আমি?
হ্যাঁ, তুমি—তুমি ছাড়া আর কে?
থাম! ঘৃণা-মিশ্রিত একটা গর্জন করে ওঠে মালঞ্চ।
একটু আগে গলায় দড়ি দেবার কথা বলছিলে না মালা—অন্য কেউ হলে হয়তো এতদিনে দিত, কিন্তু আমি–
তুমি দিতে পারলে না। তাই না?
প্রশ্নটা যে নিজেকেও নিজে অনেকবার করিনি তা নয়। জানি সব দোষ আমারই।
সেটা বোঝ?
হয়তো বুঝি বা ঝবার চেষ্টা করি, ভাবি।
আর বুঝবার চেষ্টা করো না! বুঝেছ?
একটা কথা বলব মালা?
জানি কি বলবে, আমি শুনতে চাই না।
আচ্ছা–আবার কি আমরা আমাদের পূর্বের জীবনে ফিরে যেতে পারি না?
কি বললে?
জানি তা আর কোন দিনও সম্ভব নয়—আজকের মালঞ্চ আর মালা হতে পারে না। অনেক পথ হেঁটে আমরা দুজন দুজনার থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছি। আজ তোমায় দেওয়া সুরজিৎবাবুর এই বাড়িটা, এর সব দামী দামী আসবাব-পত্ৰ, এই প্রাচুর্য জানি আমার ঘরে থাকলে এসব কিছুই তোমার হত না, কিন্তু–
বল। থামলে কেন?
সেদিনও বোধহয় আমি তোমাকে স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যেই যথাসাধ্য রাখার চেষ্টা করেছি—
কি বললে, স্বাচ্ছন্দ্য! একটা ভাল কাপড়—একটা গয়না কখনো তুমি দিতে পেরেছ?
তবু তুমি একদিন আমার সবকিছু জেনে শুনেই আমার ঘরে এসে উঠেছিলে—
ভুল—ভুল করেছিলাম। নিত্য ভাত ডাল আর চচ্চড়ি-মাসান্তে একটা মিলের শাড়ি–
তুমি তো জানতে আমার মাইনে কি ছিল—কিছুই তোমার অজ্ঞাত ছিল না কিন্তু তাহলেও বোধহয় তোমার সম্মান ছিল, ইজ্জত ছিল। সেদিন কারো রক্ষিত হতে হয়নি তোমাকে।
জোঁকের মুখে যেন নুন পড়ল, আর কোন কথা বলতে পারে না মালঞ্চ।
তুমি বুঝবে না মালা, মানুষ কত বড় অপদার্থ হলে তার নিজের স্ত্রীকে অন্য এক পুরুষের রক্ষিতা হয়ে থাকতে দেয়,-কথাগুলো বলে মালাটা সামনের টেবিলের ওপর রেখে সুশান্ত ঘর থেকে বের হয়ে যাবার জন্যে দরজার দিকে এগিয়ে যায়।
দাঁড়াও, কত টাকার দরকার তোমার। শদুই হলে চলবে?
সুশান্ত থমকে তাকায় স্ত্রীর মুখের দিকে। হাত পেতে চাইলেও যে কখনো চল্লিশ-পঞ্চাশটার বেশী টাকা দেয় না, সে কিনা আজ দুশো টাকা দিতে চায়।
শোন, আমি তোমাকে আরো বেশি টাকা দিতে পারি, তবে একটি শর্তে–
শর্তে?
হ্যাঁ। এ বাড়ি ছেড়ে তুমি চলে যাবে, আর কখনো এ বাড়িতে আসবে না। লেখাপড়া তো শিখেছ, একটা কাজ জুটিয়ে নিতে পারো না আবার–
একবার চাকরি ছেড়ে দিয়েছি, তাও আজ পাঁচ বছর, তাছাড়া বয়সও হয়েছে, এ বয়সে আর কে চাকরি দেবে!
বল তো আমি সুরজিতকে বলে দেখতে পারি। সে অত বড় অফিসের ম্যানেজার–
জানি মালা, সুরজিতবাবু হয়তো চেষ্টা করলেই তার রক্ষিতার প্রাক্তন স্বামীকে যে কোন একটা কাজ জুটিয়ে দিতে পারে, কিন্তু না, থাক মালা, তোমাকে আমার জন্যে কাউকে কিছু বলতে হবে না, আমি চললাম।
টাকা নেবে না—এই যে টাকা চাইছিলে?
