বলতে বলতে মানা সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসে।
–মানদা, ঐ ঘরের তালার চাবিটা কোথায়?
—আমি তো জানি না বাবু। মানদা বলল।
—ঐ ঘরের তালার চাবিটা কোথায় তুমি জানো না? কিরীটীর আবার প্রশ্ন?
—না, আমি এখানে আসা অবধি দেখছি, ঐ দরজায় ঐ ভাবেই তালা ঝোলে।
—কখনো কাউকে দরজা খুলতে দেখনি?
—না বাবু—
কিরীটী এবার সুশীল চক্রবর্তীর দিকে তাকাল—সুশীল, তোমার কাছে তো সেই– চাবির রিংটা আছে, সঙ্গে এনেছ?
—হ্যাঁ, এই নিন। সুশীল চক্রবর্তী অনেকগুলো চাবি সমেত একটা রুপোর চাবির রিং পকেট থেকে বের করে কিরীটীর হাতে তুলে দিল। কিন্তু রিংয়ের কোন চাবির সাহায্যেই . ঘরের তালাটা খোলা গেল না। এমন কি চাবির থোকার কোন চাবিই তালাতে প্রবেশ করানোও গেল না। অথচ তালাটা দেখে কিরীটীর মনে হয় তালাটা সর্বদাই খোলা হয়। তালাটার চেহারা দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকার মত নয়।
—কোন চাবিতেই তো তালাটা খুলছে না দাদা।
—কোন চাবি না লাগলে আর কি করা যাবে, তালাটা ভাঙতে হবে—কিরীটী শান্ত গলায় কথাগুলো বলে পর্যায়ক্রমে একবার অদূরে দণ্ডায়মান রতন আর মানদার মুখের দিকে তাকাল।
গভরেজের মজবুত বড় তালা, তালাটা ভাঙা অত সহজ হল না। একটা লোহার রড দিয়ে প্রায় পনেরো-কুড়ি মিনিট ধস্তাধস্তি করার পর তালাটা ভাঙা গেল, তাও দুজন সিপাইয়ের সাহায্যে। এবং অত যে শব্দ করে তালাটা ভাঙা হল তবু ঠিক তার পাশের ঘরে থেকেও সুশান্ত. মল্লিকের কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না বা সে এসে ব্যাপারটা জানবারও কোন চেষ্টা করল না।
ঘরটা অন্ধকার ছিল, জানালা দরজা বন্ধ থাকায় কিরীটী সুশীল চক্রবর্তীকে বলল, দেখ তো সুশীল, ঘরের আলোর সুইচটা কোথায়
হাতড়াতে হাতড়াতে সুইচটা পাওয়া গেল। খুট করে সুইচ টিপতেই একটা ড়ুম ঢাকা একশো পাওয়ারের বাতি জ্বলে উঠল।
ঐ ঘরটা ঠিক মালঞ্চর দোতলার শোবার ঘরের নীচেই। পরে সেটা বুঝেছিল কিরীটী। মাঝারি সাইজের ঘরটি, ঘরের মধ্যে মাত্র একটি দেওয়াল-আলমারি, তার পাল্লায় চাবি লাগানো। এ ছাড়া ঘরের মধ্যে আর অন্য কোন আসবাবপত্র নেই।
দেখলে মনে হয় ঘরটা কেউ কখনও ব্যবহার করে না। গোটাচারেক জানালা, সব জানালারই পাল্লা বন্ধ। দুটি দরজা, যে দরজার তালা ভেঙে একটু আগে তারা প্রবেশ করেছে তার ঠিক উল্টো দিকে আর একটা দরজা।
দরজাটা খোলাই ছিল, এবং পাল্লা ধরে টানতেই খুলে গেল। দরজাটার পিছনে একটা সরু ফালিমত যাতায়াতের পথ এবং সেই পথের ওপরেই মেথরদের দোতলায় যাবার ঘোরানো লোহার সিঁড়ি।
কিরীটীর বুঝতে কষ্ট হল না ব্যাপারটা। সে ভুল দেখেনি, কিছুক্ষণ আগে ঐ ঘরের ঈষৎ ফাঁক করা জানালার কপাটের আড়াল থেকে যে চক্ষুর দৃষ্টি সে দেখেছিল, সে যে-ই হোক, এই ঘরের মধ্যেই সে ছিল এবং পিছনের ঐ দরজাপথেই সে অন্তর্হিত হয়েছে।
—সুশীল—
—কিছু বলছেন দাদা?
