-হ্যাঁ, আগে দীপ্তেনবাবু, আর তাই নিয়েই তো বাবুর সঙ্গে রাগারাগি, বাবু বলেছিলেন মাকে খুন করবেন!
—তোমার বাবু যখন ওকে শাসাচ্ছিল তুমি তখন কোথায় ছিলে?
–দরজার বাইরে?
—আড়ি পেতে ওদের কথা শুনছিলে বুঝি?
—হ্যাঁ। বাবু যে বলেছিল মায়ের ওপরে সর্বদা নজর রাখতে।
–তাহলে এ বাড়িতে যা হত তুমিই সে-সব কথা তোমার বাবুকে বলতে?
-তা বলব না—বাবু তো ঐ জন্যেই আমাকে রেখেছিলেন।
—তোমার বাবু তাহলে তোমার মাকে সন্দেহ করতেন?
—তা সন্দেহের মত কাজ করলে সন্দেহ করবে না লোকে!
–তা বটে। কিরীটী হাসল।
—মানদা—কিরীটী আবার প্রশ্ন করল, তুমি কোন্ ঘরে থাকো?
আজ্ঞে নীচের একটা ঘরে—
—যে রাত্রে তোমার মা খুন হয়, সে রাত্রে রাত দশটা থেকে বারোটা পর্যন্ত তুমি কি। করছিলে? মনে আছে নিশ্চয়ই তোমার?
–বাবু রাগারাগি করে চলে যাবার পর রাত সাড়ে দশটা পৌনে এগারোটা পর্যন্ত নীচেই ছিলাম। ভেবেছিলাম মা হয়তো গাড়ি নিয়ে বেরুবে, কিন্তু তা যখন বের হল না, বুঝলাম আর বেরুবে না, তখন ওপরে তাকে খাবার কথা বলতে যাই—
—গিয়ে কি দেখলে?
—মার ঘরের দরজা বন্ধ।
—তারপর?
—ডাকাডাকি করলাম, মা তখন বললেন, তিনি খাবেন না, আর আমাদের খেয়ে নিতে বললেন।
—তোমার মার গলার স্বর স্পষ্ট শুনেছিলে?
—মার গলার স্বর সামান্য একটু জড়ানো ছিল, তবু ঠিক মার গলাই শুনেছি। তারপর নীচে গিয়ে আমি আর রতন খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ি।
–ওপরের তলায় কোন শব্দটব্দ কিছু শোননি সে রাত্রে?
–না।
-–ঠিক আছে, তুমি রতনকে এবারে পাঠিয়ে দাও।
একটু পরে রতন এলো।
কিরীটীই প্রশ্ন করে, রতন, সে রাত্রে তুমি কখন শুয়েছিলে?
—বোধ হয় তখন রাত সাড়ে এগারোটা বাজতে শুনেছিলাম।
—সেটা যে সাড়ে এগারোটাই তা কি করে বুঝলে, সাড়ে বারোটা বা দেড়টাও তো হতে পারে!
–মানদাও বলেছিল, বলেছিল রাত সাড়ে এগারোটা বাজল রতন।
–আচ্ছা রতন, পরের দিন তুমি কখন সদর খোল?
—যখন থানায় খবর দিতে যাই।
—তা তোমার বাবুকে আগে ফোনে খবর না দিয়ে তুমি থানায় গেলে কেন?
–আজ্ঞে মানদাই যে বললে—
—হুঁ। আচ্ছা রতন, নীচের যে ঘরটায় সর্বদা তালা দেওয়া থাকত সেটা তুমি কাউকে খুলতে দেখেছ কখনো?
-মার কাছেই চাবি থাকত, মা-ই মাঝে মধ্যে খুলতেন, আর কাউকে আমি ঐ ঘরের দরজা খুলতে দেখিনি বাবু।
–তোমার কৌতূহল হয়নি কখনো–ঘরে কেন সর্বদা তালা দেওয়া থাকে?
–না।
—মানদা কখনো ঐ ঘরে ঢোকেনি?
—না, দেখিনি বাবু।
মানদা ও রতনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে কিরীটী সুশীল চক্রবর্তীকে নিয়ে আবার সারা বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখল। বাড়ি থেকে বের হয়ে জীপে উঠে কিরীটী বলল, সুশীল, তোমায় একটা কাজ করতে হবে–
-কি বলুন দাদা?
