিল রবিবার। লিফটে করে ওপরে উঠে ফ্ল্যাটের কলিং বেলের বোম টিপতেই দরজা খুলে গেল।
—ধোপদুরস্ত জামাকাপড় পরা মধ্যবয়সী ভৃত্যশ্রেণীর একটি লোক দরজাটা খুলে বলল, কাকে চান?
–এখানে দীপ্তেন ভৌমিক থাকেন?
—হ্যাঁ। কি নাম বলব সাহেবকে?
—বল একজন ভদ্রলোক দেখা করতে চান, বিশেষ জরুরী প্রয়োজন।
–বসুন, আমি সাহেবকে খবর দিচ্ছি। তবে রবিবার তো, সাহেব কারো সঙ্গেই দেখা করেন না, আপনার সঙ্গেও দেখা করবেন কিনা জানি না।
—একটা কাগজ দাও, আমি আমার নাম লিখে দিচ্ছি—
সুশীল চক্রবর্তীর দিকে একটুকরো কাগজ এগিয়ে দিল বেয়ারা। সুশীল চক্রবর্তী কাগজটিতে নিজের নাম লিখে দিলেন। বেয়ারা কাগজটা নিয়ে চলে গেল।
বেশ বড় সাইজের একটি হলঘর, ওয়াল টু ওয়াল কার্পেট পাতা, বেশ দামী, নরম পুরু কার্পেট। সুন্দরভাবে সাজানো ঘরটি, সোফা সেট, বুককেস, ডিভান, কাঁচের শো কেসে ইংরাজী বাংলা সব বই। দেওয়ালে দীপ্তেন ভৌমিকেরই একটি রঙীন বড় ফটো, জানালা দরজায় দামী পর্দা।
কয়েক মিনিটের মধ্যে পরনে স্লিপিং পায়জামা ও গায়ে গাউন জড়ানো, মুখে সিগারেট, বের হয়ে এলেন দীপ্তেন ভৌমিক।
–আপনি মিঃ চক্রবর্তী? দীপ্তেন প্রশ্ন করল, কি প্রয়োজন আমার কাছে?
–বসুন, বলছি।
–একটু তাড়াতাড়ি সারতে হবে কিন্তু মিঃ চক্রবর্তী, আমাকে এখুনি আবার একটু বেরুতে হবে।
—হিন্দুস্থান রোডের মার্ডার কেসটার ব্যাপারে আপনাকে পুলিসের তরফ থেকে আরও কিছু জিজ্ঞাস্য আছে।
-বলুন কি জিজ্ঞাস্য আছে।
–আপনার তো মালঞ্চ দেবীর সঙ্গে হৃদ্যতা ছিল?
—হৃদ্যতা! Not at all, তবে চিনতাম তাকে।