সুশীল চক্রবর্তী ভাঙা দরজাটার দিকে এগুচ্ছিলেন। কিরীটী বাঁধা দিয়ে বললে, না, ও দরজা দিয়ে না, চল পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে লোহার সিঁড়ি দিয়ে আমরা ওপরে যাব–
সেই মতই ওরা ওপরে উঠে এলো, লোহার ঘোরানো সিঁড়ি পথ।
কিরীটীর অনুমান মিথ্যা নয়। দেখা গেল নীচের সেই ঘরটার ওপরের ঘরটাই মালঞ্চর শয়নকক্ষ। বাথরুম দিয়েই ওরা ঘরে ঢুকল, দরজা খোলাই ছিল বাথরুমের।
—দাদা, আপনি সত্যিই নীচের ঘরে কাউকে দেখেছেন?
—একটি চক্ষু—শ্যেন দৃষ্টি ছিল সেই চোখের তারায়—কিরীটী বললে, চোখাচোখি যখন একবার হয়েছে তখন পালাতে সে পারবে না। চল, ঘরের ভিতরটা আর একবার আজ দুজনে মিলে খুঁটিয়ে দেখা যাক।
ঘরের মধ্যে পা দিয়েই কিরীটীর নজর পড়ল ঘরের মধ্যে অ্যাশট্রেটার ওপরে-সোফাসেটের মাঝখানে একটি ছোট ত্রিপয়ের বেলজিয়ামের কাটগ্লাসের সুদশ্য একটি অ্যাশট্রে, তার মধ্যে চার-পাঁচটা দগ্ধাবশেষ সিগারেটের টুকরো পড়ে আছে। একটা টুকরো হাতে তুলে নিয়ে কিরীটী দেখল—বিলাতী সিগারেট-স্টেট এক্সপ্রেস ৫৫৫।
সুশীল, তোমার নিহত নায়িকার ধূমপানের অভ্যাস ছিল নাকি?
–জানি না তো–
—জিজ্ঞাসা করনি?
–না।
–জিজ্ঞাসা করাটা উচিত ছিল ভায়া। তার যদি ধূমপানের অভ্যাস না থাকে তবে এগুলো কার সিগারেটের দগ্ধাবশেষ? হয় সুরজিৎ ঘোষালের, না হয় দীপ্তেন ভৌমিকের নিশ্চয়।
—সুশান্ত মল্লিকেরও তো হতে পারে দাদা–
–মনে হয় না। কারণ যে পরমুখাপেক্ষী, তার ভাগ্যে স্মাল করা বিলাতী সিগারেট জুটত বলে মনে হয় না। স্পেশাল ব্রান্ডের সিগারেট যখন, তখন এই বঁড়শীর সাহায্যেই মাছকে খেলিয়ে ডাঙায় টেনে তোলা কষ্টকর হবে না—কথাগুলো বলে কতকটা যেন আপন মনেই কিরীটী ঘরের চতুর্দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতে লাগল। সুশীল চক্রবর্তীর মুখে শোনা ঘরের বর্ণনার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে সব কিছু।
—সুশীল, তুমি এই ঘরের বাইরে থেকে লক করে গেলেও এ ঘরে প্রবেশাধিকার তুমি বন্ধ করতে পারনি, বুঝতে পারছ বোধ হয়! কই দেখি তোমার চাবির গোছা–
সুশীল চক্রবর্তী পকেট থেকে চাবির রিংটা কিরীটীর হাতে তুলে দিলেন।
-ঐ আলমারির চাবি কোন্টা সুশীল?