–ডাঃ সমীর রায় আর ঐ অভিনেত্রী ডলি দত্ত—ওদের একটু খোঁজখবর নিতে হবে। কাল-পরশু যখন হোক ওদের থানায় ডেকে আনতে পারো?
–থানায়?
-হ্যাঁ। কিংবা এক কাজ কর, তোমাদের ডি.সি. ডি.ডি. মিঃ চট্টরাজকে আমার কথা বলে বোললা, ওদের লালবাজারে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্যে।
—সেই বোধ হয় ভাল হবে দাদা, আপনি বরং ফোনে মিঃ চট্টরাজকে বলুন, আমি আপনাকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে এখুনি লালবাজার যাচ্ছি।
—ভাল কথা, তোমার ময়না তদন্তের রিপোর্ট এসেছে?
—সে তো কালই এসে গেছে, আপনাকে বলতে ভুলে গেছি।
—ফোরেনসিক রিপোর্ট, ভিসেরা ও অন্যান্য জিনিসের?
—না, এখনো আসেনি, তবে আশা করছি দু-চার দিনের মধ্যেই এসে যাবে।
ডি.সি. ডি.ডি. মিঃ চট্টরাজকে বলতেই তিনি ডাঃ সমীর রায় ও ডলি দত্তকে লালবাজারে ডেকে আনবার ব্যবস্থা করলেন, এবং কিরীটী ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে শুনে আরও খুশি হলেন।
লালবাজার থেকে ফিরতে ফিরতে বেলা তিনটে হয়ে গেল সুশীল চক্রবর্তীর। থানায় ঢুকে তিনি দেখেন কিরীটী তার ঘরে বসে আছে।
—এ কি দাদা, আপনি কতক্ষণ? সুশীল চক্রবর্তী বললেন।
—মিনিট দশেক। কই দেখি তোমার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট-সুশীল চক্রবর্তী পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এগিয়ে দিলেন।
ময়না তদন্তের রিপোর্টে বলা হয়েছে, শ্বাসরোধ করেই হত্যা করা হয়েছে, এবং মৃত্যুর সময় সম্ভবত সাড়ে এগারোটা থেকে সাড়ে বারোটার মধ্যে কোন এক সময়। শরীরের কোথাও বিশেষ কোন আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায় নি, যাতে করে প্রমাণিত হতে পারে মৃত্যুর পূর্বে নিহত ব্যক্তি কোন রকম স্ট্রাল করেছিল। মৃতের হাতে এবং পায়ে অনেকগুলো কালো কালো চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে। আর ভিসেরার রিপোর্ট এখনো আসেনি।
-আচ্ছা দাদা, সুশীল চক্রবর্তী বললেন, হিন্দুস্থান রোডের বাড়ি থেকে যে বাক্স-ভরা সিগারেট পাওয়া গিয়েছে, আপনি বলেছিলেন, ওগুলি সম্ভবত নিষিদ্ধ নেশার সিগারেট—ওর মধ্যে কি আছে বলে আপনার মনে হয়?
—ওর মধ্যে গাঁজা বা ভাঙ জাতীয় নেশার বস্তু আছে বলে মনে হয়। ঐ যাদের তোমরা বল হ্যাসিস সিগারেট। আমাদের দেশে ভারতীয় গাঁজা থেকেই ওই বস্তুটি তৈরি হয়ে থাকে। ফার্মাকোপিয়াতেও তুমি ওর কথা পাবে—An Arabian aromatic confection of Indian hemp, পশ্চিমের দেশগুলোতে ঐ ধরনের সিগারেট নেশার জন্যে প্রচুর ব্যবহৃত হয়, ভারতীয় গাঁজা থেকেই মূলত তৈরী হয়। আমার মনে হয়, চোরাইপথে ঐ নেশার কারবার চালাত মালঞ্চ দেবী। অবিশ্যিই সে একা নয়, সঙ্গে তার আরও কেউ কেউ নিশ্চয়ই ছিল, আর ঐ নেশার চোরাকারবার করে প্রচুর উপার্জন করত মালঞ্চ ও তার সঙ্গীসাথীরা।