না মালা, আচ্ছা চলি। সুশান্ত ঘর থেকে বের হয়ে এলো।
বারান্দা পার হয়ে মোজেইক করা সিঁড়ির ধাপগুলো অতিক্রম করে নিঃশব্দে নেমে এলোর কোনদিকেই আর তাকাল না, সোজা গেট দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল।
হাঁটতে শুরু করে সুশান্ত। সন্ধ্যার তরল অন্ধকার আরো গাঢ় হয়েছে, পথের দুপাশে আললাগুলো যেন সেই অন্ধকারকে যতটা তরল করা উচিত ততটা পারছে না।
তবে কি আকাশে মেঘ নামছে? সত্যি কি মেঘ জমছে, এবার বৃষ্টি নামবে বাতাসে একটা ঠাণ্ডা ভাব, ভিজে ভিজে ভাব!
নামে—নামুক বৃষ্টি।
হঠাৎ যেন যে ঘেন্না বা লজ্জা এতদিন তার মনের মধ্যে জাগেনি সেটাই যেন তার সারা মনকে এই মুহূর্তে আচ্ছন্ন করে ফেলছে।
সত্যিই তো—সে কি মারা গেছে? একটা মৃত মানুষ সে? নচেৎ নিজের স্ত্রী আর একজনের রক্ষিতা হয়ে যেখানে আছে সেখানে সে কেমন করে পড়ে আছে! শুধু পড়ে থাকাই নয়—দুবেলা আহার করছে আর নেশার টাকা হাত পেতে নিচ্ছে। হ্যাঁ, মালঞ্চ ঠিকই বলেছে–তার গলায় দড়ি দেওয়াই উচিত ছিল।
বৃষ্টিটা বোধ হয় সত্যি সত্যিই নামবে। নামলে ভিজতে হবে—যে বাড়ি থেকে এই মাত্র সে বের হয়ে এলো সেখানে বোধ হয় আর সে ফিরতে পারবে না।
একটু মদ হলে বোধ হয় সে অনেকটা সুস্থ বোধ করতে পারত।
আগে কোন দিন মদ স্পর্শ করেনি সুশান্ত, কিন্তু ঐ মালঞ্চই একদিন তার হাতে মদের গ্লাস তুলে দিয়েছিল।
—না। সুশান্ত বলেছিল।
—খাও, দেখ তোমার মাথার ভূতটা নেমে যাবে। নিজেকে অনেকটা হালকা মনে করতে পারবে।
-তোমার ইচ্ছা আমি খাই?
–হ্যাঁ, খাও।
–বেশ, দাও—
সেই শুরু–তারপর চলেছে—এখন আর না হলে চলে না।
আবার ভাবে সুশান্ত, আর সে হিন্দুস্থান রোডের বাড়িতে ফিরে যাবে না। পাঁচ পাঁচটা বছর সে কেমন করে ছিল বালিগঞ্জের হিন্দুস্থান রোডের ঐ বাড়িটায়? সত্যিই তার মনে কোন ঘৃণা নেই, লজ্জা নেই।
সুরজিতের রক্ষিতার বাড়িতে একতলার একটা ঘরে কেমন করে কাটাল সুশান্ত এত দীর্ঘ দিন ও রাত্রিগুলো? মধ্যে মধ্যে সন্ধ্যা হলে মালঞ্চর কাছ থেকে পঁচিশ-তিরিশটা টাকা নিয়ে বের হয়ে পড়ত; এরপর ঢাকুরিয়া ব্রীজের নিচে যে লিকার শপটা খুলেছে সেখান থেকে একটা রামের বোতল কিনে লেকের কোন নির্জন জায়গায় গিয়ে বসত।
বোতলটা শেষ হলে অনেক রাত্রে টলতে টলতে সুরজিতের রক্ষিতার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াত। নীচের তলার জানালাটার সামনে মৃদুকণ্ঠে ডাকত-রতন, এই রতন, দরজাটা খো বাবা।
–দাঁড়াও খুলছি। বলে রতন দরজাটা খুলে দিত। তারপর প্রতি রাতের মতন বলত, বাবু, মানদা তোমার খাবার তোমার ঘরে ঢাকা দিয়ে রেখে গিয়েছে। বলেই রতন তার ঘরে চলে যেত। আর সেও তার ঘরে গিয়ে ঢুকত।