সুশীল চাবিটা দেখিয়ে দিলেন এবং চাবির সাহায্যে কিরীটী আলমারিটা খুলে ফেলল। দুটি ড্রয়ার, দুটি ড্রয়ারই একে একে খুলে তার ভেতরের সব কিছু পরীক্ষা করে দেখতে লাগল কিরীটী।
কিন্তু ড্রয়ারের মধ্যে সুশীল চক্রবর্তী সেদিন অনুসন্ধান চালিয়ে যা পেয়েছিলেন তার চাইতে বেশী কিছু পাওয়া গেল না। কিরীটী তবু অনুসন্ধান চালিয়ে যায়…
—কি খুঁজছেন দাদা? সুশীল প্রশ্ন করল।
–ব্যাঙ্কের পাসবই। মালঞ্চর নিশ্চয়ই একাধিক ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট ছিল।
—একটা তত পেলেন।
–যেখানে নিষিদ্ধ চোরাই দ্রব্যের কারবার, সেখানে ব্যাঙ্ক-ব্যালেন্স মাত্র হাজার দুইতিন থাকাটা ঠিক যেন বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। চোরাই কারবারের লেনদেনের নিট ফল অত সামান্য তো হতে পারে না।
শেষ পর্যন্ত দেখা গেল কিরীটীর অনুমানই ঠিক। মালঞ্চর নামে চার-পাঁচটা ব্যাঙ্কের পাসবই পাওয়া গেল। কিছু ফিক্স ডিপোজিটের কাগজপত্র পাওয়া গেল সেই সঙ্গে।
সুশীল চক্রবর্তী বললেন, এ যে দেখছি অনেক টাকা দাদা—
কিরীটী বলল, হ্যাঁ যোগফল তাই দাঁড়াচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা দেখা যাচ্ছে বেশ জটিলই হয়ে উঠল সুশীল—চোরাকারবার, হত্যা, সুন্দরী এক নারী, তিনটি পুরুষ মক্ষিকা সেই নারীকে ঘিরে, ভুলে যেও না।
ব্যাঙ্কের পাসবইগুলো সঙ্গে নিয়ে ওরা দুজনে দোতলা থেকে আগে সিঁড়ি পথেই নীচের তলায় নেমে এসে সুশান্ত মল্লিকের ঘরে ঢুকল।
সুশান্ত মল্লিক তার ঘরের মধ্যে বসে ধূমপান করছিল; সামনেই চৌকির ওপরে একটা সোনার সিগারেট কেস ও একটা ম্যাচ। ওরা ঘরে ঢুকতেই সুশান্ত মল্লিক ওদের দিকে– তাকাল। তার মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যায় সুশান্ত মল্লিক একটু যেন বিরক্ত হয়েছে, কিন্তু কোন কথা বলল না।
—কি সুশান্তবাবু, কি ঠিক করলেন? কিরীটী বলল।
—কিসের কি ঠিক করব?
—পুলিসকে সাহায্য করলে হয়তো আপনি এই ফ্যাসাদ থেকে মুক্তি পেলেও পেয়ে যেতে পারেন।
-আমি যা জানি সবই তো বলেছি—
—কিন্তু আপনার কাছ থেকে আমাদের আরো যে কিছু জানবার আছে। সুশান্তবাবু—কিরীটী বলল।
—আমি আর কিছুই জানি না।
–বেশ, তাই না হয় মেনে নিলাম। এবার আমার কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দিন।
——কি প্রশ্ন?
–মালঞ্চ নিজেই নিজের গাড়ি ড্রাইভ করতেন, গাড়ি নিয়ে তিনি মাঝেমধ্যে নিশ্চয়ই বেরুতেন, তিনি কোথায় যেতেন জানেন?
—সিনেমা, থিয়েটার, বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতে যেতে হয়তো।
—আর কোথাও যেতেন না—যেমন ধরুন কোন ক্লাব বা রেস্তোরাঁ–
—একটা নাইট ক্লাবে মাঝে-মধ্যে সে যেতো জানি। ক্লাবটা বালিগঞ্জ সারকুলার। রোডে
–হুঁ বুঝেছি। ক্লাবটার নাম দি রিট্রিট, তাই না? A notorious night club! আচ্ছা, মালঞ্চদেবী ড্রিংক করতেন না মিঃ মল্লিক?
–করত বোধ হয়—
–আপনি দেখেননি কখনো?
–সামান্য বেসামাল অবস্থায় মাঝে-মধ্যে অনেক রাত্রে বাড়ি ফিরতে দেখেছি তাকে, কিন্তু মদ্যপান করতে দেখিনি।
–দীপ্তেনবাবু আর সুরজিৎ ছাড়া অন্য কোন পুরুষের এ বাড়িতে যাতায়াত ছিল কি?
–সমীর রায় নামে একজন বিলেত ফেরত ডাক্তার আর এক তরুণ মারোয়াড়ীকে কালেভদ্রে এখানে আসতে দেখেছি।
–আর কেউ?
—একজন অভিনেত্রী দু-একবার এসেছে—