-এখন বুঝতে পারছ তো, সে রাত্রে ঐ গলিপথ দিয়েই দীপ্তেন ভৌমিক সকলের অজ্ঞাতে বের হয়ে গিয়েছিল!
-ঐ সিঁড়িটা দিয়ে?
-খুব সম্ভবত, কিরীটী বললে, হা সে রাত্রে ঐ সিঁড়ি দিয়েই দীপ্তেন মালঞ্চর ঘর থেকে বের হয়ে এসেছিল। আর আজ কিছুক্ষণ আগে এই ঘরের মধ্যে যে ছিল সে-ও ঐ দরজা আর ঐ সিঁড়ি ব্যবহার করেছে–
—এই ঘরের মধ্যে কেউ ছিল নাকি?
–হ্যাঁ। আর এ বাড়িতে এখন যারা আছে সে তাদেরই মধ্যে একজন কেউ।
–কে বলুন তো দাদা?
—জানি না, তবে এ সময় এই ঘরের মধ্যে সে কেন এসেছিল তাই ভাবছি—
—হয়তো আমাদের প্রতি নজর রাখবার জন্য।
–না। আমার ধারণা তার এ ঘরে আসার অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল এবং আমাদের। সাড়া পেয়ে এবং জানলার কপাট ঈষৎ ফাঁক করে আমাদের দেখতে পেয়েই সরে পড়েছে। তবে বাড়ির বাইরে সে নিশ্চয়ই যায়নি। চল তো, ঘরের আলমারিটা একবার পরীক্ষা করে দেখা যাক।
ঐ চাবির রিংয়ের মধ্যেই একটা চাবি দিয়ে আলমারিটা খুলে ফেলা গেল। একটা তাকে থরে থরে সাজানো কতকগুলো কার্ড-বোর্ডের বাক্স। অনেকটা সিগারেটের বাক্সর মত।
কিরীটী হাত বাড়িয়ে একটা বাক্স নিয়ে বাক্সর ঢাকনাটা খুলতেই দেখা গেল তার দেখা সুন্দর পরিপাটী করে সাজানো সব লম্বা লম্বা সিগারেট।
সুশীল চক্রবর্তী বললেন, এ সব তো সিগারেট দেখছি—
কিরীটী কোন কথা না বলে একে একে সব বাক্সগুলোই খুলে ফেলল। গোটা দশেক বাক্সের মধ্যে ছটা খালি, বাকি চারটের মধ্যে সিগারেট রয়েছে, তার মধ্যে একটায় অর্ধেক।
–কি ব্যাপার বলুন তো দাদা, এখানে এই আলমারিতে এত সিগারেট কেন?
–আমার অনুমান যদি মিথ্যে না হয় তো কিরীটী মৃদু কণ্ঠে বলল, এগুলো সাধারণ সিগারেট নয় সুশীল, এগুলো মনে হচ্ছে নিষিদ্ধ নেশার সিগারেট-হ্যাসিস–চরস ইত্যাদি দিয়ে যে-সব নেশার জন্য তৈরী সিগারেট গোপন পথে চলাচল করে এগুলো তাই—সেই জাতীয় সিগারেট–নিষিদ্ধ বস্তু–
সুশীল চক্রবর্তী নিঃশব্দে সিগারেটগুলোর দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকে।
কিরীটী বললে, মনে হচ্ছে এ বাড়িতে থেকে এই নিষিদ্ধ বস্তুর লেনদেন হত। আমি ভাবছি সুশীল, শেষ পর্যন্ত এর মধ্যেই মালঞ্চর হত্যার বীজ লুকিয়ে ছিল না তো!
—এই সিগারেটের মধ্যে?
–হ্যাঁ। এই সিগারেটকে কেন্দ্র করেই হয়তো মৃত্যুগরল ফেনিয়ে উঠেছিল। এগুলো নিয়ে চল। আর এই সিগারেটগুলোর মধ্যে থেকে আজই একটা অ্যানালিসিসের জন্যে
পাঠিয়ে দাও।
তারপর একটু থেমে কিরীটী বললে, হয়তো এগুলো সরাবার জন্যেই এখানে সে এসেছিল আজও। কয়দিন ধরেই হয়তো চেষ্টা করছিল এগুলো সরাবার, কিন্তু চাবির রিং তোমার পকেটে থাকায় সুবিধা করতে পারেনি। চল, এবার ওপরে যাওয়া যাক।